ভারত নিয়ে যাদের সামান্য হলেও জানাশোনা আছে, সবাই কমবেশি পন্ডিচেরির কথা জানেন। পন্ডিচেরি, ভালবেসে যে জায়গাটিকে পন্ডি বলে ডাকা হয়। সেটি হলো ভারতের বুকে এক টুকরো ফ্রান্স। সেই ১৬০০ শতকে সৃষ্টি হওয়া ফ্রেঞ্চ কলোনি। ফ্রান্স নিয়ে রোমাঞ্চপ্রিয়তা নেই এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। এ দেশটা ভালবাসার দেশ, এখানে বাতাসে ছড়ায় মিষ্টি সুগন্ধির ঘ্রাণ, অলিগলি থেকে রুটি আর পনিরের সুবাসের সাথে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে শিল্পীর গাওয়া গানের সুর এখানে একাকার। সুখাদ্য, সুগন্ধি আর শিল্প-সাহিত্যের এ দেশটির খানিক অংশ যেখানে ধরে রাখা যাবে তার কদর সবাই করবে- এটাই তো স্বাভাবিক। তবে ভারতে পন্ডিচেরি ছাড়াও আরো অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে ফ্রেঞ্চ কলোনি ছিল। আর তাই ফ্রান্সের খানিকটা আবহ এখনও সেসব জায়গায় লেগে আছে।
ভারতে ফরাসিদের প্রবেশ থেকে শুরু করে লোকালয় বিস্তার, বাণিজ্য অথবা আধিপত্য নিয়ে খানিক এগোলেই চোখের সামনে প্রাচীন পন্ডিচেরি কিংবা চন্দন নগরের চিত্রটা খুব করে টের পাওয়া যায়। ফরাসিরা তো আর বৃটিশ কিংবা ওলন্দাজদের মতো রাজ্য জয়ের ইচ্ছা নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেনি। তাই বুঝি ভারতীয়রা ভালবেসে আজও ফ্রেঞ্চ কলোনিগুলোর চেহারা এখনও আগের মতো রেখেছে। এমনকি তাদের অনুকরণে তৈরি করেছে আরো অনেক স্থাপনা।
ভারতে ফরাসিদের পদচারণ
১৬০০ শতকের কথা। বিশাল ভারতবর্ষ কেবল একটু একটু করে নিজেদের চিনতে শিখেছে, রাজা-রাজড়ারা তুমুল দর্পে শাসন করে চলেছে সেখানে। এরই মাঝে বৃটিশরা কী করে যেন এখানে স্বর্ণের খনির মতন বাণিজ্যের একটি অভূতপূর্ব সুযোগের সন্ধান করে ফেলেছে। ভারতের শাসকদের সাথে বনিবনা করে তারা পুরোদমে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এদিকে বাণিজ্যের আশায় ব্রিটিশদের দেখাদেখি ওলন্দাজ নাবিকেরা ভারতের তীরে এসে তরী ভেড়াতে লাগলেন। দেখতে দেখতে তারাও বেশ জোরেশোরে ঘাঁটি গেঁড়ে ফেললো এখানে। তাদের কোম্পানির নাম ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’।
এই দুই পরাক্রমশালী শক্তি যখন বাণিজ্যের সাথে সাথে ভারতের ভূমিকেও কব্জা করার পরিকল্পনায় বুঁদ, তখন ব্রিটিশদের প্রায় ৬ যুগ পর ১৬৬৭ সালে ভারতের জাহাজঘাটায় নতুন দুটি জাহাজ এসে ভীড়লো।
ফরাসিদের ভারতবর্ষে আসার মূল কারণ ছিলো ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের সঙ্গে টক্কর দেওয়া। তাই তারা একেবারে খাঁটি বণিকের মতো ব্যবসার সঠিক নথিপত্র নিয়ে আসেন। অনেকের মতে, ফরাসিদের প্রথম ভারতে আগমন আরো আগেই হয়েছিল, সম্ভবত রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের রাজত্বকালে। ১৬০৩ সালে ফরাসিরা প্রথমবারের মতো ভারতে পা রাখেন। সেসময় জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন পমিয়ের ডি গনভিল।
রাজা চতুর্থ হেনরি Compagnie des Indes Orientales নামক বেণিয়া কোম্পানিকে এই প্রথম অভিযানের অনুমোদন দেন। সেই অনুমোদন বলে কোম্পানিটি টানা ১৫ বছর ধরে ভারতে বাণিজ্য করার সুযোগ পায়। ১৬৬৪ সালে দলিল দস্তাবেজ অনুযায়ী ‘ফ্রান্স ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ গঠিত হয়েছিল। যা-ই হোক, ভারতের সমুদ্রসীমা পেরিয়ে এলো নতুন জাহাজ, নেতৃত্ব দিলেন ফ্রান্সিস ক্যারন। পরবর্তীতে তিনি ভারতে ফ্রান্সের প্রথম কমিশনারের দায়িত্ব পেয়ে যান।
ভারতে ফরাসি উপনিবেশের কথা মাথায় এলেই সবার প্রথম মাথায় আসে পন্ডিচেরির নাম। কিন্তু ফরাসিরা তাদের সর্বপ্রথম দাপ্তরিক ঘাঁটি এখানে গাড়েনি। ১৬৬৮ সালে ভারতের সুরাটে সর্বপ্রথম একটি ফরাসি ফ্যাক্টরি চালু হয়, মসিয়েঁদের পথ চলা এখান থেকেই শুরু। সুরাটের কারখানাটি চালু হয় ক্যারনের নেতৃত্বে। কর্মজীবনে ঝানু এই ব্যক্তি ৩০ বছর ধরে ওলন্দাজদের কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। কর্মজীবনের ২০ বছরই তিনি কাটিয়েছিলেন জাপানে।
ক্যারন একা আসেননি, সঙ্গে এসেছিলেন মারাকারা আভানচিন্টজ। এই ভদ্রলোক ছিলেন পারস্যের এসফাহনের অধিবাসী, শক্তিশালী একজন আর্মেনিয়ান বণিক। তিনিও থেমে থাকলেন না, তার নেতৃত্বে পরের বছরেই ‘মাছিলিপাত্নাম’ (বর্তমান মাসুলিপাতাম) এ একটি কারখানা স্থাপিত হয়। এদিকে আরো কয়েক বছর পর ১৬৭৩ সালে পশ্চিম বাংলার দিকে ফরাসিদের নজর পড়ে। পশ্চিম বাংলার চন্দননগরে নবাব শায়েস্তা খাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তারা আরেকটি কারখানা গড়ে তোলেন। তার কিছুদিনের মধ্যেই বিজাপুরের সুলতানের কাছ থেকে ফরাসিরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশ, পন্ডিচেরির দখল নেয়। আস্তে আস্তে ফরাসি উপনিবেশ ছড়িয়ে পড়ে ভারতের বুকে।
রাজনীতি আর বাণিজ্যের সংঘর্ষ
বিস্তর বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে আসা ফরাসিরা তাদের ব্যবসার জাল ছড়াতে লাগলেন। কিন্তু এক বনে তো দু’তিনটি বাঘ একসাথে বাস করতে পারে না। একটি সংঘর্ষ অনিবার্য। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। ফরাসিদের এই উড়ে এসে জুড়ে বসাটা ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের গাত্রদাহের বড় একটি কারণ হয়ে দাঁড়াল। আর তাই মসিয়েঁরা একে একে তাদের সৃষ্টি করা উপনিবেশগুলো হারাতে লাগলো, যার শুরু হলো পন্ডিচেরি হাতছাড়া হবার মধ্য দিয়ে।
১৬৯৩ সালে ওলন্দাজরা ফরাসিদের হাত থেকে পন্ডিচেরির শাসনভার কেড়ে নিল। কমিশনার ফ্রান্সিস পন্ডিচেরিকে ছোট গ্রাম থেকে সবেমাত্র বড় পরিসরের বাণিজ্যিক শহর বানানোর পরিকল্পনায় ছিলেন। ওলন্দাজরা মালিকানা হাতে পেয়েই বেশ করে সেখানে দুর্গ গড়ে তুলতে লাগল। ফরাসিরা অবশ্য দমে যাবার পাত্র নয়। তারা ওলন্দাজদের সাথে কয়েক বছরের মাঝেই সমঝোতায় চলে এল। ‘রিজউইক চুক্তি’ নামে একটি দলিলও তৈরি করল তারা। এই চুক্তিতে স্বাক্ষরের মাধ্যমে তারা পন্ডিচেরির মালিকানা আবার ফিরে পেল।
ফরাসিদের রাজনৈতিক অর্জনের ইচ্ছাটা সবসময়ই তাদের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যের ছায়ায় হারিয়ে যেতো। কাজেই ভারতে তাদের থেকে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য যখন ব্যবসায়িক হয়ে পড়ল, ফরাসি বাণিজ্য অসম্ভব দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে লাগল। তাদের কোম্পানি ছিল আকারে ব্রিটিশ কোম্পানির অর্ধেক, কিন্তু মুনাফা ছিল তাদের কয়েকগুণ বেশি। মসিয়েঁদের এত সুখ ব্রিটিশদের সহ্য হলো না, কাজেই দুই পক্ষের মাঝে শুরু হয়ে গেল দ্বন্দ-কলহ।
বৃটিশরা ভারতজুড়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে উঠেপড়ে লেগে গেল। কোম্পানি ঠিক করে ফেললো ফ্রান্সের কাছ থেকে সুরাট আর মাসুলিপাতামের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে নেবে। যেমন কথা তেমন কাজ, মোটামুটি ১৭২০ সালের মধ্যেই ফ্রান্সের তৈরি করা সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ অংশ ব্রিটিশরা দখল করে নিল। এতে ফ্রান্সের বাণিজ্যের ভিত হয়ে গেল বেশ দুর্বল। ফরাসিরা তখন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ১৭৩৯ সাল পর্যন্ত তাদের ইয়ানাম, মাহে আর কারিকালের কারখানার দখল ফেরত আনলো।
ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকার পরও ফরাসিদের মনে মনে সবসময়ই ইচ্ছা ছিল তাদের বাণিজ্যিক পরিসর বাড়ানোর। কিন্তু শক্তিতে তাদের সাথে পেরে ওঠা মোটামুটি অসম্ভব বটে। তাই নিজেদের দুর্বলতার কমতি মেটাতে তারা ঠিক করলো, ভারতবর্ষে মৈত্রীপক্ষ হিসেবে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে তারা কাজে লাগাবে। ফরাসিরা বেশ বুদ্ধিমান। তাই সরাসরি সাহায্য না চেয়ে তারা নবাবকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অনুপ্রাণিত করলো। ফরাসিদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল কলকাতার উইলিয়াম দুর্গ দখল করা, কিন্তু ধীরে ধীরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে লাগল সেসময়। ফলে ১৭৫৭ সালে ইতিহাসে অবতারণা ঘটে বিখ্যাত ‘পলাশীর যুদ্ধ’ নামক অধ্যায়ের।
পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে নবাব সিরাজের শোচনীয় পরাজয় ঘটে, সঙ্গে ফরাসিদের পরিকল্পনাও একেবারে মাঠে মারা যায়। এতে ইংরেজরা ভারতে আরও পরাক্রমশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে পড়ে। ফ্রান্স তখন পরাজয়ের জ্বালা মেটাতে ভারতবর্ষে বাঘা জেনারেল ল্যালি-টল্যান্ডালকে পাঠায়। উদ্দেশ্য- হারানো সুদিন ফিরে পাওয়া। জেনারেল ল্যালি এসেই সাফল্যের সঙ্গে কুড্ডালোরে অবস্থিত সেইন্ট ডেভিড দুর্গ ধ্বংস করে দেন। কিন্তু সাফল্যের ধারা বেশিদিন অব্যাহত রাখতে পারলেন না তিনি। কৌশলগত কিছু ভুলের কারণে তিনি ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন। পরবর্তীতে তাকে আটক করা হয়, শাস্তি হয় মৃত্যুদন্ডের। ১৭৬০ সালের দিকে ফরাসিরা দক্ষিণ ভারত ও পন্ডিচেরি ব্রিটিশদের কাছে আবারও হাতছাড়া করে ফেলে। ১৭৬৩ সালে অবশ্য শান্তিচুক্তি হিসেবে তারা আবার পন্ডিচেরিকে ফেরত পায়।
ফরাসি উপনিবেশের পতন
ভারতে প্রবেশের প্রথমদিকে ফরাসিরা একচেটিয়া ব্যবসা করতে পেরেছিল ঠিকই, কিন্তু শেষের দিকে তারা যেন একটু খেই হারিয়ে ফেলল। শূন্যের কাছাকাছি মুনাফা, নিয়মিত লোকসান আর ব্রিটিশদের সাথে অহরহ রেষারেষির দরুণ ব্যবসায় ভাটা পড়ল। শেষে ফরাসি সরকার ১৭৬৯ সালে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রদ করে দিল। তবে পরবর্তী প্রায় পাঁচ যুগ ধরে ফরাসি ও ব্রিটিশরা যুগ্মভাবে পন্ডিচেরি শাসন করেছিল।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, তখন ভারতে ফ্রান্সের অধিকৃত অংশগুলো পূর্ববর্তী ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত হয়ে পড়ে। কিন্তু সেসমস্ত অঞ্চলে তখনও রয়ে গেছে ফ্রান্সের তাজা ঘ্রাণ। আর তাই ১৯৪৮ সালে ফ্রান্স আর ভারত সরকার ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলোতে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক শাসন জারি করার সিদ্ধান্তে এলো। চন্দননগর সহ ফ্রান্সের অধীন অন্যান্য ভূখন্ড ভারত সরকার ফিরে পেল, কিন্তু ১৯৫৪ সালে পন্ডিচেরি ভারতীয় ইউনিয়নে স্থানান্তরিত হয়ে গেল। এভাবে ভারতে ফরাসি উপনিবেশের অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল, কিন্তু ফরাসিদের রেশ রয়ে গেল ভারতের আনাচে কানাচে।