[প্রথম পর্বের পর]
আলেকজান্ডারের হাতে পতনের পর পারস্য ২৫০ বছরের জন্য গ্রিকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এ সময় এখানে উত্থান ঘটে সেলুসিড সাম্রাজ্যের। পারস্য সাম্রাজ্য না হলেও রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে এই সময়কাল পারস্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিধায় আজকের পর্বে সেলুসিড সাম্রাজ্য নিয়েই আলোচনা করা হবে।
সেলুসিডদের উত্থান
আকামেনিদ সাম্রাজ্য বিজয়ের অল্প কয়েক বছর পরই আলেকজান্ডার মাত্র ৩২ বছর বয়সে ব্যাবিলনে মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তিনি কাউকেই তার সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে যাননি। ফলে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর পরই সুবিশাল মেসিডোনীয় সাম্রাজ্যের অধিপতি কে হবেন তা নিয়ে শুরু হল বাক-বিতণ্ডা এবং আলেকজান্ডারের জেনারেলরা লিপ্ত হলেন ক্ষমতার দ্বন্দ্বে। মৃত্যুর সময় আলেকজান্ডার তার অশ্বারোহী বাহিনীর কমান্ডার পার্ডিকাসকে একটি আংটি প্রদান করায় অনেকেই একে উত্তরাধিকার হিসেবে পার্ডিকাসকে মনোনীত করার ইঙ্গিত বলে মনে করলেন। ফলে পার্ডিকাস শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং উচ্চপদস্থদের বেশিরভাগ পার্ডিকাসকে মেনেও নিল ।
কিন্তু খুব শীঘ্রই দেখা দিল বিদ্রোহ। ৩২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পার্ডিকাস কিছু সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারা নিহত হন যাদের মধ্য সেলিউকাস নিকেটর অন্যতম। এই ঘটনার পর সেলিউকাস ব্যাবিলনের গভর্নর হন। কিন্তু ৩১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের আরেক জেনারেল অ্যান্টিগোনাস কর্তৃক তিনি ব্যাবিলন হতে বহিষ্কৃত হন। অবশেষে ৩১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি গাজার যুদ্ধে অ্যান্টিগোনাসের পুত্র দিমিত্রিয়াসকে পরাজিত করার মাধ্যমে পুনরায় ব্যাবিলন অধিকার করেন। সেলিউকাসের ব্যাবিলন অধিকারের মাধ্যমেই যাত্রা শুরু করে সেলুসিড সাম্রাজ্য।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরবর্তী কয়েকবছরে সংঘটিত বেশ কিছু যুদ্ধের পর সুবিশাল মেসিডোনীয় সাম্রাজ্য ক্যাসান্ডার, প্রথম টলেমী, লাইসিম্যাকাস এবং সেলিউকাস নিকেটর- এই চারজন জেনারেলের মাঝে ভাগ হয়ে গেল। ক্যাসান্ডার পেলেন গ্রিস, প্রথম টলেমী মিশর, লাইসিম্যাকাস থ্রেস এবং সেলিউকাস নিকেটর পেলেন পারস্য, মেসোপটেমিয়া এবং মধ্য এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ। ৩০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংঘটিত ইপসাসের যুদ্ধে অ্যান্টিগোনাসকে পরাজিত করার মাধ্যমে সেলিউকাস আনাতোলিয়া (আধুনিক তুরস্ক) এবং সিরিয়ার উত্তরাংশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
আলেকজান্ডারের এই পাঁচজন জেনারেলের মধ্যে সেলিউকাস নিকেটরকেই সবচেয়ে সফল বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কেননা একমাত্র তিনিই আলেকজান্ডারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, দক্ষ আমলাতন্ত্র, লাভজনক বাণিজ্য এবং সফল সামরিক অভিযানের মাধ্যমে একটি বহুজাতিক সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সম্রাট সেলিউকাস আনাতোলিয়ায় অ্যান্টিওক এবং ব্যাবিলনে সেলুসিয়া শহর প্রতিষ্ঠা করেন। দুই শহরই সাম্রাজ্যেরা রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত হত। অ্যান্টিওক থেকে সম্রাট নিজে সাম্রাজ্যের পশ্চিমাংশ এবং সেলুসিয়া থেকে তার পুত্র প্রথম অ্যান্টিওকাস পূর্বাংশের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।
সেলুসিডদের পথচলা কখনোই মসৃণ হয়নি। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে তাদেরকে পূর্বে এবং পশ্চিমে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
সেলিউকাস যখন ক্ষমতায় আরোহণ করেন ততদিনে ভারতে রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ক্ষমতায় জাঁকিয়ে বসেছেন। ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি সেলুসিড সাম্রাজ্যের বেশ কিছু অঞ্চল পুনর্খদল করে নেন যেগুলো আলেকজান্ডারের সময়ে হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। দুই বছর যুদ্ধের পর সম্রাট সেলিউকাস এবং চন্দ্রগুপ্তের মাঝে একটি শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তি অনুসারে সেলিউকাস ৫০০ রণহস্তীর বিনিময়ে দখল হওয়া অঞ্চলগুলো রাজা চন্দ্রগুপ্তের কাছে ছেড়ে দেন।
সেলিউকাসের মৃত্যুর পর তার ছেলে প্রথম অ্যান্টিওকাস সাম্রাজ্যের হাল ধরেন। তিনি তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সর্বদা পারসিক অভিজাতদের সাথে পারিবারিক বন্ধনের মাধমে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। তার শাসনামলে রাজ্যে শাসন ব্যবস্থা আরো দৃঢ় এবং সুসংহত হয়।
তিনি মৃত্যুর পর সেলিউকাসকে দেবতা তুল্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেলিউকাসের ব্যাবিলন শাসনের প্রথম বছরকে (৩১২-৩১১ খ্রিস্টপূর্ব) ১ সাল হিসেবে বিবেচনা করে ইতিহাসের প্রথম সাল গণনা শুরু করেন।
তার শাসনামলে সাম্রাজ্য ভূমধ্যসাগরীয় সমুদ্রবন্দরগুলোর অধিকারকে কেন্দ্র করে মিশরের টলেমীদের সাথে দীর্ঘ এবং রক্তক্ষয়ী শত্রুতায় জড়িয়ে পড়ে যা প্রায় পরবর্তী ৭০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই সময়কালে দুই পক্ষের মধ্যে সাতটি যুদ্ধ সংগঠিত হয় যা ইতিহাসে সিরিয় যুদ্ধ নামে পরিচিত।
প্রথম অ্যান্টিওকাসের পুত্র দ্বিতীয় অ্যান্টিওকাসের সময় অনেক এলাকা হাতছাড়া হয়ে যায়। এসময় সেলুসিডদেরকে এশিয়া মাইনরে সেল্টিক আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়। এই সুযোগে ব্যাক্ট্রিয়া, পার্থিয়া, কাপাডোসিয়ার মত প্রদেশগুলো নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে।
তবে সম্রাট তৃতীয় অ্যান্টিওকাসের সময়ে অবস্থার উন্নতি ঘটে। তিনি হারানো রাজ্যগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকেন। তিনি নিজে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে লেভান্ত থেকে ভারত পর্যন্ত ছয় বছরব্যাপী (২১০-২০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এক অভিযান পরিচালনা করেন৷ এসময় তিনি ব্যাক্ট্রিয়া রাজ্য দমন, পার্থিয়ার সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন এবং টলেমীদের নিকট হতে জুদাহ (বর্তমান ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন) এবং সিরিয়া জয় করেন। তার শাসনামলে সেলুসিডদের পূনর্জাগরণ ঘটার পাশাপাশি সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিস্তার ঘটে।
রোমের সাথে সংঘাত
ততদিনে সাম্রাজ্যের পশ্চিমে রোম সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে গেছে। গ্রিসের ছোট ছোট নগর রাষ্ট্রগুলোয় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ১৯৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে রোম-সেলুসিড স্নায়ু যুদ্ধের সূচনা হয়। ২১৮-২০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংঘটিত দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধে রোমানরা কার্থেজের বিপক্ষে জয় লাভ করলে সম্রাট তৃতীয় অ্যান্টিওকাস সন্দেহ করলেন যে তার সাম্রাজ্যের প্রভাব বলয়ে থাকা গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলো রোমের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। তাই তিনি গ্রিস এবং এশিয়া মাইনরে ক্রমবর্ধমান রোমান প্রভাব ঠেকাতে হ্যানিবালের (কার্থেজের সেনাপতি) পরামর্শে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। ১৯১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে থার্মোপাইলির প্রান্তরে এবং ১৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ম্যাগনেসিয়ার প্রান্তরে তিনি রোমানদের মুখোমুখি হন এবং দুইবারই যুদ্ধে পরাজিত হন। ফলে তিনি রোমানদের সাথে একটি অপমানজনক চুক্তি সম্পাদন করতে বাধ্য হন। আপামিয়ার চুক্তি নামে পরিচিত সম্পাদিত এই চুক্তি অনুযায়ী তৃতীয় অ্যান্টিওকাসকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণসহ সাম্রাজ্যের ইউরোপীয় অংশ এবং এশিয়া মাইনরের টরাস পর্বতমালা থেকে পারগ্যামামের মধ্যবর্তী অংশ রোমানদের নিকট ছেড়ে দিতে হয়।
শাসনব্যবস্থা
আকামেনিদ সাম্রাজ্যের সময় পুরো পারস্য অঞ্চল জুড়ে প্রদেশ ভিত্তিক যে সাত্রাপ ব্যবস্থা ছিল, সেলুসিডরা ক্ষমতায় আসার পর সেই ব্যবস্থায় তেমন কোনও পরিবর্তন আনেনি। এসময়ও প্রদেশগুলির প্রশাসনিক, বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং কর আদায়ের দায়িত্বে থাকতেন একজন সাত্রাপ তথা গভর্নর।
সংস্কৃতি
আগেই বলা হয়েছে যে, সেলুসিড সাম্রাজ্য সাংস্কৃতিক দিক থেকে পারস্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ সময় সাম্রাজ্য জুড়ে গ্রিক সংস্কৃতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রচুর শহর নির্মাণের মাধ্যমে পুরো অঞ্চলকে ব্যাপকভাবে গ্রিকীকরণ করা হয়। পারসিকরা সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সুবিধার্থে গ্রিক সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে। গ্রিকরাও ধীরে ধীরে স্থানীয় সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে থাকে। প্রচুর গ্রিক-পারসিক আন্তঃজাতি বিবাহও পরিলক্ষিত হয়। এভাবে পারস্য সংস্কৃতি এবং গ্রিক হেলেনিস্টিক সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটে যার প্রভাব পরবর্তী কয়েকশো বছর পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।
ধর্মীয় স্বাধীনতা
এজিয়ান সাগর হতে আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত এই সাম্রাজ্যে ছিল পারসিক, গ্রিক, আর্মেনীয়, ইহুদী প্রভৃতি জাতির বসবাস যাদের কেউ ছিলেন পৌত্তলিক, কেউ বা একেশ্বরবাদী। সেলিউকাস নিকেটর থেকে তৃতীয় অ্যান্টিওকাসের শাসনকাল পর্যন্ত সময়ে জনসাধারণের ধর্মীয় স্বাধীনতায় কোনও হস্তক্ষেপ হয়নি। কিন্তু চতুর্থ অ্যান্টিওকাসের সময় হতে পরিবেশ পাল্টাতে আরম্ভ করে। এ সময় গ্রিকদের নির্মিত শহরগুলোতে গ্রিক দর্শন এবং ধর্মীয় বিশ্বাস গ্রহণ করতে মানুষজনকে বাধ্য করা হতো। চতুর্থ অ্যান্টিওকাস ইহুদীদেরকে গ্রিক দেবতাদের মূর্তি স্থাপন এবং দেবতাদের উদ্দেশ্যে পশু উৎসর্গ করতে বাধ্য করার পাশাপাশি তাদের খৎনা নিষিদ্ধ করেন। তার আদেশে জেরুজালেমের বায়তুল মুকাদ্দাসে গ্রিক দেবতা জিউসের মূর্তি স্থাপিত হয়। তখন ইহুদীরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়ায় এ ঘটনা তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে। ফলে ইহুদীরা বিদ্রোহ করে বসে যা ইতিহাসে ম্যাকাবিয়ান বিদ্রোহ (Maccabean Revolt) নামে পরিচিত।
অবশেষে পতন
সম্রাট চতুর্থ অ্যান্টিওকাসের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য ক্রমেই অস্থিতিশীল হতে থাকে। ক্ষমতা নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। ফলে সাম্রাজ্য ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে দ্রুতবেগে। ইহুদীরা বিদ্রোহ করে ১৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে স্বাধীন জুদাহ রাজ্য গঠন করে। পারস্যে পার্থিয়ানরা শক্তিশালী হতে থাকে এবং পারস্যের অধিকাংশ এলাকা দখল করে স্বাধীন সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করে। শেষদিকে সেলুসিড সাম্রাজ্য সিরিয়া এবং আনাতোলিয়ায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। অবশেষে ৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান জেনারেল পম্পে সেলুসিডদের পরাজিত করলে পতন ঘটে পরাক্রমশালী সেলুসিড সাম্রাজ্যের।