মুসলিমদের বাৎসরিক দুটো ঈদের একটি হলো ঈদুল আযহা বা কুরবানির ঈদ, যার উৎপত্তি ঘটনা হিসেবে মুসলিমরা হযরত ইব্রাহিম (আ) এর কুরবানির ঘটনা জানেন; কিন্তু তার আগেও যে কুরবানি দেওয়া হতো ভিন্নরূপে সেটা কি জানা আছে সকলের? ধর্মীয় ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে কুরবানির একাল সেকাল নিয়ে রোর বাংলার পাঠকদের জন্য আমাদের আজকের আয়োজন।
শুরুতেই জেনে নেয়া যাক শাব্দিক অর্থ নিয়ে। ‘আযহা’ (الأضحى) এসেছে ‘উযহিয়্যাহ'(أضحية) থেকে; ‘কুরবান’ (قربان) মানে sacrifice, উৎসর্গ। এর আদিমূল হিব্রুতে (ק-ר-ב) এর অর্থ ছিল, ‘নৈকট্য অর্জন’, কারণ হিব্রু ‘কারব’ মানে ‘নিকট’।
খ্রিস্টানদের বিশ্বাস, হযরত আদম (আ) যে ‘পাপ’ করে মানবজাতির পতন ঘটান বেহেশত থেকে, সেই পাপের জন্য ‘কুরবান’ হচ্ছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ) এর পুত্র, যদি আসলেই সেই কুরবানিটা পুরোপুরি সম্পন্ন হত, তাহলে মানবজাতি পাপ-মুক্ত হত। কিন্তু সেটা তখন হয়নি। বরং খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে, ঈশ্বর নিজ পুত্র দ্বারাই মানুষকে পাপমুক্ত করবেন। তাই ঈশ্বরপুত্র যীশু আসলেন ও মানুষের জন্য ক্রুশে ‘কুরবান’ হলেন; ফলে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হল। যীশুকে এজন্য তারা ‘দ্বিতীয় আদম’ও বলে থাকে।
যুগে যুগে কুরবানির প্রথা ছিল বিভিন্ন রকম। বাইবেল বা তাওরাতের মতো ধর্মগ্রন্থ আর ইবনে কাসিরের মতো তাফসিরগুলো আমাদের জানায়, আগেকার যুগে কার কুরবানি আল্লাহ্র কাছে গ্রহণ হলো, কারটা হলো না, সেটা সহজেই বোঝা যেত। তখন যা কুরবানি করা হচ্ছে সেটা খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল, যেটা এখন নয়। সেটা শস্য হোক আর প্রাণীই হোক, খাওয়া যেত না। কুরবানির বেদীতে রেখে কুরবানদাতা দূরে সরে আসতেন। আকাশ থেকে তখন একটা আগুন এসে পুড়িয়ে দিয়ে যেত সেই উৎসর্গ, ইহুদীদের তাওরাতে সেটাই জানা যায়। পুড়ে গেলে বোঝা যেত, আল্লাহ কবুল করেছেন কুরবানি। যদি আগুন না আসে, তাহলে কবুল হয়নি।
হযরত আদম (আ) এর দুই পুত্র হাবিল (Abel) আর কাবিল (Cain) এর মর্মান্তিক ঘটনা এই কুরবানি নিয়েই হয়েছিল। কাবিল ছিল সঙ্কীর্ণ মনের মানুষ। কোনো একটি কারণে হাবিল আর কাবিল দুজনেই কুরবানি দিলেন। কিন্তু দূরে সরে আসতেই হাবিলের কুরবানি আকাশ থেকে আগুন এসে পুড়িয়ে দিল অর্থাৎ তাঁর কুরবানি কবুল হলো। কিন্তু কাবিলের কুরবানির কিছুই হল না। কাবিল ক্রোধোন্মত্ত হয়ে খুন করল তার ভাই হাবিলকে। মানবজাতির প্রথম খুনি কাবিল আর প্রথম নিহত হন হাবিল। পবিত্র কুরআনে এ ঘটনা বর্ণিত রয়েছে।
হযরত ইলিয়াস (আ) এর সময়, ইসরায়েলের রাজা আহাবের স্ত্রী, অর্থাৎ, ইসরায়েলের রানি ছিল ইসাবেল (Jezebel); সে ছিল পৌত্তলিক। তাঁর উপাস্য ছিল দেবতা বা’আল (Ba’al/بعل); কুরআনে তাদের এ দেবতার নাম উল্লেখ আছে।
ইলিয়াস (আ) অনেক চেষ্টা করেন এ রানির কুচক্রের হাত থেকে ইসরায়েলকে পবিত্র করতে, পারলেন না। আল্লাহ ইসরায়েলে দুর্ভিক্ষ দিলেন। শেষ পর্যন্ত হযরত ইলিয়াস (আ) প্রকাশ্য ‘চ্যালেঞ্জ’ প্রস্তাব করেন। সে হিসেবে কারমেল পাহাড়ে (הַר הַכַּרְמֶל) দুটো বেদী বানানো হল। একটাতে রাখা হল ইলিয়াসের (আ) এর কুরবানি। আরেকটাতে দেবতা বা’আলের ৪৫০ ভণ্ড নবীর কুরবানি। এরপর শুরু হল প্রার্থনা। যার কুরবানি কবুল হবে তার প্রভু সত্য। ভণ্ড নবীরা যতই চেষ্টা করল, বা’আলের কাছে প্রার্থনা করল, পারল না। কিন্তু হযরত ইলিয়াস (আ) প্রার্থনা করতেই আকাশ থেকে আগুন এসে পুড়িয়ে দিল তাঁর কুরবানি। এরপর হত্যা করা হল ভণ্ড নবীদের। আর ইলিয়াস (আ) দোয়া করতেই বৃষ্টি নামলো। দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয়ে গেল। [তাওরাত, ১ম বাদশাহনামা, ১৮]
মাউন্ট কারমেল আজ ‘ইলিয়াস পাহাড়’ নামেও পরিচিত।
“নিশ্চয়ই ইলিয়াস ছিল রসূল। যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা কি ভয় কর না? তোমরা কি বা’আল দেবতার এবাদত করবে এবং সর্বোত্তম স্রষ্টাকে পরিত্যাগ করবে, যিনি আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের পালনকর্তা? অতঃপর তারা তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। অতএব তারা অবশ্যই গ্রেফতার হয়ে আসবে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলার খাঁটি বান্দাগণ নয়। আমি তার জন্য পরবর্তীদের মধ্যে এ বিষয়ে রেখে দিয়েছি যে, ইলিয়াসের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক! এভাবেই আমি সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।” [কুরআন ৩৭:১২৩-১৩১]
হযরত নুহ (আ) মহাপ্লাবনের পর জাহাজ থেকে নেমেই শোকরানা কুরবানি করেন। হযরত মুসা (আ) এর লোহিত সাগর পাড়ি দেবার ঘটনার পর থেকে, ঈদুল ফিসাখ পালন করত ইহুদীরা এবং এখনও করে। আল্লাহ তাদেরকে কুরবানি করতে বলেছিলেন মিসর থেকে মুক্তির কথা স্মরণ করে। তবে এখন ইহুদীরা মুসলিমদের মতো করে পালন করে না কুরবানি।
মুসলিমরা যে নিয়মে জবাই করে তাকে ‘যাবিহা’ বলে, আর ইহুদীরা যে নিয়মে কুরবানি বা জবাই করে সেটাকে ‘শেহিতা’ বলে। কোনো ইহুদী বা খ্রিস্টান যদি শেহিতা (שחיטה) পদ্ধতিতে জবাই করে, তবে সেই মাংস খাওয়া মুসলিমদের জন্য হালাল; নতুবা হারাম।
হযরত ইব্রাহিম (আ) এর কুরবানির ইতিহাস সবারই জানা। স্বপ্নে নিজের প্রিয়তমের কুরবানির নির্দেশ পেয়ে তিনি একে একে অনেক কিছুই কুরবানি করলেন। কিন্তু পরে বুঝলেন আসলে কুরবানি করতে হবে নিজের একমাত্র ছেলেকে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কাকে? কে সেই ছেলে? অনেকে এ বিষয়ে না জানলেও, ইব্রাহিম (আ) এর কোন পুত্রকে কুরবানি দেয়া হয়েছিল সেটা নিয়ে ইহুদি খ্রিস্টান বনাম ইসলামের মাঝে রয়েছে একটি বিতর্ক।
ইহুদি আর খ্রিস্টানরা বলে, বাইবেলের Old Testament মতে, কুরবানি করতে নেয়া হচ্ছিল ইব্রাহিম (আ) এর দ্বিতীয় পুত্র হযরত ইসহাক (আ)-কে, হযরত ইসমাইলকে (আ) না! ইহুদী আর খ্রিস্টানরা যেহেতু নিজেদেরকে হযরত ইসহাক (আ) এর আধ্যাত্মিক (ধর্মীয়) বংশধর মনে করে, তাই তাদের মতে, তারা বেশি সম্মানিত, যেহেতু তাদের পূর্বপুরুষকে কুরবানি করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এবং তারাই পবিত্র ভূমি মধ্যপ্রাচ্যের মালিক। তাদের কাছে এ ঘটনা Binding of Isaac নামে পরিচিত। (আইজ্যাক = ইসহাক)
কিন্তু মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, কুরবানি করতে নেয়া হচ্ছিল হযরত ইসমাইল (আ)-কেই।
হযরত ইসমাইল (আ)-কে কুরবানি দেয়ার সময় সহ্য হবে না দেখে চোখে কাপড় বেঁধে নিয়েছিলেন ইব্রাহিম। আল্লাহর রহমতে, কুরবানি হয় একটি বেহেস্তি দুম্বা, যেটা হযরত জিবরাঈল (আ) এসে ইসমাইলের জায়গায় বসিয়ে দেন। এ ঘটনার স্মরণে মুসলিমরা আজও কুরবানি করে।
এটা সত্য যে, কুরআনে বলা হয়নি, ইব্রাহিম কাকে কুরবানি করেছিলেন, কেবল “তাঁর পুত্র” বলা আছে। এজন্য প্রথম দিকের কিছু ইসলামি বিশেষজ্ঞ (যেমন ইবনে কুতাইবা, তাবারি) বলতেন হযরত ইসহাক (আ) ছিলেন সেই পুত্র। কিন্তু বেশিরভাগ স্কলার একমত যে, হযরত ইসমাইল (আ)-ই ছিলেন সেই পুত্র, এবং সেটি দেখাবার জন্য ইসলামিক স্কলারগণ যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ ব্যবহার করেছেন। এ কারণেই ‘ইসমাইল যাবিহুল্লাহ’ নাম রয়েছে তাঁর।
কুরআনের ভাষায় পুরো ঘটনা তুলে দেয়া হচ্ছে-
“হে আমার পরওয়ারদেগার! আমাকে এক সৎপুত্র দান কর। সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম। অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বলল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কী দেখ। সে বলল, পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্যে শায়িত করল। তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহীম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্যে এক মহান জন্তু। আমি তার জন্য এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি যে, ইব্রাহীমের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক। এমনিভাবে আমি সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। সে ছিল আমার বিশ্বাসী বান্দাদের একজন।” (সুরা সাফফাত, ৩৭:১০০-১১১)
কুরবানির ঈদ ‘ঈদুল কবির’ নামেও পরিচিত ইয়েমেন, সিরিয়া ও উত্তর আফ্রিকার মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও মিসরের মতো দেশে। ঈদুল কবির মানে ‘বড়’ ঈদ। জিলহজ মাসের ১০ তারিখে অনুষ্ঠিত এ ঈদ মিসর, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যে ‘ঈদুল বাকারাহ’ নামেও পরিচিত। পাকিস্তান, ভারত আর বাংলাদেশের কিছু জায়গাতেও এটি ‘বকরি ঈদ’ বলে পরিচিত।
সব শেষে পাঠকদের জন্য ঈদুল আযহার শুভেচ্ছা থাকল। ঈদ মুবারাক!
ফিচার ইমেজ- wishyouhappyday.com