‘বিশ্বযুদ্ধ’ শব্দটি শুনলে আমাদের মনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে দ্বিতীয়টির কথাই সবার আগে চলে আসে। এর কারণ হিসেবে সেই যুদ্ধে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা, জার্মান একনায়ক অ্যাডলফ হিটলারের চূড়ান্ত পতনের মতো বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য। আবার হিটলারের নাম আসলে অবধারিতভাবেই চলে আসে ইহুদী নিধনযজ্ঞের কথাটি, যাতে প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদী প্রাণ হারিয়েছিলেন।
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী করে আনা সেই ইহুদীদের উপর হিটলার বাহিনীর বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকেরা নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন। তাদের পরীক্ষার বিবরণ শুনলে মনে হবে, তারা বুঝি মানুষ নয়, বরং কোনো কুকুর, শেয়াল কিংবা বানরের উপর পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। ইচ্ছামতো মানুষ মেরে তার দেহ নিয়ে গবেষণা হতো তখন। যেন সেগুলো খেলনা পুতুল; খেলা শেষ, তো ফেলে দাও!
বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বন্দীদের উপর চালানো অমানবিক নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাহিনী নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের লেখাটি।
রক্ত জমাট বাধার পরীক্ষা
প্রথমেই যে জার্মান চিকিৎসকের নাম বলবো তিনি ডাক্তার সিগমুন্ড র্যাশার। ডাকাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদের উপর রক্ত জমাট বাধা সংক্রান্ত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন তিনি। এ উদ্দেশ্যে বীট ও আপেলের পেক্টিন (চিনির মতো এক ধরনের যৌগিক পদার্থ যা জ্যাম, জেলি বানাতে ব্যবহৃত হয়) থেকে তিনি পলিগ্যাল নামক একটি ট্যাবলেট বানিয়েছিলেন। ডাক্তার র্যাশার ভেবেছিলেন তার নিজস্ব ফর্মুলায় তৈরিকৃত এ ট্যাবলেটটি বোধহয় যুদ্ধক্ষেত্র ও চিকিৎসায় রক্তপাত বন্ধ করতে সাহায্য করবে।
ট্যাবলেটটি আসলেই কাজ করছে কিনা সেটি বোঝার জন্য প্রথমেই বন্দীকে সেটি খাওয়ানো হতো। এরপর সরাসরি গুলি করা হতো তার বুক কিংবা ঘাড়ে! পরবর্তীতে চেতনানাশক প্রয়োগ না করেই দুর্ভাগা সেই বন্দীদের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নেয়া হতো।
সালফোন্যামাইড পরীক্ষা
এবার যাওয়া যাক র্যাভেন্সব্রুক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানকার বন্দীদের উপর সালফোন্যামাইড তথা সালফা ড্রাগের বিভিন্ন পরীক্ষা চালানো হতো। এজন্য প্রথমেই একজন বন্দীর পায়ের বেশ কিছু অংশ কেটে ফেলা হতো। এরপর সেখানে ব্যাক্টেরিয়ার মিশ্রণ ঘষে জায়গাটি সেলাই করে বন্ধ করা হতো। আসল যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা আনার জন্য মাঝে মাঝে সেখানে গ্লাস স্প্লিন্টারও লাগানো হতো।
তবে সত্যি কথা হলো, সম্মুখযুদ্ধে সৈন্যরা যেভাবে আহত হতো, সেই তুলনায় বন্দীদের এই কাটাছেঁড়া ছিলো একেবারেই নগণ্য। বন্দুকের গুলির ক্ষতের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে একজন বন্দীর রক্ত নালিকা কেটে উভয়পাশই বেঁধে দেয়া হতো যেন রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এই অমানবিক পরীক্ষাগুলো পরবর্তীকালে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ওষুধের উন্নতিতে অনেক অবদান রেখেছিলো- এ কথাটি যেমন অস্বীকার করার উপায় নেই, তেমনি এটাও অনস্বীকার্য যে, মারাত্মক সেই ব্যথা সহ্য করতে না পেরে অনেক বন্দীরই আজীবনের জন্য কোনো শারীরিক ক্ষতি হয়ে যেত, এমনকি মারাও গিয়েছে অনেকে।
নিম্ন তাপমাত্রা সংক্রান্ত পরীক্ষা
ইস্টার্ন ফ্রন্টে গিয়ে জার্মান বাহিনী যে ধরনের শীতের মুখোমুখি হয়, তার জন্য তারা একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না। ফলে মারা যায় হিটলার বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য। তখন আবারো তাদের জন্য ত্রাতা (!) হয়ে আসেন ডাক্তার সিগমুন্ড র্যাশার। বার্কন’, অসউইৎজ ও ডাকাউয়ের বন্দীদের উপর এ উদ্দেশ্যে পরীক্ষা চালান তিনি। তার উদ্দেশ্য ছিলো মূলত দুটি- শরীরের তাপমাত্রা কমতে কমতে কতক্ষণে একজন বন্দী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সেই সময়টি বের করা এবং যারা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়, তাদেরকে কিভাবে পুরোপুরি চাঙ্গা করে তোলা যায় তার উপায় খোঁজা।
এজন্য বন্দীদেরকে উলঙ্গ করে বরফপূর্ণ চৌবাচ্চা কিংবা হিমশীতল পানিতে ডুবিয়ে রাখা হতো। কখনো আবার বাইরের মারাত্মক ঠান্ডা আবহাওয়ায় সেই অবস্থাতেই ছেড়ে দেয়া হতো। অধিকাংশ বন্দীই এতে মারা যেত। যারা বেঁচে যেত, তারা হয়তো তাদের মৃত সঙ্গীদের সৌভাগ্যবান ভাবতো। কারণ সেই পরিস্থিতিতে কেবলই জ্ঞান হারিয়ে বেঁচে যাওয়াদের উপরই শুরু হতো আসল পরীক্ষা।
পুনরুজ্জীবিত করতে বন্দীদের মারাত্মক উত্তপ্ত সানল্যাম্পের নিচে রাখা হতো যাতে পুড়ে যেত তাদের চামড়া। শরীর উত্তপ্ত করতে তাদেরকে কোনো নারীর সাথে দৈহিক মিলনে বাধ্য করা হতো। এরপর তাদের গরম পানি পান করানো হতো কিংবা চুবানো হতো গরম পানিতে।
আগ্নেয় বোমার পরীক্ষা
১৯৪৩-৪৪ সালের মাঝে তিন মাস ধরে বুখেনওয়াল্ড কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদের উপর চালানো হয় অমানবিক এক পরীক্ষা। বিভিন্ন আগ্নেয় বোমায় (Incendiary Bomb) ব্যবহৃত ফসফরাসের কারণে শরীরে যে ক্ষতের সৃষ্টি হতো, তার বিরুদ্ধে জার্মানদের ওষুধগুলো কতটা কার্যকর সেটা বুঝতেই করা হতো এমন পরীক্ষা। এ উদ্দেশ্যে প্রায় সময়ই সেসব বোমায় ব্যবহৃত ফসফরাস দিয়ে বন্দীদের শরীর পুড়িয়ে দেয়া হতো!
নোনা পানির পরীক্ষা
সমুদ্রের নোনা পানি মুখে গেলে আমরা সাথে সাথেই চোখ-মুখ কুঁচকে তা ফেলে দেই। কিন্তু এই নোনা পানিকে পানযোগ্য করতে চালানো পরীক্ষাতেও গিনিপিগ হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিলো ডাকাউ ক্যাম্পের বন্দীদের। এজন্য প্রথমে বন্দীদের চারটি দলে ভাগ করে নেয়া হতো। এগুলো হলো- ১) কোনো পানি নয়, ২) কেবলমাত্র সামুদ্রিক পানি, ৩) বার্কা পদ্ধতিতে শোধনকৃত সামুদ্রিক পানি এবং ৪) লবণমুক্ত সামুদ্রিক পানি।
এ সময় বন্দীদেরকে কোনো খাবার কিংবা দলের জন্য নির্ধারিত পানীয় ব্যতীত অন্য কোনো পানীয়ও দেয়া হতো না। যাদের পানীয়ের তালিকায় সমুদ্রের নোনা পানি স্থান পেতো, তারা নানাবিধ শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হতো। ডায়রিয়া, কনভালশন, হ্যালুসিনেশন, উন্মত্ততা ইত্যাদির পর একসময় তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো।
বিষ নিয়ে পরীক্ষা
মানবদেহে বিভিন্ন বিষের প্রভাব যাচাইয়ের জন্য বেছে নেয়া হয়েছিলো বুখেনওয়াল্ড কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদের। ১৯৪৩ সালের দিকে গোপনে তাদের খাবারের মাঝে বিষ মেশানো শুরু হয়।
কেউ কেউ সেসব বিষের প্রভাবে তাৎক্ষণিকভাবেই মারা গিয়েছিলো। কিছু বন্দীকে মেরে ফেলা হয়েছিলো ময়নাতদন্ত করে অধিক তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। এক বছর পরে আরো অনেক বন্দীকে সরাসরি বিষ মেশানো বুলেট দিয়ে গুলি করা হয়েছিলো দ্রুত তথ্য লাভের আশায়। এদের কষ্ট হয়েছিলো সবচেয়ে বেশি।
অনার্যদের নিধন
অনার্যদের নিধনের জন্য কোন পদ্ধতিতে সবচেয়ে কম সময় ও অর্থ খরচ হবে, সেটি খুঁজে বের করতেও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে নাৎসি বাহিনীর চিকিৎসকেরা। এক পরীক্ষায় স্ত্রী-জননাঙ্গে একটি রাসায়নিক পদার্থ ঢুকিয়ে দেয়া হতো যাতে করে বন্ধ হয়ে যেত ফ্যালোপিয়ান টিউব। কেউ কেউ এর ফলে মারা যেতেন। আবার ময়নাতদন্ত করার জন্যও এদের মাঝে কোনো কোনো মহিলাকে হত্যা করা হতো।
আরেক পরীক্ষার কথা জানা যায় যেখানে বন্দীদের সুতীব্র এক্স-রে’র মুখোমুখি হতে হত। ফলে তাদের পাকস্থলি, কুঁচকি ও নিতম্ব অনেকটাই পুড়ে যেত। এ ক্ষতগুলোর অনেকগুলোই ছিলো নিরাময়ের অযোগ্য। আক্রান্তদের কেউ কেউ এর ফলে মারাও যেত।
ম্যালেরিয়া এক্সপেরিমেন্ট
এবারের দুর্ভাগারা ছিলো ডাকাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দী। প্রায় তিন বছর সময় ধরে ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য সেখানকার প্রায় এক হাজার বন্দীর উপর পরীক্ষা চালায় নাৎসি বাহিনীর চিকিৎসকেরা। সুস্থ বন্দীদের শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করানো হতো। এরপর নাৎসি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত বিভিন্ন ওষুধ দিয়ে চলতো রোগীদের উপর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অনেকেই এ সময় মারা যায়। যারা বেঁচে যায়, তাদেরও সহ্য করতে হয় নিদারুণ কষ্ট। অনেকে সেসব ওষুধের প্রভাবে চিরতরে পঙ্গুও হয়ে গিয়েছিলো।
উচ্চতা সংক্রান্ত পরীক্ষা
আবারো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা, আবারো ডাকাউ ক্যাম্প। এবারের পরীক্ষাটি চালানো হয়েছিলো ১৯৪২ সালের মার্চ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত। ডাকাউ ক্যাম্পের বন্দীদের দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিলো মানুষ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ কত উচ্চতা পর্যন্ত জ্ঞান না হারিয়ে টিকে থাকতে পারে। এই পরীক্ষাটি জার্মান এয়ার ফোর্সের জন্য করা হয়েছিলো।
বন্দীদেরকে নিম্ন-চাপ সম্বলিত এমন একটি কক্ষে রাখা হতো যার অবস্থা হতো অনেকটা ২১,০০০ মিটার (৬৮,০০০ ফুট) উচ্চতার মতো। এ পরীক্ষার মাঝে দিয়ে যাওয়া অধিকাংশ বন্দীই মারা গিয়েছিলো। যারা বেঁচে ছিলো, তাদের শারীরিক অবস্থারও মারাত্মক অবনতি ঘটেছিলো।
স্পটেড ফিভারের পরীক্ষা
এ পরীক্ষার ব্যাপ্তিকাল ছিলো ১৯৪১ সালের শেষের দিক থেকে ১৯৪৫ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত। বুখেনওয়াল্ড ও নাৎজওয়েইলার কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের চিকিৎসকেরা জার্মান সেনাবাহিনীর জন্য সেখানকার বন্দীদের উপর স্পটেড ফিভার ও অন্যান্য রোগের ভ্যাক্সিন নিয়ে গবেষণা চালায়।
প্রথমে ৭৫ ভাগ বন্দীকে স্পটেড ফিভারের পরীক্ষণরত ভ্যাকসিনটি দেয়া হয়। এরপর তাদের দেহে প্রবেশ করানো হয় রোগটির ভাইরাস। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভ্যাকসিনটি অকার্যকর হওয়ায় তাদের প্রায় ৯০ ভাগই মারা যায় এতে।
অবশিষ্ট ২৫ ভাগের শরীরে কোনো ভ্যাকসিন ছাড়াই স্পটেড ফিভারের ভাইরাস প্রবেশ করালে তাদেরও অধিকাংশ মারা যায়।
যমজদের নিয়ে পরীক্ষা
‘অ্যাঞ্জেল অফ ডেথ’ তথা ‘মৃত্যুদূত’ খ্যাত নাৎসি চিকিৎসক জোসেফ মেঙ্গেল যমজদের নিয়ে অনেক পরীক্ষাই চালিয়েছিলেন। অসউইৎজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দীরা আসলেই তিনি সেখান থেকে বেছে বেছে যমজদের আলাদা করে রাখতেন। প্রতিদিন রুটিন করে যমজদের রক্তের নমুনা নেয়া হতো। এর পেছনের কারণ যে আসলে কী তা আজও জানা যায় নি। যমজদের শরীর অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করা হতো। তাদের শরীরের প্রতিটি অংশের মাপ নেয়া হতো যথাসম্ভব নির্ভুলভাবে। এমনকি কখনো কখনো একজন থেকে আরেকজনের শরীরে রক্ত সঞ্চালনও করা হতো মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে।
মাঝে মাঝে যমজদের একজনের শরীরে হয়তো কোনো রোগের জীবাণু প্রবেশ করিয়ে দেয়া হতো। যদি সে মারা যেত, তাহলে অপরজনকেও মেরে ফেলা হতো দুজনের শারীরিক বিষয়াবলীর তুলনামূলক গবেষণার জন্য। চেতনানাশক ব্যবহার ব্যতিরেকেই অনেকের বিভিন্ন অঙ্গ কেটে ফেলা হতো।
ক্যাম্পে হাসি-খুশি যে যমজ শিশুগুলো পা রাখতো, তাদের অধিকাংশেরই আর বাইরের পৃথিবী দেখার সৌভাগ্য হতো না। ময়নাতদন্তের মাধ্যমে মানুষরুপী একদল জানোয়ারের গবেষণার বিষয়বস্তুতে পরিণত হওয়াই ছিলো তাদের অন্তিম নিয়তি।