বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরনের জনপ্রিয় বোর্ড গেম রয়েছে, যার মধ্যে মনোপলি বেশ জনপ্রিয়। একে ঘিরে রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা শিরোনাম দেখে আপনি ইতোমধ্যেই আঁচ পেয়ে গিয়েছেন। চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক মনোপলি কীভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েদিদের পালাতে সাহায্য করেছিল সেই সম্পর্কেই।
ঘটনার শুরু
মনোপলির যাত্রা শুরু ১৯০০ সালের শুরুর দিকে। এই বোর্ড গেম তৈরি করে ওয়েডিংটন নামক একটি ব্রিটিশ কার্ড এবং বোর্ড গেম প্রস্তুতকারক কোম্পানি। ১৯৪০ সালের দিকে ওয়েডিংটনে অ্যালস্টন নামক একজন ভদ্রলোক নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়ে কিছু ভিজিটিং কার্ড বানাতে চান। তাকে তার চাহিদামতো কার্ড বানিয়েও দেওয়া হয়।
কিছুদিন পর ভদ্রলোক আবারও আসেন, তবে এবার তিনি কোম্পানির মালিকের সাথে দেখা করতে চান। তৎকালীন মালিক ছিলেন নরমান ওয়াটসন। অ্যালস্টন মূলত এক ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের হয়ে কাজ করতেন, যার নাম এম নাইন্টিন। এর মূল হোতা ছিলেন হুটন।
যা-ই হোক, অ্যালস্টন নরমানকে নিজেদের পরিকল্পনা খুলে বলে তার সাহায্য চান। ১৯৪১ সালের দিকে হুটন এবং ওয়েডিংটন মিলে মনোপলি বোর্ডের সাথে ‘এস্কেপ কিট’ তৈরি করে সংযুক্ত করে দেওয়া শুরু করে, যা পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসি বন্দীশালার কয়েদিদের কাছে সরবরাহ করা হয়।
যা ছিল সেই এস্কেপ কিটে
এস্কেপ কিটে ছিল একটি সিল্কের কাপড়ের উপর তৈরি করা ইউরোপের একটি ম্যাপ, যেখানে নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ইত্যাদি দেশ ছিল। এছাড়াও ছুরি, তামার ফাইল, ছোট আকৃতির কম্পাস, দড়ি এবং অর্থও থাকত।
সবকিছুই মনোপলি বোর্ডের নিচে একটি কম্পার্টমেন্ট তৈরি করে সেখানে সংযুক্ত করে উপরে সিল করে দেওয়া হয়েছিল।
অন্য ম্যাটেরিয়ালের কাপড় ব্যবহার না করে সিল্কের কাপড়ের তৈরি ম্যাপ ব্যবহার করা হয়েছিল, কারণ সিল্কের কাপড় সহজে ছিঁড়বে না কিংবা পানিতে ভিজবে না এবং খুব পাতলা, ফলে খুব সহজেই বোর্ডে লুকিয়ে সংযুক্ত করে দেওয়া যায়। হুটন খুব সাবধানতার সাথে মনোপলি বোর্ডের আকার-আকৃতির সাথে মিল রেখে এই এস্কেপ কিট তৈরি করেন।
এবার এস্কেপ কিট পৌঁছে দেওয়ার পালা
এস্কেপ কিট তৈরির পর নাৎসি ক্যাম্পের কয়েদিদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় কীভাবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হলো। কিট বানানোর থেকেও সফলভাবে পৌঁছে দেওয়া আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল, কিন্তু হুটনের ভাগ্য বেশ ভাল ছিল এবার।
জেনেভা কনভেনশন জার্মানি কিছু চ্যারিটি অর্গানাইজেশনকে কয়েদিদের কাছে খেলার সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিল, কারণ তারা মনে করতো- কয়েদিরা খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে জেল থেকে পালানোর চিন্তাভাবনার সময় পাবে না।
কয়েদিদের পালানোর জন্য তৈরি করা ভিন্ন রকমের মনোপলি বোর্ডগুলো এভাবেই একটি ভুয়া চ্যারিটির মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এছাড়াও ওয়েডিংটন যেহেতু বিখ্যাত কোম্পানি, তাই তাদের সন্দেহ করার সুযোগ ছিল না।
রেড ক্রস পার্সেলে করে চা, সিগারেট, চিনি, কুকিজ, ক্যানে থাকা সবজি এবং ফলমূল যেত। এগুলোর সাথেই কয়েদিদের কাছে এই বোর্ডগুলোও এভাবে সরবরাহ করা হয়। যেসব সৈন্য মিশনে যেত, তাদের এই এস্কেপ বোর্ড সম্পর্কে আগেই জানিয়ে রাখা হতো, যাতে ধরা পড়লে তারা যেন এটি কাজে লাগিয়ে পালিয়ে আসতে পারে।
প্রতিটি বোর্ডে কোন মানচিত্র লুকিয়ে আছে তা দেখানোর জন্য একটি বিশেষ চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছিল। যেমন-মেরিলেবোন স্টেশনের পর একটি ফুল স্টপ চিহ্ন মানে একটি ইতালীয় মানচিত্র, মেফেয়ারের পরে ফুল স্টপ মানে নরওয়ে, সুইডেন ও জার্মানির মানচিত্র, এবং ফ্রি পার্কিংয়ের পর ফুল স্টপ মানে উত্তর ফ্রান্স এবং জার্মানির মানচিত্র।
আদৌ কি সফল হয়েছিল?
ওয়েডিংটন এবং এম নাইনটিনের উদ্যোগে যৌথভাবে তৈরি কয়েদিদের পালানোর এই পরিকল্পনা আদৌ সফল হয়েছে কিনা তা ওয়েডিংটন নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে ফিলিপ অরবেন্স নামক একজন মনোপলি ইতিহাসবিদ বলেছেন, ৭০০ জন যুদ্ধবন্দি এই এস্কেপ কিট এবং অন্যান্য উপায়ে পালাতে সক্ষম হয়েছিল।
অন্য একটি সূত্রানুযায়ী, নাৎসি বন্দীশালা থেকে সেই সময়ে ৩৫ হাজারেরও বেশি কয়েদি পালাতে পেরেছিল। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজার কয়েদির কাছে সিল্ক ম্যাপ, কম্পাসসহ অন্যান্য জিনিস পাওয়া যায়, যা সরবরাহ করা মনোপলি বোর্ডে লুকানো ছিল।