রুশ–ওসমানীয় দ্বন্দ্ব ছিল ষোড়শ থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরেশিয়ার ইতিহাসের একটি নিয়মিত বৈশিষ্ট্য। ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত রুশ সাম্রাজ্য ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে মোট ১২টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘ সময় ধরে সাম্রাজ্য দুটির মধ্যে তিক্ত সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। বস্তুত এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের ইতিহাস এখন পর্যন্ত রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যেকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ায় তুর্কিবিরোধী এবং তুরস্কে রুশবিরোধী মনোভাব প্রবল। বর্তমানেও পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ ককেশাস, মধ্য এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে রাষ্ট্র দুটি একে অপরের বিরুদ্ধে ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত।
কিন্তু রুশ–তুর্কি সম্পর্কের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে বিগত এক শতাব্দীতে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে কোনো যুদ্ধবিগ্রহ সংঘটিত হয়নি। সময়ে সময়ে রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে ছোট ছোট সংঘর্ষ হয়েছে (যেমন: ১৯২১ সালের মার্চে জর্জিয়ায় তুর্কি–সোভিয়েত সংঘর্ষ এবং ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়ার ইদলিবে তুর্কি সৈন্যদের ওপর রুশ বিমান হামলা), কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে পূর্ণমাত্রার কোনো যুদ্ধ হয়নি। বস্তুত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে রুশ ও ওসমানীয় উভয় সাম্রাজ্যেরই পতন ঘটে এবং রুশ–ওসমানীয় দ্বন্দ্ব এক্ষেত্রে বড় একটি ভূমিকা রেখেছিল।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র এবং তুরস্কের ‘গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সরকার’ বা সংক্ষেপে ‘আঙ্কারা সরকার’ নিজ নিজ স্বার্থে পরস্পরের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে। এসময় রাশিয়ায় বিপ্লবী বলশেভিক সরকারের সঙ্গে বলশেভিকবিরোধী শ্বেত ফৌজ ও মিত্রশক্তির (ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য) যুদ্ধ চলছিল। অন্যদিকে, তুরস্কের আঙ্কারা সরকার গ্রিস, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে’ লিপ্ত ছিল। এমতাবস্থায় রুশ বলশেভিক ও তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা একটি মৈত্রী গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং এই উদ্দেশ্যে দক্ষিণ ককেশাসে তাদের সীমান্ত চিহ্নিত করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে বর্তমান আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া এবং উত্তর–পূর্ব তুরস্কের অংশবিশেষ (কার্স, আরদাহান, আর্তভিন, সুরমালি ও অন্যান্য অঞ্চল) রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের ফলে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ১৯১৮ সালে স্বাক্ষরিত ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তি অনুযায়ী বলশেভিকরা প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের কার্স ও বাতুমি প্রদেশ ওসমানীয় সাম্রাজ্যের কাছে হস্তান্তর করে, এবং আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া রাশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইতোমধ্যে বলশেভিকরা নিজেদের গৃহযুদ্ধ ও মিত্রশক্তির আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া কার্স ও বাতুমি অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে। এ সময় তুর্কিরা মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।
কিন্তু ১৯২০ সাল নাগাদ পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসে। ১৯২০ সালের এপ্রিলে বলশেভিকরা আজারবাইজান অধিকার করে নেয় এবং সেখানে একটি আজারবাইজানি বলশেভিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বরে তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা আর্মেনিয়া আক্রমণ করে এবং ডিসেম্বর নাগাদ আর্মেনিয়ার অর্ধেকের বেশি ভূমি দখল করে নেয়। ১৯২০ সালের নভেম্বরে বলশেভিকরাও আর্মেনিয়া আক্রমণ করে এবং ডিসেম্বর নাগাদ আর্মেনিয়ার অবশিষ্ট অংশে একটি আর্মেনীয় বলশেভিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বলশেভিকরা জর্জিয়া আক্রমণ করে এবং মার্চের মধ্যে জর্জিয়ার অধিকাংশ ভূমি দখল করে সেখানে একটি জর্জীয় বলশেভিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। একই সময়ে তুর্কি জাতীয়তাবাদীরাও জর্জিয়ায় আক্রমণ চালায় ও বাতুমি অঞ্চল দখল করে নেয়।
১৯২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত মস্কোয় বলশেভিক ও তুর্কি জাতীয়তাবাদী প্রতিনিধিরা একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন এবং উভয় পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। অবশেষে ১৯২১ সালের ১৬ মার্চ মস্কোয় রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ও তুরস্কের আঙ্কারা সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটি ‘বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব চুক্তি’ বা ‘মস্কো চুক্তি’ নামে পরিচিত। ১৬টি ধারাবিশিষ্ট এই চুক্তিতে রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের পক্ষে স্বাক্ষর করেন সোভিয়েত রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিওর্গি চিচেরিন এবং দাগেস্তান সোভিয়েত স্বায়ত্তশাসিত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী জেলালেদ্দিন কর্কমাজভ। অন্যদিকে, আঙ্কারা সরকারের পক্ষে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত আঙ্কারা সরকারের রাষ্ট্রদূত আলী ফুয়াদ চেবেসোয়, আঙ্কারা সরকারের অর্থমন্ত্রী ইউসিফ কামাল তেঙ্গিরশেঙ্ক এবং শিক্ষামন্ত্রী রিজা নূর।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই চুক্তিটি স্বাক্ষরের সময় রুশ বলশেভিক ও তুর্কি জাতীয়তাবাদী সরকারদ্বয়ের কোনোটিই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ছিল না। সেসময় রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের সরকারকে মাত্র অল্প কয়েকটি রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছিল। অন্যদিকে, সেসময় কনস্ট্যান্টিনোপল–কেন্দ্রিক ওসমানীয় সরকার ছিল তুরস্কের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার এবং আঙ্কারা সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ছিল না। সেদিক থেকে মস্কো চুক্তির বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং আঙ্কারা সরকারের নেতৃত্বে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়। এজন্য এই চুক্তিটি স্থায়ীত্ব লাভ করে।
এছাড়া, মস্কো চুক্তির সময় আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত ছিল ঠিকই, কিন্তু আইনত রাষ্ট্রগুলো তখনো স্বাধীন ছিল। কিন্তু মস্কো চুক্তিতে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি এবং তাদের পক্ষ থেকে রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রই তাদের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলোর মতামত গ্রহণ করা হয়েছিল কিনা, সেটি স্পষ্ট নয়। যাই হোক, মস্কো চুক্তি রুশ–তুর্কি সম্পর্কের একটি নতুন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে দেয়, এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও এই চুক্তিটি এখন পর্যন্ত টিকে আছে।
চুক্তিটির প্রথম ধারা অনুযায়ী, মস্কো ও আঙ্কারা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া কোনো শান্তিচুক্তিকে স্বীকৃতি না দেয়ার ব্যাপারে একমত হয়। এর মধ্যে দিয়ে আঙ্কারা পরোক্ষভাবে ১৯১৮ সালে সম্পাদিত ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তিকে বাতিল হিসেবে স্বীকার করে নেয় এবং তুরস্কের ওপর মিত্রপক্ষের চাপিয়ে দেয়া কোনো শান্তিচুক্তিকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য মস্কো সম্মত হয়।
তদুপরি, প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের কার্স প্রদেশ ও সুরমালি জেলা, বাতুমি প্রদেশের দক্ষিণাংশ (আরদাহান ও আর্তভিনসহ) এবং আলেক্সান্দ্রোপোল জেলার পশ্চিমাংশ আঙ্কারার হস্তগত হয়। এর মধ্যে দিয়ে ১৮৭৭–১৮৭৮ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধে রাশিয়া কর্তৃক ওসমানীয় সাম্রাজ্যের কাছ থেকে অধিকৃত ভূমির সিংহভাগ এবং ১৮২৬–১৮২৮ সালের রুশ–ইরানি যুদ্ধে রাশিয়া কর্তৃক ইরানের কাছ থেকে অধিকৃত ভূমির অংশবিশেষ তুরস্কের হস্তগত হয়। এটি ছিল আঙ্কারার জন্য একটি বৃহৎ সাফল্য এবং মস্কোর জন্য একটি কৌশলগত ব্যর্থতা।
ইতিহাসবিদ ও গবেষক আলেক্সান্দর মোসিয়াকিনের মতে, মস্কো চুক্তির ভূখণ্ড সংক্রান্ত ধারাটি ছিল রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের জন্য একটি ‘কৌশলগত ভুল’। রুশ বলশেভিকদের ধারণা ছিল, তুরস্ককে কিছু ভূমি প্রদানের বিনিময়ে তারা তুরস্কের সঙ্গে স্থায়ী সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হবে এবং তুরস্কের একটি বলশেভিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু তুরস্কে বলশেভিকবাদ সাফল্য অর্জন করতে পারে নি এবং ১৯৩০–এর দশক নাগাদ তুরস্ক ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেকার সম্পর্ক ক্রমশ শীতল হয়ে পড়ে।
চুক্তিটির দ্বিতীয় ধারা অনুযায়ী, প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের বাতুমি প্রদেশের উত্তরাংশ এবং বাতুম শহর ও বন্দর জর্জীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই অঞ্চলের জনসাধারণকে (যাদের বৃহদাংশ ছিল মুসলিম) বিস্তৃত প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসারে একটি ভূমি আইন প্রণয়নের ব্যাপারে মস্কো সম্মত হয়। একই সঙ্গে ন্সকো বাতুম বন্দর দিয়ে তুরস্ক হতে বা তুরস্কের উদ্দেশ্যে আগত সকল পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক তুলে নেয়।
এই ধারা অনুযায়ী ১৯২১ সালের ১৬ জুলাই বলশেভিকরা এতদঞ্চলে ‘আদজারীয় স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করে এবং এটি জর্জীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। তুর্কিবিশারদ পাভেল শ্লিকভের মতে, মস্কো চুক্তির আগে বলশেভিকরা কার্স বা বাতুমি অঞ্চলদ্বয়ের যে কোনো একটি রেখে দিতে আগ্রহী ছিল এবং অপরটি তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করতে সম্মত ছিল। বাতুম ছিল একটি সমুদ্রবন্দর এবং কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এজন্য শেষ পর্যন্ত বলশেভিকরা বাতুমকেই বেছে নেয়।
চুক্তিটির তৃতীয় ধারা অনুযায়ী, মস্কো নাখচিভান অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে সম্মত হয় এবং একে অপর কোনো রাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা হবে না, এই শর্তে আজারবাইজানি সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হয়। কার্যত এই চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক নাখচিভানের স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা প্রদানকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই ধারা অনুযায়ী নাখচিভানের সীমান্ত নির্ধারণের জন্য তুরস্ক, আজারবাইজান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও আর্মেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি সীমান্ত কমিশন গঠিত হবে বলেও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এই ধারা অনুসারে ‘নাখচিভান স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯২৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এটিকে আজারবাইজান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। চুক্তিটির এই ধারাটিকে ইতিহাসে অনন্য বললে অত্যুক্তি করা হবে না, কারণ এর মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্র (তুরস্ক) অপর একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের (সোভিয়েত ইউনিয়ন) অন্তর্ভুক্ত একটি ভূখণ্ডের স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা প্রদানকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়।
চুক্তিটির চতুর্থ ধারা অনুযায়ী, মস্কো ও আঙ্কারা প্রাচ্যের (তুরস্কসহ) জনসাধারণের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এবং একটি নতুন সামাজিক ব্যবস্থা সৃষ্টির জন্য রুশ শ্রমজীবী শ্রেণির প্রচেষ্টার প্রেক্ষাপটে উভয় জনগণের মুক্তি ও স্বাধীনতা এবং নিজস্ব শাসনব্যবস্থা বেছে নেয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এটি ছিল মূলত একটি রাজনৈতিক বক্তব্য। এর মধ্য দিয়ে আঙ্কারা রুশ গৃহযুদ্ধে বলশেভিকদের এবং মস্কো তুর্কি স্বাধীনতা যুদ্ধে তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের প্রতি নিজেদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে।
চুক্তিটির পঞ্চম ধারা অনুযায়ী, বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীদ্বয়ের ভবিষ্যৎ কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে, এই মর্মে মস্কো ও আঙ্কারা একমত হয়। প্রণালীদ্বয় উন্মুক্ত থাকবে, সকল রাষ্ট্রের বাণিজ্য জাহাজ সেখান দিয়ে মুক্তভাবে চলাচল করতে পারবে এবং তুরস্কের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষিত হবে – এই শর্তগুলোকে প্রণালীদ্বয় সংক্রান্ত যে কোনো সিদ্ধান্তের ভিত্তি হিসেবে উভয় পক্ষ স্বীকার করে নেয়। এর মধ্য দিয়ে মস্কো ও আঙ্কারা পরোক্ষভাবে প্রণালীদ্বয় থেকে বাইরের বৃহৎ শক্তিগুলোকে দূরে রাখার ব্যাপারে একমত হয়।
চুক্তিটির ষষ্ঠ ধারা অনুযায়ী, ইতোপূর্বে উভয় পক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমস্ত চুক্তিকে বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে অতীতে রুশ ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমস্ত চুক্তি অকার্যকর হয়ে পড়ে। এই ধারাটি ছিল মস্কোর জন্য প্রতীকী এবং এর মধ্য দিয়ে রুশ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের ঐতিহ্য থেকে বলশেভিকরা নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে নেয়ার প্রয়াস পায়। অন্যদিকে, আঙ্কারার জন্য এই ধারাটি ছিল হৃত সম্মানের পুনরুদ্ধারস্বরূপ, কারণ ইতিপূর্বে বিভিন্ন যুদ্ধের পরাজয়ের পর ওসমানীয়রা রুশদেরকে যেসব সুযোগ-সুবিধা দিতে বাধ্য হয়েছিল, এই ধারাটির মধ্য দিয়ে সেগুলোর বিলুপ্তি ঘটে।
চুক্তিটির সপ্তম ধারা অনুযায়ী, ইতিপূর্বে ‘ক্যাপিচুলেশন’ ব্যবস্থার অধীনে রুশ সাম্রাজ্যের নাগরিকরা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ভূমিতে যেসব সুযোগ–সুবিধা ভোগ করত (যেমন: ওসমানীয় আইন থেকে অব্যাহতি), মস্কো সেগুলোকে বাতিল বলে ঘোষণা করে। এটি ছিল পূর্ববর্তী ধারাটিরই যৌক্তিক সম্প্রসারণ।
চুক্তিটির অষ্টম ধারা অনুযায়ী, মস্কোর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কোনো পক্ষকে আশ্রয় প্রদান থেকে বিরত থাকতে আঙ্কারা সম্মত হয়, এবং মস্কোও আঙ্কারার ব্যাপারে অনুরূপ প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়ার ক্ষেত্রেও উভয় পক্ষ একই প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। এই ধারাটির মধ্য দিয়ে রাশিয়া, আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়ার বলশেভিকবিরোধী দলগুলো (যেমন: শ্বেত রুশ, আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদী ও জর্জীয় মেনশেভিক দল) যাতে তুরস্ককে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ না পায়, মস্কো সেটি নিশ্চিত করার চেষ্টা চালায়। অনুরূপভাবে, তুর্কি কমিউনিস্টরা যাতে বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ না পায়, আঙ্কারা সেটি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চালায়।
চুক্তিটির নবম ও দশম ধারা অনুযায়ী, মস্কো ও আঙ্কারা যত দ্রুত সম্ভব পরস্পরের সঙ্গে রেল, টেলিগ্রাফ ও অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং উভয় পক্ষের মধ্যে মুক্তভাবে মানুষ ও পণ্য চলাচলের ব্যাপারে সম্মত হয়। একই সঙ্গে এক পক্ষের ভূমিতে আগত অপর পক্ষের মানুষ ও পণ্যের ক্ষেত্রে ঐ ভূখণ্ডে প্রচলিত আইন প্রযোজ্য হবে বলেও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
চুক্তিটির একাদশ ধারা অনুযায়ী, উভয় পক্ষ একে অপরের নাগরিকদেরকে ‘Most Favored Nation’ হিসেবে গণ্য করবে বলে একমত হয়। অবশ্য এই সুবিধা রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে মিত্রতাবদ্ধ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর নাগরিকদের ক্ষেত্রে কিংবা তুরস্কের সঙ্গে মিত্রতাবদ্ধ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না বলেও এই ধারায় উল্লেখ করা হয়।
চুক্তিটির দ্বাদশ ধারা অনুযায়ী, আঙ্কারার কাছে হস্তান্তরকৃত ভূমিতে বসবাসকারী যেকোনো ব্যক্তি মুক্তভাবে নিজ সম্পত্তিসহ বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত ভূমিতে চলে যেতে পারবে বলে উভয় পক্ষ একমত হয়। একই সঙ্গে জর্জীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের কাছে হস্তান্তরকৃত ভূমিতে বসবাসকারী যেকোনো ব্যক্তি নিজ সম্পত্তিসহ তুরস্কে চলে যেতে পারবে বলে উভয় পক্ষ সম্মত হয়।
চুক্তিটির ত্রয়োদশ ধারা অনুযায়ী, রাশিয়ায় অবস্থানরত সকল তুর্কি যুদ্ধবন্দিকে রুশ সোভিয়েত সরকারের খরচে তুরস্কের নিকট সমর্পণ করা হবে, এই মর্মে মস্কো প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। এই বিষয়ে মস্কো ও আঙ্কারার মধ্যে অতিরিক্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে এই ধারায় উল্লেখ করা হয়।
চুক্তিটির চতুর্দশ ধারা অনুযায়ী, মস্কো ও আঙ্কারা একটি ‘কনস্যুলার চুক্তি’ স্বাক্ষরের বিষয়ে একমত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যবর্তী অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সম্পর্ক স্থাপন করা হবে বলে উভয় পক্ষ সম্মত হয়।
চুক্তির পঞ্চদশ ধারা অনুযায়ী, চুক্তিটির যেসব ধারা আজারবাইজান, আর্মেনিয়া ও জর্জিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, মস্কো সেগুলোর ব্যাপারে এই রাষ্ট্রগুলোর সম্মতি আদায় করে নেয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।
চুক্তির ষোড়শ (এবং সর্বশেষ) ধারা অনুযায়ী, উভয় পক্ষ যত দ্রুত সম্ভব চুক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন প্রদান করবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই অনুযায়ী ১৯২১ সালের ২০ মার্চ রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের ‘নিখিল রুশ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি’ চুক্তিটিকে অনুমোদন প্রদান করে এবং ১৯২১ সালের ২১ জুলাই আঙ্কারার ‘গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’ চুক্তিটির অনুমোদন দেয়। এর মধ্য দিয়ে চুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়। ১৯২১ সালের অক্টোবরে তুরস্ক এবং আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়ার মধ্যে ‘কার্স চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে মস্কো চুক্তি পূর্ণরূপ লাভ করে।
সামগ্রিকভাবে, মস্কো চুক্তির মধ্য দিয়ে মস্কো ও আঙ্কারার মধ্যবর্তী সম্পর্কে একটি নতুন সমীকরণের সৃষ্টি হয়। এই চুক্তিটি ঐতিহ্যগতভাবে শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনাকে বহুলাংশে হ্রাস করে। এই চুক্তির পর বলশেভিকরা আঙ্কারা সরকারকে তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে ৪০ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রদান করে। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংমিশ্রণে একটি দ্বৈত সম্পর্কের সৃষ্টি হয়, যেটি এখন পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে।
২০১৫ সালের নভেম্বরে তুর্কি বিমানবাহিনী তুর্কি–সিরীয় সীমান্তে একটি রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিত করে এবং এর ফলে একজন রুশ বৈমানিক নিহত হয়। এই ঘটনার ফলে রুশ–তুর্কি সম্পর্কে এক মারাত্মক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। ২০১৬ সালের প্রথমদিকে রাশিয়ার অন্যতম প্রধান বিরোধী দল ‘রুশ ফেডারেশন কমিউনিস্ট পার্টি’ তুরস্কের প্রতি একটি সতর্কবার্তা হিসেবে মস্কো চুক্তি বাতিল করার প্রস্তাব উত্থাপন করে। আজারবাইজানি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তোফিগ আব্বাসভের মতে, এই প্রস্তাব মেনে মস্কো চুক্তি বাতিল করা হলে জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া তুরস্কের কাছে তাদের হারানো ভূমি প্রত্যাবর্তনের দাবি উত্থাপন করার সুযোগ পেত, তুরস্ক জর্জিয়ার বাতুম অঞ্চল দাবি করার সুযোগ পেত এবং আজারবাইজানের নাখচিভান অঞ্চল নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হত। সুতরাং মস্কো চুক্তি বাতিল হলে দক্ষিন ককেশাস কার্যত একটি ‘রাজনৈতিক মাইনক্ষেত্রে’ পরিণত হবে।
কিন্তু রুশ সরকার এই চুক্তিটি বজায় সিদ্ধান্ত নেয় এবং সম্প্রতি ২০২১ সালের ১৬ মার্চ রাশিয়া ও তুরস্ক উৎসাহের সঙ্গে চুক্তিটির শততম বার্ষিকী উদযাপন করেছে। বস্তুত বর্তমানে রাশিয়া ও তুরস্ক কৌশলগত কারণে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে ইচ্ছুক, এবং এক্ষেত্রে মস্কো চুক্তি প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। সম্প্রতি আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীরা আর্মেনিয়ায় অবস্থিত রুশ দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করে মস্কো চুক্তি বাতিল করার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু ককেশাস এবং বৃহত্তর ইউরেশিয়া অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে আবর্তিত হচ্ছে, তাতে করে সহসা মস্কো চুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।