১৯৪৫ সাল; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে গেছে। তবে, যুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবী তখনও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে ধুঁকছে। নগর পুড়লে নাকি দেবালয়ও এড়ায় না। আর উপমহাদেশ তো তখন ছিল ব্রিটিশদের উপনিবেশ। যুদ্ধ-পরবর্তী কোপ ভারতবর্ষকে কতটা কাবু করেছিল তার উত্তর কালের ব্যবধানে মানুষ পেয়ে গেছে।
সেই নিদারুণ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই আব্দুর রাজ্জাক পাড়ি জমান লন্ডনে, উদ্দেশ্য লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্সে উচ্চতর গবেষণা। মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে আসে দু’বছর পরের দেশভাগ। ‘৪৭-এর দেশভাগের সময় অনেক মেধাবী শিক্ষক ভারতে পাড়ি জমান। ফলে, শিক্ষক সংকট দেখা দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষক সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তৎকালীন উপাচার্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন লন্ডন সফর করেন। পূর্বেই বলা হয়েছে, আব্দুর রাজ্জাক তখন লন্ডনে। এ বিষয়ে সহযোগিতার জন্য আব্দুর রাজ্জাক তার গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক হ্যারল্ড জে লাস্কির সাথে উপাচার্যের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। তার পরমার্শ অনুযায়ী উপাচার্য মোয়াজ্জেম হুসাইন কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। তার কিছুকাল পরই জে লাস্কির আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। অতঃপর উচ্চতর গবেষণা অসমাপ্ত রেখেই আব্দুর রাজ্জাককে দেশে ফিরে আসতে হয়।
১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর আব্দুর রাজ্জাক পুনরায় বিভাগে যোগদান করেন। তখন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ছিলেন অস্ট্রিয়ান-জার্মান প্রফেসর কার্ল জন নিউম্যান। উপাচার্য মোয়াজ্জেম হুসাইন জে লাস্কির পরামর্শে যে ক’জন শিক্ষক নিয়ে এসেছিলেন, নিউম্যান তাদেরই একজন। কার্ল নিউম্যানের একাডেমিক ক্যারিয়ার ছিল বেশ ভালো। কিন্তু, নিজের খামখেয়াল অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার বদভ্যাস ছিল তার। আব্দুর রাজ্জাক দেশে ফেরার পর নিউম্যান তাকে তার অসমাপ্ত গবেষণা তত্ত্বাবধানের প্রস্তাব দেন। কিন্তু, আব্দুর রাজ্জাক তাকে বলেন, তার গবেষণার বিষয় নিউম্যানের ক্ষেত্র নয়, এমন ভাবনা থেকে নিউম্যানের বিরত থাকা উচিত হবে। এ ঘটনায় স্বভাবতই নিউম্যান রুষ্ট হন।
ঘটনার পঞ্জিকায় হাজির হয় ১৯৫২ সাল। আব্দুর রাজ্জাক নিজেও পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু, দেশভাগের পর পূর্ব বাংলার জনগণের উপর পাকিস্তানিদের অত্যাচার, বৈষম্যের ধারায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। বাঙালির উপর পাকিস্তানের এরূপ অবিচারের প্রথম সংগঠিত বিপ্লবের চিত্র ছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। আর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ফুলকি জ্বলে উঠেছিল তার প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই।
সেসময়ের উপাচার্য মোয়াজ্জেম হুসাইন ছিলেন একেবারে সাদাসিধে গোছের। শক্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে একেবারেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন না। পাকিস্তানের দমন-পীড়ন নীতির কারণে তাকে বেশ চাপে থাকতে হয়েছিল। একইসাথে তিনি গ্রহণযোগ্যতা হারান সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছেও।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই আব্দুর রাজ্জাক ক্যাম্পাসে উপস্থিত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ করা গেট ভেঙে যখন ছাত্ররা মিছিল বের করার চেষ্টা করছিল, তখনই উপাচার্যের সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটে। সেসময় তিনি উপাচার্য মোয়াজ্জেম হুসাইনকে বলেন,
এইগুলা ছেলেরা করছে কেন? দে হ্যাভ নো কনফিডেন্স অন ইউ। আপনি তাদের সঙ্গে আছেন এই বিশ্বাস তাদের নাই। এই বিশ্বাস যদি তাদের থাকে তাহলে নিশ্চয় তারা এক্সট্রিমে যাবে না। সৈয়দ সাহেব বললেন, আমার কী করতে হবে? আমি বললাম, আপনি ছেলেদের বলুন যে, ইট ইজ ইনঅ্যাডভাইসেবল টু গো আউট ইন প্রসেশন। তবে, তোমরা যদি প্রসেশন নিয়ে বার হও, তবে সে প্রসেশন আমিই লিড করব। আপনি ভিসি হিসেবে যদি বাইরে যান, পুলিশ নিশ্চয়ই গুলি করবে না, করতে পারে না। এবং ছেলেদের ইমোশন ক্যান বি কাম ডাউন। তাদের শান্ত করা যায়।
কিন্তু, পরবর্তীতে আরেক শিক্ষকের পরামর্শে উপাচার্য শেষপর্যন্ত ঘটনাস্থল থেকে চলে আসেন। আব্দুর রাজ্জাক মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, সেদিন উপাচার্য মোয়াজ্জেম হুসাইন মিছিলে নেতৃত্ব দিলে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হতো না,
আই রিমেইন স্টিল কনভিন্সড যে, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন যদি সেদিন একথা বলতেন, তাহলে সেদিনকার ট্রাজেডি এড়ানো যেত।
উপাচার্য ঘটনাস্থল ছাড়ার পরও আব্দুর রাজ্জাক সেখানে ছিলেন। ছাত্রদের মিছিল ঠেকানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সেদিন বসানো হয় পুলিশি প্রহরা। ছাত্ররা সেটা অগ্রাহ্য করে মিছিল বের করার চেষ্টা করলে দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার ইদ্রিস ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনারা যদি এরকম করেন, আমি গুলি করার অর্ডার দেব।” কাকতালীয়ভাবে, ইদ্রিস ছিলেন আব্দুর রাজ্জাকের প্রাথমিক শিক্ষকজীবনের একজন ছাত্র। নিজের ছাত্রের মুখে এমন কথা শুনে আব্দুর রাজ্জাক আহত হন। তিনি ইদ্রিসের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনি কি বললেন?” গুলি চালানোর বিষয়ে আব্দুর রাজ্জাকের প্রশ্নে হতচকিত হয়ে তিনি বলেন, “আই ডিড নট মিন ইট স্যার।” এ কথা শুনে আব্দুর রাজ্জাক বলে ওঠেন, “আপনি যে এরকম একটা সাংঘাতিক কথা বলতে পারেন, আমি ভাবতেও পারি না।”
২১শে ফেব্রুয়ারি দুপুরের দিকে তিনি নিজের বাসায় ফেরত আসলে মিছিলে গুলিবর্ষণের ঘটনা শুনতে পান। এই ভয়ংকর নিন্দনীয় অপরাধের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে বাংলার জনগণ। নিঃসন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সেই আন্দোলনের কান্ডারী। ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় আব্দুর রাজ্জাক, মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী, মুনির চৌধুরী, খান সরোয়ার মুর্শিদসহ কয়েকজন শিক্ষকের নেতৃত্বে ২৩শে ফেব্রুয়ারি শিক্ষক সমিতির আয়োজনে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপরই ছাত্রদের পাশাপাশি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন নীতির শিকার হন শিক্ষকরাও।
প্রতিবাদ সভা আয়োজনের জের ধরে মুনীর চৌধুরী, মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়। এমনকি, তাদের গ্রেফতারের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবহিত করার প্রয়োজনও মনে করেনি শাসক সম্প্রদায়। ঘটনার আকস্মিকতায় আহত আব্দুর রাজ্জাক ২৮শে ফেব্রুয়ারি উপাচার্য মোয়াজ্জেম হুসাইনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি উপাচার্যকে অনুরোধ করেন, যেহেতু গ্রেফতারকৃত শিক্ষকদের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়কে কিছুই জানানো হয়নি, সুতরাং উপাচার্য যেন তাদের বেতন-ভাতা চালু রাখেন।
তার অনুরোধ একদিক দিয়ে যেমন ছিল মানবিক অধিকারের, অন্যদিকে সহকর্মীদের প্রতি দায়িত্ববোধের উদাহরণ। উপাচার্যের সাথে আলাপ চলার সময়ই সেখানে উপস্থিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রফেসর হাদি। সেদিনের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে আব্দুর রাজ্জাক বলেন,
আমার কথার মধ্যে তিনি (হাদি) ইন্টারভেন করে ভিসিকে বললেন, কী বলছে আব্দুর রাজ্জাক? আমার প্রস্তাব শুনে তিনি ভিসিকে বললেন, চিন্তা না কইরা এসব করবেন না। এতে রিস্ক আছে। সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন সোজা মানুষ। এই রিস্কের কথা শোনার পরে তাকে আর এদিকে টানতে পারলাম না। হাদি সাহেবের ওপর আমার সেদিন ভয়ানক রাগ হয়েছিল।
উপাচার্যের কাছে বিফল হলেও হাল ছেড়ে দেননি আব্দুর রাজ্জাক। তিনি এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের প্রভাবশালী সদস্য ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রাধ্যক্ষ ওসমান গণির সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাকে অনুরোধ করেন যেন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে বিষয়টি উত্থাপিত হলে তিনি এই বিষয়ে সমর্থন দেন। কিন্তু, ওসমান গণিও বাকি সদস্যদের মতের অজুহাতে বিষয়টি কাউন্সিলে পাশ হবে না বলে মত দেন।
তখন আব্দুর রাজ্জাক তাকে শেষপর্যন্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো আলোচনা উঠলে সেটি আপাতত স্থগিত রাখার জন্য অনুরোধ করেন। ড. গণির সাথে সাক্ষাতের পর তিনি কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি কেরানীগঞ্জে চলে যান। ঢাকায় ফিরে তিনি শুনতে পান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শাসকগোষ্ঠীর চাপে গ্রেফতারকৃত শিক্ষকদের সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আব্দুর রাজ্জাকের মনে একইসাথে ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দেয়। এরপর একদিন কাউন্সিলের সদস্য প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর সাথে দেখা হলে তিনি সরাসরি এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের উপর নিজের ক্ষোভ ও হতাশার কথা ব্যক্ত করেন। নিজ সহকর্মীদের উপর এরূপ অবিচারের জন্য কাউন্সিলের সদস্যদের নিন্দা করতেও পিছপা হননি আব্দুর রাজ্জাক।
প্রকৃতপক্ষে, আব্দুর রাজ্জাক আজন্ম বাংলা ভাষার জন্য নিজের হৃদয়ে গভীর মমতা লালন করে গেছেন। সেই সাথে তার ছিল নিজ দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি অগাধ দায়িত্ববোধ। তিনি বিশ্বাস করতেন, মাতৃভাষা ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি হয় না। বাঙালির জাতীয়তাবাদের প্রথম বড় ঘটনা ছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। মাতৃভাষার সেই বিপ্লবেও আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন একাত্মপ্রাণ। শুধু সমর্থন নয়, ২১শে ফেব্রুয়ারির পর ঘটনাপ্রবাহে তার ছিল সক্রিয় ও গঠনমূলক ভূমিকা।