আমাদের বাংলাদেশে তুষারপাত না হলেও তুষারমানব চেনে না এমন মানুষ কিন্তু পাওয়া যাবে না বললেই চলে। আর তুষারপাত হলে তুষারমানব বানাতে চাইবে না এমন মানুষের সংখ্যাও কিন্তু নেহাতই কম। বরফের দেশে না থেকেও সাদা পেটমোটা তুষার মানবের ছবি দেখলেই কেমন যেন মনের ভেতর একটা বাচ্চামি জেগে ওঠে সবার। আর বরফের দেশের মানুষদের অবস্থা তো তাহলে বোঝাই যায়।
সারা পৃথিবী জুড়ে যেসব দেশে তুষারপাত ঘটে তুষারমানব সেখানের বাচ্চাদের জন্য তো বটেই, বড়দের জন্যও খুব আনন্দের একটি বিষয়। আর এছাড়াও এই তুষারমানবকে নিয়ে বেশকিছু বিচিত্র এবং চমৎকার বিষয় রয়েছে সারা পৃথিবী জুড়ে। তুষারমানব নিয়ে সেই বিচিত্র তথ্যগুলোই আজ তুলে ধরা হবে আপনাদের সামনে।
১) পৃথিবীর প্রথম তুষারমানব
পৃথিবীতে প্রথম তুষারমানব কবে তৈরি হয়েছিল, এটি জানা সত্যিই অনেক কঠিন। আর তুষারমানব যেহেতু এমনিতেই সংরক্ষণ করার মতো কোনো বস্তু নয়, তাই এক্ষেত্রে তো ব্যাপারটা আরো কঠিন। তবে ১৩৮০ সালে লেখা ‘বুক অফ আওয়ারস’ নামের একটি বইতে প্রথম ‘তুষারমানব’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই ধারণা করা হয়, ১৩৮০ সাল বা এর আগে থেকেই তুষারমানব তৈরি করা হতো।
২) বিশ্বের সবচেয়ে বড় তুষারমানব
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তুষারমানবটি ছিল আসলে তুষারমানবী! এটিকে ২০০৮ সালে মাইনের বেথনেলে তৈরি করা হয়। তুষারমানবীটি উচ্চতায় ছিল ১২২ ফুট লম্বা এবং এর নাম দেওয়া হয়েছিল অলিম্পিয়া। এটি তৎকালীন মার্কিন সিনেটর অলিম্পিয়া স্নোয়ীর সম্মানে নির্মাণ করা হয়েছিল। অবশ্য সবচেয়ে বড় তুষারমানবের রেকর্ডটিও রয়েছে বেথনেলের হাতে। ২০০৯ সালে তৎকালীন মাইনের গভর্নরের সম্মানে তারা একটি বিশাল তুষারমানব তৈরি করে। এর নাম পাহাড়ের রাজা অ্যানগাসের নাম অনুসারে দেওয়া হয় ‘অ্যানগাস কিং’, যার উচ্চতা ছিল ১১৩ ফুট ৭ ইঞ্চি।
৩) সেক্সেলাজেন
স্যুইজারল্যান্ডের জ্যুরিখে তুষারমানবকে নিয়ে প্রচলিত আছে এক অদ্ভুত উৎসব, যার নাম সেক্সেলাজেন। এটি আসলে জ্যুরিখের বসন্তবরণ উৎসব। এ উৎসবে একটি তুষারমানবকে জ্বালিয়ে দেয়ার মাধ্যমে বসন্তবরণ করা হয়। উৎসবটি সেখানে চলে আসছে ১৮১৮ সাল থেকে।
উৎসবটি করা হয় প্রতি বছর এপ্রিল মাসের তৃতীয় সোমবারে। উৎসবের শুরুতে একটি তুলার তুষারমানব তৈরি করা হয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘বুগ’ এবং এর ভেতরে বিভিন্ন বিষ্ফোরক ও বাজি ভরা হয়। এরপর তুষারমানবটিকে নিয়ে সারা শহর জুড়ে মিছিল করা হয়। মিছিলটি যখন বিভিন্ন দোকানের সামনে দিয়ে যেতে থাকে, দোকানিরা তখন বিভিন্ন খাবার, সসেজ ও রুটি মিছিলে ছুঁড়ে দিতে থাকে।
মিছিলের শেষে বুগকে বসানো হয় ৪০০ ফুট উঁচু খড়ের স্তূপের উপর। এরপর যখন সেইন্ট পিটার চার্চের ঘণ্টাটি ৬ বার বেজে ওঠে, তখনই বোঝা যায় শীতের বেলা বিদায় নিয়েছে এবং বসন্তকালের আগমন ঘটেছে। তখন খড়ের স্তূপে আগুন দিয়ে দেওয়া হয়। সম্পূর্ণ স্তূপ পুড়তে যত কম সময় লাগে, ধরে নেওয়া হয় আসন্ন গ্রীষ্মকাল তত বেশি স্থায়ী হবে।
৪) স্নোজিলা
২০০৫ সাল থেকে শুরু করে বিলি পাওয়ারস নামের একজন ব্যক্তি প্রতি বছর ক্রিসমাসের সময় তার বাড়ির সামনে স্নোজিলা তৈরি করে থাকেন। স্নোজিলা হচ্ছে ২২ ফুট উচ্চতার একটি বিশাল তুষারমানব, যেটি প্রথমবার তৈরির পরই মানুষের নজর কেড়ে নেয় এবং এর জনপ্রিয়তার ধারাবাহিকতায় এখন এটি প্রতি বছরই তৈরি করা হয়।
অবশ্য সবাই যে স্নোজিলাকে পছন্দ করে তা-ও কিন্তু নয়। বিলির প্রতিবেশিরা অভিযোগ করেন, ২২ ফুট উঁচু এই তুষারমানবটির জন্য তাদের প্রায়ই যানজটের ঝামেলা পোহাতে হয় এবং এটা ভেঙে পড়ার ভয় তো লেগেই থাকে। এজন্য ২০০৮ সালে স্নোজিলা তৈরি করার মাঝামাঝি সময় এটি তৈরি করা একবার নিষিদ্ধও করা হয়। কিন্তু তার পাড়ার বাচ্চারা কয়েকদিনের মধ্যে ঠিকই একটি বেশ বড়সড় স্নোজিলা তার বাড়ির সামনে আবার তৈরি করে ফেলে এবং এর জনপ্রিয়তার খাতিরে এরপর থেকে প্রতি বছরই স্নোজিলা তৈরি হয়ে আসছে।
৫) তুষারমানবের তোলা প্রথম ছবি
উপরের ছবিটিই হচ্ছে তুষারমানবের তোলা সর্বপ্রথম ছবি। ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৮৫৩ সালে। এটি এখন ওয়েলসের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। মেরি ডিলোয়েন তার ভাতিজার ছবি তুলতে গিয়ে বাড়ির উঠানে এ ছবিটি তুলেছিলেন।
৬) ১ ঘন্টায় তৈরি সর্বাধিক তুষারমানব
১ ঘন্টার মধ্যে সবচেয়ে বেশি তুষারমানব তৈরির গিনেজ রেকর্ডটি আছে জাপানের হাতে। জাপানের আকাবিরাতে ২০১৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি নাটকের শ্যুটিংয়ের সময় একটি ইভেন্টের মাধ্যমে ৬০ মিনিটে প্রায় ২,০৩৬টি তুষারমানব তৈরি করা হয়। ইভেন্টটিতে উপস্থিত ছিল প্রায় ১,৪০৬ জন মানুষ এবং এর সাথে নাটকের নায়কও উপস্থিত ছিল। আসলে নাটকটিতে দেখানোর কথা ছিল নায়ক গিনেজ বুক রেকর্ডের এই ইভেন্টে অংশগ্রহণ করছে এবং এর শ্যুটিংয়ের উদ্দেশ্যেই এ ইভেন্টটি করা হয়েছিল।
৭) তুষারমানবের সর্ববৃহৎ সংগ্রহ
তুষারমানবের সবচেয়ে বড় সংগ্রহটি রয়েছে মিনেসোটার কারেন স্কচমিডটের কাছে। ৫,১২৭টি তুষারমানবের বিভিন্ন পুতুল সংগ্রহের জন্য তিনি গিনেজ বুকে রেকর্ড করেন। কারেন তার তুষারমানব সংগ্রহ শুরু করেন ১৯৮০ সাল থেকে। এরপর থেকে এখনও তিনি তুষারমানবের বিভিন্ন পুতুল ও সামগ্রী সংগ্রহ করে যাচ্ছেন।
৮) সবচেয়ে ক্ষুদ্র তুষারমানব
পশ্চিম লন্ডনের জাতীয় পদার্থবিজ্ঞান গবেষণাগারের গবেষকেরা ২০০৯ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র তুষারমানবটি তৈরি করেন। এটি লম্বায় ছিল মাত্র ০.০১ মিলিমিটার। গবেষকেরা একে ন্যানো টেকনোলোজির মাধ্যমে তৈরি করেছিলেন।
৯) তুষারমানব পোড়ানো দিবস
সর্বপ্রথম তুষারমানব পোড়ানো দিবস উদযাপিত হয় ১৯৭১ সালের ২০ মার্চ লেক সুপিরিওর স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। এই তুষারমানব পোড়ানো দিবসের বুদ্ধিটি অবশ্য তারা পায় জার্মানির রোজ সানডে উৎসব থেকে। এই উৎসবটিতে শহরের মেয়র একটি খড়ের তৈরি তুষারমানব নিয়ে সারা শহর ঘুরে দেখতেন শহরের সব বাচ্চারা ভালো আচরণ করছে কিনা, তারা ঠিকমতো লেখাপড়া করছে কিনা এবং বাবা-মায়ের কথা শুনছে কিনা। যদি তিনি দেখতেন সব ঠিক আছে, এরপর তিনি তুষারমানবটি পোড়ানোর আদেশ দিতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই ধারণাটি থেকে এবং সাথে সাথে বসন্তবরণ উৎসব হিসেবেও তুষারমানব পোড়ানো দিবস পালন করা শুরু করে। ১৯৯২ সালে একবার পরিবেশ দূষণের কথা চিন্তা করে উৎসবটি নিষিদ্ধ করা হলেও, ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন শুরু করলে এরপর থেকে প্রতি বছর তুষারমানব পোড়ানো দিবস পালন করে আসা হচ্ছে।
১০) সবচেয়ে বড় তুষারের ভাস্কর্য
গিনেজ বুকের রেকর্ড অনুসারে সবচেয়ে বড় তুষারের ভাস্কর্যটি তৈরি হয়েছিল চীনের হারবিনে, ২০০৭ সালের ১লা জানুয়ারিতে। ভাস্কর্যটির উচ্চতা ছিল ১১৫ ফুট এবং তা ছিল ৬৫৪ ফুট প্রস্থ। এটি পরিচিত মূলত ‘রোমান্টিক ফিলিংস’ নামে। ভাস্কর্যটি তৈরি হয়েছিল হারবিনের জাতীয় তুষার ভাস্কর্য প্রতিযোগিতার একটি অংশ হিসেবে।
১১) মাইকেলঅ্যাঞ্জেলোও তৈরি করেছিলেন তুষারমানব
কোনো বিখ্যাত শিল্পীর বিখ্যাত কোনো কাজ গলে যাওয়ার ঘটনা আগে ঘটে না থাকলেও বিষয়টি ঘটেছিল বিখ্যাত ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী মাইকেলঅ্যাঞ্জেলোর সাথে। মাইকেলঅ্যাঞ্জেলোকে একবার ফ্লোরেন্সের রাজা পিয়েরো দে মেদিভি ডেকেছিলেন তার জন্য কোনো সুন্দর শিল্পকর্ম তৈরি করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু রাজার শিল্পকর্ম সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিল না এবং তিনি মাইকেলঅ্যাঞ্জেলোর কাছ থেকে ঠিক কী চাচ্ছিলেন, সে সম্পর্কেও তিনি নিশ্চিত ছিলেন না।
অতঃপর অনেকদিন মাইকেলঅ্যাঞ্জেলোকে বসিয়ে রাখার পর একদিন ভারি তুষারপাত হবার পর তিনি তাকে তার প্রাসাদের সামনে একটি তুষারমানব তৈরি করার আদেশ দেন! যেহেতু মাইকেলঅ্যাঞ্জেলোর হাতে আদেশ পালন করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না, তাই তিনি আদেশটি পালনও করেন। যেহেতু তুষারমানব সংরক্ষণ করা যায় না, তাই মাইকেলঅ্যাঞ্জেলোর তৈরি ওই বিখ্যাত তুষারমানবটি কেমন ছিল, তা আজ আর জানা যায় না। তবে যারা তুষারমানবটি দেখেছিল তাদের সবাই নাকি সেটির খুব প্রশংসা করেছিল!
১২) ফ্রান্সের বিরোধিতার প্রতীক তুষারমানবী
ফ্রান্স এবং পারস্যের যুদ্ধের মধ্যবর্তী যুদ্ধবিরতি চলাকালীন ফ্রান্সের বিভিন্ন সেনারা মিলে ঠিক করেন তারা তুষার দিয়ে তাদের এই স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি প্রতীক তৈরি করবেন। এ লক্ষ্যে তারা আলেকজান্ডার ফাল্গুইয়ারের নেতৃত্বে ৯ ফুট উচ্চতার ‘লা রেজিস্টেন্স’ নামে একটি তুষারমানবী তৈরি করেন। কামানের উপর বুকে আড়াআড়িভাবে হাত রেখে বসে থাকা নগ্ন এই তুষারমানবীটি গলে যাওয়ার পরও হয়ে ওঠে ফ্রান্সের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতীক।
১৩) ষোড়শ শতাব্দীতে তুষারমানব দিয়ে প্রতিবাদ
তুষারমানববিদ বব এক্সটেইনের বই ‘দ্য হিস্টরি অফ দ্য স্নোম্যান’ থেকে জানা যায়, ১৫১১ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে তুষারমানব দিয়ে করা হয়েছিল এক অদ্ভুত প্রতিবাদ, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মিরাকল অফ ১৫১১’। তখনকার বেলজিয়ামে প্রচলিত শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে সেখানের কিছু নাগরিক প্রতিবাদ স্বরূপ সারা শহর জুড়ে প্রায় ১০০টির মতো বিভিন্ন নোংরা ভঙ্গিমার তুষারমানব বানায়।
তুষারমানবগুলো ছিল আসলে তখনকার রাজনীতিবিদদের ক্যারিকেচার, যা দিয়ে শ্রেণী বৈষম্যের নোংরা দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছিল। একটি তুষারঝড় সবগুলো তুষারমানব নষ্ট করে ফেললেও সেই তুষারমানবগুলো তখনকার বেলজিয়ামের নাগরিকদের শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য প্রচুর উদ্যম জুগিয়েছিল।
১৪) তুষারমানব তৈরি করা হতে পারে ব্যায়াম স্বরূপ
যারা ওজন কমাতে চান এবং নিজেদের ফিট রাখতে চান, তাদের জন্য তুষারমানব তৈরি করাও কিন্তু হতে পারে ব্যায়াম স্বরূপ। ‘দ্য হিস্টোরি অফ স্নোম্যান’ বই অনুসারে, একটি তুষারমানব তৈরি করার জন্য ১ ঘন্টা খাটলে শরীর থেকে প্রায় ২৩৮ ক্যালরি খরচ হয়, যা এক ঘন্টা নাচা বা সাইকেল চালানো থেকে ঢের বেশি।
১৫) আদর্শ তুষারমানব তৈরি করার জন্যও রয়েছে শর্ত
ইঞ্জিনিয়ার জার্নাল অনুসারে, আপনি যেকোনোভাবে একটি তুষারমানব তৈরি করে ফেললেই কিন্তু সেটি একটি আদর্শ তুষারমানব হয়ে যাবে না। তাদের মতে, তুষারমানব তৈরির আদর্শ তাপমাত্রা হচ্ছে ৩০ ডিগ্রী ফারেনহাইটের কাছাকাছি, যখন তুষার জলীয়বাষ্প সঠিকভাবে ধারণ করতে পারে। এছাড়া আদর্শ তুষারমানবের কিন্তু নির্দিষ্ট মাপও রয়েছে। একটি আদর্শ তুষারমানব তৈরি করার জন্য এর নিচের ধাপটি হতে হবে ৩ ফুট এবং উপরের ধাপটি হতে হবে ১ ফুট। এছাড়া তুষারমানবটিকে সঠিকভাবে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য এর নিচে ২ ইঞ্চি তুষার অবশ্যই থাকতে হবে!
ফিচার ইমেজ: stemjobs.com