দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শেষ মুহূর্ত; ১৪ই এপ্রিল, ১৯৪৫। জার্মান নৌ-বাহিনীর শিকারি সাবমেরিন ইউ-১২০৬ (U-1206) এর নেতৃত্বে রয়েছেন ক্যাপ্টেন কার্ল অ্যাডলফ শ্লিতথ। নাৎসি বাহিনীর দখলকৃত নরওয়ের উপকূল অঞ্চল থেকে ছেড়ে আসা সাবমেরিনটি মিত্র বাহিনীর জাহাজ ধ্বংস করার মিশন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে উত্তর আটলান্টিকের দিকে। যাত্রা শুরুর আট দিন পর সাবমেরিনটি যখন প্রায় ২০০ ফুট গভীরে, তখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ক্যাপ্টেন শ্লিতথ নতুন প্রযুক্তির টয়লেট ব্যবহার শেষে সামান্য ভুল করে ফেললেন। এই সামান্য ভুলে শিকারি পরিণত হলো শিকারে এবং সাবমেরিনটির ভাগ্যে নেমে এলো অন্তিম পরিণতি। টয়লেটের পয়ঃনিষ্কাশন করতে গিয়ে ভুলের কারণে ইতিহাসের একমাত্র সাবমেরিনডুবির ঘটনা এটি।
তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ বা আমেরিকান সাবমেরিন ও জার্মান সাবমেরিনের অন্যতম পার্থক্য ছিল তাদের পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা। ব্রিটিশ ও আমেরিকান সাবমেরিনগুলো তাদের টয়লেটের বর্জ্যের জন্য ব্যবহার করত সেপটিক ট্যাংক, যেগুলো পাইপের মাধ্যমে যুক্ত ছিল। সাবমেরিনের ওজন ও অত্যন্ত মূল্যবান জায়গা বাঁচানোর লক্ষ্যে জার্মান সাবমেরিনে কোনো সেপটিক ট্যাংক ছিল না। টয়লেটের সকল মানব বর্জ্য তারা সরাসরি সমুদ্রে ছেড়ে দিত। সরাসরি বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য অবশ্যই সাবমেরিনটিকে অগভীর সমুদ্রে বা উপরে অবস্থান করতে হতো, যেখানে পানির চাপ কম। গভীর পানিতে থাকাকালীন সময়ে নাবিকরা টয়লেট ব্যবহার করতে পারত না, জরুরী প্রয়োজনে তারা টিনের কৌটা, বালতি কিংবা হাতে কাছে যা পেত তাই দিয়ে কাজ চালাতো। খুব সাবধানে সেগুলো রাখতে হতো, যেন আবার সাবমেরিনের ভিতরের পরিবেশ দূষিত না হয়। এরপর যখন তারা সাবমেরিন নিয়ে উপরে বা অগভীর পানিতে উঠে আসত, তখন সেগুলোর একটা সহজ ব্যবস্থা করতে পারত।
অন্যদিকে, সময়ের সাথে মিত্রপক্ষও সাবমেরিনের অবস্থান নির্ণয় ও ধ্বংসের প্রযুক্তিতে উন্নতি সাধন করেছিল। বর্জ্য ফেলতে উপরে উঠে আসলে একদিকে শত্রুপক্ষের চোখে ধরা পড়ার সম্ভাবনা, অন্যদিকে বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় পর অগভীর সমুদ্রে জার্মানদের না এসেও উপায় নেই। পুরো ব্যাপারটি চলমান যুদ্ধে জার্মান সাবমেরিনের জন্যে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই সমস্যা দূরীকরণে ১৯৪৫ সালের দিকে জার্মান ইঞ্জিনিয়াররা নিরলস চেষ্টা চালিয়ে শেষপর্যন্ত গভীর সমুদ্রে উচ্চ চাপে পয়ঃনিষ্কাশনের উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন। জার্মান ইঞ্জিনিয়ারদের নতুন উদ্ভাবনটিকে ‘গভীর পানিতে উচ্চচাপীয় টয়লেট’ বলা যায়, যা গভীর সমুদ্রে উচ্চচাপেও ব্যবহারযোগ্য।
উন্নত প্রযুক্তির হলেও নতুন টয়লেট ব্যবহারের প্রক্রিয়া খুবই জটিল ছিল। এতটাই জটিল নিয়মাবলী ছিল যে, প্রতিটি সাবমেরিনে উচ্চ প্রযুক্তির টয়লেট ব্যবহারের উপর একজন করে প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ ছিল। নির্ভুল ও নিয়মানুযায়ী টয়লেট ব্যবহার করে মানব বর্জ্য খোলা সমুদ্রে ছেড়ে দিতে সাবমেরিন সদস্যদের সাহায্য করাই ছিল তাদের মূল দায়িত্ব। নতুন প্রযুক্তিতে টয়লেট থেকে বর্জ্য প্রথমে গিয়ে জমা হয় নির্দিষ্ট চাপে থাকা একটি অস্থায়ী চেম্বারে। বর্জ্যসহ চেম্বারটি অত্যাধিক বায়ু চাপের মাধ্যমে সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়া হয়। পুরো কাজটি করতে হয় একটি নির্দিষ্ট নিয়মে ও ক্রমে, সামান্য ভুলের অবকাশ এই প্রযুক্তিতে ছিল না।
ইউ-১২০৬ সাবমেরিনটিতে উচ্চ প্রযুক্তির টয়লেট থাকায়, গভীর সমুদ্রে থাকাকালীনও তাই টয়লেট ব্যবহার করতে দ্বিধা করেননি সাবমেরিন কমান্ডার শ্লিতথ। নতুন টয়লেট ব্যবহারে খুব একটা দক্ষ ছিলেন না ক্যাপ্টেন। পয়ঃনিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় তার টয়লেট বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়ার কথা থাকলেও তা তিনি নেননি। জটিল কাজটি করতে গিয়ে কিছু একটা গোলমাল করে ফেললেন তিনি, সমস্যা সমাধানের জন্য শেষপর্যন্ত সাবমেরিনে থাকা বিশেষজ্ঞকে ডেকে পাঠানো হলো। সমাধান করতে গিয়ে সমস্যাটিকে চূড়ান্ত ভয়ানক রূপ দিয়ে ফেললেন বিশেষজ্ঞ ভদ্রলোকটিও। সাবমেরিনের ভিতরের ভাল্বটি খোলা রেখেই ভুলক্রমে বাইরের ভাল্বটি খুলে ফেললেন তিনি। বাইরের ভাল্ব দিয়ে সরাসরি সমুদ্রের পানি প্রবেশ করে, একইসাথে ভিতরের ভাল্বটিও খোলা থাকায় প্রচণ্ড চাপে সমুদ্রের পানি প্রবল বেগে ঢুকে পড়ে সাবমেরিনের টয়লেটের ভিতর।
না, এই পানির প্রবাহ সাবমেরিনটিকে ডুবিয়ে দেয়নি। প্রাথমিক এই ধাক্কা সামলে উঠলেও শুরু হয় নতুন সমস্যা, যা ডেকে আনে জার্মান বাহিনীর জন্যে সাক্ষাত যম। পানির গভীরে সাবমেরিনটি শক্তির উৎস ছিল বিশাল একগুচ্ছ ব্যাটারি চালিত ইলেকট্রিক মোটর। বিশাল আকৃতির ব্যাটারিগুলো যে কক্ষে ছিল, সেই কক্ষটি আক্রান্ত টয়লেটের ঠিক নিচেই। সমুদ্রের পানির প্রবাহ ততক্ষণে টয়লেট হয়ে চলে গেছে ব্যাটারি কক্ষে। ব্যাটারির অ্যাসিডের সাথে সামুদ্রিক পানির বিক্রিয়ায় উৎপন্ন ক্লোরিন গ্যাস মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে পুরো সাবমেরিনে। সম্পূর্ণ পরিস্থিতি সম্পর্কে শ্লিতথ বলেন, “মারাত্মকভাবে প্লাবিত হওয়া সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ইঞ্জিনিয়ার সাবমেরিনটিকে চালু রাখতে ও উপরে তুলে আনতে সক্ষম হন। এর মধ্যে ব্যাটারিগুলো সমুদ্রের পানিতে ডুবে গেছে ও ক্লোরিন গ্যাস ছেয়ে গেছে।” বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাসের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে ক্যাপ্টেন কোনো উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত সাবমেরিনটিকে পানির উপরে নিয়ে আসতে বাধ্য হন। নাবিকরা সর্বাত্মক চেষ্টা করতে থাকে খোলা সমুদ্রের বাতাসের প্রবাহের সাহায্য নিয়ে ভিতরের পরিবেশ স্বাভাবিক করে তুলতে।
সমুদ্রের উপরিভাগের বিশুদ্ধ বাতাস দিয়ে ক্লোরিন গ্যাস দূর করে সাবমেরিন নিয়ে আবারো পানির তলায় ডুব দেয়ার ইচ্ছে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। সাবমেরিনটি যখন উপরে উঠে আসে, তখন তা ছিল স্কটিশ উপকূল থেকে মাত্র ৮ মাইল দূরে, ব্রিটিশ বিমানবাহিনী শত্রুপক্ষের সাবমেরিনটি চিহ্নিত করতে বেশি সময় নেয়নি। বিমান বাহিনীর আক্রমণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাবমেরিনটি, ডেকের উপরে থাকা একজন মারা যায় এবং সমুদ্রে হারিয়ে যায় আরো তিনজন, যাদেরকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ক্ষতিগ্রস্ত সাবমেরিন নিয়ে পানির তলায় ডুব দেওয়ার মতো আর কোনো অবস্থা না থাকায় ক্যাপ্টেন শ্লিতথ তার নাবিকদের জীবন বাঁচাতে সাবমেরিন ত্যাগ করতে বলেন। এরপর নিজেই সাবমেরিনটি ডুবিয়ে দেন যেন তা মিত্রবাহিনী কিছুতেই হস্তগত করতে না পারে। নৌকায় করে ৩৬ জন ও বাকি ১০ জন সাঁতরে উপকূলে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। ৫০ জন নাবিকের মধ্যে ৪ জন মারা গেলেও সাবমেরিনটির কমান্ডার ক্যাপ্টেন শ্লিতথসহ বাকিরা ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে বন্দি হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অবশ্য আর কেড়ে নিতে পারেনি শ্লিতথের জীবন, ২০০৯ সালে মারা যান তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সাবমেরিনের প্রায় ৭৫% ধ্বংস হয় মিত্রবাহিনীর আক্রমণে। ৪০,০০০ নাবিকের মধ্যে ৩০,০০০ জনের সলিল সমাধি ঘটে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এই অভাগাদের মধ্যে ছিল না টয়লেটের কারণে ডুবে যাওয়া সাবমেরিনের নাবিকেরা। টয়লেটের সামান্য ভুলে ডুবে গিয়ে ইতিহাসের অংশ হওয়া ব্যতীত জাহাজটি যুদ্ধে তেমন ভূমিকা রাখেনি। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝিতে সমুদ্রের তলদেশে স্কটল্যান্ডের ক্রুডেন বে’তে তেল সরবরাহ করতে পাইপ লাইনের কাজ করতে গিয়ে ইউ-১২০৬ সাবমেরিনটির পুনরায় সন্ধান পাওয়া যায়।
ফিচার ইমেজ- popularmilitary.com