পিতার দ্বিতীয় মুরাদের মৃত্যুর পর অটোমান সাম্রাজ্যের হাল ধরেন দ্বিতীয় মেহমেদ। পূর্বের ন্যায় কাউকে সুযোগ না দিয়ে এবারে তিনি শক্ত হাতে লাগাম টেনে ধরেন সাম্রাজ্যের। সৈন্যদের জন্য বিশেষ নিবন্ধন ব্যবস্থার প্রচলন করেন। ফলে জেনিসারি সৈন্যদের নতুন সুলতানের প্রতি আস্থা ও আনুগত্য বেড়ে যায়। এছাড়াও প্রশাসনিক ব্যাপক সংস্কার শুরু করেন তিনি। যেসব প্রশাসকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ছিল, তাদের সরিয়ে দিয়ে নতুন লোক নিয়োগ করেন। কূটনৈতিক কারণে অটোম্যানদের সেনাঘাঁটি নির্মাণকাজ স্থবির হয়ে পড়েছিল আগের সুলতানদের শাসনকালে। মেহমেদ বুঝতে পারেন, নতুন সেনাঘাঁটি তাকে আরো শক্তিশালী করে তুলবে। তাই তিনি এবার সেসব কূটনীতির তোয়াক্কা না করে নতুন নতুন ঘাঁটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।
এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রুমেলি দুর্গ। সুলতান বায়েজিদ বসফরাস প্রণালীর সংকীর্ণ অংশে এশিয়ার স্থলভাগে পূর্বেই একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। সুলতান মেহমেদ এবার তারই ঠিক বিপরীত তীরে আরেকটি দুর্গ স্থাপনের কাজ শুরু করেন। এটি ছিল অত্যন্ত বড় একটি সামরিক পদক্ষেপ। এ দুর্গের নির্মাণ সম্পন্ন হলে বসফরাসের উভয়পাশে অবস্থিত অটোম্যান দুর্গের হাতে প্রণালীর উপর দিয়ে যাতায়াত করা সকল জাহাজের উপর অটোম্যান কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতো। অটোম্যান সম্রাটের অনুমতি ছাড়া কোনো জাহাজই এ প্রণালী অতিক্রম করতে পারতো না।
মূলত এটি ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপোলকে ইউরোপীয় মিত্রদের সাহায্য থেকে বঞ্চিত রাখার একটি সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ। (কনস্টান্টিনোপোল নিয়ে একটু পরেই আসছি, তার আগে দুর্গের কাজ শেষ করে নেওয়া যাক!) অকল্পনীয় কূটনৈতিক চাপ আর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সুলতান মেহমেদ একটি সুরক্ষিত দুর্গ তৈরিতে সক্ষম হন। এর প্রাচীর ছিল সুউচ্চ; প্রায় ৮২ মিটার উঁচু। এ দুর্গ নির্মাণের ফলে প্রণালীর দু’পাশে থাকা অটোম্যান দুর্গের দূরত্ব দাঁড়ায় ৬৬০ মিটার। উভয় দুর্গে রাখা অটোম্যান কামানগুলো প্রণালীর যেকোনো শত্রু জাহাজ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম ছিল। এ দুর্গের মাধ্যমে বসফরাস প্রণালীতে অটোম্যানদের একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপিত হয়। এবার পালা আসলো লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার।
কনস্টান্টিনোপোল
কনস্টান্টিনোপোল ছিল তত্কালীন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী। খ্রিস্টপূর্ব ২৩ সালে প্রজাতন্ত্রের পাট চুকিয়ে অগাস্টাস সিজার রোমান সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। সেই সাম্রাজ্য বিস্তৃত আকার ধারণ করলে শাসনের সুবিধার্থে তত্কালীন সম্রাট ডিওক্লেটিয়ান রোমান সাম্রাজ্যকে পূর্ব আর পশ্চিম, দু’ভাগে ভাগ করেন। পরবর্তী সময়ে সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন দ্য গ্রেট রোম নগরীর নিরাপত্তাজনিত দুর্বলতা অনুধাবন করে সাম্রাজ্যের রাজধানী রোম থেকে বর্তমান তুরস্কের অন্তর্গত বাইজেন্টিয়ামে স্থানান্তর করেন। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টিয়ামের সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার পর তার নামানুসারে নগরীর নামকরণ করা হয় কনস্টান্টিনোপোল।
এরপর কিছুদিন সাম্রাজ্যের দুই অংশ এই সম্রাটের শাসনে চললেও ৩৯৫ সালে সম্রাট থিওডিয়াসের মৃত্যুর পর রোমান সাম্রাজ্য স্থায়ীভাবে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পশ্চিম অংশের রাজধানী হয় রোম, আর পূর্ব অংশের রাজধানী হয় কনস্টান্টিনোপোল। পশ্চিম অংশ, অর্থাৎ মূল অংশের নাম হয় রোমান সাম্রাজ্য। নবগঠিত পূর্ব অংশটি পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য- দুই নামেই পরিচিত ছিল। বিভক্তির পরবর্তী সময়ে পশ্চিম রোমানরা, অর্থাৎ মূল রোমান সাম্রাজ্য পাশ্ববর্তী হান, গোথ ও ভ্যান্ডাল জনগোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হতে থাকে এবং অবশেষে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পুরোপুরি বিলুপ্তি ঘটে রোমান সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশের।
তখন থেকেই রোমের মূলভূমির অধিবাসী না হয়েও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করে টিকে ছিল পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত। পূর্বেই বলা হয়েছে, কনস্টান্টিনোপোল ছিল তাদের রাজধানী। শুধু রাজধানী বললে ভুল হবে। কনস্টান্টিনোপোল শহরটি আসলে ছিল তত্কালীন বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ও সুরক্ষিত শহর। কনস্টান্টিনোপোল তিন দিকে জলভাগ বেষ্টিত ছিল। বসফরাস প্রণালী, মারমারা সাগর আর গোল্ডেন হর্ন। এই গোল্ডেন হর্ন সুরক্ষিত থাকতো এক দীর্ঘ শিকল দ্বারা, যার কারণে কোনো শত্রু জাহাজ কনস্টান্টিনোপোলের সীমানার কাছাকাছিও আসতে পারত না। আর বাকি একদিক ছিল স্থলভাগ, কিন্তু এই স্থলভাগই সবচেয়ে সুরক্ষিত ছিল বাইজেন্টাইনদের জন্য। এই স্থলভাগ বেষ্টিত ছিল এক ঐতিহাসিক সুরক্ষিত প্রাচীর দিয়ে। পাঁচ স্তরে ঘেরা প্রাচীর এই নগরীকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সুরক্ষিত রেখেছিল শত্রুর হাত থেকে। মধ্যযুগের এক অভেদ্য প্রাচীরে রূপ নিয়েছিল কনস্টান্টিনোপোলের এই প্রাচীর। জনবসতি আর বাণিজ্যের দিক থেকেও এটি ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। বলা হয়ে থাকে,
পুরো পৃথিবী যদি একটি দেশ হতো, তবে এর রাজধানী হওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হতো কনস্টান্টিনোপোল শহর!
এ উক্তি থেকেই শহরের অতুলনীয় গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। তবে, মুসলমানদের জন্য শহরটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল অন্য কারণে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) খন্দকের যুদ্ধের সময় সাহাবীদের উদ্দেশে কনস্টান্টিনোপোল জয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন,
“নিশ্চিতরূপে তোমরা (মুসলিমরা) কুসতুনতিনিয়া (কনস্টান্টিনোপল) জয় করবে। কতই না উত্তম হবে সেই শাসক, কতই না উত্তম হবে সেই সেনাবাহিনী!”
এই হাদিসের কারণেই কনস্টান্টিনোপোল ছিল মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর। আর দুনিয়াত্যাগী আলেম ও ধর্মীয় শিক্ষকদের সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা সুলতান মেহমেদ ততদিনে নিজের মধ্যে ধর্মের প্রতি চরম ভালোবাসা ও আনুগত্য জন্ম দিয়েছেন। ধর্মীয় বিধিবিধান তিনি এত কঠোরভাবে পালন করতেন, যা অবিশ্বাস্য। এমনকি তিনি যদি কোনো অবিশ্বাসী লোকের সাথে দেখা করতেন, তাহলে সাক্ষাতের পরেই তিনি ওযু করে নিতেন, যেন শয়তান তাকে প্রলুব্ধ করতে না পারে। এমন ধর্মভীরু সুলতানের কাছে হাদিসের অংশ হতে পারা নিঃসন্দেহে ছিল সবচেয়ে মর্যাদার বিষয়। ঠিক এ কারণেই সুলতান কনস্টান্টিনোপোল জয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন একেবারে কৈশোরেই!
স্বপ্ন সত্যি করার জন্য মেহমেদ প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি রাখেন না। রুমেলি দুর্গ নির্মাণ করায় প্রথমেই তার বসফরাসের উপর কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি মাঝে মাঝেই শহরের বাইরে থেকে কনস্টান্টিনোপোলের প্রাচীর পরিদর্শন করতেন এবং এর দুর্বলতা খোঁজার চেষ্টা করতেন। তিনি পুরো অভিযানের সমস্ত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিজেই তদারকি করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে এই শহর পতনের জন্য শুধুমাত্র স্থলভাগের আক্রমণ পর্যাপ্ত নয়। স্থলপথ ও নৌপথের যৌথ আক্রমণ ছাড়া এই শহর মাথা নোয়াবে না! তাই তিনি নৌশক্তি বৃদ্ধির দিকে নজর দেন। এই অভিযানের জন্য মেহমেদ তড়িৎগতিতে বিপুল সংখ্যক জাহাজ নির্মাণের আদেশ দেন।
অটোম্যান কারখানায় বসন্তের আগেই অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় ৪০০ এর অধিক যুদ্ধজাহাজ! এরপর তিনি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে সৈন্য একত্র করতে শুরু করেন। বিশাল সাম্রাজ্যের বন্দী ও অভ্যন্তরীণ মিলিয়ে দুই লক্ষাধিক সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী দাঁড় করান তিনি। কিন্তু এত এত যুদ্ধজাহাজ আর বিপুল পরিমাণ সৈন্য আসলে কার্যত ভূমিকাহীন ছিল যদি না গোল্ডেন হর্নের শিকল অতিক্রম করা যায় অথবা শহর সুরক্ষা প্রাচীর না ভাঙা যায়। শহর সুরক্ষা প্রাচীর এতটাই মজবুত ছিল যে সাধারণ কামানের গোলা এর কিছুই করতে পারতো না। তাই এত বিশাল সংখ্যক সৈন্য আদতে কোনো কাজের নয় যদি না প্রাচীরে ফাটল তৈরি করে তাদের শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করানো যায়। মেহমেদ এবার তাই নজর দিলেন তার আর্টিলারি সাপোর্টের দিকে!
সেসময় এক হাঙ্গেরীয় প্রকৌশলীর সুখ্যাতি ছিল নতুন নতুন কার্যকরী সব যুদ্ধাস্ত্র নকশার জন্য। হাঙ্গেরীয় এই প্রকৌশলীর নাম ছিল উরবান। সম্রাট তাকে অভিযানের জন্য কামান তৈরির নির্দেশ দেন যা মধ্যযুগের তৈরি এই সুরক্ষা দেওয়ালের গৌরবকে চূর্ণ করতে পারবে! সম্রাট মেহমেদ যেকোনো মূল্যে কনস্টান্টিনোপোল জয়ের জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। তাই অভিযানের জন্য তিনি সম্পদ ব্যবহারের কোনো কার্পণ্য করেননি। উরবান সম্রাটের আদেশ পেয়ে একটি বিশাল কামান নির্মাণের নকশা করেন। প্রস্তাবিত এই কামানের পাল্লা ছিল কয়েক মাইল!
উরবান সম্রাটকে আশ্বস্ত করেন এই কামান কনস্টান্টিনোপোলের দেয়াল ভেদ করতে সক্ষম হবে। পুরোদমে চলতে থাকে কামান তৈরির প্রস্তুতি। তৈরির পর বিশাল আকৃতির এই কামান দেখে খোদ সুলতানের পিলে চমকে যায়। কয়েকশো টন ওজনের এই কামান টানতে একশোর বেশি গরুর দরকার পড়তো। এই কামান পরীক্ষার সময় বারুদের বিস্ফোরণ দেখে কারো মনে আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না এই কামানের সক্ষমতা নিয়ে। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই কামানের নাম দেওয়া হয় ‘ব্যাসিলিকা’। সব প্রস্তুতি শেষ করে সম্রাট আদেশ দেন কনস্টান্টিনোপোলের দিকে রাস্তা নির্মাণের, যাতে করে তার সৈন্য ও কামান অতি সহজেই শহরের দেয়ালের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে। দুই লক্ষাধিক সৈন্যের সুবিশাল বাহিনী, চার’শর অধিক যুদ্ধজাহাজ আর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কামান নিয়ে মেহমেদ বেরিয়ে পড়েন ইতিহাস লিখতে!
এই অভিযানের সময় বাইজান্টাইন সম্রাট ছিলেন একাদশ কনস্টান্টাইন। তিনি অটোম্যানদের বিশাল এই বাহিনীর আগমন সম্পর্কে পূর্বেই অবগত ছিলেন। বিশেষ করে রুমেলি দুর্গ নির্মাণ বলে দিচ্ছিল যে যুদ্ধ আসন্ন। তাই কনস্টান্টাইন সর্বশক্তি দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য উদ্যত হন। তিনি পশ্চিমা খ্রিস্টানদের কাছে ভ্রাতৃত্বের সাহায্যের আবেদন করেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে জেনোয়া, ভেনিস, সিসিলি থেকে সাহায্য পাঠায় খ্রিস্টান দেশসমূহ। এদের মধ্যে জেনোয়া থেকে সাতশো সৈন্যের সাথে কনস্টান্টিনোপোল আসেন জেনোইস সেনাপতি জাস্টিনিয়ানি। শহর প্রতিরক্ষা আর গেরিলা আক্রমণে যার সুখ্যাতি ছিল। তাকে সম্রাট শহর রক্ষার নেতৃত্ব প্রদান করেন। সুরক্ষিত প্রাচীর ঘিরে গড়ে ওঠে রোমান প্রতিরক্ষা ব্যুহ। মাত্র সাত হাজার প্রতিরক্ষা বাহিনী নিয়ে বাইজেন্টাইনরা প্রস্তুত হয় দুই লক্ষাধিক অটোম্যান সৈন্যের মোকাবেলা করার জন্য। কিন্তু তাদের রক্ষার জন্য সামনে যে ছিল একটি সুরক্ষিত ও ঐতিহাসিক দেয়াল!
১৪৫৩ সালের ৬ এপ্রিল শুরু হয় মধ্যযুগীয় দেয়াল বনাম আধুনিক কামানের এক ঐতিহাসিক দ্বৈরথ! সুলতান মেহমেদ তার কামান দিয়ে মুহুর্মুহু আক্রমণ চালাতে থাকেন শহরের প্রাচীরের উপর। দিন-রাত চলতে থাকে কামানের গোলাবর্ষণ। এদিকে গোল্ডেন হর্নের শিকলের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে অটোম্যান নৌবাহিনী। দিন-রাত গোলাবর্ষণের পরও দেয়ালে বলার মতো কোনো ফাটল সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয় অটোম্যান সেনারা। মেহমেদ বুঝে যান, এই দেয়াল এত সহজে নিজেকে বিলিয়ে দেবার পাত্র নয়। এই অভিযানে বাইজেন্টাইনদের মূল শক্তিই ছিল এই দেয়াল, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রক্ষা করে এসেছে তাদের!
তবু হতাশ না হয়ে প্রাচীরের ওপর দিন-রাত কামান দাগতে থাকে মেহমেদের বাহিনী। কামান যতটুকু ভাঙনের সৃষ্টি করতে সক্ষম হচ্ছিল রোমানরা পুনরায় তা মেরামত করে দেয়ালের স্থিরতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। উরবানের বানানো কামান আশাহত করে তাকে! অনবরত কামান দাগার ফলে যান্ত্রিক ত্রুটি ঘটে কামানের বারুদ বিস্ফোরিত হয়। মারা যান কামানের প্রখ্যাত নকশাকার উরবান। এত বিশাল প্রস্তুতি সত্ত্বেও যুদ্ধের প্রথমেই আরেক যুদ্ধে হেরে যান সুলতান মেহমেদ।
এদিকে ইউরোপীয় সাহায্য নিয়ে সেনা ও সরঞ্জামভর্তি চারটি জাহাজ উপকূলে দেখা দেয়। সুলতান অনতিবিলম্বে জাহাজগুলো ডুবিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সুলতান তার নৌবাহিনী প্রধান বালিতাহ আওগালিকে বলেন, “তুমি হয়তো এই জাহাজগুলোর বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে নয়তো জাহাজগুলো ডুবিয়ে দেবে। যদি তুমি তা করতে না পারো তবে আমাদের নিকট আর জীবিত ফেরত এসো না।“
অটোম্যান নৌবাহিনীর সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও ভেনিশীয় এই জাহাজগুলো গোল্ডেন হর্নে সাহায্য নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। প্রকৃতপক্ষে বিশালাকার জাহাজগুলোর তুলনায় অটোম্যান ছোট ছোট জাহাজগুলোর সক্ষমতা ছিল খুবই কম। জলপথেও এমন পরাজয়ে সুলতান হতাশ হয়ে পড়েন এবং নৌপ্রধান আওগালিকে বরখাস্ত করেন। এরপরই প্রধান উজির হালিল পাশা খারাপ এই সময়ে সন্ধির পরামর্শ দিলেও দরবারের অন্য পাশাদের পরামর্শে সুলতান যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর মেহমেদ রচনা করেন সেনা প্রকৌশলের এক অমর উপাখ্যান।
গোল্ডেন হর্নে বিস্তৃত শিকলের কারণে মেহমেদের নৌবাহিনী হর্নের ভেতরে প্রবেশ করতে পারছিল না। তাই মেহমেদ সবাইকে অবাক করে দিয়ে এক অভূতপূর্ব পরিকল্পনা করেন। তিনি তার জাহাজগুলোকে স্থলভাগের উপর দিয়ে শিকলের রক্ষিত এলাকা অতিক্রম করে আবার পানিতে অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন। এর মাধ্যমে গোল্ডেন হর্নের পানিতে অটোম্যান নৌবাহিনীর কর্তৃত্ব স্থাপন করা সম্ভব হবে। এবং তাদের এই উপস্থিতির কারণে এই অংশের দেয়ালের সুরক্ষায় অধিক সৈন্যের প্রয়োজন পড়বে যার ঘাটতি মেটাতে হবে সম্মুখ দেয়ালের সৈন্যবাহিনী থেকে সৈন্য সরবরাহ করে। ফলে সম্মুখ দেয়ালের প্রতিরোধ অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে যাবে।
এই চমকপ্রদ পরিকল্পনাটি সেই সময়ের জন্য ছিল অভাবনীয়। কাঠের রাস্তার উপর তেল-চর্বি ছড়িয়ে সুলতান মেহমেদ যখন নিজের জাহাজগুলোকে টেনে নিচ্ছিলেন গোল্ডেন হর্নের দিকে, তখন রোমানরা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কী হতে চলতেছে। এই প্রক্রিয়াটি এত গোপনভাবে সম্পন্ন হয় যে সুলতান মেহমেদ বলেছিলেন,
“আমার দাড়ির একটি চুলও যদি আমার পরিকল্পনার কথা জানতে পারে তবে আমি সেটাকে তুলে ফেলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব!“
রাতের আঁধারে জাহাজগুলো রোমানদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গোল্ডেন হর্নে প্রবেশ করাতে সক্ষম হয় অটোম্যান বাহিনী। সকালের আলো ফুটে যখন রোমানরা গোল্ডেন হর্ণের দিকে তাকায় তখন অবিশ্বাসের দৃষ্টি তাদের ছেয়ে ফেলে। ৮০টি অটোম্যান পতাকা খচিত জাহাজ গোল্ডেন হর্ণের পানিতে ভাসতে দেখে যেন তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। একইসাথে পাহাড়সম কৌতূহল আর অজানা আশঙ্কা ভর করে বসে তাদের মনে!
এরপর উভয়মুখী আক্রমণ চলতে থাকে অটোম্যান বাহিনীর। এর আগে সুরঙ্গ খুড়ে শহরে প্রবেশের চেষ্টা ভেস্তে যাওয়ার পর অটোম্যান বাহিনী সর্বশক্তি নিয়োগ করে প্রাচীর ভেঙে ফেলার উপর। মুহুর্মুহু আক্রমণে ভেঙে পড়তে থাকে প্রাচীর। এদিকে আর কোনো পাশ্চাত্য সাহায্য না পেয়ে ভেঙে পড়তে থাকে রোমানদের মনোবলও। যদিও খোদ কনস্টান্টিনোপোলবাসীরাই ইউরোপের ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সাহায্য নেওয়ার ব্যাপারে সম্মত ছিল না। নিজেরা অর্থডক্স হওয়ার কারণে বাইজেন্টাইন খ্রিস্টানরা পশ্চিমের ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ঘৃণা করতো। তাই ক্যাথলিক পোপের কাছে এই সাহায্যের আবেদন তাদের মধ্যে চরম রোষের জন্ম দেয়। এমনকি সেসময় এটাও বলতে শোনা যায় যে, লাল টুপিওয়ালা ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের থেকে এই শহরে আমরা বরং পাগড়িওয়ালা তুর্কিদের দেখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করব!
যা-ই হোক, ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের সাহায্যের আশা নিভে গেলে মনোবলের দিক থেকে ভেঙে পড়ে রোমানরা। এর মধ্যেই জোরালো আক্রমণ এবং একইসাথে আত্মসমর্পণের সমন আসে অটোম্যান শিবির থেকে। সেখানে রোমানদের আত্মসমর্পণের বিনিময়ে তাদের জান, মাল, পরিবার এবং ধর্ম পালনে নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয় সুলতানের পক্ষ থেকে! কিন্তু রোমানরা এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় এবং শেষ সময় পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এরপরের ইতিহাস খুবই সংক্ষিপ্ত। সম্রাট একাদশ কনস্টান্টাইন দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করতে থাকেন অটোম্যানদের। এর মধ্যেই দেয়ালে দেখা যায় বড় ফাটল। ওসমানীয় সৈন্যরা এই ফাটল দিয়ে প্রবেশের মধ্যেই রোমানদের সেনাপতি জাস্টিনিয়ান তীরের আঘাতে ঘায়েল হন এবং খুব বাজে অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন। আহত হবার আগপর্যন্ত তিনি খুব বীরত্বের সাথে অটোম্যানদের মোকাবেলা করেন। কিন্তু তিনি যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগের পর তার সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যায় আর ততক্ষণে ফাটল দিয়ে বিপুল পরিমাণ অটোম্যান সেনা শহরের মধ্যে প্রবেশ করায় পরাজয় একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে যায় রোমানদের। কিন্তু সম্রাট কনস্টান্টাইন শেষ পর্যন্ত বীরত্বের সাথে লড়ে যান। শহরের মধ্যে ওসমানীয় সৈন্য ঢুকে পড়লে তিনি তার রাজকীয় পোশাক খুলে ফেলেন এবং উলঙ্গ তরবারি হাতে শত শত অটোম্যান সৈন্যের মধ্যে হারিয়ে যান।
২৯ মে, ১৪৫৩। বিজয়ীর বেশে কনস্টান্টিনোপোল শহরে প্রবেশ করেন বিজেতা সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ। কনস্টান্টিনোপোল শহরে প্রবেশ করেই তিনি প্রথমে যান হাজিয়া সোফিয়ায়। এটি ছিল সবচেয়ে বড় অর্থোডক্স চার্চ এবং তত্কালীন ইউরোপের সবচেয়ে বড় ইমারত। সুলতান শহরে অভিযানের পূর্বে সেনাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, শহর বিজিত হলে শহরের প্রাচীর আর স্থাপনা বাদে বাকি সবকিছু সৈন্যদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সৈন্যদের মধ্যে সম্পদ বণ্টন করা হয় আর সম্রাট নিজে হন শহরের সমস্ত স্থাপনা আর শহর রক্ষাকারী প্রাচীরের মালিক।
বিজয়ের পর তিনি হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রুপান্তর করেন এবং পরবর্তী জুম্মার নামাজের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় এই মসজিদের পথচলা। শহর বিজয়ের পর সুলতান মেহমেদ অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেন। আদ্রিয়ানোপোলকে বাদ দিয়ে অটোম্যান সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানী করা হয় কনস্টান্টিনোপোলকে। শহরের নাম পাল্টে এর নাম রাখা হয় ইসলামবুল যার অর্থ ইসলামের শহর। পরে এর নাম হয় ইস্তাম্বুল।
রোমানদের দুই হাজার বছরের ইতিহাসে কেউ যেটা পারেনি সেটাই করে দেখান ইতিহাসের এই মহানায়ক। শহরের গোড়াপত্তনের পর থেকে সর্বমোট ২৩টি সেনাবাহিনী এই শহর দখলের চেষ্টা করেছে, যার মধ্যে সর্বশেষ ছিলেন তার বাবা সুলতান মুরাদ। কিন্তু সবাইকে ঠেকিয়ে দিয়ে মাথা উচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল কনস্টান্টিনোপোল শহরের বাইরে রক্ষাপ্রাচীর। প্রাচীরের সেই দম্ভ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে শহরের মাঝে প্রথমবারের মতো অটোম্যান পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন সুলতান মেহমেদ।
রোমান সাম্রাজ্যের শাসককে সেসময় বলা হতো কায়সার। সুলতান মেহমেদ কনস্টান্টিনোপোল বিজয়ের পর তাকে ‘কায়সার-এ-রোম’ উপাধি দেওয়া হয়। এছাড়াও তার নামের শেষে যুক্ত হয় ফাতিহ শব্দটি যার অর্থ বিজেতা! নিজের ক্ষমতা গ্রহণের অল্প সময়ের মধ্যেই প্রশাসনিক সংস্কার, কার্যকরী ঘাঁটি নির্মাণ, কর ও জিজিয়া আদায়, আধুনিক কামান নির্মাণের মাধ্যমে মধ্যযুগীয় যুদ্ধকৌশলের অবসান ঘটানো এবং সর্বশেষ কনস্টান্টিনোপোল বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় শত্রুদের নিজের উত্থানের জানান দিয়েছিলেন বিজেতা মেহমেদ! আর এসব কিছু করেছিলেন যখন তার বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর!