সিগারেট আমাদের দেশে সবচেয়ে বিতর্কিত পণ্যগুলোর একটি। ধূমপান নিয়ে আমাদের মধ্যে রয়েছে নানা রকম মতামত। অনেকে সিগারেট এবং ধূমপায়ীদের রুটিন করে পিণ্ডি চটকান প্রতিদিন, তাদের কাছে এই ছোট্ট ধুম্রশলাকা দেশ উচ্ছন্নে যাওয়ার মূল কারণ; অনেকের আবার সব কাজের আগে একটা সিগারেট না হলে চলেই না; অনেকে আবার হয়তো নিজে খান না, কিন্তু অপরকে নিরুৎসাহিতও করেন না।
ধূমপান নিয়ে যেহেতু কথা হলোই, তো চলুন আপনাদের জানানো যাক সিগারেট নিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের একটি নারী আন্দোলন ও একটি জনসংযোগ প্রকল্পের মজার কাহিনী।
এডওয়ার্ড বার্নেইস: জনসংযোগের প্রবাদপুরুষ
সবাই জানে, জনসংযোগ ব্যবসায়িক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে জনসংযোগের যে নতুন ধারণাগুলো আজকাল ব্যবহার হচ্ছে সর্বত্র, তার পেছনের মাথাটির নাম অনেকেই জানে না। তাই এই লেখার মূল কাহিনীতে যাওয়ার আগে সেই মহারথীর ছোট্ট পরিচয় দেয়া দরকার।
তার নাম এডওয়ার্ড বার্নেইস, জন্ম ১৮৯১ এর ২২ নভেম্বর, ভিয়েনাতে একটি ইহুদি পরিবারে। তিনি মনস্তত্ত্বের আরেক মহারথী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের আত্মীয়, বাবা-মা দুই সূত্রেই। তারা ১৮৯০ সালে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে সপরিবারে চলে আসেন।
কর্মজীবনের শুরুতে তিনি বেশ কয়েক বছর সাংবাদিকতার কাজ করেন। সেই সময়ই জনগণের মন বোঝার আশ্চর্য দক্ষতা ও দূরদর্শিতা প্রদর্শন করেন তিনি। তার বিভিন্ন লেখার কারণেই অনেক পড়ন্ত থিয়েটার দর্শক দিয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে আবার। এই সময়ই তিনি অনেক নতুন কৌশল উদ্ভাবন করছিলেন জনসংযোগের, যা পরবর্তী যুগে যেকোনো জনসংযোগ প্রকল্পের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠবে।
তার মেধার আসল ব্যবহার শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। আমেরিকার জনতথ্য পরিষদ (কমিটি অন পাব্লিক ইনফরমেশন) তাকে নিয়োগ দেয় যুদ্ধের জন্য দেশে ও বাইরে সমর্থন আদায় করতে, বা ‘তৈরি’ করতে। এই কাজকে বার্নেইস পরে বলেছিলেন ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ বলে।
এর পরে আরও কিছু জায়গায় জনসংযোগের কাজে সাফল্যের পর তিনি তার এই মেধাকে ব্যবসার কাজে লাগান, একটি জনসংযোগ ব্যবসা গড়ে তোলেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য করা তার অনেকগুলো প্রকল্প অভাবনীয় সাফল্য লাভ করে। তারই একটি আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়।
তার লেখা অনেক বই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য; ‘ক্রিস্টালাইজিং পাবলিক অপিনিয়ন (১৯২৩)’, ‘প্রোপাগান্ডা (১৯২৮)’, ‘পাবলিক রিলেশন্স (১৯৪৫)’, ‘দি ইঞ্জিনিয়ারিং অফ কন্সেন্ট (১৯৫৫)’ ইত্যাদি।
টর্চেস অফ ফ্রিডম বা স্বাধীনতার মশাল প্রকল্প
১৯২৭ সালে বার্নেইস বিখ্যাত চেস্টারফিল্ড সিগারেটের নির্মাতা লীগেট ও মায়ার্স কোম্পানির জন্য কাজ করেন। এই সময় লাকি স্ট্রাইক নামে আরেকটি প্রতিযোগী সিগারেটের ব্র্যান্ডকে পিছে ফেলে দেয়ার পরে আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির (লাকি স্ট্রাইকের নির্মাতা) জর্জ ওয়াশিংটন হিল তাকে লীগেট ও মায়ার্স থেকে কিনে নেন।
আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানিতে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় নারীদের মধ্যে লাকি স্ট্রাইকের জনপ্রিয়তা বাড়াতে। কাজটি ছিল যথেষ্ট কঠিন, কারণ তখন মেয়েরা তেমন ধূমপান করতো না এবং কাজটি সামাজিকভাবে খারাপ চোখে দেখা হতো। বার্নেইসের প্রথমে চাল ছিল ‘ধূমপানে ওজন কমে’ এই গুজব ছড়িয়ে দেয়া। বার্নেইসের প্রকল্পে বিভিন্ন আলোকচিত্রী, শিল্পী, মডেলদের কাজে লাগানো হয়। তারা বিভিন্ন পত্রিকা ও পোস্টারে প্রচার করা শুরু করেন চিকন হওয়ার সৌন্দর্য ও উপায়। এমনকি ডাক্তারদেরও ব্যবহার করানো হয় চিকন করাতে সিগারেটের গুণ প্রচার করার জন্য।
একইসাথে বার্নেইস সিগারেটের সামাজিক মূল্যও বৃদ্ধি করার কাজ শুরু করেন। গৃহিণীদের হাতে হাতে সিগারেট থাকা একটি সময়ের প্রয়োজন, এটাও প্রচার করা হয়। এতে মোটামুটি ভালোই কাজ হয়। মেয়েদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং লাকি স্ট্রাইকের বিক্রিও বাড়ে। তবে মেয়েদের ধূমপানের যে সামাজিক কলঙ্ক, তা এত সহজে দূর হওয়ার ছিল না। ভাবা হতো, ধূমপান করে শুধুমাত্র ‘নষ্ট’ মেয়েরা। এমনকি খোদ আমেরিকার কিছু জায়গায় এমন ‘জঘন্য’ আচরণের জন্য অনেক নারীকে জেলে পোরা হতো।
এই সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায় তা বোধহয় বার্নেইসও একা ভেবে উঠতে পারছিলেন না। তাই তিনি গেলেন তার মামা/চাচার (ফ্রয়েডের) ছাত্র আব্রাহাম ব্রিলের কাছে। ব্রিল তখন গবেষণা করছিলেন বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সামাজিক প্রবণতাগুলোর পরিবর্তন নিয়ে। তিনি বার্নেইসকে দেখান, বিশ্বযুদ্ধের পর পুরুষদের মধ্যে ধূমপানের পরিমাণ আকাশছোঁয়া, যা আগে ছিল না। একইসাথে তিনি এটাও দেখান যে, বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সমাজে নর-নারীর ভূমিকায় এসেছে অনেক পরিবর্তন। এর মূল কারণ ছিল পুরুষেরা যখন গিয়েছিল যুদ্ধে, নারীদের তখন করতে হয়েছিল জীবিকার সন্ধান। তাদের ঘরের বাইরের জীবন দেখতে হয়েছিল প্রথমবারের মতো, এবং তারা উপলব্ধি করতে শুরু করে যে, তারাও পুরুষদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
এই উপলব্ধি জন্ম দেয় কয়েকটি ক্রমাগত নারী আন্দোলনের, যা নারী অধিকার আদায়ে, ও নারীবাদের ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য অপরিহার্য ছিল। এই আন্দোলনগুলোর ফলেই নারীরা ভোটাধিকার লাভ করে পশ্চিমে।
যা-ই হোক, ব্রিল এই আন্দোলনগুলোর দিকে বার্নেইসের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, এবং পরামর্শ দেন যে সিগারেট হতে পারে নারীদের জন্য একটি ‘স্বাধীনতার মশাল’ বা টর্চেস অফ ফ্রিডম। বার্নেইস ত্বরিত গ্রহণ করে নেন এই আইডিয়া। তিনি নারীবাদী ছিলেন কি না বলা মুশকিল, তবে সুযোগসন্ধানী ছিলেন সন্দেহ নেই। বিশের দশকে তিনি পাচ্ছিলেন ২৫,০০০ ডলার বেতন, তার লক্ষ্য ছিল নারীদের মধ্যে ধূমপান বাড়ানো ও লাকি স্ট্রাইকের বিক্রি বৃদ্ধি। এতে নারীদের স্বাধীনতা বাড়ল কী কমলো তা নিয়ে তার তেমন কিছু আসতো-যেতো না।
যেই ভাবা সেই কাজ, বার্নেইস তার যুদ্ধ পরিকল্পনা শুরু করেন। তিনি বানান ‘টর্চেস অফ ফ্রিডম’ প্রকল্প, পৃথিবীতে প্রথম জনসংযোগ স্টান্টের পরিকল্পনা। ১৯২৯ সালের ৩১ মার্চে, একটি ইস্টার সানডে প্যারেডের মাঝে এক ভাড়া করা অভিনেত্রী বার্থা হান্ট ভিড় থেকে বের হয়ে সবার সামনে সিগারেট ধরান। এতে একটি অবশ্যম্ভাবী হট্টগোল শুরু হয়, যা সংবাদপত্রে প্রচুর কভারেজ পায়। পুরো ঘটনাটিই ছিল এমনভাবে সাজানো, যাতে জনগণের কাছে বার্নেইসের পাঠানো বার্তাটিই যায়। এই ঘটনা ছিল সবেমাত্র শুরু। শীঘ্রই অনেক নারী প্রকাশ্যে ধূমপান শুরু করেন বিদ্যমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে। এবং পেছন থেকে বার্নেইসের প্রকল্পও চলতে থাকে, প্রচার করা হতে থাকে ধূমপান নারীদের জন্য একপ্রকার মুক্তিই, তাদের নতুন শক্তি ও স্বাধীনতা প্রদর্শনের একটি বাহন!
বার্নেইস অবশ্য নিজেকে রেখেছিলেন সবকিছুর পেছনে। তার বুদ্ধিতে হওয়া প্রকল্পের পেছনে তার টিকিটিরও হদিস পাওয়া যেতো না। তার লেখা থেকেই সর্বপ্রথম এই ব্যাপারে জানা যায়। তবে সম্প্রতি কিছু গবেষণায় বলা হচ্ছে, প্রকল্পটি ততটা তার দখলে ছিল না, যতটা বার্নেইস ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলেছেন, বরং বিদ্যমান সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করলে এই ঘটনা ছিল অবশ্যম্ভাবী। গবেষক ভেনেসা মার্ফি বলেছেন, বার্নেইসের প্রকল্পের বেড় এত দীর্ঘ ছিল না, যে সারা আমেরিকা জুড়ে এর প্রভাব পড়বে।
তবে যত যা-ই হোক না কেন, এটি যে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, নারী অধিকার ও নারী আন্দোলনের জন্য, তাতে কোন সন্দেহ নেই। একইসাথে এই ঘটনা আমাদের দেখায় যে, বর্তমান সময়ে ছোটখাট কিছু ব্যাপার নিয়ন্ত্রণ করেই কীভাবে জনগণের ইচ্ছা, চাহিদা, মতামত ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
ফিচার ইমেজ- wonderwardrobes.com