মেরি অ্যান শার্লট করডে দ্য আরমন্ত অসম্ভব সুন্দরী, রূপবতী এক ফরাসি তরুণী। জন্ম তার ২৭ জুলাই, ১৭৬৮ সালে ফ্রান্সের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। নরমান্ডি গ্রামে জন্মগ্রহণকারী শার্লট ছিলেন পিতা-মাতার চতুর্থ সন্তান। পিতা জ্যাক-ফ্রাঙ্কোস ডি করডের বংশে জন্ম নিয়েছিলেন পিয়ের কর্নেলের মতো প্রখ্যাত নাট্যকার।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে শার্লটের মা ও তার বড় বোনের মৃত্যু হয়। এই সময় তাকে সহ তার ছোট বোনকে পাঠিয়ে দেয়া হয় কায়েন শহরের নিকটবর্তী এক আশ্রমে। আশ্রমের পরিবেশ শার্লটের মনোজগতে নিয়ে আসে এক বিরাট পরিবর্তন। শার্লট বড় হতে থাকে আশ্রমের নিয়মশৃঙ্খলা এবং ঈশ্বর প্রেমে। কিন্তু তার চিন্তার জগতে এক বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে আশ্রমে থাকা এক বিশাল লাইব্রেরি। সেই লাইব্রেরিতে ছিল বিভিন্ন বিষয়ের, বিভিন্ন মাত্রিকের, প্রখ্যাত সব লেখকের বই। সেসব বই যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করতো শার্লটকে। লাইব্রেরিতে থাকা ল্যাটিন ভাষায় রচিত নানা ক্লাসিক তাকে প্রবল আর্কষণ করতো। এছাড়াও বিভিন্ন দেশের সাম্রাজ্য বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস তাকে প্রবলভাবে টানতো।
লাইব্রেরির সেই শিক্ষা শার্লটের চিন্তার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রতি তার আস্থা জন্মায়। সে বিশ্বাস করতে থাকে, ফ্রান্সের আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হচ্ছে ফরাসি সম্রাটদের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা। এ থেকে ফ্রান্সকে মুক্ত করতে না পারলে ফ্রান্সের জনগণের কোনো উন্নতিই হবে না। আশ্রমের স্নিগ্ধ, শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ এবং বইয়ের রাজ্যে নিজেকে সঁপে দিয়ে শার্লট যৌবনে পা দিল। এই সময়টা নিয়ম-ভাঙার সময়। কবিরা বলেন, সময়টা প্রেমের সময়, ভালবাসার সময়। তবে কারো ক্ষেত্রে তা হয়ে পড়ে ব্যক্তি প্রেম, কারো ক্ষেত্রে দেশপ্রেম। শালর্ট দ্বিতীয়টিকেই পছন্দ করলো। এই সময়েই ফ্রান্সে বিপ্লবের দামামা বেজে উঠেছে।
১৭৮৯ সাল, ফ্রান্সের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। দীর্ঘদিন ফ্রান্স ছিল রাজতন্ত্রের অধীন। রাজাই ছিলেন সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। প্রজাদের সুখ-শান্তির চেয়ে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করাই ছিল রাজাদের লক্ষ্য। ফলে সময়ের সাথে সাথে রাজতন্ত্র হয়ে পড়েছিল স্বৈরাচারী শাসকের প্রতিভূ। শাসন বিভাগের বিশৃঙ্খলা এবং রাজকর্মচারীদের অত্যাচারে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল ফরাসি জনগণ।
রাজা চতুর্দশ লুই এর শাসনামলের শেষ দিকে রাজতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতা চরমে পৌঁছে। রাজা পঞ্চদশ লুই আমোদ-প্রমোদ ও বিলাসিতায় ছিলেন মত্ত। ক্রমাগত রাজাদের ঔদ্ধত্য, উচ্ছৃঙ্খলতা, অমিতব্যয়িতা এবং অভিজাত শ্রেণীর প্রাধান্য, রাজ্যের সাধারণ মানুষের প্রতি শাসকদের শোষণ দিন দিন জনগণের মনে তীব্র ক্ষোভের ডালপালা বিস্তার করছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারতে ইংরেজদের কাছে ফ্রান্সের শোচনীয় পরাজয়ের পর ফরাসি রাজশক্তির প্রভাব ধীরে ধীরে কমে আসছিল। এসব দেশে ব্যবসা বাণিজ্যে ফরাসিদের প্রভাব কমে আসায় রাজকোষের ভান্ডার শূন্য হয়ে পড়ছিল। এর প্রভাব সমাজের উচ্চশ্রেণীর মানুষদের মধ্যে যতটুকু না পড়েছে, তার চেয়ে বেশি পড়েছে রাজ্যের সাধারণ ও খেটে-খাওয়া মানুষের উপর।
রাজাদের সামন্তবাদী মানসিকতার কারণে চারদিকে চলছিল সন্ত্রাসের রাজত্ব। প্রধানত প্রশাসনের তিন উর্ধ্বতন ব্যক্তি এই সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছিলেন- দানত, রোবসপিয়ের আর মারাট। এদের মধ্যে আবার শেষের জন একেবারেই নির্দয়, নিষ্ঠুর। বিপ্লবের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে রোজ শত-শত মানুষকে গিলোটিনে মৃত্যুদন্ড দিচ্ছিলেন। ফলে সাধারণ মানুষদের মধ্যে রাজপরিবার ও অভিজাত শ্রেণীর বিপক্ষে একধরনের ক্ষোভ ও হতাশা গ্রাস করতে থাকে। সব মিলিয়ে ফরাসি জনগণকে বিপ্লবমুখী করে তুলেছিলেন ষোড়শ লুই। রাজতন্ত্রের অবসান এবং সাম্য-মৈত্র্যের ভিত্তিতে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চারদিকে বিপ্লবের আগুন ছড়াতে থাকে।
১৭৮৯ সালের ৪ জুলাই ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে খাবারের দাবীতে রাস্তায় নেমে আসে শ্রমিক, কারিগর, গ্রাম ও শহরের গরিব মানুষের দল। প্যারিসের সর্বত্র চলছিল বিক্ষোভ মিছিল। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য রাজার নির্দেশে মিছিলের ওপর চালিয়ে দেওয়া হলো অশ্বারোহী বাহিনী। কিন্তু বিক্ষুব্ধ বিশাল জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সেনাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। রাস্তায় রাস্তায় চলে ব্যারিকেড আর শ্লোগান। লুট করা হয় আগ্নেয়াস্ত্রের দোকান। উত্তেজিত জনতা আরও অস্ত্র সংগ্রহের লক্ষ্যে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল কারাদুর্গে আক্রমণ করে। উন্মত্ত জনতা কারাগারের থাকা রাজবন্দীদের মুক্ত করে এবং কারাগারে রক্ষিত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র লুট করে। বিপ্লবের সূত্রপাত ঘঠে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে।
এই বিপ্লব রুখতে রাজা চরম ব্যবস্থা ঘোষণা করেন। বিপ্লবীদের ধরার জন্য শহরে, গ্রামে সৈন্য পাঠাতে থাকেন। বিপ্লবীদের ধরে দেওয়ার জন্য পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়। এই বিপ্লবের প্রভাব পড়তে থাকে পরিবার, সমাজ, এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয় ও আশ্রমেও। এর আঁচ এসে লাগে সদ্য যৌবনে পৌঁছা শার্লটের জীবনেও। শার্লট মনে-প্রাণে এই বিপ্লবের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। এতদিনের শিক্ষা তাকে ধীরে ধীরে বিপ্লবী হয়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করলো। ১৭৯১ সালের দিকে বিপ্লবকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য সব স্কুল, কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে শার্লট ও তার বোন কিছুদিনের জন্য কায়েন শহরে তার এক খালার বাড়িতে থাকতে শুরু করে। তখন অনেক বিপ্লবী পালিয়ে এসে এই কায়েন শহরেই আশ্রয় নেয়। কায়েন হয়ে ওঠে বিপ্লবীদের প্রধান আশ্রয়স্থল।
এই তথ্য শাসকদের হাতে পড়তে খুব একটা দেরী হয়নি। শাসন ক্ষমতায় থাকা দুই প্রভাবশালী ব্যক্তি জেকোবিন এবং জেইন পল মারাট এই বিপ্লবীদের ধরার জন্য কায়েন শহরে বিপুল সৈন্যবাহিনী পাঠান এবং তাদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে নিষ্ঠুরভাবে গিলোটিনের মাধ্যমে সেসব বিপ্লবীদের মৃত্যদন্ডের নির্দেশ দেন। কায়েন শহরে শুরু হয় নির্মম হত্যালীলা। দলে দলে ধরা পড়তে থাকলো শত শত বিপ্লবী। কোনরকম বিচার ছাড়াই তাদের গিলোটিনে তুলে প্রকাশ্যে হত্যা করা হতো।
এই দৃশ্য শার্লটকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। বিপ্লবীদের হত্যাকান্ডে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত তিনি। তার মনে জন্মায় তীব্র প্রতিশোধের স্পৃহা। একদিন হঠাতই খালার বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। তাকে যে করেই হোক প্যারিসে পৌঁছতে হবে। কারণ প্যারিসেই রয়েছে সেই কুখ্যাত মারাট। তাকে নিজের হাতে খুন না করা পর্যন্ত শার্লটের মনে শান্তি আসবে না। কাউকে কিছু না জানিয়ে চব্বিশ বছরের এই সুন্দরী তরুণী ২০০ মাইল পায়ে হেঁটে প্যারিসে এলেন।
যাকে হত্যা করার জন্য শার্লট প্যারিসে এলেন, সেই মারাট সম্পর্কে এবার একটু জেনে নেয়া যাক। জেইন পল মারাট ছিলেন পেশায় চিকিৎসক এবং রাজার অনুগত। তিনি বিপ্লবের বিরুদ্ধে ছিলেন। ১৭৯২ সালে বিপ্লব যখন তুঙ্গে এবং রাজা যখন গৃহবন্দী, তখন শাসনতন্ত্র পরিচালনার জন্য মারাটকে প্যারিসের ডেপুটি নিযুক্ত করা হয়। ফলে ক্ষমতাশালী হয়ে মারাট বিপ্লবীদের ওপর চরম নিষ্ঠুর আচরণ করতে থাকেন। বিপ্লবকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য তার অধস্তনদের দিতে থাকেন একের পর এক কঠোর সব নির্দেশ। তাই এই মারাটকে হত্যা করা বিপ্লবীদের আশু প্রয়োজন হয়ে দেখা দিল। বিপ্লবীদের হয়ে কাজটা করার জন্য এগিয়ে এলেন শার্লট।
প্যারিসে শার্লট মারাটের বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হলেন। তখন বাড়ির পাহারায় নিযুক্ত থাকা সৈন্যরা শার্লটকে ঢোকার অনুমতি দিচ্ছিল না। শার্লট তখন এক কৌশলের আশ্রয় নেয়। সে সৈন্যদের জানায়, তার কাছে বিপ্লবীদের তথ্য আছে এবং তা সে মারাটকে ছাড়া আর কাউকে জানাবে না। তখন সৈন্যদের একজন গিয়ে মারাটকে শার্লটের সেই কথাটি জানায়। তখন মারাট ছিল স্নানঘরে। বিপ্লবীদের তথ্য জানার জন্য স্বভাবতই মারাট উদগ্রীব ছিলেন। তাই স্নানাগারেই মারাট শার্লটকে নিয়ে আসার জন্য সৈন্যকে নির্দেশ দেন।
শার্লটকে মারাটের স্নানের ঘর দেখিয়ে দেওয়া হলো। ‘জনগণের পিতা’ (মারাটকে তার অনুগামীরা ওই নামেই ডাকতেন) তখন বাথটবে বসে আছেন। ভিনেগারে ভেজানো একটি বড় রুমাল তার মাথায় জড়ানো, যাতে মাথা না ধরে। মারাট তরুণী শার্লটকে কাছে ডেকে জানতে চাইলেন তার দরকারের কথা। শার্লট শান্তচিত্তে মারাটকে জানালেন, তিনি কায়েন থেকে আসছেন এবং সেখানকার বিদ্রোহ সম্পর্কে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে। মারাট যেন বেশ খুশি হলেন, সঙ্গে সঙ্গে কলম নিয়ে নতুন বিশ্বাসঘাতকদের নাম লিখতে শুরু করে দিলেন। শার্লট বলে চললেন, মারাট লিখে গেলেন।
মারাট লেখায় মগ্ন, খেয়াল করলেন না তরুণীটি কখন তার বসার টুলটাকে মারাটের খুব কাছে টেনে এনেছেন। শার্লট বহু নাম বললেন, যার সব নামই ছিল কাল্পনিক। একসময় তালিকা শেষ হলো। মারাট কলম রেখে জয়ের হাসি হাসলেন। তরুণীর দিকে ঘুরে বললেন, “দারুণ, কয়েকদিনের মধ্যেই এদের আমি গিলোটিনে খতম করবো।” এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শার্লট তার পোশাকের মধ্যে লুকানো খাপ থেকে একটি বড় ছুরি বের করলেন, মুহূর্তের মধ্যে উঠে দাঁড়ালেন এবং মারাটের বুকে তা বসিয়ে দিলেন। মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাতে-কাতরাতে মারাট চিৎকার করে বলে উঠলেন, “আ ময়, মা চেরে অ্যামি, আ ময়!” (আমাকে বাঁচান, প্রিয় বন্ধু, আমাকে বাঁচান।) পরিচারকেরা স্নানঘরে ছুটে আসার আগেই মৃত্যু হলো মারাটের।
শার্লট স্নানঘরের বাইরে এলেন। কিন্তু সদর দরজায় পৌঁছানোর আগেই লাগোয়া এক ঘরে তাকে ধরে ফেললো পরিচারকেরা। লরেঁ বাস নামে এক পরিচারক তার মাথায় চেয়ার দিয়ে আঘাত করলো। এরপর তাকে আটকে রাখা হলো, নিয়ে যাওয়া হলো কারাগারে।
তড়িঘড়ি বিচার শুরু হলো শার্লটের। আদালত কক্ষে সকলের সামনে নিগ্রহ করা হলো শার্লট করডেকে। তার যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করার চেষ্টা করা হলো এই বলে যে, এটি নিশ্চয় তৃতীয় ব্যক্তির কাজ যে শার্লটকে এই খুন করার পরামর্শ দিয়েছে। নিশ্চয়ই ওই ব্যক্তির সাথে এক বিছানায় শুয়েছেন শার্লট। এভাবে নানা অপমানে জর্জরিত করা হলো শার্লটকে। কিন্তু সবকিছুতেই শার্লট ছিলেন নিস্পৃহ, নির্বিকার। পরবর্তীতে সাজানো আদালতে মারাটের মৃত্যুর চারদিন পরেই শার্লটের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করা হলো।
দিনটা ছিল ১৭৯৩ সালের ১৭ জুলাই, মাথা কেটে ফেলে দেওয়া হলো শার্লটের। তার জল্লাদ ছিল চার্লস হেনরী সেনসন। সেনসন তার এক স্মৃতিকথায় লিখেছেন,
“সুন্দরী আততায়ী নারীসুলভ গুণের সঙ্গে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন।”
শার্লটের মৃত্যুদন্ড সম্পর্কে আরেকটি বর্ণনায় সেনসন লিখছেন ,
“তার মাথাটা পাশে রাখা ঝুড়িতে পড়তেই নিষ্ঠুর হৃদয়হীন এক দর্শক চুলের মুঠি ধরে মাথাটা তুলে আনলো, সুন্দর মুখটাকে নির্মমভাবে আঘাত করলো, সেই মুখ তখনও ক্রোধ, ঘৃণা আর প্রতিবাদে জ্বলছে।”
ফিচার ইমেজ- ab-international.com