গ্যাংস্টাররা ক্ষেত্রবিশেষে এমন একটি মুগ্ধতার মায়াজাল তৈরি করে যে অনেক সময় নিজেদের কুখ্যাতিকে ছাপিয়ে পূজনীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয় তারা। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করেও গ্যাংস্টার বা দস্যুরা মানুষের মুখে মুখে রীতিমতো নায়কে পরিণত হচ্ছে আজকাল। আর সবকিছু বাদ দিলেও, হলিউডে গ্যাংস্টারদের নিয়ে বানানো চলচ্চিত্রের যে জনপ্রিয়তা আছে তা নিঃসন্দেহে এই রহস্যময় মানবদের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহের বহিঃপ্রকাশই নির্দেশ করে। বলা হয়, সিনেমার জগতে গ্যাংস্টার ক্যাটাগরি এই মানুষগুলোর অমরত্বের পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছে।
কয়েক দশক ধরে গ্যাংস্টাররা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ইউরোপ, এশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ল্যাটিন আমেরিকা কোথায় নেই তারা! আজ তাহলে বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করে বেড়ানো এমন কয়েকজন গ্যাংস্টারের গল্প শুনে আসা যাক।
পাবলো এসকোবার
কলম্বিয়ার মাদক সম্রাট পাবলো এমিলিও এসকোবার গাভিরিয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল অসংখ্য মাদক সাম্রাজ্য। বিশ্বব্যাপী প্রায় হাজারখানেক খুনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পাবলো এসকোবার নামেই বেশি পরিচিত সে। ইতিহাসের অন্যতম ক্ষমতাবান আর ভয়ংকর বেশ কিছু অপরাধমূলক সংগঠনের হোতা ছিল এসকোবার। অগণিত প্রাসাদ, এয়ারলাইনস, কুখ্যাত সব অপরাধী আর অসংখ্য সৈন্য দিয়ে সাজানো গ্যাং ছিল তার হাতিয়ার। যেসব পুলিশ অফিসার তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করতো, তাদের খুন করতে বেশ কয়েকজন হিট ম্যানকে মিলিয়ন ডলার দিয়ে ভাড়া করে এসকোবার। তার সময়ে কলম্বিয়ায় অপরাধের হার নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। ‘দ্য কিং অফ কোকেইন’ খ্যাত এই মাদক ব্যবসায়ী পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী অপরাধী ছিল। ১৯৪৯ সালে জন্মগ্রহণ করা পাবলো এসকোবার ১৯৯৩ সালে ৪৪ বছর বয়সে কলম্বিয়ার ন্যাশনাল পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
গ্রিসেল্ডা ব্লাংকো
‘কোকেইন গডমাদার’ হিসেবে বহুল পরিচিত গ্রিসেল্ডা ব্লাংকো মায়ামির কোকেইন সাম্রাজ্যের অন্যতম অগ্রদূত। শৈশব থেকে বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত পকেটকাটা আর পতিতাবৃত্তিই ছিল তার প্রধান পেশা। ফেডারেল ড্রাগ ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে অভিযুক্ত করা হয় এবং ১০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। গোপন সহচরদের সহায়তায় জেলে বসেও দিব্যি তার কোকেইন ব্যবসা চালিয়ে যায় ব্লাংকো। ‘লা মাদ্রিনা’, ‘দ্য ব্ল্যাক উইডো’, ‘কুইন অফ নারকো-ট্র্যাফিকিং’ এমন আরও অজস্র নামে পরিচিত এই গ্যাংস্টার। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ এর দশকে মায়ামির আন্ডারওয়ার্ল্ডের প্রায় পুরোটাই তার দখলে ছিল। কলম্বিয়া থেকে শুরু করে নিউ ইয়র্ক, মায়ামি আর সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার প্রায় ২০০ খুনের সাথে জড়িত সন্দেহে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০২ সালের জুন মাসে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে কারাগারেই মৃত্যুবরণ করে ৫৬ বছর বয়সী এই মাফিয়া নারী।
আল কাপোনে
আলফোনসে গ্যাব্রিয়েল আল কাপোনে গ্যাংস্টারদের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র যিনি তার সারাজীবন অতিবাহিত করেছেন মদ চোরাচালান এবং পতিতাবৃত্তির ব্যবসায়। খুব অল্প বয়সে ‘শিকাগো আউটফিট’ নামে নিউ ইয়র্কের একটি কুখ্যাত গ্যাং এর প্রতিষ্ঠাতা এই গ্যাংস্টার ‘স্কারফেস’ নামেই বেশি পরিচিত। নির্বিঘ্নে নিজের অবৈধ অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে শহরের মেয়র থেকে শুরু করে পুলিশ পর্যন্ত সবাইকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে হাত করে ফেলেছিল কাপোনে। সমাজসেবামূলক কাজে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে ‘আধুনিক যুগের রবিনহুড’ খেতাবও জুটেছিল তার। কিন্তু কয়েকটি ক্রাইম সিন্ডিকেটের মধ্যকার সংঘর্ষে সাতজন নিরীহ ব্যক্তি নিহত হলে তাকে ‘এক নম্বর গণশত্রু’ আখ্যা দিয়ে আটক করে পুলিশ। ক্রাইম বস হিসেবে ৭ বছর দাপটের সাথে পৃথিবী কাঁপানো আলোচিত-সমালোচিত এই গ্যাংস্টার আলকাতরাজ কারাগারে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ৩৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
লাকি লুসিয়ানো
চার্লস ‘লাকি’ লুসিয়ানো আমেরিকান-ইটালিয়ান একজন গ্যাংস্টার যাকে আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের জনক বলা হয়। দেশটিতে পাঁচটি মাফিয়া পরিবারের জন্ম দেয়ার পিছনে মূল হোতা ছিল লুসিয়ানো একাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম কমিশনপ্রাপ্ত এই ব্যক্তি জেনোভিজ ক্রাইম ফ্যামিলির প্রধান ছিল। জাতীয় অপরাধ সিন্ডিকেটের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দেশ জুড়ে এখনো তাকে স্মরণ করা হয়। ১৯৩৬ সালে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর বাধ্যতামূলক পতিতাবৃত্তির দায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে জেলা অ্যাটর্নি থমাস ই. ডিউই। অপরাধ প্রমাণের পর ৩০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয় লুসিয়ানোকে। কিন্তু ইতোমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ একটি চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে একটি জায়গায় দ্বীপান্তরিত করা হয় তাকে।
এনোক জনসন
এনোক লুইস নাকি জনসন নিউ জার্সির আটলান্টিক সিটির রাজনৈতিক নেতা ও আটলান্টিক কাউন্টির শেরিফ, ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল। প্রজাতান্ত্রিক মেক্সিকান কমিটির আটলান্টিক কাউন্টির শেরিফ হওয়ার পর থেকেই তার ক্ষমতা বাড়তে থাকে। ১৯১০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪১ সালে আটক হওয়ার আগ পর্যন্ত আটলান্টিক সিটির রাজনৈতিক যন্ত্রের পুরোপুরি অপব্যবহার করে এনোক জনসন। তার একটি ব্যক্তিগত সংস্থা ছিল যাদের প্রধান কাজ ছিল জুয়া এবং পতিতাবৃত্তিতে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস ইন্ডাস্ট্রির অ্যাডভোকেট জনসন ‘জয় করতেই জন্মেছিল’ বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আটলান্টিক সিটির সংবাদ সংস্থা।
ফ্র্যাংক কস্টেলো
ফ্র্যাংক কস্টেলো যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ একজন গ্যাংস্টার। আমেরিকান-ইটালিয়ান এই মাফিয়া ‘প্রাইম মিনিস্টার’ বা ‘প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে সুপরিচিত। বিশেষত নিউ ইয়র্কে তার দৌরাত্ম্য এতটাই বেশি ছিল যে জনপ্রিয় সব মব গ্রুপ পরিচালনা করতে একটুও বেগ পেতে হয়নি তাকে। কুখ্যাত ‘মরেলো গ্যাং’-এর হয়ে কাজ করার সময়ই ম্যানহাটনে একাধিক মাফিয়া দলের সাথে যোগ দেয় কস্টেলো। কস্টেলো আর লুসিয়ানো মিলে সিসিলিয়ান মাফিয়া পরিবার গড়ে তোলে। তাদের যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠে রাম প্রস্তুতকারক বিভিন্ন অবৈধ প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম দুর্ধর্ষ গ্যাংস্টার হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে কস্টেলো।
কার্লো গ্যাম্বিনো
সিসিলিয়ান মবস্টার ডন কার্লো গ্যাম্বিনো ছিল গ্যাম্বিনো ক্রাইম ফ্যামিলির প্রধান। ১৯৫৭ সালে আমেরিকান মাফিয়া কমিশনের হাল ধরে গ্যাম্বিনো। এটি একটি ইটালিয়ান-আমেরিকান অপরাধচক্র ছিল যা অনেকটা সিসিলিয়ান মাফিয়ার মতো কাজ করতো। গত শতকের ষাটের দশকে অ্যানাস্টেসিয়ার বিশ্বস্ত লোকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গ্যাম্বিনো এবং ধীরে ধীরে দখল করে নেয় যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বন্দর। নিউ ইয়র্কের প্রায় ৯০% বন্দর তার দখলে ছিল এবং এগুলো থেকে প্রাপ্ত অর্থ অচিরেই তাকে মিলিয়নিয়ার বানিয়ে দেয়। সে সময়ে ম্যানহাটনে গ্যাম্বিনো ক্রাইম ফ্যামিলি সবচেয়ে ক্ষমতাবান ছিল। ৭৪ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচে এই গ্যাংস্টার। মারিও পুজোর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য গডফাদার’ কার্লো গ্যাম্বিনোর জীবনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা হয়েছে বলে মনে করা হয়।
জেমস বার্ক
‘দ্য আইরিশম্যান’ নামে খ্যাত আইরিশ আমেরিকান গ্যাংস্টার জেমস বার্ক লুচিস ক্রাইম পরিবারের প্রধান ছিল। গত শতকের সত্তরের দশকে তার রাজত্ব চলতো। সে সময়ে একাধিক ব্যক্তিকে নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয় সে। ১৯৭৮ সালে জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঘটে যাওয়া বিখ্যাত সেই ডাকাতির পিছনে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে জেমস ছিল বলে ধারণা করা হয়। এই এক ডাকাতির ঘটনা তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় দুই মিলিয়ন ডলার জমা করে। ১৯৯০ সালে রবার্ট ডি নিরোর সিনেমা ‘গুডফেলাস’ এর ‘জিমি দ্য জেন্ট কনওয়ে’ চরিত্রটি জেমসকে অনুসরণ করেই নির্মিত হয়।
দাউদ ইব্রাহিম
দাউদ ইব্রাহিম কাসকার তার বিশ্বখ্যাত সিন্ডিকেট ‘ডি কোম্পানির’ জন্য বিশেষভাবে আলোচিত-সমালোচিত। সাধারণ জনগণের কাছে দাউদ ইব্রাহিম নামেই অধিক পরিচিত ভারতের মুম্বাইয়ের এই গ্যাংস্টার। ২০১১ সালে ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীদের তালিকায় প্রথম স্থান দখল করে দাউদ ইব্রাহিম। ভারতীয় পুলিশও হন্যে হয়ে খুঁজছে তাকে। ডংরি থেকে দুবাই কাঁপিয়ে বেড়ানো এই গ্যাংস্টারের দলে প্রায় পাঁচ হাজার সদস্য রয়েছে যারা খুন, অপহরণ, মাদক চোরাচালান সহ যাবতীয় অরাজকতার সাথে জড়িত। ১৯৯৩ সালে ১২ মার্চ মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জে এক সিরিজ বোমা বিস্ফোরণে প্রায় ৩১৫ জন লোক নিহত হয়। ডান হাত ছোটা শাকিলকে সাথে নিয়ে ভারত, পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে দাউদ ইব্রাহিম।
ফিচার ইমেজঃ twimg.com