প্রাচীন যে কয়েকটি সভ্যতা নিয়ে মানুষের আগ্রহ তুঙ্গে, রোম সেগুলোর মাঝে শীর্ষস্থানীয়। তাদের কোন কোন বিষয়ে মানুষের আগ্রহ সেটা জিজ্ঞেস না করে বরং তাদের কোন বিষয়ে মানুষের আগ্রহ নেই সেটা জিজ্ঞেস করাই অধিক যুক্তিযুক্ত!
রোর বাংলায় আমরা নিয়মিতই ইতিহাসের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করে থাকি। এরই ধারাবাহিকতায় আজ আলোচনা করা হবে প্রাচীন রোমের নারীদের জীবনযাত্রার নানা দিক নিয়ে, যা হয়তো এতদিন আপনাদের অজানাই ছিলো।
১. সন্তানকে স্তন্যদান
সন্তান জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ খাবে- সেটাই স্বাভাবিক। তবে প্রাচীন রোমে এই বিষয়টি অর্থবিত্তের উপর নির্ভরশীল ছিলো। ধনী নারীরা সাধারণত জন্মের পর আপন সন্তানকে স্তন্যদান করতে চাইতেন না, বরঞ্চ তারা বিষয়টি ছেড়ে দিতেন একজন ধাত্রীর উপর। সাধারণত একজন ক্রীতদাসী কিংবা ভাড়ায় কাজ করা স্বাধীন নারীরাই চুক্তিভিত্তিক এ কাজটি করে থাকতেন।
গ্রিক চিকিৎসক সোরানাস ২য় শতকে গাইনিওকোলজির উপর বেশ জনপ্রিয় একটি বই লিখেছিলেন। সেখানে তিনি ধাত্রী নিয়োগের বিষয়টিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন এই যুক্তিতে যে, সন্তান জন্মের সময় একজন মাকে বেশ শারীরিক ধকলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাই জন্মের পর পর একজন শিশুকে ধাত্রীর বুকের দুধ পান করতে দেয়া যেতেই পারে। তবে সেই সাথে তিনি এটাও পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, সেই সন্তানকে যেন ছ’মাস বয়স থেকে বিভিন্ন শক্ত খাবার, যেমন- ওয়াইনে ভেজানো পাউরুটি খাওয়ানো শুরু করে দেয়া হয়।
অবশ্য তৎকালীন রোমান চিকিৎসক ও দার্শনিকগণ মায়েদেরকে নিজ বুকের দুধই সন্তানকে পান করাতে উপদেশ দিতেন। কারণ, তারা মনে করতেন, একজন ধাত্রী মা যখন একটি বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করান, তখন তিনি এর সাথে তার ক্রীতদাসসুলভ বিভিন্ন দোষ-ত্রুটিও সেই সন্তানের চরিত্রের মাঝে সঞ্চারিত করতে পারেন। অন্যদিকে আপন মায়ের দুধ সন্তানের স্বাস্থ্য ও নৈতিক চরিত্র- দুয়ের জন্যই মঙ্গলজনক।
সেই সাথে এ ধরনের মায়েদের ভর্তসনা করে তারা বলতেন, এ মায়েরা আসলে অলস, তাদের মা হওয়াই বৃথা এবং অপ্রকৃতস্থ এ মায়েরা কেবলমাত্র তাদের দৈহিক সৌষ্ঠব নিয়েই চিন্তিত, আপন সন্তানদেরকে নিয়ে নয়।
২. কন্যাশিশুর বিয়ে
নারীদের থেকে এবার নজর ফেরানো যাক রোমান মেয়েদের দিকে। একটি রোমান কন্যাশিশুর শৈশবের ইতি ঘটতো মাত্র ১২ বছর বয়সেই। কারণ প্রাচীন রোমে আইন করে দেয়া ছিলো যে, ১২ বছর হওয়া যেকোনো মেয়েই বিয়ের উপযুক্ত হিসেবে গণ্য হবে। আর বিয়ের আগে তাকে শৈশবের সকল স্মৃতিই পরিত্যাগ করে আসতে হতো, এমনকি যে পুতুলটা কিছুদিন আগেও তার খেলার সাথী ছিলো সেটাকেও।
বিয়ের বয়সে পৌঁছানোর আগে যদি কোনো মেয়ে মারা যেত, তবে তাকে তার সেই খেলনাসহই কবর দেয়ার প্রথাও দেখা গিয়েছে। উনিশ শতকের শেষের দিকে একটি সার্কোফ্যাগাসের সন্ধান পাওয়া যায়, যা ছিল ক্রিপেরেইয়া ট্রাইফিনা নামক এক মেয়ের। আনুমানিক ২য় শতকে রোমের অধিবাসী ছিল সে। তার সাথে আরো যেসব জিনিস কবরে ঠাই পেয়েছিলো, সেখানে হাতির দাঁতের তৈরি একটি পুতুলও ছিলো। আজকের দিনের বাচ্চা মেয়েদের খেলার সাধারণ পুতুলের মতো সেই পুতুলটিরও হাত-পা নাড়ানো যেত। এমনকি এর সাথে আরেকটি বাক্সে কিছু ছোট ছোট কাপড়চোপড় ও অলঙ্কারও ছিলো, যা পুতুলটিকে সাজানোর জন্য ব্যবহার করা হতো।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, পুতুলটি একটি বাচ্চা মেয়ের হলেও এর দেহাবয়ব ছিলো একজন নারীর, যে কি না সন্তান ধারণে সক্ষম। একজন মা হিসেবেই রোমান নারীরা যে তাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ- পুতুলটির দেহাবয়ব সেদিকেই ইঙ্গিত করে।
৩. স্বামী-স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি
বিয়ে আমাদের কাছে এমন একটি সম্পর্ক যা আমরা টিকিয়ে রাখতে চাই আজীবন, যে সম্পর্কের প্রতি আমাদের আবেগ অন্য সকল সম্পর্কের থেকে আলাদা। যদিও আধুনিকতার দোহাই দিয়ে আমাদের সমাজে ধীরে ধীরে বিবাহ বিচ্ছেদের হার দিনকে দিন বেড়ে চলেছে, তারপরও পাশ্চাত্য সভ্যতার দেশগুলো থেকে আমরা যে এখনও শত-সহস্র গুণ ভালো আছি, তা না বললেও বোধহয় চলে।
প্রাচীন রোমের ব্যাপারটা অবশ্য আমাদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। তৎকালীন রোমে স্বামী-স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়াটা ছিলো খুবই সাধারণ ও সহজ একটি ঘটনা। দুটি পরিবারের মাঝে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ়তর করতেই মূলত বিয়ে নামক বন্ধনের দ্বারস্থ হতো তারা। কিন্তু যদি একপক্ষ মনে করতো অপরপক্ষের কাছ থেকে সে আর লাভবান হতে পারছে না, তাহলে খুব অল্প সময়ের নোটিশেই তারা আলাদা হয়ে যেত।
আজকের দুনিয়ার মতো এ বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য তাদেরকে কোনো আইনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েও যাওয়া লাগতো না। যদি স্বামী, কিংবা খুব দুর্লভ ক্ষেত্রেও স্ত্রী, মনে করতো তাদের আর একসাথে পোষাচ্ছে না, তাহলেই বলা চলে সেই বন্ধনের ইতি ঘটতো। এমনকি, চাইলে মেয়ের বাবাও তার মেয়ের পক্ষ নিয়ে এই বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর করতে পারতেন। কারণ প্রাচীন রোমে আইন মোতাবেক বিবাহিত মেয়ের উপর আইনী অভিভাবকত্ব তার বাবারও থাকতো। আরো মজার বিষয় হলো, এই আইনের মাধ্যমে চাইলে মেয়ের পরিবার বিয়ের সময় ছেলের পরিবারকে দেয়া যৌতুকও ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানাতে পারতো। তবে কোনো কোনো স্বামী আবার আইনের ফাঁকফোকর খুঁজে সেই যৌতুক নিজের কাছে রেখে দেয়ারও ব্যবস্থা করতো। তেমনই একটি উপায় ছিলো নিজের স্ত্রীকে চরিত্রহীনার অপবাদ দেয়া।
বিবাহ বিচ্ছেদের বেলায় রোমান আইন নারীদের পরিবর্তে পুরোপুরি পুরুষদের পক্ষ নিয়েই কথা বলতো। এজন্য অনেক নারীকেই এই পথ বেছে নিতে নিরুৎসাহিত করা হতো। ছেলে-মেয়েদের পুরো অধিকারও থাকতো একজন বাবার হাতেই, একজন মা সেখানে কোনো দাবিই জানাতে পারতেন না। তবে কখনো কখনো একজন বাবা যদি মনে করতেন যে, বিচ্ছেদের পর তার ছেলে-মেয়েরা মায়ের কাছেই বেশি ভালো থাকবে, তবে তিনি চাইলে সেই ব্যবস্থাও করতে পারতেন।
৪. রুপচর্চা
নারীদের সৌন্দর্যচর্চার বিষয়টি চলে আসছে সেই আদিকাল থেকে। প্রাচীন রোমান নারীরাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তারা এটা নিয়ে বেশ চাপের মাঝেও থাকতেন। কারণ একজন নারীর সৌন্দর্যের সাথে তার স্বামীর মর্যাদার বিষয়টিও জড়িত ছিলো। ফলে তাদের রুপচর্চার জন্য বেশ ভালো একটা মার্কেটও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তখন। তেমনই কিছু রুপচর্চার উপাদান সম্পর্কে চলুন জেনে নেয়া যাক:
- মুখের দাগ নিরসনের জন্য মুরগির চর্বি ও পেঁয়াজ।
- মৃত চামড়া তুলে ফেলার জন্য শামুকের খোলস চূর্ণ।
- বয়সের সাথে সাথে পেকে যাওয়া চুল ঢাকতে কেঁচো পিষে এর সাথে তেল মিশিয়ে নেয়া হতো।
- কিছু কিছু লেখক গালে লালচে রঙের আভা আনতে কুমিরের মল ব্যবহারের কথাও জানিয়েছেন।
৫. নারীশিক্ষা
শৈশব, বিয়ে, রুপচর্চা, তালাক- সবকিছু নিয়েই তো কথা হলো। সবার শেষে চলুন জানা যাক প্রাচীন রোমে নারীদের শিক্ষাদীক্ষার অবস্থা নিয়েই।
প্রাচীন রোমান সমাজে নারীশিক্ষা নিয়ে বিতর্কের অন্ত ছিলো না। লেখাপড়ার প্রাথমিক পাঠটুকু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত অধিকাংশ রোমান নারীই সম্পন্ন করতো। তবে উচ্চবিত্তরা আরো এগিয়ে নিতো বিষয়টিকে। কখনো কখনো গৃহশিক্ষক রেখে তারা ঘরের মেয়েদেরকে আরো উন্নত ব্যাকরণ-বিদ্যা কিংবা গ্রিক ভাষায় শিক্ষিত করে তুলতো।
তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই পড়ালেখা কিন্তু একজন নারী নিজেকে কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত করার জন্য শিখতেন না। বরঞ্চ নিজের সংসার আরো ভালো করে চালানো এবং স্বামীর যোগ্যতর সঙ্গী হয়ে ওঠার অভিপ্রায়েই তারা এসব শিখতেন।
তবে সবার কাছে নারীদের এই পড়ালেখার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য ছিলো না। অনেক রোমান নাগরিকই মনে করতেন, অতিরিক্ত পড়ালেখা একজন নারীকে দাম্ভিক করে তোলে, তাকে অবাধ যৌনতার দিকে ধাবিত করে। অবশ্য উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত পরিবারের লোকেরা এসব জনমতের ধার ধারতো না। তারা ঠিকই তাদের ঘরের মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যেত। এর এক বড় উদাহরণ হয়ে আছেন হর্টেনসিয়া। সমসাময়িক কালের একজন বিখ্যাত বক্তা ছিলেন তিনি, যা তখনকার দিনে কেবলমাত্র পুরুষদেরই একচ্ছত্র অধিকার বলে ধরে নেয়া হতো। ৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান ফোরামে বক্তার মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি রোমের ধনী নারীদের উপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ-কর ব্যবস্থার সরাসরি সমালোচনা করেন।
ফিচার ইমেজ: fatosdesconhecidos.com.br