স্ফটিক করোটি নিয়ে লেখার প্রথম পর্ব পড়ুন এখানে। প্রত্নতাত্ত্বিক মিচেল হেজেসের আবিস্কৃত স্ফটিক করোটি সহ আরও নানাভাবে আবিস্কৃত স্ফটিক করোটি নিয়ে একসময় পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক হৈচৈ পড়ে যায়। মানুষের মনে তৈরি হতে থাকে নানা কৌতুহল। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, গবেষকদের মধ্যেও বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের এক অদ্ভুত মায়াজাল তৈরি হতে থাকে।
এই স্ফটিক করোটিগুলোর ক্ষমতা সম্পর্কে এক পক্ষের অভিমত হচ্ছে, এই করোটি নাকি মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আরেক পক্ষ তা মানতে নারাজ। তাদের মতামত, মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা একটি করোটির থাকা অবাস্তব ভাবনা ছাড়া কিছুই নয়। তবে সম্মোহনী কোনো ব্যাপার নাকি করোটির মধ্যে থাকলেও থাকতে পারে।
আবার অনেকের মতে, এই করোটি অভিশপ্ত। অভিশাপের বিষয়টির চাক্ষুস প্রমাণ হিসেবে অনেকে দেখেন হেজেসের জীবনের নানা ঘটনাকে। এই করোটি আবিস্কৃত হওয়ার পর থেকেই কাকতালীয়ভাবে হেজেসের জীবনে ঘটতে থাকে একের পর এক দুর্ঘটনা। তিনবার ছুরিকাহত ও আটবার গুলিবিদ্ধ হন হেজেস। আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও বারবার ফিরে এসেছেন তিনি মৃত্যুর দুয়ার থেকে। কিন্তু তারপরও এই স্ফটিক করোটির বিষয়ে ত্রিশ বছর ধরে হেজেস নিজেকে নানাভাবে ব্যস্ত রেখেছেন। বাইরের কাউকে তিনি এই করোটি দেখাতে চাইতেন না।
১৯৪৯ সালের ১২ জুন হেজেস মারা গেলে তিনি তার পালিত কন্যা অ্যানার নামে স্ফটিক করোটি উইল করে যান। করোটি অ্যানার কাছে হস্তগত হওয়ার পর থেকেই এর আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পর্কে অ্যানা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করতে থাকেন। ফলে প্রচারের আলোয় চলে আসেন অ্যানা।
অ্যানা একশ বছর বেঁচে ছিলেন। এজন্য অ্যানা তার স্ফটিক করোটির আধ্যাত্মিক শক্তির কথাই প্রতিনিয়ত বলে গেছেন। তার মতে, এই করোটির এক ধরনের ঐশ্বরিক ক্ষমতা রয়েছে যা মানুষকে দীর্ঘজীবন দান করে। এই করোটির সামনে দীর্ঘসময় একাগ্রচিত্তে বসে থাকলে নাকি করোটি ঐ ব্যক্তির মধ্যে এক ঐশ্বরিক শক্তি প্রদান করে, যা ঐ ব্যক্তির জীবনকে দীর্ঘায়িত করে। আর এই করোটির প্রভাবেই অ্যানা নিজেকে সুস্থ ও সুখী ভাবতেন।
আরেক পক্ষের মতে, এই করোটির সাথে দীর্ঘসময় অতিবাহিত করা গেলে জীবন আনন্দময় হয়ে উঠে। অনেকে নাকি করোটি থেকে একধরনের রশ্মি বিকরিত হতে দেখেছে, আবার অনেকে একাকি করোটির সাথে সময় কাটানোর সময় করোটি থেকে গানের সুর ভেসে আসে বলে জানান। অনেকে আবার বলেন, করোটির দিকে একাগ্র চিত্তে তাকিয়ে থাকলে এই করোটি মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের নানা ঘটনা, প্রথা ও নানা ইতিহাস চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলে।
‘Mysteries of the Crystal Skulls Revealed’ এর লেখক জশুয়া শাপিরোর অভিমত হচ্ছে, এই করোটি আসলে এক ধরনের কম্পিউটার, যা বিভিন্ন ঘটনা এবং দৃশ্য সংরক্ষণ করে রাখে। অর্থাৎ তার মতে, করোটির মাঝে পৃথিবীর ইতিহাস সংরক্ষণ করা আছে! সৃষ্টির আদি রহস্য, মহাজাগতিক এই ভূখণ্ডের নানা উত্থান, পতন, পৃথিবীর ধ্বংস ও সৃষ্টির এক অনন্তকালীন ইতিহাস নাকি চিত্রায়িত করা আছে করোটির মধ্যে। সেসময় এসব দাবিকে স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশ প্রত্নতাত্বিক এবং বিজ্ঞানী হেসেই উড়িয়ে দেন।
তবে করোটি নিয়ে নানা মুনির দেয়া নানা তথ্যের কোনো বাস্তব ভিত্তি কখনোই প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। এই কিংবদন্তীগুলো অ্যাজটেক সভ্যতা থেকে উৎসারিত বলে বিভিন্ন তাত্ত্বিকদের অভিমত।
ক্রিস্টাল করোটি নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর তখনও সমাধান হয়নি। করোটিটি সত্যিই কি মায়ানদের, নাকি প্রচার পাওয়ার আশায় হেজেস ও তার দলের কোনো সুচতুর কারসাজি আর পুরোটাই মানুষকে ধাপ্পাবাজি দেয়ার উদ্দেশ্য রচিত কাহিনী; সেটাই ছিল মূল প্রশ্ন।
গবেষকরা বরাবরই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেছেন অ্যানার এই করোটিকে। কারণ, মায়ানরা স্ফটিকের ব্যবহার জানতো, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর এই স্ফটিককে এত সূক্ষ্মভাবে শিল্পে পরিণত করার কোনো ধাতব যন্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে মায়ানদের অভিজ্ঞতা ছিল, সেরকম তথ্য-প্রমাণও পাওয়া যায় না। ফলে সন্দেহের দানা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকায় করোটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। ১৯৭০ সালে অ্যানার স্ফটিক করোটিটি আর্ট রিস্টোরার ফ্রাঙ্ক ডোরলান্ডের কাছে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। সেসময় প্রচলিত পদ্ধতিতে ক্রিস্টাল পাথরের বয়স বের করার কোনো উপায় ছিল না। করোটির বয়স বের করা দুঃসাধ্য ছিল। কারণ, প্রকৃতিতে যে পাথুরে স্ফটিক পাওয়া যায় তাতে কার্বনের কোনো অংশ নেই। ফলে কার্বন টেস্ট করে স্ফটিক খণ্ডটির বয়স জানবার কোনো উপায় নেই। ডোরলান্ড অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও করোটির বয়স সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে সক্ষম হননি। পরবর্তীতে, ডোরলান্ড এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বালি এবং দক্ষ কারিগরের সহায়তায় নিঁখুতভাবে তৈরি করা হয়েছে করোটিটি।
পরবর্তীতে এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় হিউলেট প্যাকার্ড ল্যাবরেটরিকে। তাদের দীর্ঘ গবেষণার পর ল্যাবরেটরির দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞরা এই অভিমত দেন যে, কমপক্ষে তিনশ বছরের দক্ষ কারিগরের সহায়তায় এমন পাথর তৈরি করা সম্ভব। মূলত বিশাল একখণ্ড স্ফটিক থেকে হাত দিয়ে ঘষে বালু ও জলের সাহায্যে এমন নিখুঁত করোটি তৈরি করা হয়েছে। এমন নিঁখুতভাবে তৈরি এই ক্রিস্টাল বিশ্বে সত্যিই বিরল। ক্রিস্টাল পাথরের মূল্যমান ঠিক হীরার পরেই। এমন নিখুঁত ক্রিস্টাল তৈরির জন্য কয়েক শতাব্দী ধরে প্রচুর সময় ও পরিশ্রম দরকার। দক্ষ শিল্পীর হাতের ছোঁয়া ভিন্ন এমন নির্মাণ কিছুতেই সম্ভব নয় বলে তাদের মতামত। ফলে তখনকার প্রযুক্তিতে অ্যানার দাবিকে নস্যাৎ করার মতো কিছু পাওয়া যায়নি।
করোটি এবং এর নিচের চোয়ালে এমনি নিঁখুতভাবে কারুকার্য করা কীভাবে সম্ভব তার সঠিক কোনো উত্তর কোনভাবেই পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে সমাধান পাবার পরিবর্তে আরো নানা প্রশ্ন ঘনীভূত হতে লাগলো করোটি বিষয়ে। বয়স, উৎপত্তি এবং এর ভূমিকা নিয়ে প্রচলিত মতবাদ নিয়ে বিভ্রান্তি বাড়তে থাকে।
বিজ্ঞানীরা হিউলেট-প্যাকার্ডের দেয়া ব্যাখ্যা গ্রহণ করেনি। কিছু বিজ্ঞানী এই কোয়ার্টজ ক্রিস্টালে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবাহিত করে দেখেন যে, এটি বৈদ্যুতিক প্রভাবের কারণে চার্জিত হয় এবং একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় বৈদ্যুতিক শক্তি ধরে রাখতে সক্ষম। ফলে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় এটির তরঙ্গায়িত হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।
আবার, আরেক ফরেনসিক গবেষণায় দেখা যায়, এই করোটির গঠনের সাথে সাধারণ মানুষের করোটির কোনো মিল পাওয়া যায় না, বরং ককেশিয়ান নারীদের করোটির সাথে এর মিল রয়েছে। তাই অনেকের অভিমত, বিংশ শতকে ইউরোপে এ ধরনের জাল খুলি তৈরি হয়েছে।
এরপর ২০০৭ সালে অ্যানার মৃত্যু হয়। ফলে করোটি হস্তগত হয় অ্যানার স্বামী বিল হল ম্যানের কাছে। বিলও যথারীতি করোটির অলৌকিক ক্ষমতা প্রচার করতে থাকে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে হেজেসের এই স্ফটিক করোটি সহ সেসময় আবিস্কৃত আরো বেশ কয়েকটি করোটির ওপর পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য হতে দেখা যায়, করোটিগুলো আসলে খুব একটা পুরনো নয়। করোটিগুলো তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিলো আধুনিক পাথর খোদাইয়ের যন্ত্র। ধারণা করা হয়, আনুমানিক ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে শেষ দিকের কোনো এক সময়ে এগুলো তৈরি করা হয়েছিলো। কিন্তু কার্বনের উপস্থিতি না থাকায় এদের সঠিক বয়স বের করার কোনো উপায় নেই। আর স্ফটিকগুলো কোনো মায়ান শাসিত অঞ্চল থেকে আসেনি, এসেছে হয় আফ্রিকার মাদাগাস্কার না হয় ব্রাজিল থেকে।
আর এভাবে বিগত শতকের এক অজানা ও অদ্ভুত রহস্যের সমাধান হয়। কিছু মানুষের অর্থের লোভ, বিশ্ববাসীর কাছে প্রচার পাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হয় এমন ঘৃণ্য এক ষড়যন্ত্র। সাধারণ মানুষের অতিপ্রাকৃতিক অন্ধ বিশ্বাসের সুযোগ নেয় নিজেদের প্রত্নতাত্ত্বিক বলে পরিচয় দেওয়া এই মানুষেরা।
বর্তমানে হেজেসের স্ফটিক করোটিটি রাখা আছে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। আর বাকিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের নানা সংগ্রহশালায়।
কিন্তু এত কিছুর পরও এই আধুনিক যুগে এসেও স্ফটিক করোটিগুলো নিয়ে অনেক মানুষের অন্ধ বিশ্বাসের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সাধারণ মানুষ এখনও প্রবলভাবে বিশ্বাস করে থাকে এসব করোটির আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পর্কে। তাই হেজেসের করোটি দেখার জন্য ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রতিনিয়ত ভিড় জমে ভক্তদের। আর এখনো মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য আধুনিক যুগের অনেক জ্যোতিষী নামধারী ক্রিস্টালের বল ব্যবহার করে মানুষের ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকেন।
প্রথম পর্ব: স্ফটিক করোটি: মায়া সভ্যতার এক অপার রহস্য (১ম পর্ব)