৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২; প্রথমবারের মতো জাপানী বিমান হামলার শিকার হলো আমেরিকার মূলভূমি। যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন স্টেট ফরেস্টে একটি ইন্সেন্ডিয়ারি বোমা ফেলে পালিয়েছে পাইলট নবুউ ফুজিটার উভচর বিমান। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে দমকল বিভাগ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এই ঘটনাটি চেপে যেতে ‘নিউজ ব্ল্যাকআউট‘ এর নির্দেশ দেন। ফলে মার্কিন জনগণ জানতেই পারেনি যে সেদিনের দাবানল আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের দেশে হওয়া প্রথম এবং একমাত্র জাপানি বিমান হামলার কথা। কিন্তু সাগরে এত কঠোর প্রহরা থাকার পরও হামলাটি কীভাবে হলো? জাপানি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার কিভাবে মার্কিন উপকূলে আসলো? মার্কিন সমরবিশারদরা বুঝলেন, সাবমেরিন থেকে পাঠানো উভচর বিমান দিয়ে এই হামলা করা হয়েছে। এ ধরনের বিমান পানিতে ল্যান্ড করতে সক্ষম। কিন্তু নবুউ ফুজিটার ‘আই-২৫’ নামক সাবমেরিনটি একটি সাধারণ জলযান। যুক্তরাষ্ট্রের মূলভূমিতে হামলা করতে হয় এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নিয়ে যেতে হবে, নয়তো বিশেষ ধরনের বিমানবাহী সাবমেরিন নির্মাণ করতে হবে। দ্বিতীয় আইডিয়াটি এগিয়ে নিয়ে আসেন জাপানি নৌবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোতো।
পার্ল হারবার আক্রমণের পরপরই যুদ্ধকে যত দ্রুত সম্ভব যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে যাওয়ার যাওয়ার চিন্তা করে জাপান। তাদের এই হামলার জবাবে মার্কিনীদের ডুলিটল রেইড নামক অপারেশনে ততক্ষণে জাপানের মূল ভূখণ্ডে একবার হামলা হয়ে গেছে। কিন্তু জাপানি বোমারু বিমান নিয়ে এতদূর যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র-জাপানের বিশাল দূরত্বের ঠিক মাঝে থাকা মিডওয়ে দ্বীপের বিমানঘাঁটি দখলের চেষ্টা করে জাপানিরা ব্যর্থ হয়। ইয়ামামোতো হিসাব করে দেখলেন যে, মার্কিনীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে হামলা করা সম্ভব নয়। একই কারণে তাদের মিত্র জার্মানি-ইতালি আটলান্টিক অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে হামলা করতে পারবে না। তাই তিনি এমন এক বিশেষ সাবমেরিনের ধারণা নিয়ে আসেন যা কোনোপ্রকার রিফুয়েলিং (মাঝসাগরে জাহাজ থেকে জ্বালানী সরবরাহ) ছাড়াই জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে তিনবার যাওয়া-আসা করতে পারবে। অথবা একবার রিফুয়েলিং করে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যেতে পারবে। অর্থাৎ ইয়ামামোতোর পরিকল্পনা ছিল প্রশান্ত মহাসাগর-আটলান্টিক অতিক্রম তথা অর্ধেক পৃথিবী পাড়ি দিয়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে হামলা করা!
তিনি ১৯৪২ সালের শুরুতে এধরণের ১৮টি সাবমেরিন বানানোর প্রস্তাব নেভাল হেডকোয়ার্টারে পাঠান। এর নামকরণ করা হয় Sentoku type submarine (潜特型潜水艦-Sen-Toku-gata sensuikan) বা স্পেশাল সাবমেরিন। ডিজাইন চূড়ান্ত হওয়ার পরের বছরের জানুয়ারিতে প্রথম সাবমেরিন আই-৪০০ এর নির্মাণ শুরু হয়। এই প্রজেক্টে জার্মান ইঞ্জিনিয়ার ও তাদের ইউবোট সাবমেরিন নির্মাণ কৌশলের সাহায্য নেয়া হয়। কয়েক মাসের মধ্যে আরো তিনটি সাবমেরিন বানানোর কাজ শুরু হয়। কিন্তু মার্কিন নৌবাহিনীর পরিচালিত গোপন মিশনে এডমিরাল ইয়ামামোতো নিহত হওয়ায় এবং সাবমেরিন নির্মাণে প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে এই প্রজেক্ট রীতিমত মুখ থুবড়ে পড়ে। ১৮ থেকে কমতে কমতে শেষ পর্যন্ত বাজেট স্বল্পতা ও যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার কারণে মাত্র তিনটি সাবমেরিনের নির্মাণকাজ শেষ হয়। এর মধ্যে আই-৪০০ এবং আই-৪০১ সাবমেরিন নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়। আই-৪০২ সাবমেরিনটি ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ায় মাত্র পাঁচ সপ্তাহ আগে নির্মাণ শেষ হওয়ায় যুদ্ধে কোনো কাজে আসেনি। একে বাধ্য হয়ে জ্বালানী তেলবাহী ট্যাংকার জাহাজে রুপান্তর করা হয়।
ডিজাইন ও সক্ষমতা
আই-৪০০ ক্লাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সবচেয়ে বড় সাবমেরিন। এটি ছিল লম্বায় ৪০০ ফুট, চওড়ায় প্রায় ৪০ ফুট। এর ডিসপ্লেসমেন্ট ছিল ৬,৬৭০ টন। প্রতিটি সাবমেরিনে চারটি করে ২,২৫০ অশ্বক্ষমতার ডিজেল ইঞ্জিন ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব কিংবা পশ্চিম উপকূলে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত জ্বালানি বহন করত এটি। আরো ভালভাবে বললে এটি পুরো পৃথিবী ১.৫ বার চক্কর দিতে পারত একবার জ্বালানি নিয়েই! এরকম সক্ষমতার সাবমেরিন সেই সময়ে আর কোনো দেশের কাছে ছিল না।
ডিজেল ইঞ্জিনের পাশাপাশি এতে ২,১০০ অশ্বক্ষমতার দুটো ইলেকট্রিক মোটর ছিল। ফলে সাবমেরিনটি ডিজেল কিংবা ব্যাটারি – যেকোনো একটির শক্তির সাহায্যে চলতে পারতো। এছাড়া ইলেকট্রিক মোটর পানিতে তুলনামূলক কম শব্দ উৎপন্ন করে যা শত্রুর সোনারের হাতে ধরা থেকে বাঁচতে সহায়তা করত। জার্মানির তৈরি ‘ইউবোট স্নোরকেল’ থাকায় অন্যান্য সাবমেরিনের মতো একে ব্যাটারি চার্জ দেয়ার জন্য পানির উপরে আসার দরকার ছিল না। সাবমেরিনটি পানির উপরে ঘণ্টায় প্রায় ৩৫ কি.মি. এবং পানির নিচে ঘণ্টায় ১২ কি.মি. গতিতে চলতে পারতো। সাবমেরিনগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ১০০ মিটার গভীরতায় ডুব দিতে সক্ষম ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাবমেরিনগুলোর ক্রাশ ডাইভ সক্ষমতা সর্বোচ্চ ২৫০ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকত।
ইয়ামামোতোর পরিকল্পনা ছিল প্রতিটি সাবমেরিনে কমপক্ষে দুটো করে বিমান থাকবে। কিন্তু বাস্তবে এটি তিনটি করে বিমান ‘আইচি এম-৬’ উভচর বিমান নিতে সক্ষম ছিল। সাবমেরিনের ডেকের উপর ১০২ ফুট লম্বা ও ১১ ফুট চওড়ার বিশেষ এয়ারটাইট হ্যাঙ্গার টিউবে বিমানগুলোর ডানা ভাঁজ করে লুকানো থাকতো। একটি ক্যাটাপুল্ট সিস্টেমের মাধ্যমে বিমানগুলো অল্প জায়গা থেকে আকাশে উড়তে সক্ষম ছিল। প্রতিটি বিমান একটি টর্পেডো বা ৮০০ কেজি ওজনের বোমা বহন করতে পারত যা দিয়ে এক হাজার কি.মি. দূরে গিয়ে অপারেশন চালানো যেত। উভচর বিমান হওয়ায় এগুলো সাবমেরিনের নিকট এসে পানিতে অবতরণ করতো। পরবর্তীতে সাবমেরিনের ভাঁজযোগ্য বিশেষ ক্রেন দিয়ে উঠিয়ে একে আবারও এয়ারটাইট হ্যাঙ্গার টিউবে ঢোকান হতো। পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। এই জলযানে কর্মরত জাপানি পাইলট ও ক্রুদের সাবমেরিন থেকে আকাশে ওঠানামার বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাড়াতাড়ি টেকঅফ করতে বিমানগুলোতে গরম জ্বালানী তেল সরবরাহ করা হতো। তারপরও সবগুলো বিমান আকাশে ওড়াতে প্রায় ত্রিশ মিনিট লাগত। শত্রু এলাকায় এত দীর্ঘ সময় পানির উপরে ভেসে থাকা যেকোনো সাবমেরিনের জন্যই বিপদজনক।
সাবমেরিনে সব মিলিয়ে ১৪৪ জন ক্রু এর দরকার হতো। পানির নিচ থেকে হামলা করতে এতে আটটি টর্পেডো টিউব ছিল। পানির উপরে আক্রমণের জন্য একটি ১৪০ এমএম কামান ছিল যা ১৬ কি.মি. রেঞ্জে গোলাবর্ষণ করতে পারতো। আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য নয়টি ২৫ এমএম মেশিনগান ও একটি অটোক্যানন ছিল। এর রাডারের রেঞ্জ ছিল ৮০ কিলোমিটার যা তৎকালীন সময়ের সর্বোচ্চ। এছাড়া দিনে-রাতে ব্যবহারের উপযোগী জার্মানির তৈরি দুটো পেরিস্কোপ, রাডার ওয়ার্নিং সিস্টেম, ম্যাগনেটিক নেভাল মাইনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মিলিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সাবমেরিনগুলোর মধ্যে আই-৪০০ ক্লাস ছিল তুলনামূলক উন্নত।
তারপরও এর বেশ কিছু সমস্যা ছিল। সাবমেরিনের ডানে-বায়ে ঘোরানোর ‘র্যাডার’ সাবমেরিনের আকারের তুলনায় ছোট থাকায় এর ম্যানুভার সক্ষমতা কম ছিল। আবার জলযানটিকে সোজা চালাতে সাত ডিগ্রি ডান দিকে কাত করে চালাতে হতো। এছাড়া জরুরি মুহূর্তে পানির নিচে ডুব দিতে ৫৬ সেকেন্ড সময় লাগত যা মার্কিন সাবমেরিনের চেয়ে দ্বিগুণ। অন্যদিকে বিশালাকারের সাবমেরিন হওয়ায় পানির উপরে থাকাকালে রাডারে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল। তৎকালে জাপানি সাবমেরিন টেকনোলজি উন্নত হলেও সেটি ক্রুদের জন্য আরামদায়ক ছিল না। অন্যান্য সাবমেরিনের মতো এতে এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম বা ফ্লাশ টয়লেট ছিল না। ফলে পানির নিচে থাকাকালে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়া সম্ভব ছিল না। একই সঙ্গে ক্রুদের ঘুমানোর জায়গা প্রয়োজনের চেয়ে কম ছিল। অনেকেই বাধ্য হয়ে প্যাসেজওয়েতে বা গরমের কারণে ডেকের উপর ঘুমাতো।
ঘুমন্ত জাপানি নাবিকদের আলু নিক্ষেপের মজার ঘটনা পড়ুন ‘আলু মেরে সাবমেরিন ডুবিয়ে দেয়ার গল্প‘ শিরোনামের এই লেখায়।
অপারেশনাল হিস্ট্রি
একদিকে লস অ্যাঞ্জেলস, স্যান ফ্রান্সিসকো, এবং অপরদিকে নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি– দেশের দুই প্রান্তের বড় বড় আমেরিকান শহরে হামলার জন্য আই-৪০০ ক্লাস সাবমেরিন নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরে যুদ্ধের গতিপথ ঘুরে যাওয়ায় সেটি আর সম্ভব হয়নি। পরে জাপানি নেভির ক্যাপ্টেন চিকাও ইয়ামামোতো ও কমান্ডার ইয়াসেও ফুজিমারি নামের দুজন মধ্যম সারির কর্মকর্তা এডমিরাল ইয়ামামোতোর শখের সাবমেরিন দিয়ে পানামা খালের গেটলকগুলো ধ্বংস করে দেয়ার পরিকল্পনা করেন।
বলে রাখা ভাল, প্রশান্ত মহাসাগর থেকে আটলান্টিকে যেতে হলে জাহাজগুলোকে হয় চিলি-আর্জেন্টিনা উপকূল ঘুরে যেতে হবে অথবা ৮২ কি.মি. দীর্ঘ পানামা খাল পাড়ি দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত যুদ্ধজাহাজ, সাপ্লাই শিপ এই খাল দিয়ে আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করে থাকে। খালের দুই প্রান্তে দুই মহাসাগরের মধ্যে উচ্চতার গড় ব্যবধান প্রায় ২০ ফুট। তবে পাহাড় কেটে বানানো পানামা খাল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮৫ ফুট উপরে। এই উঁচু ভূপৃষ্ঠ অতিক্রম করে জাহাজগুলোকে এক মহাসাগর থেকে আরেক মহাসাগরে যেতে হয়। এই খালের নির্দিষ্ট কয়েক স্তরের ওয়াটার লিফটের মাধ্যমে পানির লেভেল সমান করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় জাহাজ পারাপার করা হয়। জাহাজগুলোকে পারাপারের জন্য নির্দিষ্ট চ্যানেলে গেটের ন্যায় বিরাট বাঁধ দিয়ে পানি জমিয়ে উচ্চতা বাড়ানো হয়। প্রতিটি গেট সাত ফুট পুরু ইস্পাতে তৈরি এবং অবস্থান অনুযায়ী ৪৭-৮২ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। এক স্তরে পানির লেভেল সমান হলে গেট খুলে দেয়া হয়।
আটলান্টিক এবং প্যাসিফিক প্রান্তে এ ধরনের মোট নয়টি গেট রয়েছে। একটি গেট নষ্ট হলেই পুরো খাল কমপক্ষে ছয় মাসের জন্য অচল হয়ে পড়বে। মার্কিনীরা খালের নিরাপত্তার জন্য সাগরে কঠোর প্রহরার পাশাপাশি এর প্যাসিফিক প্রান্তে ‘ফোর্ট শেরম্যান’ নামে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিল যেখানে থাকা কামান দিয়ে ২৭ কি.মি. পর্যন্ত গোলাবর্ষণ করা যেত। ফলে সাধারণ যুদ্ধজাহাজ নিয়ে সেখানে আক্রমণ করা এককথায় অসম্ভব। পানামা খালে দায়িত্ব পালন করা এক আমেরিকান যুদ্ধবন্দী সেনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব তথ্য জানতে পারেন কমান্ডার ফুজিমারি। তাই পানামা খাল অভিযানে আই-৪০০ সাবমেরিন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পানামা খাল নির্মাণে নিয়োজিত জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের দেয়া নকশা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় খালের প্যাসিফিক সাইডে ‘মিরাফ্লকস’ লক বিমান হামলা সহ্য করার ক্ষেত্রে খুবই নাজুক। কিন্তু আটলান্টিক প্রান্তের ‘গাতুন’ লকে হামলা করলে পানির চাপে পুরো ক্যানেল রক্ষা বাঁধ ও কৃত্রিম হ্রদ হুমকির মুখে পড়বে। তাই দুই পাশেই হামলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সাবমেরিন আই-৪০০ ও আই-৪০১-কে এই অপারেশনের জন্য নির্বাচন করা হয়। অপর সাবমেরিনের নির্মাণ তখনও সম্পন্ন হয়নি। বিমানের সংখ্যা বাড়াতে আই-১৩ ও আই-১৪ নামে দুটো মডিফাইড সাবমেরিন মিশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় যারা দুটি করে বিমান বহন করতে পারত। কিন্তু সমস্যা হলো আইচি এম-৬ উভচর বিমানগুলো চালানোর মতো দক্ষ পাইলট তাদের ছিল না। পরিকল্পনা ছিল যে দুই মাস ব্যাপী যাত্রার পর ইকুয়েডরের জলসীমায় গিয়ে রাতের বেলা চাঁদের আলোতে বিমান ওড়ান হবে। পরে ক্যারিবিয়ান সাগরে ফিরে আসা বিমানগুলোকে রিসিভ করবে সাবমেরিনগুলো। কিন্তু এটি বিপদজনক বিধায় পাইলটদের না জানিয়ে কামিকাজি (আত্মঘাতী) হামলার সিধান্ত নেয়া হয় যা নিয়ে ভেটেরান পাইলটদের সাথে সিনিয়র অফিসারদের বাকবিতণ্ডা হয়। সাধারণত অনভিজ্ঞ, তরুণ পাইলটদের কামিকাজি মিশনে পাঠানো হতো।
এরই মধ্যে তিনবার দিনে-রাতে জাপানিরা অনুশীলন সম্পন্ন করে। পানামা খালের লকগুলোর আদলে কাঠের বিশাল স্কেল মডেল বানিয়ে সেখানে বিমান হামলা চালানো হয়। সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে মিশন গ্রিন সিগন্যাল পায়। পানামার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার মুহূর্তেই আসে দুঃসংবাদ। দাঁত কামড়ে পড়ে থেকে লড়াই করার পরও পতন ঘটেছে গুরুত্বপূর্ণ ওকিনওয়া দ্বীপের। মার্কিনীরা এবার জাপানের মূলভূমিতে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফলে পানামা খাল অভিযান সফল হলেও যুদ্ধে তেমন প্রভাব ফেলবে না। এদিকে প্রশান্ত মহাসাগরের উলিথি দ্বীপের মার্কিন নৌঘাঁটিতে জড়ো হয়েছে পনেরোটি মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার! এরা জাপানের মূলভূমিতে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখানে আই-৪০০ সাবমেরিন দিয়ে আচমকা হামলা করে সামান্য ক্ষয়ক্ষতি করতে পারলেও যুদ্ধে তা বিরাট প্রভাব ফেলবে। তাই একেবারে শেষ মুহূর্তে পানামা খালের অভিযান বাতিল করে উলিথি ঘাঁটিতে অবিলম্বে হামলা করার জন্য সাবমেরিনগুলোকে পাঠানো হয়।
এই অপারেশনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ‘হিকারি’ নামক ফেজে আই-১৩ ও আই-১৪ সাবমেরিন দুটো মিলে চারটি ‘সি-৬এন’ গোয়েন্দা বিমান নিকটস্থ তুর্ক আইল্যান্ডের জাপানি ঘাঁটিতে ডেলিভারি দেবে। এই বিমানগুলো উলিথিতে আমেরিকান এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আছে কিনা সেটা পর্যবেক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হওয়ার কথা ছিল। পরে তারা সাবমেরিন দুটো হংকংয়ে গিয়ে রিফুয়েলিংয়ের পাশাপাশি নিজেদের ডাইভ বোম্বার সংগ্রহ করে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করা আই-৪০০ ক্লাসের সাবমেরিন দুটোর সাথে যোগ দেবে। এসময় সাবমেরিনের আইচি এম-৬ বিমানগুলোকে মার্কিন বিমানের ন্যায় রঙ করা হয় যা যুদ্ধের আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কামিকাজি হামলা করতে রাজি হওয়া জাপানি পাইলটরাও নিজেদের শেষ মিশনে মার্কিন পতাকা অঙ্কিত বিমান ওড়াতে অপমানিত বোধ করেন। শেষ পর্যন্ত ‘আরাশি’ ফেজের অপারেশনে সাবমেরিনগুলো ১৭ আগস্ট, ১৯৪৫ সালে উলিথিতে হামলার উদ্দেশ্য নিয়ে রওনা দেয়।
কিন্তু জাপানিদের ভাগ্য আসলেই খারাপ ছিল। আই-১৩ সাবমেরিনটি তুর্ক আইল্যান্ডে যাওয়ার পথে আকস্মিক মার্কিন বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ ও পরবর্তীতে যুদ্ধজাহাজের হামলায় ডুবে যায়। এরই মধ্যে ৬ ও ৯ আগস্ট জাপান দুটো পারমাণবিক বোমা হজম করে। বাকি তিনটি সাবমেরিন উলিথি উপকূলে পৌঁছানোর একদিন আগেই দেশটি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তাই সাবমেরিনগুলোকে হামলা বাতিল করে নিকটস্থ মার্কিন যুদ্ধজাহাজের কাছে সারেন্ডারের নির্দেশ দেয়া হয়। তবে আই-৪০০ এর প্রকৃত উদ্দেশ্য গোপন করতে বিমানগুলো পানিতে ফেলে দিয়ে সাবমেরিনটি কার্গো পরিবহন জাহাজের বেশ ধরে।
ইউএসএস ব্লু নামের ডেস্ট্রয়ারের নাবিকদের চোখ তখন কপালে। তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করা আই-৪০০ সাবমেরিনটি লম্বায় তাদের যুদ্ধজাহাজটির থেকেও ২৪ ফুট লম্বা! যুদ্ধের শেষদিকে সার্ভিসে আসায় তৎকালীন মার্কিন সাবমেরিন থেকেও লম্বা আই-৪০০ তার নামের প্রতি মোটেও সুবিচার করতে পারেনি। পানামা ও উলিথি আক্রমণের চেয়েও ভয়ংকর অপারেশনে আই-৪০০ কে ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কুখ্যাত জাপানি বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার সংস্থা ‘ইউনিট ৭৩১’ যদি ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ সালে তাদের পূর্বনির্ধারিত ‘অপারেশন চেরি ব্লসম অ্যাট নাইট’ বাস্তবায়নের সুযোগ পেত, তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো পৃথিবীতে জীবাণু অস্ত্রের কারণে রোগাক্রান্ত হয়ে বিশাল আকারে মহামারি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। ইউনিট ৭৩১ এর পরিকল্পনা ছিল আই-৪০০ সাবমেরিন ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগোতে বিশেষ ধরনের মাছি ভর্তি ক্যানিস্টার বোমা ফেলবে। এজন্য তারা কয়েক মাস ধরে বিপুল পরিমাণে জীবাণুবাহী মাছির চাষ করছিল। কিন্তু তার আগেই জাপান আত্মসমর্পণ করায় একটি সম্ভাব্য মহামারি থেকে বেঁচে যায় মার্কিন জনগণ।
ইউনিট ৭৩১ এর ভয়ংকর সব অপকর্ম ও ‘অপারেশন চেরি ব্লসম অ্যাট নাইট’ নিয়ে বিস্তারিত পড়ুন Roar বাংলায়।
আই-৪০০ এর পরিণতি
মার্কিনীরা কল্পনাও করেনি যে এত বড় সাবমেরিন জাপান বানাতে সক্ষম ছিল। ভয়ংকর এই গোপন অস্ত্র কেন তখনও মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার হয়নি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না। মার্কিন গোয়েন্দাদের কাছে এই প্রজেক্ট সম্পর্কে কোনো তথ্যই ছিল না। নির্মাণকৌশল সম্পর্কে জানতে আমেরিকান ইঞ্জিনিয়াররা সাবমেরিনটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে তিনটি আই-৪০০ সাবমেরিনসহ মোট ২৪টি জাপানি সাবমেরিন তারা আটক করে। এসময় মার্কিনীদের যুদ্ধকালীন মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন আটক সাবমেরিনগুলো পরীক্ষা করতে একটি দল পাঠাতে চায়। কিন্তু ভবিষ্যতের শত্রুকে স্পর্শকাতর প্রযুক্তি সম্পর্কে জানার সুযোগ না দিতে ইউএস নেভি সবগুলো সাবমেরিনে বিস্ফোরক বসিয়ে ধ্বংস করে দেয়। আই-৪০০ সিরিজের সাবমেরিনগুলো হাওয়াই দ্বীপের নিকটে টর্পেডো মেরে ডুবিয়ে দেয়া হয়। এর ধ্বংসাবশেষের অবস্থান কখনই ফাঁস করেনি তারা। ২০০৫ ও ২০১৩ সালে হাওয়াই আন্ডারসি রিসার্চ ল্যাবরেটরি পানির প্রায় আড়াই হাজার ফুট গভীরতায় যথাক্রমে আই-৪০১ ও আই-৪০০ এর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়।
সব মিলিয়ে আই-৪০০ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার এক বিস্ময়। কিন্তু মিসাইল টেকনোলজির উন্নতি ঘটায় তৎকালীন পরাশক্তিগুলো এ ধরনের বিমানবাহী সাবমেরিন বানানোর পরিকল্পনা আর গ্রহণ করেনি। তবে অনেকেই ধারণা করেন যে পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন টাইফুন ক্লাস নামক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যালাস্টিক মিসাইল সাবমেরিন তৈরি করে তার অনুপ্রেরণা ছিল জাপানের এই আই-৪০০ ক্লাস। বর্তমানে উন্নত ড্রোনের পাশাপাশি হেলিকপ্টারের ন্যায় অল্প জায়গা থেকে সোজাসুজি আকাশে উড়তে সক্ষম এরকম যুদ্ধবিমানের যুগ শুরু হয়েছে।
প্রিয় পাঠক, আপনার কী মনে হয়? ভবিষ্যতে আই-৪০০ এর ন্যায় বিমানবাহী সাবমেরিন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বা প্রয়োজনীয়তা আছে কি?