সম্রাট বা রাজার মতো পদগুলো আমাদের কাছে এমন ঠেকে যে, এই পদের অধিকারী যিনি হবেন, তিনি হবেন সাধারণত মধ্যবয়সী, তার চেহারার মাঝে বুদ্ধিদীপ্ততা ও পরিপক্বতার ছাপ থাকবে, কথাবার্তায় ফুটে উঠবে জ্ঞানের ছাপ, পোশাকে দেখা যাবে আভিজাত্যের ছোঁয়া ইত্যাদি। কিন্তু, ইতিহাস বলে, মানবজাতির ইতিহাসে এমনও অনেকে রাজা কিংবা সম্রাট হয়েছেন, যাদের দাঁতও তখনও গজায়নি, এমনকি মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে কেবলমাত্র পৃথিবীর আলো দেখা মানুষের নামও রয়েছে এই তালিকায়। তেমনই কিছু বাচ্চা-রাজার সাথেই পরিচিত হবো আমরা আজ।
ওয়ো
রাজ্য: তোরো
বয়স: সাড়ে ৩ বছর
শিরোনামে রাজার নাম মাত্র এক অক্ষরের দেখালেও পুরো নাম উচ্চারণ করতে গেলে দাত ভেঙে যাবার দশা হবে। চতুর্থ রুকিরাবাসাইজা ওয়ো নয়িম্বা কাবাম্বা ইগুরু রুকিদি- এটার হলো তোরোর রাজা ওয়োর পুরো নাম! ১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল রাজা তৃতীয় প্যাট্রিক ডেভিড ম্যাথিউ কাবোয়ো ওলিমি এবং রানী বেস্ট কেমিগিসা কাবোয়োর ঘর আলো করে জন্ম নেন ওয়ো।
১৯৯৫ সালে যখন তিনি তোরো রাজ্যের সিংহাসনে বসেন, তখন তার বয়স মাত্র সাড়ে ৩ বছর! রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের সময় বাচ্চা রাজা বারবার সিংহাসন থেকে পিছে নেমে যাচ্ছিলেন। এত মানুষ দেখে ভয়ে দৌড় দিয়ে মায়ের কোলে আশ্রয় খুঁজছিলেন!
সে যা-ই হোক, সেদিনের সেই বাচ্চা ওয়ো কিন্তু আজও আছেন ১৮০ বছরের পুরনো তোরোর রাজা হয়েই। রাজ্যটির দ্বাদশ এ রাজার আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে এর ২০ লক্ষাধিক জনতা।
পুয়ি
দেশ: চীন
বয়স: ২ বছর
আজকের বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী রাষ্ট্র চীনের সর্বশেষ এ সম্রাট বয়সের দিক থেকেও ছিলেন অনেক ছোট। ১৯০৮ সালে যখন দেশটির শাসনভার তার হাতে ন্যস্ত হয়, তখন তার বয়স মাত্র ২ বছর! রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের সময় তার বাবাই কোলে করে তাকে সিংহাসনের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাচ্চা সম্রাট ভয় পেয়ে এলোপাথাড়ি লাথি-ঘুষি আর কান্নাকাটি করেই কাটিয়ে দেয় পুরোটা সময়। তার বয়স যখন মাত্র ছ’বছর, তখনই বিদ্রোহের কবলে পড়ে দেশটি, অবসান ঘটে রাজতন্ত্রের, প্রতিষ্ঠিত হয় ‘রিপাবলিক অফ চায়না’। ফলে ক্ষমতার স্বাদ পাবার আগেই, সম্রাট হবার মাহাত্ম্য বোঝার আগেই তাকে সবকিছু ত্যাগ করতে হয়।
ক্ষমতা হারালেও বিলাসবহুল জীবনযাপনের অনুমতি ছিলো পুয়ির। তাই বেইজিংয়ের নিষিদ্ধ নগরীতেই সুখে-শান্তিতে জীবন কাটাতে থাকেন তিনি। যখনই তিনি কোথাও হাঁটতে বেরোতেন, তখনই তার সাথে থাকতো বেশ কয়েকজন খোজা ভৃত্য, যারা সম্রাটের জন্য দরকারি ওষুধ, চা এবং কেক সাথে নিয়ে ঘুরতো।
কালক্রমে এই নিষিদ্ধ নগরীতে থাকার অধিকারও হারিয়ে ফেলেন পুয়ি। জীবন বাঁচাতে তখন তিনি আশ্রয় নেন জাপানে। তার জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলো একটির চেয়ে আরেকটি যেন বেশি চমক জাগানিয়া।
জাপান-নিয়ন্ত্রিত চীনের একটি প্রদেশের সম্রাট হন পুয়ি। তবে মূল ক্ষমতা ছিলো জাপানের হাতেই। তিনি ছিলেন কেবলই তাদের হাতের পুতুল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুয়ি ধরা পড়েন সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে। পরবর্তী পাঁচ বছর তাকে কাটাতে হয় সাইবেরিয়ায়। সেখান থেকে চীনে ফিরিয়ে এনে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাকে নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে।
প্রায় এক দশক পর মুক্তিলাভ করেন তিনি। এরপর থেকে জীবনের বাকিটা সময় বেইজিংয়ের একটি বাগানে মালী হিসেবেই কাটিয়ে দেন তিনি। অবশেষে ১৯৬৭ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি জমান দুর্ভাগা এই সাবেক শিশুসম্রাট। সিনেমার গল্পকেও হার মানানো তার জীবনের এই কাহিনীর উপর ভিত্তি করে বানানো ‘দ্য লাস্ট এম্পেরর’ সিনেমাটি অস্কার জিতে নেয়।
তৃতীয় পোমার
দেশ: তাহিতি
বয়স: ১৭ মাস
রাজা তৃতীয় তেরি’ইতারি’আ পোমার যখন তার বাবা রাজা দ্বিতীয় পোমারের মৃত্যুর পর তাহিতির সিংহাসনে বসেন, তখন তার বয়স মাত্র ১৭ মাস!
পোমারের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন ব্রিটিশ মিশনারি হেনরি নট। রাজাকে কোলে করে পাথরের ভিত্তিমূলের উপর গদিমোড়ানো চেয়ারে বসানো হয়। তার সামনে একটি টেবিলে রাজমুকুট, বাইবেল এবং তাহিতির আইন সম্বলিত একটি বই রাখা ছিলো। পোমারের পক্ষে শপথ নেন সিনিয়র মিশনারি ডেভিস।
রাজা তৃতীয় পোমার একেবারেই অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তার রিজেন্ট তথা রাজপ্রতিভূ হিসেবে ছিলেন তার মা রানী তেরি’ইতো’ওতেয়ারি তেরে-মো-মো, খালা এবং সৎমা তেরি’ইতারি’আ আরি’ইপায়িআভাহিন।
অবশ্য খুব বেশিদিন রাজার আসনে থাকবার সৌভাগ্য জোটেনি পোমারের। মাত্র ছ’বছর বয়সে আমাশয়ে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
ষষ্ঠ হেনরি
দেশ: ইংল্যান্ড
বয়স: ৯ মাস
১৪২২ সালে হেনরি যখন ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন, তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ন’মাস। যখন তিনি শাসনক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেন, ততদিনে দুটো ক্ষমতাধর পরিবারের মাঝে সিংহাসনের দখল নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গিয়েছে: ল্যাঙ্কাস্টার (এটা ছিলো হেনরির পরিবার) এবং ইয়র্ক। এ যুদ্ধটি ওয়্যার অফ রোজেস নামে পরিচিতি লাভ করে। শেষপর্যন্ত ষষ্ঠ হেনরির পক্ষ অবশ্য পরাজয় বরণে বাধ্য হয়।
পরবর্তীতে তাকে বন্দী করা হয়। টাওয়ার অফ লন্ডনে ৫০ বছর বয়সে তাকে হত্যা করা হয়েছিল।
দ্বিতীয় সভুজা
দেশ: সোয়াজিল্যান্ড
বয়স: ৪ মাস
নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখার আগেই একটি রাজ্যের দায়িত্ব চেপে বসেছিলো রাজা দ্বিতীয় সভুজার কাঁধে। কারণ, মাত্র ৪ মাস বয়সেই সোয়াজিল্যান্ডের রাজা হয়েছিলেন তিনি। অবশ্য, চীনের শিশুরাজা পুয়ির মতো তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়নি। বরং পরবর্তী ৮২ বছর ধরে নিষ্ঠার সাথে নিজের উপর শৈশবে অর্পিত এ দায়িত্বটি পালন করে গেছেন তিনি।
দ্বিতীয় সভুজার শাসনামলেই ১৯৬৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে সোয়াজিল্যান্ড। ঐ একই বছর তার তত্ত্বাবধানেই সোয়াজিল্যান্ডের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হয়।
দ্য গ্রেট মাউন্টেন, দ্য বুল, দ্য সান অফ দ্য শি-এলিফ্যান্ট, দ্য ইনএক্সপ্লিকেবল এবং দ্য লায়নের মতো নানাবিধ উপাধিতে ভূষিত এ মানুষটির মৃত্যুর সময় কতজন স্ত্রী ছিল অনুমান করতে পারবেন? প্রায় ১০০ জন!
শাং অফ হান
দেশ: চীন
বয়স: বড়জোর ১০০ দিন
চীনের মতো বিশাল বড় একটি দেশের ক্ষমতার সিংহাসনে আরোহণের সময় শাং অফ হানের বয়স ছিল খুব বেশি হলে ১০০ দিন! অর্থাৎ নিজের দাঁত ঠিকমতো গজাবার আগেই লাখ লাখ মানুষের অন্ন সংস্থানের দায়িত্ব এসে পড়েছিল এই বাচ্চা ছেলের কাঁধে!
সেই যা-ই হোক, শাং অফ হানের শাসনকাল কিন্তু খুব বেশিদিন স্থায়ী ছিলো না। মাত্র ১ বছর রাজত্ব করার পরই তার ১২ বছর বয়সী কাজিন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসনে বসে।
ষষ্ঠ আইভান
দেশ: রাশিয়া
বয়স: ২ মাস
মাত্র ২ মাস বয়সেই রাশিয়ার মতো বিশাল এক দেশের জার তথা সম্রাটে পরিণত হন ষষ্ঠ আইভান। এত অল্প বয়সে ক্ষমতারোহণের বিষয়টি আসলে তার পতনের পথই যেন তৈরি করে দিয়েছিল। মাত্র ১ বছরের মাথাতেই আইভান ও তার রাজপ্রতিভূকে ক্ষমতাচ্যুত করে ১৭৪১ সালে ক্ষমতা দখল করেন এলিজাভেতা পেত্রোভনা।
২০টি বছর আইভানকে একাকী বন্দীজীবনই কাটাতে হয়েছে, যেতে হয়েছে এক দুর্গ থেকে অন্য দুর্গের কারাগারে। সবশেষে, মাত্র ২৩ বছর বয়সে কারারক্ষীর হাতে খুন হবার মধ্য দিয়েই যেন মুক্তি মেলে তার।
ম্যারি
দেশ: স্কটল্যান্ড
বয়স: ৬ দিন
ম্যারি যখন স্কটল্যান্ডের রানী হন, তখন তার বয়স মাত্র ছ’দিন। এই বয়সের বাচ্চার পক্ষে যেখানে নিজের দেখভাল করাই সম্ভব না, সেখানে একটি রাজ্যের কথাই বা আসে কী করে? তাই ম্যারির পক্ষে রাজ্যের শাসনকার্য চালাতে থাকেন তার মা।
১৮ বছর বয়সে যখন তিনি রাজ্যের শাসনভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন, তখন বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিলো। তিনি যাকে বিয়ে করেছিলেন, ধারণা করা হয় সেই লোকটিই ম্যারির আগের স্বামীকে হত্যা করেছিল। ফলে ম্যারিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তিনি তখন পালিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানে কাজিন রানী প্রথম এলিজাবেথের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু এলিজাবেথ পরবর্তী ১৮টি বছর ধরে বন্দী করে রাখেন ম্যারিকে।
অবশেষে এলিজাবেথকে হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে ১৫৮৭ সালে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
প্রথম জন
দেশ: ফ্রান্স
বয়স: ১ দিন
বলা চলে মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর আলো দেখামাত্রই জন হয়ে যান ফ্রান্সের রাজা! কীভাবে? কারণ তার জন্মের চার মাস আগেই মারা যান তার বাবা। তবে দুর্ভাগ্যই বলতে হবে বাচ্চাটির। মায়ের পেট থেকে বেরিয়েই এত বড় একটি দায়িত্ব পেলেও সেটা পালন করার সৌভাগ্য তার হয়নি।
মাত্র পাঁচ দিন পরই পৃথিবীর বুকে সংক্ষিপ্ত যাত্রা সেরে আবার সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে যান রাজা প্রথম জন। এরপর ফ্রান্সের সিংহাসনে আসেন তারই চাচা ফিলিপ, যিনি তখন রাজপ্রতিভূর দায়িত্ব পালন করছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন, নিষ্পাপ শিশুটিকে ফিলিপই বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছিলেন।
ত্রয়োদশ আলফন্সো
দেশ: স্পেন
বয়স: ১ দিন
১৮৮৬ সালের ১৭ মে জন্মগ্রহণ করেন ত্রয়োদশ আলফন্সো। সেই একই দিনে স্পেনের শাসনভার তার হাতে ন্যস্ত করা হয়। তবে দুর্ভাগ্য আলফন্সোর, কারণ শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন পুরোপুরি ব্যর্থ।
আলফন্সোর শাসনামলেই স্পেন তার সর্বশেষ কলোনিগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে। দেশ থেকে অবসান ঘটে রাজতন্ত্রেরও। ১৯৪১ সালে ফ্রান্সিস্কো ফ্রাঙ্কোর হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে বাধ্য হন তিনি।
দ্বিতীয় শাহ শাপুর
রাজ্য: সাসানিদ
বয়স: মাতৃগর্ভে থাকাকালে
দ্বিতীয় শাহ শাপুরের কাহিনী বেশ অদ্ভুত। কিংবদন্তীতে আছে, ৩০৯ সালে পারস্যের অভিজাত ব্যক্তিবর্গ রাজা দ্বিতীয় হরমিজ্দের পেটের উপর সসম্মানে একটি রাজমুকুট রেখেছিলেন। ফলে মাতৃগর্ভে ভ্রূণাবস্থায় থাকা শাহ শাপুর হয়ে যান ইতিহাসের প্রথম ও একমাত্র ভ্রূণ-রাজা! সাসানিদ সাম্রাজ্যের নবম এ শাসক মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে পরবর্তী ৭০ বছর ধরে নিজের ক্ষমতার চর্চা করে গেছেন।