সময়টা তখন ১৬৭৬ সাল, আমেরিকান বিপ্লবেরও এক শতাব্দী আগে। আধুনিক বিশ্বে ইংরেজ উপনিবেশের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বিপ্লবের ঘটনা এটি। আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে ইংরেজ গভর্নর স্যার উইলিয়াম বার্কলির জনপ্রিয়তা ক্রমেই কমতে শুরু করেছিল। বিশেষ করে গ্রামীণ কৃষক এবং সীমান্তবর্তী জনগণ বিশেষ কিছু কারণে ফুঁসে ওঠে। স্থানীয় আমেরিকানদের নির্যাতন, ভোটাধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, উচ্চ ট্যাক্স নির্ধারণের মতো বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করেই মূলত বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। ‘বেকন বিপ্লবের’ সূচনা করেছিল খুব ছোট একটা জনগোষ্ঠী যারা আদতে ছিল অজ্ঞ এবং গোঁড়া, কিন্তু এতটুকু আঘাতেই ভার্জিনিয়াতে ইংরেজ উপনিবেশ প্রায় বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছায়।
যার নামে বেকন বিদ্রোহের নামকরণ, সেই বেকন ছিলেন সেখানকার গভর্নর উইলিয়াম বার্কলির নিকটাত্মীয়। বার্কলি ছিলেন ইংরেজ গৃহযুদ্ধের একজন পোড় খাওয়া সৈনিক। অন্যদিকে বেকনের বাবা বেকনকে ভাগ্যের সন্ধানে আমেরিকায় পাঠান। বার্কলি বেকনের থাকার বন্দোবস্ত করেন এবং কাউন্সিলে তাকে একটি পদ দেন।
ভার্জিনিয়ায় সেই সময়ে জীবন ধারণ করাটা ছিল কষ্টের। খরা, দারিদ্র্য আর স্থানীয় আমেরিকানদের সাথে সংঘাতের মধ্য দিয়েই তাদের জীবন কেটে যেত। ১৬০৯ সালে আদিবাসী আমেরিকানদের ক্যানিবালিজমের শিকার হওয়ার পর থেকে এই জনপদের লোকজন পুরো সপ্তদশ শতাব্দী জুড়ে আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সবচেয়ে দুর্বলও ছোবল দিতে পারে, তারই উদাহরণ বেকন বিপ্লব। বিপ্লবের সময়ে ভার্জিনিয়ার অর্থনীতি ছিল টালমাটাল। সেখানকার মাটিতে যেন ফসল জন্মাতে ভুলে গেছে। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকান একটি স্থানীয় আদিবাসী দল তাদের ক্ষেতখামার লুটপাট করে। এর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ফ্রন্টিয়াররা ভুলে অন্য একটি আদিবাসী দলের উপর আক্রমণ করে বসে।
নাথানিয়েল বেকন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই যেন ছিলেন। বেকন উপনিবেশের জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, স্থানীয় আদিবাসীরা তাদের জন্য সবসময় হুমকি, কিন্তু গভর্নর মোটেই তাদেরকে নিরাপত্তা দিতে আগ্রহী নন। তাই যা করার নিজেদেরই করতে হবে। এমন উষ্কানিমূলক কথা ছড়িয়ে পড়ে পুরো উপনিবেশ জুড়ে। যার ফলাফল হিসেবে তাদের সাথে স্থানীয় আদিবাসীদের যুদ্ধও অনিবার্য হয়ে পড়ে।
বিদ্রোহের বীজ
সংঘর্ষ যখন অনিবার্য তখন গভর্নর বার্কলি উপনিবেশের লোকদের স্থানীয় জনগণের প্রতি বিদ্বেষ না ছড়ানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু বেকন এবং তার অনুসারীরা স্থানীয় কিছু জনপদের উপর খাদ্যশস্য লুটপাটের অভিযোগ আনে এবং তাদের উপর আক্রমণ করে বসে। কিন্তু এবারও তারা ভুল জনপদের উপর অভিযোগের তীর চালায়। তবুও তারা এই ভুলের উপরই প্রতিষ্ঠিত থাকে। গভর্নর বার্কলির সিদ্ধান্তমতে স্থানীয় আদিবাসীদের সকল অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং অধিবেশন ডাকা হয়। অধিবেশনে তেমন ফলপ্রসু সিদ্ধান্ত না আসায় বেকন আদিবাসীদের উপর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
অধিবেশনে বার্কলির বিরুদ্ধে আদিবাসীদের পক্ষ নেয়ার অভিযোগ আনা হয়, সেই সাথে ফলাফল যাতে আদিবাসীদের অনুকূলে হয়, তারও গোপন প্রচেষ্টার অভিযোগ ছিল বার্কলির বিরুদ্ধে। কলোনির বাসিন্দারা বেকনকে তাদের নেতা নির্বাচিত করে এবং স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধা নিয়ে একটি ছোটখাট বাহিনী তৈরি করে বসে বেকন! এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে অধিবেশন ভেঙে যায় এবং খুব দ্রুতই দু’শো যোদ্ধা নিয়ে স্থানীয় কিছু আদিবাসীদের তাদের বাড়িঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। এই খবর শোনার পর বার্কলি তিনশোজনের একটি বাহিনী প্রেরণ করেন অভিযান পরিচালনা করার জন্য, বেকন বনে পালিয়ে যান।
বার্কলি আনুষ্ঠানিকভাবে বেকনকে একজন বিদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা দেন এবং তার জন্য দুটো প্রস্তাবনা দেয়া হয়। বেকনকে শীঘ্রই তার জনপদের লোকজনের কাছে এমন কর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে এবং তাকে কাউন্সিল থেকে পদচ্যুত করা হবে, সেই সাথে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু বেকন এই আদেশকে বুড়ো আঙুল দেখান এবং আদিবাসীদের উপর আরেক দফা আক্রমণ চালান। অন্যদিকে বার্কলির উপর কলোনিস্টরা ক্ষেপে গেলে তিনি একটি প্রস্তাবনা পেশ করেন, যাতে বলা হয় বেকনকে ক্ষমা করে দেয়া হবে, যদি সে ইংল্যান্ডে গিয়ে বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে রাজি হয়। বেকন বুঝতে পারে- এই প্রস্তাব কেবলই ছলছাতুরির একটা অংশ, বিচারের মুখোমুখি হলে তাকে কখনো ছাড় দেয়া হবে না।
ভার্জিনিয়ার ক্ষমতাবান লোকজন বেকনকে ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের পরিচালিত ‘হাউস অব বারগেসেস’ স্বীকার করে নেয় যে, বেকনের ক্ষমা চাওয়া উচিত! তারপর বেকনকে তারা নিজেদের কাউন্সিলেই জায়গা করে দেয়। কিন্তু এটা করার মূল উদ্দেশ্য ছিল চলমান যুদ্ধকে আরও উষ্কে দেয়া। কাউন্সিল কখনোই চায়নি এই যুদ্ধের একটা বিহিত না করা পর্যন্ত তারা থামুক। অন্যদিকে বেকনের মতো এমন একজন বিদ্রোহী নেতাকে পেয়ে তাদের বরং উপকারই হয়েছে।
বেকনের বিদ্রোহ
যখন বেকন আবার যোগদান করেন, সেখানে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে শর্ত দেয়া হয়, তিনি যদি নিজের দোষ স্বীকার করে নেন, তবে তার পদ ফিরিয়ে দিয়ে মুক্ত করে দেয়া হবে। জবাবে বেকন অধিবেশন ত্যাগ করেন এবং নিজের মিলিশিয়া বাহিনীর সহায়তায় স্টেট ভবন ঘেরাও করেন। বেকন একজন মিলিশিয়া লিডার হিসেবে নিজের কমিশন দাবি করেন। কিন্তু বার্কলি কিছুতেই রাজি হলেন না। যদিও আলোচনার একপর্যায়ে বেকনকে একজন মিলিশিয়া নেতা হিসেবে কমিশন দিতে রাজি হন।
এবার বেকন আবার বেঁকে বসেন। তিনি আর কমিশনে আগ্রহী নন! উল্টো বেকন নিজেকে স্থানীয় আমেরিকানদের বিরুদ্ধে লড়তে থাকা সকল সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল পদবি দাবি করেন। বার্কলি অবস্থা বেগতিক দেখে বেকনকে জেনারেল পদবি দিয়ে স্থানীয় আমেরিকানদের উপর হামলার অনুমতি দেন। বার্কলি জেমসটাউনে ফিরে আসেন, একই সময়ে বেকন আনুষ্ঠানিকভাবে বেকন বিদ্রোহের নথি প্রকাশ করেন এবং বার্কলিকে দুর্নীতিগ্রস্থ, যোগ্যতাহীন নেতা হিসেবে ঘোষণা দেন। ঘোষণার পাশাপাশি অভিযান পরিচালনাকালীন সময়ে যাবতীয় সহায়তার নিশ্চয়তা চান বার্কলির কাছে।
বার্কলি চাইলেই ফিরে গিয়ে নিজের অনুগত বাহিনী নিয়ে বেকনকে পাকড়াও করতে পারতেন। সেই সাথে জেমসটাউনকে বিদ্রোহের হাত থেকেও মুক্ত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কেন এমন সিদ্ধান্ত নেননি সেটা বড় বিস্ময়ের। বরং এই সুযোগকে আর বার্কলির কালক্ষেপণকে কাজে লাগিয়ে বেকনের বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসে, যারা সবাই বার্কলির সমর্থক।
ইতোমধ্যে জেমসটাউন ধ্বংসের দোড়গোড়ায় পৌঁছে গিয়েছে, পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল বেকনের মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে। কিন্তু মিলিশিয়া বাহিনী তখনও সন্তুষ্ট হতে পারেনি, তাদের মূল শিকার বার্কলিকে তারা এখনও পাকড়াও করতে পারেনি। এতে বেকনের উপর বাড়তি চাপ এসে যায়, তাই তিনি বার্কলির উপর মনোযোগ দেন। দুর্ভাগ্যবশত কিছুদিনের মাথায় বেকন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অক্টোবরের ২৬ তারিখ মৃত্যুবরণ করেন।
বিদ্রোহের ফলাফল
বেকনের মৃত্যুর পর বার্কলি মিলিশিয়াদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীদের ফাঁসিতে কার্যকর করতে থাকেন। কিন্তু তখনও ভার্জিনিয়ার আনাচে-কানাচে বিদ্রোহীরা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখে। অবশেষে ইংল্যান্ড থেকে রাজকীয় বাহিনী এসে উপস্থিত হয় এবং দিনে দিনেই বিদ্রোহ দমন করে ফেলে। দেখতে দেখতে বিদ্রোহের আগুনে জ্বলতে থাকা ভার্জিনিয়া শান্ত হয়ে আসে।
রাজকীয় বাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় যে, মিলিশিয়া নেতাদের ফাঁসি দেয়া এবং তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা বার্কলির জন্য বাড়াবাড়ি ছিল। তাই তারা বার্কলিকে বিচারের মুখোমুখি করতে ইংল্যান্ড পাঠিয়ে দেয়। সেই সময়ে বার্কলি বয়সের কারণে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং নিজের বিচার দেখার আগেই ১৬৭৭ সালের ৯ জুলাই ৭২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
এদিকে ভার্জিনিয়াতে সৈন্যদের করার মতো কোনো কাজ ছিল না। তাদের বিদ্রোহ দমন করার জন্য পাঠানো হয়েছিল, সেটা তারা করেছে। অবসর সময়টা তারা কাজে লাগাতে স্থানীয় একটি গাছ নিয়ে গবেষণা করতে নামে! জেমসটাউন উইড (বর্তমানে জিমসন উইড) নামের গাছটি ছিল বিষাক্ত, রাসায়নিক উপাদান ছিল এট্রোপিন এবং স্কোপোলামিন। স্থানীয়রা এই গাছটিকে চেনে এর দারুণ হ্যালুসিনেশন তৈরির ক্ষমতার কারণে। সৈনিকরা গাছটির পাতা থেকে স্যুপ তৈরি করে তা পান করে। ফলে তাদের ভেতর মাতলামির প্রভাব পড়ে। পুরো দিন-রাত জুড়ে তারা মাতলামি করতে থাকে; একে অন্যের সাথে মারামারি করে, জিনিসপত্র ভাংচুর করে। তাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে পুরো জেমসটাউনের চিত্র বদলে যায়। কিন্তু পরদিন সকাল থেকেই চিত্র পাল্টে যায়। পুরো রাত জুড়ে যারা এত মাতলামি করল, তারা সকাল থেকেই কাজে ফিরে যায়। তাদের কারোরই ঠিক মনে নেই তারা গতরাতে ঠিক কী করেছিল!
বেকনের বিদ্রোহ দমন করার পর ভার্জিনিয়ার শাসক শ্রেণীর মদতে ভার্জিনিয়া আবারও ১০০ বছরের জন্য ইংরেজ শাসনের চাদরে ঢেকে যায়। যার স্থায়িত্ব ছিল ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত। এই বিদ্রোহ সফল না হলেও এর প্রভাব রয়ে গিয়েছিল পুরো ইংরেজ শাসন জুড়ে। ইংরেজদের উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এরপর যতবারই কেউ অস্ত্র ধরেছে, ততবারই তারা বেকনের নাম স্মরণ করেছে। বেকন বিদ্রোহকে পুঁজি করেই পরবর্তীতে আরও বড় বড় বিদ্রোহ ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল।