ইউরোপীয়দের দেওয়া ‘রেড ইন্ডিয়ান’ নামের আমেরিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে বেশ সমৃদ্ধ ছিল। আঞ্চলিক অবস্থান ও সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এই জনগোষ্ঠী অনেক বিচিত্র উপজাতীয় জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশের প্রভুরা তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার শুরু করলে আদিবাসী জীবনধারা সংকটের মুখে পড়ে। বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা থাকায় ইউরোপ থেকে আসা সাম্রাজ্যবাদীরা এর সুযোগ নিয়ে নিজেদের দখলকৃত সীমানা আরো বাড়িয়ে তুলতে থাকে।
১৭৭৬ সালে ইউরোপের রাজকীয় আধিপত্য রাজনৈতিকভাবে অস্বীকার করার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক রক্তক্ষয়ী যাত্রা শুরু হয়। ইউরোপের আধিপত্য থেকে স্বাধীনতা লাভের ফলাফল সবার জন্য সমান সু্খকর হয়নি। বরং স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকার ও প্রশাসন আগের চেয়ে আরো বেশি মাত্রায় সম্প্রসারণ নীতি গ্রহণ করে। ফলে আদিবাসী আমেরিকান জনগোষ্ঠী রীতিমতো অস্তিত্বের সংকটে পড়ে।
১৮৩০ সালের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া, আলাবামা, নর্থ ক্যারোলিনা ও ফ্লোরিডা অঞ্চলে প্রায় ১,২৫,০০০ আদিবাসী আমেরিকায় বসবাস করতো। এসব অঞ্চলে এ জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষরা বহুকাল আগে থেকে বসতি স্থাপন করে শিকার, পশুপালন ও কৃষি পেশায় নিয়োজিত ছিলো। আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে ‘চিরোকি’ সম্প্রদায় ছিলো অন্যতম। এছাড়া ‘ক্রিক’ ও ‘সেমিনোল’ গোষ্ঠীরও বসবাস ছিলো। শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়া চালু রাখতে এসব অঞ্চলের জমি’র দখল পাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। আর মার্কিন প্রশাসন পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জবরদখলের নীতি প্রসারিত করে তুলেছিলো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন হবার পর থেকে এর নেতাগণ আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে সমান উৎসাহী ছিলেন। তবে সবার ভূমিকা সমান আগ্রাসী ছিলো না। জাতির জনক ও প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ‘রেড ইন্ডিয়ান’ প্রশ্নে সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের পক্ষপাতী ছিলেন। আদিবাসীদের ক্রমশ খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা, ইংরেজি শেখানোর স্কুলে আসতে উৎসাহ দেওয়া, সম্পত্তির মালিকানার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ধাঁচের ব্যক্তিগত জমি ও প্রতিপত্তি অর্জন ও ‘বর্বর’ আদিবাসী জীবন ত্যাগ করে শ্বেতাঙ্গদের মতো জীবনযাপনে প্রভাবিত করার মাধ্যমে তাদের ‘সিভিলাইজড’ বা সভ্য করে তোলার নীতি গৃহীত হয়েছিলো।
শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের মধ্যে সবাই এই নীতি মেনে নেয়নি। বিশেষ করে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া জমি ও বনজ সম্পদের চাহিদার কারণে দক্ষিণ-পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলোর দিকে তাদের নজর বেশি ছিলো। ফলে ফেডারেল সরকারের নীতিতে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে থাকে। ১৮৩২ সালে এন্ড্রু জ্যাকসন দ্বিতীয় মেয়াদে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ‘রেড ইন্ডিয়ান’ প্রশ্নে উদারবাদী নীতির তীব্র বিরোধী ছিলেন। এ বছরই যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে শ্বেতাঙ্গ ও ‘সাউক’ আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে ছোট আকারে যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে আদিবাসীদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ‘ব্ল্যাক হক’। আগ্রাসী শ্বেতাঙ্গরা এই যুদ্ধের ফলে আরো বেশি আদিবাসী বিরোধী নীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব ভূখণ্ডের জর্জিয়া, অ্যালাবামা ও ফ্লোরিডা অঞ্চল শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিলো। আমেরিকায় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া তুলা শিল্পের প্রসারের জন্য এসব অঞ্চলের জমির প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বেড়ে চলছিল। ফলে আদিবাসী ‘রেড ইন্ডিয়ান’ জনগোষ্ঠীকে ধীরে ধীরে ‘সভ্য’ ও ‘খ্রিস্টান’ করার প্রয়োজনীয়তা একসময় ফুরিয়ে আসলো। দরকার ছিলো দমনমূলক কঠোর আইনের মাধ্যমে আদিবাসীদের জমি ও আবাসভূমি যেকোনো উপায়ে দখল করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা।
১৯২৮ সালে প্রথমবারের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার আগে এন্ড্রু জ্যাকসন টেনেসি অঞ্চল থেকে নির্বাচিত সিনেটর ছিলেন। তার আগে তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। বেশ কিছু ‘রেড ইন্ডিয়ান’ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আঞ্চলিক ও খণ্ডযুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। উগ্র আদিবাসী-বিদ্বেষ রাজনীতিবিদ ও প্রশাসক হিসেবে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর তিনি জর্জিয়া অঞ্চলে শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য বিস্তারে উৎসাহ দিতে থাকেন। এ অঞ্চলের ‘চিরোকি রেড ইন্ডিয়ান’ গোষ্ঠী এতদিন একরকম স্বায়ত্তশাসিত জীবন উপভোগ করে আসছিলো। নতুন প্রেসিডেন্ট জর্জিয়ার প্রশাসনকে আদিবাসীদের উপর রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগ করার অনুমতি দিলেন। ফলে ‘চিরোকি’ জনগোষ্ঠী এতদিন যে স্বাধীনতা ভোগ করে আসছিলো, তা রীতিমতো হুমকির মুখে পড়ে।
জর্জিয়া ও আলবামা অঞ্চলের ‘ক্রিক’ এবং ফ্লোরিডা অঞ্চলের ‘সেমিনোল’ আদিবাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রেসিডেনশিয়াল ক্যাম্পেইন চালিয়ে এন্ড্রু জ্যাকসন বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। বিশেষ করে ‘জর্জিয়া গোল্ড রাশ’ এর সময় সোনার খোঁজে ভাগ্য বদল করতে আসা অভিযাত্রী ও ব্যবসায়ীদের জন্য জ্যাকসনের রাজনৈতিক অবস্থান সুবিধা করে দিয়েছিলো। ১৮৩০ সালে তিনি ‘ইন্ডিয়ান রিমুভাল অ্যাক্ট’ এর প্রস্তাব কংগ্রেসে উত্থাপনের ব্যবস্থা করেন। মার্কিন কংগ্রেস তার প্রস্তাব অনুমোদন করে। ফলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে নিজেদের বহু যুগের আবাসভূমি থেকে সমূলে উৎখাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়, যা ইতিহাসে ‘ট্রেইল অব টিয়ারস’ নামে কুখ্যাত। উল্লেখযোগ্য, এই আইনে আদিবাসীদের অন্য স্থানে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে জোর করা কিংবা নিষ্ঠুরতাকে দণ্ডনীয় হিসেবে দেখা হয়েছিলো। শ্বেতাঙ্গদের আইনে এটিই ছিলো আদিবাসীদের প্রতি ‘দয়া’র মতো !
১৮৩১ সালে ‘ইন্ডিয়ান রিমুভাল অ্যাক্ট’ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়। আদিবাসী ‘চকটাও’ জনগোষ্ঠী প্রথম এই আইনের শিকার হয়। আমেরিকার পশ্চিম ভূখণ্ডে নির্ধারিত ‘ইন্ডিয়ান টেরিটোরি’তে তাদের নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হয়। এই জনগোষ্ঠীর সবাই তাদের পূর্বপুরুষের ভূমি ছেড়ে আসতে প্রস্তুত ছিলো না। তাদের জোর করে পায়ে ও গলায় শেকল পরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হয়। এন্ড্রু জ্যাকসন প্রশাসন ‘ইন্ডিয়ান রিমুভাল অ্যাক্টের’ কিছু ধারা সরাসরি লঙ্ঘন করে। সরকার থেকে আদিবাসীদের জন্য কোনোরকম খাদ্য, পানীয় ও সাময়িক আশ্রয়ের সামান্য ব্যবস্থাও করা হয়নি। যাত্রাপথে প্রায় হাজারেরও বেশি আদিবাসী কষ্ট নিয়ে মৃত্যুবরণ করে। আলাবামার এক সংবাদপত্রে আদিবাসীদের উপর এই নিষ্ঠুরতাকে ‘ট্রেইল অব টিয়ারস অ্যান্ড ডেথ’ নামে অভিহিত করা হয়।
ক্রমান্বয়ে এই আইন অন্যান্য গোষ্ঠীর ওপর কার্যকর হতে শুরু করে। ১৮৩৬ সালে ফেডারেল সরকার ‘ক্রিক’ জনগোষ্ঠীকেও আপন ভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য করে। ওকলাহোমা প্রদেশে তাদের ভবিষ্যৎ নিবাস ঠিক করা হয়। যাত্রাপথে প্রায় ৩,৫০০ আদিবাসী ক্ষুধা, পিপাসা ও অত্যাচারে মৃত্যুবরণ করে।
স্থানান্তর প্রশ্নে ‘চিরোকি’ জনগোষ্ঠীর মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছিলো। গোষ্ঠীর এক অংশ ফেডারেল সরকারের নীতি উপেক্ষা করে সংঘর্ষের পক্ষে ছিলো। অন্য অংশ স্থানান্তরের বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ আদায় করার পক্ষে ছিলো। ১৮৩৫ সালে গোষ্ঠীর পক্ষের একদল প্রতিনিধি সরকারপক্ষের সাথে ‘নিউ ইকোটা ট্রিটি’ স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির অধীনে ভূমি, খাদ্য ও অন্যান্য ক্ষতিপূরণ বাবদ ‘চিরোকি’ গোষ্ঠীকে ৫ মিলিয়ন ডলার দেবার অঙ্গীকার করা হয়। তবে এই চুক্তিটি গোষ্ঠীর সবার কাছে গ্রহণযোগ্য পায়নি। চিরোকি নেতা জন রস প্রায় ১৬ হাজার ‘চিরোকি’ সদস্যের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি চিঠি মার্কিন সিনেটে পাঠান। এই চিঠিতে আগের চুক্তির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। তবুও এই চুক্তি কংগ্রেসে পাস হওয়া ঠেকানো যায়নি।
১৮৩৮ সালের মধ্যে চিরোকি ‘গোষ্ঠীর’ ২০০০ সদস্য জর্জিয়া থেকে তাদের নির্ধারিত ‘ইন্ডিয়ান টেরিটোরি’তে যেতে বাধ্য হয়। তাদের আরো বেশি সংখ্যায় স্থান ত্যাগে বাধ্য করার জন্য নতুন উপায় বের করা হয়। এন্ড্রু জ্যাকসনের পর মার্টিন ভ্যান বুরেন প্রেসিডেন্ট হন। তিনি আদিবাসী প্রশ্নে অনেক ক্ষেত্রে জ্যাকসনের চেয়েও কঠোর ছিলেন। তিনি জেনারেল উইনফিল্ড স্কটকে ৭ হাজার সৈন্যসহ জর্জিয়ায় পাঠান। তাদের কাজ ছিলো অনিচ্ছুক ‘চিরোকি’দের জোর করে স্থানান্তরিত করা। স্কট ও তার বাহিনী অস্ত্রের মুখে তাদের বাড়িঘর ও সহায় সম্পত্তি ত্যাগে বাধ্য করেন। শ্বেতাঙ্গ লুটেরার দল এ সময় নির্বিচারে আদিবাসীদের বাড়িঘর ও সম্পত্তি লুট করেছিলো। তারপর তারা আদিবাসীদের ১২০০ মাইলেরও অধিক দূরের ‘ইন্ডিয়ান টেরিটোরি’তে যেতে বাধ্য করে। যাত্রাপথে অনাহারে এবং ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, হুপিংকফ ও কলেরায় আক্রান্ত হয়ে অগণিত মানুষ নিহত হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রায় ৫ হাজার চিরোকি আদিবাসী এই যাত্রায় করুণভাবে মৃত্যুবরণ করে।
১৮৪০ সালের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের আদিবাসীদের এক বড় অংশকে এভাবেই হত্যাকাণ্ড, অনাহার ও দুরারোগ্য রোগে মৃত্যুর মাধ্যমে আপন ভূমি থেকে উৎখাত করা হয়। তৎকালীন মার্কিন সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, পশ্চিমের ‘ইন্ডিয়ান টেরিটোরি’তে ভবিষ্যতে মার্কিন সরকার আর কখনও হস্তক্ষেপ করবে না। তবে উপযুক্ত সময়ে ফেডারেল সরকার আবারও আগ্রাসী হয়েছিলো। প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জ্যাকসনের এই ‘আদিবাসী উৎখাত নীতি’ আজও পরিকল্পিত জাতিগত হত্যাকাণ্ডের এক ঘৃণ্য নিদর্শন হয়ে আছে।