ক্যাথারিন অফ অ্যারাগন: এক হতভাগিনী রাজকুমারীর মর্মস্পর্শী আখ্যান

৭ জানুয়ারি, ১৫৩৬; ইংল্যান্ডের কিম্বল্টন ক্যাসেলে নির্বাসিতা অবস্থায় মারা গেলেন প্রাক্তন রাজবধূ ক্যাথারিন। মৃত্যুর আগে তার একমাত্র মেয়ে লেডি মেরিও অনুমতি পায়নি মায়ের সাথে দেখা করার। কিন্তু কে ছিলেন এই ক্যাথারিন? কীইবা ছিল তার নির্বাসনের কারণ? আর কেনইবা ‘রাজবধূ’ কথাটার আগে যুক্ত হলো ‘প্রাক্তন’ শব্দটি?

শিল্পীর তুলিতে ক্যাথারিন অফ অ্যারাগন; Image Source: Wikimedia Commons

প্রখ্যাত রাজদম্পতি ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার কথা মনে পড়ে? আরে হ্যাঁ! সেই স্পেনীয় রাজদম্পতির কথাই বলা হচ্ছে, যারা স্পন্সর করেছিলেন স্বয়ং ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে। তাদেরই ঘরের সবচেয়ে ছোট্ট মেয়েটির নাম ক্যাথারিন, ক্যাথারিন অফ অ্যারাগন। ১৪৮৫ সালের ১৫ অথবা ১৬ ডিসেম্বর স্পেনের আলকালা দে হেনারেস শহরে জন্ম হয় তার। ক্যাথারিনের জন্মের ৪ মাস আগে ওয়েলসের সপ্তম হেনরি ইংল্যান্ডের মসনদ হাসিল করে টিউডর রাজবংশের পত্তন করে। আর মাত্র ৩ বছর বয়সেই রাজনৈতিক কারণে হেনরির বড় ছেলে আর্থারের বাগদত্তা হতে হয় ক্যাথারিনকে!

বাগদানের প্রায় এক দশক পর রাজকুমারী পাড়ি জমায় ইংল্যান্ডের উদ্দেশে। সাথে থাকে বহুসংখ্যক পরিচারক-পরিচারিকা। তাদের ভেতর কাতালিনা দে কার্দোনেসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে ক্যাথারিনের অন্তঃপুরে দাসীর দায়িত্ব পালন করেন এই আইবেরিয়ান মুর।

‘দ্য স্প্যানিশ প্রিন্সেস’ ধারাবাহিকে আর্থার ও ক্যাথারিন; Image Source: collider.com

পথের নানা প্রতিকূলতা ও প্রাকৃতিক বৈরিতা উপেক্ষা করে ১৫০১ এর অক্টোবরে প্লাইমাউথে পৌঁছান ভাবী রাজবধূ। রাজা হেনরি মহাসমারোহে স্বাগত জানান তাকে। ঠিক তার পরের মাসের ১৪ তারিখে লন্ডনের সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন আর্থার ও ক্যাথারিন। তখন তারা দু’জনেই ১৫ বছরের কিশোর-কিশোরী। বিয়ের পর নবদম্পতি শ্রপশারের লুডলো ক্যাসেলে বসবাস শুরু করেন। আর্থার সেখানে ‘কাউন্সিল অফ ওয়েলস’-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন।

বিয়ের পাঁচমাসের ভেতরেই স্বামীকে হারান স্পেননন্দিনী! আর্থারের মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে জানা যায় না। কেউ বলে, হাইপার হাইড্রোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন যুবরাজ। আবার অনেকে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করেন যক্ষ্মাকে। কারণ যাই হোক। আর্থারের অকালমৃত্যু টিউডর রাজবংশের পরবর্তী ঘটনাবলি ও গতিপ্রকৃতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। আর তার থেকেও বেশি প্রভাবিত করে ক্যাথারিন অফ অ্যারাগনের জীবনকে।

বড় ছেলের মৃত্যুশোকে কাতর রানি এলিজাবেথ আরেকটি পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৫০৩ সালে টাওয়ার অফ লন্ডনে একটি শিশুকন্যার অকাল প্রসবের পর তিনিও পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। এদিকে সদ্যবিধবা ক্যাথারিনকে স্পেনে ফেরত পাঠালে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো রাজা সপ্তম হেনরিকে। আর রাজকুমার হেনরি (অষ্টম হেনরি) অর্থাৎ আর্থারের ছোট ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে দেওয়াটাও সহজ ছিল না বিভিন্ন ধর্মীয় জটিলতার কারণে। তাই তিনি নিজেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন ক্যাথারিনকে। কিন্তু মহারানি ইসাবেলার তীব্র বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।  

হ্যান্স হলবাইনের ক্যানভাসে অষ্টম হেনরি; Image Source; Wikimedia Commons

অবশেষে ১৫০৯ সালে সপ্তম হেনরির মৃত্যুর পর অষ্টম হেনরি সিংহাসনে বসেন এবং অতিসত্ত্বর তার বড় ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করেন। এজন্য অবশ্য তাকে পোপের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছিল। ইতিহাসকারদের মতে, তারা সুখী হয়েছিল- ক্যাথারিন ও হেনরি একসঙ্গে শিকারে যেতেন এবং তারা একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করতেন।

ইংল্যান্ডের প্রজাদের ভেতরেও তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল রানি ক্যাথারিনের। শুধুমাত্র প্রণয়সঙ্গিনী হিসেবে নয়, রাজনৈতিক প্রতিভার জন্যও হেনরির আস্থাভাজন ছিলেন তার অর্ধাঙ্গিনী। ১৫১৩ সালে যখন রাজা ফরাসিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে দেশের বাইরে ছিলেন তখন স্কটল্যান্ডের চতুর্থ জেমস ইংল্যান্ড আক্রমণ করে। সেই সঙ্কট মুহূর্তে রাজ প্রতিনিধি ক্যাথারিন ইংরেজ সেনাদের উদ্দেশে এমন ভীষণ উত্তেজনা সঞ্চারী ভাষণ দেন যে, ঐ যুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিজয়ের নেপথ্যে ওনার অবদানকে বিন্দুমাত্র খাটো করে দেখার অবকাশ থাকে না।

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে হেনরি আর ক্যাথারিনের সংসারে আপাতদৃষ্টিতে অশান্তির কোনো কারণ ছিলনা। কিন্তু তবুও ভেতরে ভেতরে তাদের দাম্পত্য জীবন ধীরে ধীরে বিষময় হয়ে উঠছিল। আর তার কারণ ছিল, হেনরির পুত্রসন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষা এবং ক্যাথারিনের বারংবারের ব্যর্থতা! ১৫১০ থেকে ১৫১৮ সালের মধ্যে রানি মোট ৬টি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। যাদের মধ্যে লেডি মেরি বাদে বাকি সকলেই হয় শৈশবেই মারা গিয়েছিল নয়তো মৃত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিল!

ফলস্বরূপ অধীর হেনরি ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং তার দরুন বেশ কিছু অবৈধ সন্তানেরও জন্ম হয়। যাদের মধ্যে হেনরি ফিটজরয়-ই একমাত্র ভাগ্যবান যে রাজকুমারের মর্যাদা পেয়েছিল। 

অ্যান বোলিনের প্রতিকৃতি; Image Source; Wikimedia Commons

কিন্তু ক্যাথারিনের কফিনে শেষ পেরেকটি বিঁধেছিল তখন, যখন রাজা অষ্টম হেনরি অ্যান বোলিন নামক এক নারীর মোহপাশে আবদ্ধ হন এবং তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। কারণ এতদিনের অবহেলা তখন অপ্রয়োজনীয়তায় পরিবর্তিত হয়- হেনরি তার প্রথম স্ত্রীকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন।

অবশ্য এই বিবাহ-বিচ্ছেদের ভাবনার পেছনে আরো একটি কারণ ছিল। এবং সেই কারণটিকেই যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে ১৫২৭ সালে পোপ ক্লেমেন্ট সপ্তমের কাছে বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করেন তিনি।

হেনরির ভাষ্যমতে, যেহেতু তিনি নিজেরই বড় ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করেছিলেন, যা কিনা খ্রিস্টমতাদর্শের পরিপন্থী তাই তাদের দাম্পত্যজীবন ছিল অভিশপ্ত। আর ক্যাথারিনের গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব ইত্যাদি এই পাপ-পঙ্কিল বৈবাহিক সম্পর্কেরই চরম পরিণতি।

ক্যাথারিন অবশ্য এই যুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি সর্বসমক্ষে নিজেকে হেনরির ধর্মসম্মত স্ত্রী দাবি করেন। তিনি বলেন, যুবরাজ আর্থারের সাথে তার বিয়ে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্ক তাদের ভেতর কখনোই গড়ে ওঠেনি। অর্থাৎ, আর্থারের মৃত্যুর পরেও তিনি ছিলেন যথাবৎ কুমারী! রাজবধূ ক্যাথারিনের এহেন জবানি তাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী অসংখ্য মানুষের সমালোচনা আর গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু করে রাখে।

সে যা-ই হোক, হেনরি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য তদবির বহাল রাখে। এদিকে পোপ ক্লেমেন্ট পড়েছিলেন মহা দোটানায়। কেননা, ক্যাথারিনের ঘর ভাঙায় সামিল হয়ে তার ভাগ্নে রোমান সম্রাট চার্লস পঞ্চমের রোষানলে পড়ার কোনো ইচ্ছেই তার ছিল না।

অন্যদিকে অষ্টম হেনরির সাথে শত্রুতার ফলাফলও যে পোপতন্ত্রের জন্য মোটেও মঙ্গলকর হবে না, সেটাও তার অজ্ঞাত ছিল না। তাই বিভ্রান্ত ও শঙ্কিত পোপ দীর্ঘ ৭ বছরেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন না। আর তার এই সিদ্ধান্তহীনতার জের ধরেই পত্তন ঘটে ইংলিশ রিফর্মেশন এর। 

                                               

হেনরি ১৫৩৩ এর জানুয়ারিতে অ্যান বোলিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেন। যদিও তার আগের বছর ডোভারে তারা গোপনে বিয়ে করে রেখেছিলেন বলে গুঞ্জন শোনা যায়। বিয়ের পাঁচমাস পরে নবনিযুক্ত আর্চবিশপ থমাস কার্নমার ক্যাথারিন অফ অ্যারাগন ও সপ্তম হেনরির বিবাহ বিচ্ছেদের সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। কারণ ইংলিশ রিফর্মেশনের ফলে ইংল্যান্ড, রোমান পোপতন্ত্রের এখতিয়ারের বাইরে চলে আসে।

হেনরির সাথে ছাড়াছাড়ির পর কিম্বল্টন প্রাসাদে নির্বাসিতা অবস্থায় ৩ বছরের মতো বেঁচে ছিলেন ক্যাথারিন অফ অ্যারাগন। তার শেষ দিনগুলো যে কতটা দুর্বিষহ ছিল, তার আভাস শুরুতেই দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসের এই ট্র্যাজিক চরিত্রকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে বহু বই; নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু চলচ্চিত্রও। সম্প্রতি ‘স্টারজ’ নেটওয়ার্কেও সম্প্রচার শুরু হয়েছে ‘দ্য স্প্যানিশ প্রিন্সেস’ নামক একটি ধারাবাহিকের, যার টিজারটি উপরে সংযুক্ত করা হয়েছে। চাইলে দেখে নিতে পারেন ক্যাথারিন অফ অ্যারাগনের মর্মান্তিক জীবনের এই নাট্যায়িত সংস্করণ।

This Bangla article is about the tragic historical character 'Catherine of Aragon' .

References:

1) Prof. L. Mukherjee, A Study of English History, 12th chapter

2)  www.historyextra.com 

3) www.britannica.com 

Featured Image: ew.com

Related Articles

Exit mobile version