আমেরিকার ইতিহাসে প্রায় বিশজন প্রেসিডেন্টকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে আততায়ীরা সফলভাবে চারটি হত্যাকান্ড সংগঠিতও কর। গুজব আছে প্রেসিডেন্ট জেসারি টেইলর এবং প্রেসিডেন্ট ওয়ারিং জি হার্ডিংও হত্যাকান্ডের শিকার। বিষ্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে তালিকার মধ্যে আব্রাহাম লিংকন, বিল ক্লিন্টন, এমনকি বারাক ওবামার মতো জনপ্রিয়রাও ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন সব রথী-মহারথীদের হত্যা করা হয় যেগুলো কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ইতিহাসে আলোচিত এমনই কিছু কুখ্যাত হত্যাকান্ড নিয়ে সাজানো হয়েছে লেখার দ্বিতীয় কিস্তি।
জন লেনন
সত্তরের দশকের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল ‘বিটলস’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা জন লেননকে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “আপনি কীভাবে মারা যাবেন বলে আপনার মনে হয়?” উত্তরে লেনন বলেছিল, “আমি সম্ভবত কোনো উন্মাদগ্রস্তের গুলির আঘাতে মারা যাবো!” জগতের স্রষ্টা মনে হয় আগে থেকেই তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাকে জানিয়ে দিয়েছিল। ১৯৮০ সালের ৮ই ডিসেম্বর মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান নামের এক উন্মাদের গুলিতে লেননের মৃত্যু হয়।
দিনটা ছিল সোমবার। ফটোগ্রাফার Annie Leibovitz লেননের বাড়িতে আসেন ‘রোলিং স্টোন’ ম্যাগাজিনের ফ্রন্ট কভারের জন্য ছবি উঠাতে, যেটাতে লেননের দ্বিতীয় স্ত্রী ওনোও থাকবেন। যদিও ফটোগ্রাফার বলেছিলেন “কেউ ওনো’কে ফ্রন্ট কভারে চাইবে না।” কিন্তু লেননের জিদের কাছে অ্যানিকে হারতে হয়। ছবি তোলা শেষ করে সাড়ে তিনটার সময় অ্যানি লেননের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হন। এরপর লেনন ডিজে ডেভ শাওলিনের কাছে RKO Radio Networkএ ব্রডকাস্ট হওয়া একটি শো সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দেন পাঁচটা চল্লিশের দিকে। এটাই ছিল লেননের শেষ সাক্ষাৎকার। ইন্টারভিউ শেষে স্ত্রী ওনো’কে নিয়ে তার ফিচারিংয়ে হওয়া গান ‘Walking on Thin Ice’ কম্পোজ করতে যান ‘রেকর্ড প্লান্ট স্ট্যুডিও’তে। যেটাতে লেনন লিড গিটারিস্ট ছিল।
রেকর্ড প্লান্ট স্টুডিওর দিকে যাওয়ার সময় অটোগ্রাফ এবং ফটোগ্রাফের জন্য ডাকোটার সামনে সব সময়ের মত ভক্তরা দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের মধ্যে হত্যাকারী ডেভিড চ্যাপম্যানও ছিল। সেদিন চ্যাপম্যান বিটলসের অ্যালবাম ‘ডাবল ফেন্টাসি’র একটি কপি লেননের দিকে এগিয়ে দেয়। লেনন অ্যালবামের কভারে অটোগ্রাফ দেওয়ার পর চ্যাপম্যান আর কিছু চায় কিনা জিজ্ঞেস করে। চ্যাপম্যান মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয়, এতোটুকুতেই সে সন্তুষ্ট। চ্যাপম্যান এবং লেননের কথোপকথনের মূহুর্তটা লেননের গানের ভক্ত পাওল গর্স তার ক্যামেরায় ধরে রাখে।
লেনন ডাকোটায় ফেরার আগে আনুমানিক দশটা পঞ্চাশ পর্যন্ত স্টুডিওতে ছিলেন। তার ইচ্ছে ছিল ওনোর সাথে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য স্টেজ ডেলি রেস্টুরেন্টে যাওয়ার আগে তিনি তার ছেলেকে ‘শুভ রাত্রি’ জানিয়ে আসবেন। লেনন তার অভ্যাস অনুযায়ী অনেক সময় নিয়ে অটোগ্রাফ এবং ফটোগ্রাফের জন্য অপেক্ষায় থাকা ভক্তদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ডাকোটার নিরাপদ প্রাঙ্গণ বাদ দিয়ে ৭২ স্ট্রিটে লিমুজিন থেকে নামেন। ডাকোটার দারোয়ান জস পারডোমো এবং কাছাকাছি অবস্থানরত ক্যাব চালকের ভাষ্য অনুযায়ী, চ্যাপম্যান আর্কওয়ের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল। লেনন সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় চ্যাপম্যানের সাথে চোখাচোখি হয়। এর কিছু সময় পরেই চ্যাপম্যান সরাসরি লেননের পিছনে অস্ত্র তাক করে এবং প্রায় তিন মিটার দূর থেকে ‘চার্টার আর্মস পয়েন্ট থার্টি এইট স্পেশাল রিভলবার’ দিয়ে লেননের পিঠ বরারবর পাঁচ রাউন্ড হলো-পয়েন্ট-বুলেট চালিয়ে করে। এগারোটা পনেরোর দিকে Roosevelt Hospital এর জরুরি বিভাগের ডাক্তাররা লেননকে মৃত ঘোষণা করেন।
চ্যাপম্যান কর্তৃক লেনন হত্যাকান্ডের কারণ অনেকটা অস্পষ্ট। তবে অনেকের ধারণা লেননের ধর্ম বিরোধী লেখা, বক্তব্য এবং বিশেষ করে তার উক্তি ‘Beatles’ more popular than Jesus’ শোনার পর ক্ষেপে গিয়ে চ্যাপম্যান তাকে হত্যা করে।
প্রথমদিকে ডেভিড চ্যাপম্যান বিটলস, বিশেষ করে লেননের ভক্ত ছিল। বিটলসের গানের কালেকশন সংগ্রহ করা, লাইভ স্টেইজ পারফমেন্স গুলোতে অংশগ্রহণ করা, নিজের গিটারে বিটলসের গানের কভার করা ছিল তার নেশা। তবে চ্যাপম্যান খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর লেননের লেখা, বক্তব্যগুলোর ব্যাপারে কিছুটা বিরুপ ভাব প্রকাশ করা শুরু করে। তাছাড়া চ্যাপম্যানের ভাষ্য অনুযায়ী, “লেনন বলতো- ‘imagine, no possessions’। কিন্তু সে ছিল কয়েকটা ফার্ম, ইয়ট এবং মিলিয়ন ডলারের মালিক। আদতে আমরা যারা তার কথায় (লেননের কথা এবং কাজের মধ্যে ভিন্নতা) বিশ্বাস করি, তার রেকর্ড কিনে, তার মিউজিকের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ইন্ড্রাস্টিকে উপরে উঠিয়ে দিয়েছি, সেই আমাদের উপর সে হাসতো।”
এ কথায় বোঝা যায়, লেননের গানে সমান অধিকারের কথা, ধনী গরীবদের সমতার কথা থাকলেও লেননের আর্থিক এবং চালচলনের দিক থেকে তার নিজস্ব কথাগুলোর থেকে ভিন্ন ছিল। চ্যাপম্যানের কাছে তেমনটাই মনে হতো। আর এ কারণগুলোই চ্যাপম্যানকে আরো বেশি উগ্র করে তুলে। যা পরবর্তীতে তাকে লেনন হত্যাকান্ডে প্ররোচিত করে।
কারাগারে চ্যাপম্যানকে পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সাইকোলজিস্টরা অবশ্য তাকে ‘সিজোফ্রেনিক’ রোগী হিসেবে দেখিয়েছে।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র
কৃষ্ণাঙ্গদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সবচাইতে বেশি কাজ করে যাওয়া মানুষটি মার্টিন লুথার কিং। ১৯৫০ মধ্যবর্তী সময় থেকে আমৃত্যু তিনি ছিলেন আমেরিকান সিভিল রাইট মুভমেন্টের নেতা। ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহন করা এই কিংবদন্তি পৃথিবী জুড়ে তার বিখ্যাত ভাষন, “আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ এর জন্য বেশি জনপ্রিয়। সর্বকনিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ নোবেল জয়ী হিসেবে তার নামই সবার আগে ইতিহাসে আসে। কিন্তু তার পরিচিতি, জনপ্রিয়তা, এমনকি শান্তিতে পাওয়া নোবেল পুরষ্কারও তাকে আততায়ীর হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি।
সময়টা ছিল ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার। মেমফিসে অবস্থিত লরাইন মোটেলে অবস্থান করছিল মার্টিন লুথার কিং। সেখানকার সিটি স্যানিটেশন কর্মীদের ধর্মঘটকে সমর্থন দেওয়ার জন্য তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। বায়োগ্রাফার টেইলর ব্রাঞ্চের লেখা মার্টিন লুথারের জীবনী থেকে জানা যায়, সেদিন লুথার সর্বশেষ কথা বলেন বেন ব্রাঞ্চ নামক একজন গায়কের সাথে। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ইভেন্টটাতে বেন যাতে “Take my hand, precious lord” গানটা গেয়ে শোনান সেই অনুরোধই করেছিলেন মার্টিন লুথার কিং।
তখন সন্ধ্যা ছয়টা এক মিনিট। লুথার কিং মোটেলের ৩০৬ নাম্বার কামরার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় জেমস আর্ল রে নামক শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদী যুবকের গুলিতে নিহত হন। হত্যাকান্ডে জেমস রেমিংটন ৩০-০৬ রাইফেল ব্যবহার করে, যা ছদ্মনামে দিন পাঁচেক আগে সে কিনেছিল। গুলি করার পর বুলেটটি লুথারের ডান গাল ভেদ করে, স্পাইনাল কর্ড হয়ে ঘাড়ের শিরা ছিড়ে ফেলে। তিনি জ্ঞান হারিয়ে বারান্দায় পড়ে যান। ঐদিনই রাত সাতটা পাঁচ মিনিটে সেন্ট জোসেফ হসপিটালের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পুলিশ রাস্তার পাশে অবস্থিত ক্যানিপ’স অ্যামিউজমেন্ট ষ্টোরের বাইরের একটি বাক্স থেকে কাগজে পেঁচিয়ে ফেলে রাখা রাইফেল, অব্যবহৃত কিছু বুলেট এবং একটি দূরবীন আবিষ্কার করে, যাতে পরবর্তীতে জেমস আর্ল রে এর হাতের ছাপ পাওয়া যায়। প্রত্যক্ষদর্শী এবং ষ্টোরের মালিকের ভাষ্য অনুযায়ী, কেউ একজন কাগজের মোড়ানো প্যাকেটটা রেখে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
হত্যাকান্ডের প্রায় দুই মাস পরে, জুন মাসের আট তারিখে লন্ডন হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে জেমস ধরা পড়ে। হত্যাকান্ডের দায়ে তার ৯৯ বছরের কারাদণ্ড হয় এবং কারাগারে থাকা অবস্থায় ১৯৯৮ সালে ৭০ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
প্রথম কিস্তিঃ ইতিহাসে আলোচিত কুখ্যাত হত্যাকান্ডগুলো