১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে তিনজন নভোচারী অ্যাপোলো ১১ নভোযানে করে চাঁদের বুকে পা রেখেছিলেন। বর্তমানে আমরা মহাকাশ অভিযানের যুগে বাস করছি। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে চাঁদে বা মঙ্গল গ্রহে কিংবা আরো দূরের কোনো গ্রহে যাওয়া যেন মামুলি ব্যাপার। কিন্তু একটি সময় ছিল যখন চাঁদে যাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। সেখানে যাবার জন্য কোনো রাস্তা নেই, নেই কোনো মাধ্যমে। সেজন্য সেখানে যাওয়ার কথা মানুষ কল্পনাও করতে পারতো না। চাঁদের বুড়ি কিংবা আয় আয় চাঁদ মামার মতো গল্প উপকথাই শুধু প্রচলিত ছিল চাঁদকে নিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে কেউ যদি চাঁদে গমন করে এবং সেখান থেকে নিরাপদে ফিরেও আসে তাহলে তা বিশ্বব্যাপী কেমন আলোড়ন তৈরি করবে তা ভাবা যায়?
ছোট একটি উদাহরণ দিতে পারি। ১৯৬৯ সালের দিকে ‘নাবিস্কো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ফ্যাক্টরি’ বিদ্যমান ছিল। সে সময় এটিই ছিল অদ্বিতীয়। সুদূর আমেরিকার লোকদের চন্দ্রবিজয়ের উল্লাসে নাবিস্কোও যুক্ত হয়েছিল। এক বিজ্ঞাপনে নাবিস্কো বলে, “আমরা ব্যর্থ হয়েছি আপনাদের চন্দ্রাভিযানের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে। তবে এ গৌরব অর্জনে আমাদের খুব বেশি দেরী নেই বোধ হয়।” আসলে এ বিজয় শুধু আমেরিকারই নয়, এটি ছিল সমস্ত পৃথিবীর বিজয়। সেজন্য বাংলাদেশের এক বিস্কুট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বলছে চন্দ্রাভিযানকারীরা যদি খাদ্য হিসেবে তাদের পণ্য গ্রহণ করে নিতো তাহলে পুরো প্রতিষ্ঠানটি ধন্য হয়ে যেতো।
যেহেতু পুরো পৃথিবীর জন্যই আনন্দের খবর তাই এর উদযাপনও হয় বিশ্বব্যাপী। সারা বিশ্বের মানুষ তো একযোগে উদযাপন করেছেই, পাশাপাশি তিন চন্দ্রবিজয়ীকেও অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই চাঁদের বুকে পা রাখেন তারা। সেখানে ২১ ঘণ্টা অবস্থান করে আবার ফিরে আসেন পৃথিবীতে। তাদের সেই ফিরতি যান পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল স্পর্শ করে ২৪ তারিখে। তবে এ সময় তারা পৃথিবীতে অবতরণ করলেও তাদেরকে কোথাও বের হতে দেয়া হয়নি, একটি আবদ্ধ চেম্বারে পৃথিবীর অন্য সকল কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে দেয়া হয়েছিল টানা ২১ দিন।
কেন আলাদা করে রাখা হয়েছিল তার পেছনেও কারণ আছে। বর্তমানে আমরা জানি চাঁদের বুকে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু তৎকালে ধারণা ছিল চাঁদেও হয়তো প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবাণু থাকলেও থাকতে পারে সেখানে। সেসব জীবাণু চন্দ্রাভিযানকারীদের গায়ে লেগে চলেও আসতে পারে এ পৃথিবীতে। যেখানে পৃথিবীর পরিচিত জীবাণুকে প্রতিহত করে রাখতেই বিজ্ঞানীদের অবস্থা কাহিল হয়ে যায়, সেখানে চাঁদ থেকে সম্পূর্ণ অপরিচিত জীবাণু যদি পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে কী অবস্থা হতে পারে? সেজন্য পৃথিবীকে ঝুঁকিতে না ফেলার জন্য সতর্কতা হিসেবে তাদেরকে চেম্বারে রেখে দেয়া হয়েছিল এবং পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল তারা আদৌ কোনো জীবাণু বহন করে নিয়ে এসেছেন কিনা। পরে দেখা গেল তারা কোনো জীবাণু বহন করছেন না এবং আরো পরে দেখা গেল চাঁদে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনাই খুব ক্ষীণ। তাই পরবর্তীতে চন্দ্রাভিযান থেকে ফিরলে নভোচারীদেরকে এরকম চেম্বারে রাখার আর প্রয়োজন হয়নি।
চেম্বার থেকে বের হবার পরপরই আরেক অভিযান শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট থেকে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন জানান যুক্তরাষ্ট্রের এই বিজয়ের আনন্দ সমগ্র পৃথিবীর সাথে ভাগাভাগি করা হবে এবং সেই সাথে মহাকাশ অভিযান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও জানানো হবে। সে লক্ষ্যে ২৩টি দেশের মোট ২৭টি শহর ভ্রমণের পরিকল্পনা তারা করেন। ২৩টি দেশের তালিকায় তৎকালীন পাকিস্তানও ছিল, শহরের তালিকায় ঢাকাও ছিল। তাদের অভিযান শুরু হয় ২৯শে সেপ্টেম্বর। প্রথমেই তারা মেক্সিকো সিটিতে অবতরণ করেন। পরিকল্পনা অনুসারে তাদের ঢাকায় আসার সময় নির্ধারিত হয় ২৭ অক্টোবর। এ খবর অনেক আগেই জেনে যায় বাংলাদেশীরা। দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় ২ অক্টোবরেই তাদের আগমনের খবর প্রকাশিত হয়।
এতে উল্লসিত হয়ে যায় বাংলার মানুষ। এমনকি চন্দ্রবিজয়ীদের সংবর্ধনা জানানোর জন্য সরকারি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হয়। ১৭ তারিখে দৈনিক পূর্বদেশ-এ প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে লেখা ছিল-
চন্দ্রবিজয়ীদের যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে সংবর্ধনা জানানোর উদ্দেশ্যে ঢাকায় এক ব্যাপক প্রস্তুতিপর্ব চলছে। এপোলো ১১ এর তিনজন নভোচারী আগামী ২৭ অক্টোবর এখানে আগমন করবেন।
নভোচারী নেইল আর্মস্ট্রং, এডুইন অলড্রিন ও মাইক্যাল কলিন্স্ একটি মোটর গাড়ি করে ঢাকার রাজপথ অতিক্রম করবেন। এতে অধিক সংখ্যক লোক তাদের দেখতে ও সম্বর্ধনা জানাতে সুযোগ পাবে।
প্রাদেশিক চীফ সেক্রেটারী ও অভ্যর্থনা কমিটির সদস্যরা বিমানবন্দরে নভোচারী ও তাদের স্ত্রীদের অভ্যর্থনা জানাবেন। তারা ঢাকায় মাত্র একদিন অবস্থান করবেন এবং সেই দিনই প্রাদেশিক গভর্নর প্রদত্ত এক সম্বর্ধনায় যোগ দেবেন। চন্দ্রবীররা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করবেন।
তাদের দেখার উদ্দেশ্যে স্কুলের ছেলেমেয়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। চন্দ্রবীররা পরের দিন ঢাকা ত্যাগ করবেন।
চাঁদের হিরোদের আগমন নিয়ে দেশের লোকজন এবং পত্র-পত্রিকা এতই উচ্ছ্বসিত ছিল যে পুরো ঢাকা শহরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সুসজ্জিত করার আমেজ পড়ে যায়। উচ্চপদস্থ কোনো অতিথি এলে প্রাসঙ্গিক কিছু এলাকা ও কিছু রাস্তা পরিষ্কার করা হয়, কিন্তু পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির নজির হয় না সাধারণত। কিন্তু চন্দ্রবিজয়ীদের আগমন উপলক্ষে শহর পরিষ্কার করার বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়। ২১ অক্টোবরে দৈনিক পূর্বদেশ-এ প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিটি এরকম-
চন্দ্রলোক থেকে ফেরা তিন জন মার্কিন মহাশূন্যচারী বিশ্ব সফরে আগামী ২৭শে অক্টোবর ঢাকায় আসছেন। আর এই উপলক্ষে শহরের রাজপথগুলোকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও ঝকঝকে করে তোলা শুরু হয়েছে। কোথাও রাস্তার আইল্যান্ডগুলোর পাকা সীমানাগুলোয় চুন দেয়া হচ্ছে, কোথাও ভাঙাচোরা জায়গাগুলো সিমেন্ট বালি দিয়ে মেরামত করা হচ্ছে, আবার কোথাও ফুটপাতের উপর থেকে ময়লা আগাছা লতাগুল্ম ঘাসপাতা পরিষ্কার করা হচ্ছে এবং কোথাও কোথাও রাস্তার পাশের নোংরা দেয়ালগুলো ঘষেমেজে পরিষ্কার করা হচ্ছে, চুনকাম করে ঝকঝকে করে তোলা হচ্ছে। ঢাকা শহরের নতুন পুরাতন এলাকার রাস্তাঘাটে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা এমনিতে বড় দেখা যায় না।
সময়সূচী অনুসারে ২৭ তারিখ ঢাকায় আসেন চন্দ্রবিজয়ী ও তাদের সহধর্মিণীরা। তাদের দেখতে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে বিমানবন্দরে এবং তার আশেপাশে রাস্তার দু’ধারে। লোক সমাগম এতই বেশি ছিল যে পুলিশের বেষ্টনী ভেঙ্গে লোকজন বিমানের সিঁড়ির দিকে ছুটে চলে যায়। দৈনিক ইত্তেফাক-এর ভাষ্যে, পুলিশের পক্ষে জনতার চাপ নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর ছিল। একসময় লোকজনকে কোনোক্রমে সরিয়ে তাদেরকে বিমান থেকে বেরিয়ে আসতে রাস্তা করে দেয় পুলিশ। তারপর সেখান থেকে চন্দ্রবিজয়ী ও তাদের সহধর্মিণীরা নেমে আসেন। পত্রিকার আকর্ষণ বিজয়ীদের দিকে তো ছিলই, পাশাপাশি তাদের স্ত্রীদের দিকেও ছিল। নারী সাংবাদিকদের বড় আকর্ষণ ছিল তারাই।
তাদেরকে পৌঁছে দিয়েছিল সুরক্ষিত বিমান ‘এয়ারফোর্স ওয়ান’। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের আনা-নেয়ার কাজে এটি ব্যবহৃত হতো। তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণের পর শহরের অনেক রাস্তা ঘুরিয়ে দেখানো হয়। তাদের গাড়ির ছাঁদ ছিল খোলা। ফলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দূর থেকেই জনতা তাদের দেখতে পেয়েছিল। কয়েক মাইল ভ্রমণের পর তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। এটি শেরাটন হোটেল বা রূপসী বাংলা হোটেল নামে বর্তমানে সমধিক পরিচিত। সেখানে তাদেরকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। যতক্ষণ তারা ঢাকায় অবস্থান করেছেন ততক্ষণ তাদেরকে দেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা।
মেক্সিকো সিটি থেকে শুরু করে সর্বশেষে জাপানের টোকিওতে পৌঁছান ৪ নভেম্বর। এটিই তাদের গন্তব্যের সর্বশেষ শহর। এরপর ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে তাদের বিশ্বভ্রমণ সমাপ্ত করেন।
ফিচার ছবি- লাইফ