রোজকার সংবাদ পত্র খুললেই আমাদের চোখে নানা রঙের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। প্রচারেই প্রসার এই কথাকে সামনে রেখে ব্যাপক বিজ্ঞাপন দেখা যায় মিডিয়ায়। বিভিন্ন প্রোডাক্ট এবং ব্র্যান্ডের প্রতিযোগিতা চলছে, কার আগে কে টিকে থাকবে। তাই কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। হোক সে বিজ্ঞাপনটি সুশ্রী বা কুশ্রী, পছন্দনীয় বা অপছন্দনীয়, ভাল বা মন্দ, শিক্ষণীয় বা বর্জনীয়, প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক।
সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, কোল্ড ড্রিংক্স-হট ড্রিংক্স, শাড়ি-কাপড়, জমি-জমা, কাগজ-কলম, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, টয়লেট ক্লিনার-বডি ক্লিনার, আলতা-স্নো, প্লাস্টিক-রড; এমন কোনো জিনিস নেই যেটার বিজ্ঞাপন দেয়া হয় না। এমনকি পত্রিকার বিশেষ কিছু পাতা খুললে বর-কনের বিজ্ঞাপন ও চোখে পড়ে। পাত্র চাই/পাত্রী চাই শিরোনামে নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করে দেয়া হয় পাত্র-পাত্রীর চারিত্রিক ও শারীরিক গঠনের বিবরণ।
বিজ্ঞাপনের ইতিহাস
বিজ্ঞাপনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, প্রাচীন মিশরীয়রা পণ্য বিক্রয়ের জন্য পণ্যের বিস্তারিত তথ্য ও গুণাগুণ জানাতে প্যাপিরাস ব্যবহার করত। প্রাচীন আরব ও ধ্বংসপ্রাপ্ত রোমান নগর পম্পেইতেও বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের নমুনা পাওয়া যায়। ইনান (Tsinan) বর্তমান পূর্ব চীনের এক পরিচিত শহর ভ্রমণপিপাসুদের কাছে। এই ইনান শহর সভ্যতা ও ব্যবসা বাণিজ্যের জন্যও বিখ্যাত। এই শহর ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে তাদের সভ্যতা, পণ্যের ব্যবহার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য। এই ইনান শহর থেকেই খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ বছর আগে গঠনমূলক বিজ্ঞাপনের যাত্রা শুরু। সেখানকার ‘নিও ফ্যামিলি নিডল শপ’ তাদের তৈরিকৃত সুই বিক্রয়ের জন্য ব্রোঞ্জের প্লেটে খোদাই করে সর্বপ্রথম বিজ্ঞাপন দেয়। এমনকি সেই বিজ্ঞাপনের ভাষার সাথে বর্তমান বিজ্ঞাপনের ভাষার অনেক মিলও রয়েছে। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিলো,
“We buy high quality steel rods and make fine quality needles, to be ready for use at home in no time.”
বাংলা বিজ্ঞাপনের ইতিহাস
প্রথম বাংলা হরফে বিজ্ঞাপন ছাপা হয় ১৭৭৮ সালে ‘Calcutta Chronicle‘ ইংরেজি পত্রিকায়। পঞ্চানন কর্মকার প্রকাশ করেন এই বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটি ছিলো বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ক এক বইয়ের। এরপর ধীরে ধীরে বাংলায় প্রকাশিত হতে থাকে নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন। কেমন ছিলো সেসময়কার সাদা-কালো যুগের বাংলা বিজ্ঞাপন?
এখনকার মতো সেসময়কার বিভিন্ন বিজ্ঞাপনও ছিলো অনেক ক্ষেত্রে সত্য বর্জিত। এখন যেমন বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে অনেক সময় অপ্রাসঙ্গিক মিথ্যা নানা গুণের কথা বলা হয়, সেসময়ও এমনই ছিলো। যেমন- উপরের শ্রী মতিলাল বসু এণ্ড কোম্পানির এই বিজ্ঞাপনে “লক্ষ্মীবিলাস তেল” এ যাবতীয় শিরঃপীড়া ও হাত-পা জ্বালা বন্ধ হওয়া, সুগন্ধী ‘গোলাপ সার’-এর সুগন্ধে মাথা ঠাণ্ডা হওয়া, গাছগাছড়ায় প্রস্তুত কুইনাইন বর্জিত ‘সুধাসিন্ধু রসে’ প্লীহা ও যকৃত সংক্রান্ত জ্বর, ম্যালেরিয়া ও পুরাতন জ্বর থেকে আরোগ্য লাভ করা ইত্যাদি দাবি করা হয়েছে! অবশ্য গ্যারান্টি দেওয়া হয়নি। এ বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয়েছিলো বাংলা ১৩১৫ সনে। অর্থাৎ আজ থেকে ১১০ বছর আগে!
উপরের বিজ্ঞাপনটি ক্যালকাটা কেমিক্যালের মার্গো সোপ এর। বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয়েছিল আনুমানিক বংলা ১৩৪৪ সনে। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৮১ বছর আগে। শুরু থেকেই নিম গাছের উপকারিতা উপলব্ধি করে এই কোম্পানি অনেক সামগ্রীতেই (মার্গো সাবান, নিম টুথপেস্ট, রেণুকা টয়লেট পাউডার) নিমকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিলেতি সাবান ও টুথপেস্টের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগুলোর বিক্রিও মন্দ হতো না। মার্গো সাবান ও নিম টুথপেস্ট পরে একসময়ে হেঙ্কেল ইণ্ডিয়া লিমিটেড কিনে নেয়। সেই হেঙ্কেল ইণ্ডিয়া এখন জ্যোতি ল্যাবোরেটরিজ লিমিটেড কোম্পানি নামে পরিচিত ।
এটিও ক্যালকাটা কেমিকোর আরেকটি বিজ্ঞাপন। এই বিজ্ঞাপনে তাদের ‘নিম টুথপেস্ট’ এর গুণাগুণ উল্লেখ করেছে। বিজ্ঞাপনে সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই দাঁতের সুরক্ষার জন্য নিম টুথপেস্ট ব্যবহার শেখাতে বলছে। এখনকার টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের ভাষার সাথে তেমন কোনো পার্থক্যই নেই।
বিজ্ঞাপনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এখন যেমন বিভিন্ন চিত্রনায়ক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, খেলোয়াড় ও তারকারা বিজ্ঞাপন করেন, সেসময়ও তেমনি বিভিন্ন খ্যাতিমান লেখক, অভিনেতা, তারকাদের দিয়ে বিজ্ঞাপন করানো হতো।
উপরের বিজ্ঞাপনটি ‘কুন্তলীন’ নামক কেশ-তেলের। স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিজ্ঞাপনটি লিখেছিলেন। বিজ্ঞাপনে লেখা আছে, “কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন :- কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া এক মাসের মধ্যে নুতন কেশ হইয়াছে।” এমনকি সেই সাথে কুন্তলীন কেশ তেল নিয়ে কবির লেখা একটি গানের অংশ বিশেষ ও উল্লেখ করা হয়েছে বিজ্ঞাপনে।
কুন্তলীনের এই বিজ্ঞাপনটি আজ থেকে প্রায় ৭৬ বছর আগে প্রকাশিত হয়। ‘কুন্তলীন’ তেলের জনক হেমেন্দ্র মোহন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। তাই বলে বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুন্তলীনের গুণগান নিছক বন্ধুপ্রীতির জন্য মনে করা হলে ভুল করা হবে। বিজ্ঞাপনজগতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাম অকাতরে ব্যবহার করতে দিয়েছেন।
উপরের বিজ্ঞাপনটি কলকাতার রেডিয়ম ল্যাবটরী কর্তৃক প্রকাশিত তাদের স্নো, ক্রিম, কেশ তেল, লাইম জুস, তিল তেল ও গ্লিসারিনের বিজ্ঞাপন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রেডিয়ম ল্যাবটরীর বিজ্ঞাপনও করেছেন। রেডিয়াম ক্রিম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “রুপচর্চার জন্য স্নো ও ক্রিমজাতীয় প্রসাধন যারা ব্যবহার করেন, তারা রেডিয়াম ফ্যাক্টরির তৈরি ক্রিম ব্যবহার করে দেখুন, বিদেশি পণ্যের সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবেন না।”
ঘি থেকে শুরু করে স্নো-পাউডার, এমনকি হারমোনিয়াম পর্যন্ত প্রায় শতাধিক বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের লিখিত বাণী দেখা যায়। সেই সময় লেখার জন্য বাজারে পাওয়া যেত সুলেখা কালি। ডট পেন, জেল পেন ইত্যাদি তখনও বাজারে আসেনি। ঝর্ণা কলম বা ফাউন্টেন পেনে এই কালি ভরে লোকে লিখতো। সুলেখা কালির বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “সুলেখা কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।”
অল্প কথায়, এরকম আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন এখন আর চোখে পড়ে না। বিদেশি কোম্পানি পার্কারের Quink এবং শেফার্সের Skrip এর সঙ্গে পাল্লা দিতে হয়েছিল সুলেখাকে। ফাউন্টেন পেনের ভালো কালি বানানো সহজসাধ্য ছিল না। কালি যেন শুকিয়ে গিয়ে নিব দিয়ে কালি ঝরা বন্ধ না করে- কালির উপাদান নির্বাচনে সেটি ছিল মস্ত বড় বিষয়। তাছাড়া লেখা যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে না হয়, সহজে উৎপাদন করা যায়– সবই ছিল বিবেচ্য বিষয়। রবীন্দ্রনাথের এই ঢালাও সুখ্যাতি সুলেখা কালিকে বাজারে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছিলো– সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
১৯৬০ সালে ‘দেশ সাহিত্য সংখ্যা’ থেকে আরেকটি বিজ্ঞাপনের সন্ধান পাওয়া যায়। এটি হলো ‘কাজলকালী’র বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের ভাষাটি ছিলো, “কাজলকালী ব্যবহার করে সন্তোষ লাভ করেছি, এর কালিমা বিদেশী কালীর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়- ইতি ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩০, শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”
উপরের বিজ্ঞাপনটি বোর্ন-ভিটার। এ বিজ্ঞাপনেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। বিজ্ঞাপনে কবির স্বহস্তে লেখা চিঠিতে দেখা যাচ্ছে তিনি লিখেছেন, “বোর্ন-ভিটা সেবনে উপকার পাইয়াছি।”
রবীন্দ্রনাথের আরেকটি জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন ছিল ‘জলযোগ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ এর জন্য। ঐ বিজ্ঞাপনে তিনি লিখেছিলেন,
“জলযোগের বানানো মিষ্টান্ন আমি চেখে দেখেছি। এটা আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে। এর আলাদা স্বাদ আছে।” জলযোগ সে যুগে কেকের জন্য বিখ্যাত হলেও রবীন্দ্রনাথের সার্টিফিকেটের সুবাদে মিষ্টান্ন জগতেও প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ পেয়েছিল।
সেসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক বিজ্ঞাপন লিখেছিলেন। তাঁকে লিখতে হয়েছিলো, তাঁর নিজের জন্য ও তাঁর শান্তিনিকেতনের জন্য! এমনকি এস সি রায় এন্ড কোং এর ড. উমেশচন্দ্র রায়ের কথিত পাগলের মহৌষধের বিজ্ঞাপনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর করেছিলেন।
উপরের বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে, ভারতবর্ষের পূর্ব রেলওয়ের বিজ্ঞাপনেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা ব্যবহার করা হয়েছে। পূর্ব রেলওয়ের বিজ্ঞাপনে কবির ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতার দু’লাইন তুলে দেয়া হয়েছে। এয়ারলাইন্সের বিজ্ঞাপনেও রবীন্দ্রনাথের লেখা পাওয়া যায়। কবি ‘কে এল এম রয়াল ডাচ’ এয়ারলাইন্সের জন্য বিজ্ঞাপন লিখেছিলেন। রয়াল ডাচ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ সেই বিজ্ঞাপন ‘গুরুদেবের বিমান যাত্রা’ শিরোনামে বিশ্বভারতী পত্রিকায় প্রকাশ করেছিল।
তথ্যসূত্র
রবীন্দ্র প্রসঙ্গ, আনন্দবাজার, প্রথম খণ্ড
ফিচার ইমেজ: আনন্দবাজার