ধরুন, আপনি উত্তর ইংল্যান্ডের কোনো এক উপকূলীয় এলাকায় গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। সমুদ্রের নোনা হাওয়ার ঝাপটা একটু পর পর আপনার শরীর স্পর্শ করছে। আপনি চোখ বুজে উপভোগ করছেন প্রতি মুহুর্ত। এমন মুহুর্তগুলো উপভোগের ফাঁকে আপনি সামনের দিনের জন্য পরিকল্পনার কাজও সেরে নিচ্ছেন। আপনি হয়তো উত্তর ইংল্যান্ডের একজন জেলে। পরের দিন কোথায় মাছ ধরবেন, কখন বাড়ি থেকে বেরোবেন– তা ঠিক করে নিচ্ছেন। অথবা একজন কৃষক। পরের দিন কোথায় জমি কর্ষণ করতে হবে, ফসলের গোড়ায় পানি দিতে হবে কিনা, আকাশের অবস্থা কেমন– তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন।
জীবন নিয়ে বাস্তবিক ভাবনার জগতে হারিয়ে যাওয়ার কিছু সময় পর হঠাৎ আপনার সংবিৎ ফিরে এলো। দেখতে পেলেন, দূর সমুদ্র থেকে লম্বা লম্বা জাহাজে করে ভিনদেশি কিছু মানুষ গর্জন করতে করতে উপকূলের দিকে ছুটে আসছে। আপনি হঠাৎ সেই মানুষগুলো সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠলেন, তারা উপকূলে নোঙর করার পরে কী করতে পারে, নিরাপদ দূরত্বে থেকে তা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পরক্ষণে যা দেখলেন, তাতে আপনার শরীর শিউরে উঠল। দেখলেন, ভিনদেশি মানুষগুলো অসীম হিংস্রতায় দু’মুখো কুড়াল দিয়ে সামনে যা পাচ্ছে সবকিছু ফালাফালা করছে, লুটপাটের পর জনশূন্য বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করছে। পবিত্র মঠগুলোতে আক্রমণ করে সেখানকার মূল্যবান সম্পদ লুট করে তা জাহাজ বোঝাই করে আবার চলে যাচ্ছে। তাদের আগমনের সময় যেমন আকস্মিকতা ছিল, ঠিক একইভাবে তারা প্রস্থান করল। তাদের পরবর্তী গন্তব্য সম্পর্কে আপনার ন্যূনতম ধারণা নেই।
নবম ও দশম শতাব্দীতে ইউরোপের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে এই ধরনের ঘটনা ছিল খুবই স্বাভাবিক। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চল তথা আজকের সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্কের অধিবাসীরা ৭৯৩-১০৬৬ সালের মধ্যে ব্রিটিশ উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এই সময়কে বলা হয় ‘ভাইকিং এজ’ (Viking Age)। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের অধিবাসীদের ভাষা অনুযায়ী ভাইকিং শব্দের বাংলা পরিভাষা দাঁড়ায় ‘জলদস্যু’। বাস্তবে ভাইকিংরা গতানুগতিক জলদস্যুদের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল সবদিক থেকেই।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মানুষেরা কেন এভাবে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপজুড়ে দুধর্ষ আক্রমণ চালিয়ে বেড়াত, তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতবিভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের জীবিকার্জনের পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। তাই সেখানকার অধিবাসীরা জীবিকার তাগিদে দস্যুতার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। আবার কেউ বলেন, ইউরোপের তৎকালীন রাজতন্ত্রের অন্তর্কোন্দলের সুবিধা কাজে লাগিয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ানরা নিজেদের সম্পদশালী করতে চেয়েছিল, তাই তারা এই পথ বেছে নেয়।
এবার তাদের সামরিক কৌশল নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। ভাইকিংরা যেহেতু চলাচলের পথ হিসেবে সমুদ্রকেই বেছে নিয়েছিল, তাই তাদের প্রধান বাহন ছিল জাহাজ। তাদের জাহাজগুলো গতানুগতিক জাহাজের মতো ছিল না। এগুলো ছিল সেই সময়ের জাহাজগুলোর তুলনায় খানিকটা লম্বা এবং হালকা, যাতে নাবিকেরা খুব সহজেই দিক পরিবর্তন করতে পারেন। ‘ড্রাক্কার’ নামের এই জাহাজগুলো বানানোর দায়িত্ব দেয়া হতো একদল বিশেষজ্ঞ কাঠমিস্ত্রীকে, যাদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তির উপর জাহাজ তৈরির কাঠ নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পিত হতো। ডেভিড ফার্নান্দেজ আবেয়া নামের একজন বিশেষজ্ঞের মতে, “মধ্যযুগের আগপর্যন্ত ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী সভ্যতাগুলোর কোনো জাহাজই আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয়ার মতো উপযুক্ত ছিল না। অথচ ভাইকিংদের দীর্ঘ জাহাজগুলো অনায়াসে পৃথিবীর যেকোনো সাগর পাড়ি দিতে পারত।“
ভাইকিংদের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে প্রধান ছিল ধারালো দু’মুখো তলোয়ার। ধারণা করা হয়, আজকের জার্মানি থেকে এসব ধারালো তলোয়ার সেসময় স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় রপ্তানি করা হতো (বলা রাখা ভালো, সেসময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো তলোয়ার তৈরি হতো জার্মানিতেই)। জার্মানির বিভিন্ন দেশের রাজ্যের শাসকেরা যখন বুঝতে পারেন এসব তলোয়ার তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হচ্ছে, তখন তারা এই তলোয়ার রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ভাইকিংদের পছন্দের কুড়ালগুলো আক্রমনের সময় প্রতিপক্ষের উপরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতো, কারণ সেসময় এমন কোনো জিনিস ছিল যা এই কুড়াল দিয়ে দুই টুকরা করা যেত না। এছাড়াও নৌযুদ্ধের সময় স্থানীয় জাহাজগুলোর উপর বৃষ্টির মতো তীর ও বর্শা নিক্ষেপ করতে পারদর্শী ছিল ভাইকিংরা, যা তাদেরকে বাড়তি সুবিধা এনে দিত।
তবে ভাইকিংদের সবচেয়ে বড় যে অস্ত্র ছিল, তা হচ্ছে তাদের খুনে মানসিকতা। সাধারণত একটি অভিযানে একই এলাকার বা ছোট থেকে একসাথে বড় হওয়া একদল যোদ্ধাকে প্রেরণ করা হতো। একজন ভাইকিংয়ের জন্য সবচেয়ে লজ্জাজনক ব্যাপার ছিল পরিচিত মানুষের সামনে যুদ্ধে পরাজিত হওয়া। যুদ্ধ কিংবা আক্রমণ শেষে যেখানে একই জাহাজে পাশাপাশি বসে মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে হবে, সেখানে কে-ই বা পরাজয়ের গ্লানি কাঁধে বয়ে নিতে চাইবে? আর স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সংস্কৃতিতে যুদ্ধের বিজয়ীদের খুব বড় ও মহৎ করে দেখার যে প্রচলন ছিল, তাতে পরাজিতের জন্য কোনো সহানুভূতির স্থান ছিল না। এ কারণে কোনো আক্রমণের সময় ভাইকিং যোদ্ধারা জয়ের জন্য বাড়তি চাপ অনুভব করতেন, যেগুলো তাদের দক্ষতাকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিপক্ষ বিরুদ্ধে প্রকাশ করতে সহায়তা করত।
ভাইকিংদের আরেকটি বড় সুবিধা ছিল একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আবির্ভূত হওয়ার বিষয়টি। ভাইকিং লংবোটগুলোর খুব দ্রুতগতির হওয়ার কারণে এগুলো হুট করে কোনো উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানতে পারত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে রাজা ও তার পুত্রদের মধ্যে হয়তো গোলযোগ চলছে, এই সুযোগে অরক্ষিত উপকূলীয় অঞ্চলের উপর আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে ভাইকিংরা সব লুটপাট করে আবার নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে বা এলাকা দখল করে নিজেরা শাসন করা শুরু করে দিয়েছে। ভাইকিংদের অতর্কিত আক্রমণের বিরুদ্ধে রাজার সামরিক বাহিনী কিংবা স্থানীয় জনগণ– কেউই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারত না।
ইউরোপের যেকোনো যুদ্ধের ক্ষেত্রে একটি নীতি ছিল যে একপক্ষ আরেকপক্ষের সবকিছু ধ্বংস করে দিলেও সন্ন্যাসীদের মঠ ও ধর্মীয় স্থাপনা– এগুলোতে কখনও আক্রমণ করবে না। কিন্তু ভাইকিংদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা আক্রমণ চালানোর পর লুটের ক্ষেত্রে সন্ন্যাসীদের মঠকেই বেছে নিত। কারণ এখানে সেসময়ের সবচেয়ে দামী জিনিসপত্র জমা থাকত। প্রথমদিকে সন্ন্যাসীরা দাবি করেছিল, ভাইকিংরা হচ্ছে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে প্রেরিত শাস্তিস্বরূপ। মানুষ অতিরিক্ত পাপাচারে লিপ্ত হওয়ায় ঈশ্বর হিসেবে ভাইকিংদের দ্বারা শাস্তি দিচ্ছেন– এই ধরনের বাণী প্রচার করতেন তারা।
ভাইকিংরা যেভাবে একসময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল ইউরোপের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে, তাতে তাদের সমসাময়িক জাতিগুলোর তুলনায় তাদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আর কারোও সন্দেহের অবকাশ থাকা উচিত নয়। তাদের নিজস্ব সামরিক কৌশল, মানসিকতা ও উন্নত যুদ্ধাস্ত্রের কারণে তারা সমসাময়িক ইউরোপীয় জাতিগুলোর চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে ছিল এবং এগুলো তাদেরকে প্রায় প্রতিটি অভিযানেই সাফল্য এনে দিয়েছে।
ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের ইতিহাসবিদেরা তাদের লেখায় ভাইকিংদের ‘বর্বর’, ‘হিংস্র’ এই ধরনের নেতিবাচক বিশেষণে বিশেষায়িত করলেও বাস্তবে তারাও পরবর্তীতে বিদেশি রাজ্য দখলে নিতে ভাইকিংদের চেয়ে অনেক বেশি নির্মমতার আশ্রয় নিয়েছিল। প্রায় তিন শতাব্দী ধরে ভাইকিংরা ইউরোপে আধিপত্য কায়েম করেছিল তাদের সামরিক শক্তির উপর বলীয়ান হয়ে– এ কথাটি বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না।