১
১৫৪৪ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে কিংবা আগস্ট মাসের শুরুর দিকের কোনো একদিন সুলতানিয়া থেকে কিছুটা দূরে ভাগ্যবিড়ম্বনায় বিপর্যস্ত মুঘল সম্রাট হুমায়ুন আর পারস্যের সাফাভিদ সাম্রাজ্যের শাহ তামাস্পের প্রথমবারের মতো দেখা হলো।
সম্রাটকে অভ্যর্থনা জানাতে স্বয়ং শাহ ঘোড়ার পিঠে করে কিছুটা এগিয়ে এলেন। সম্রাটকে দেখা মাত্র ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে তিনি সম্রাটকে জড়িয়ে ধরলেন। শাহ প্রথমে সম্রাটের শারিরীক খোঁজ খবর নিলেন। এরপর বিশ্রামের জন্য শাহের ভাই বাহরাম শাহের প্রাসাদে যেতে অনুরোধ করলেন।
বাহরামের প্রাসাদে সম্রাট রাত্রিযাপন করলেন। পরদিন স্বয়ং শাহ সম্রাটকে সুলতানিয়ার প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। তবে এসময় লক্ষনীয় একটা ব্যাপার ছিলো, শাহকে সম্রাটের প্রতি ততটা আন্তরিক মনে হয়নি। শাহের এ ধরনের মানসিক পরিবর্তন দেখে সম্রাট বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
যা-ই হোক, সেই রাতে সম্রাটের থাকার ব্যবস্থা করা হলো সুলতান মুহাম্মদ খোদাবন্দের বাড়িতে। এই বাড়িতেই সম্রাটের সাথে সাক্ষাৎ করলেন পারস্যের প্রধান কাজী কাজী জাহান। তিনি এসেই সম্রাটের কাছে অভিযোগ করে বললেন,
‘আপনার লোকজন ও কর্মচারীরা সঠিক পন্থা অনুসরণ করছে না। তারা খারিজীদের মতো আদর্শ ধারণ করে। শাহ এজন্য আপনার প্রতি অসন্তুষ্ট।’
প্রায় সাথে সাথেই সম্রাট বুঝে গেলেন সম্রাটের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শাহ আসলে কী খেলা খেলতে চাইছেন। তিনি আসলে হুমায়ুনের উপর শিয়া মত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন!
তবে সম্রাট কোনো ঝামেলা না করে কূটনৈতিক জবাব দিলেন এভাবে,
‘আমি সবসময়ই নিষ্পাপ ইমামদের সমর্থন ও অনুসরণ করে এসেছি।’
কাজী জাহান সম্রাটের এ কথার জবাবে কোনো কথা না বলে শাহের পক্ষ থেকে পাঠানো দুটি বিবৃতিপত্র সম্রাটকে পাঠ করতে দিলেন। সম্রাট বিবৃতিপত্র দুটি পড়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।
এরপর কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে তাবুর বাইরে এসে উচ্চস্বরে হযরত মুহাম্মদ (স), তাঁর উত্তরাধীকারী ও ইমামদের দুশমনের প্রতি ধিক্কার জানাতে লাগলেন।
এরপর ঘটনার মঞ্চে আবির্ভূত হলেন স্বয়ং শাহ। তাঁর হাতে আরেকটি কাগজ। সম্রাটকে কাগজটি পড়তে হলো। পড়ে তিনি আবারও কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এরপর ধীরে ধীরে ঘোষণা করলেন, আমি ইমামিয়া আসনা আশরিয়া মতবাদ গ্রহণ করলাম!
২
ঘটনা আসলে কী ঘটেছিলো সেদিন?
শাহের সাথে সম্রাটের সাক্ষাতের শুরুটা বেশ ভালোই ছিলো। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই শাহের থলের বেড়াল বেড়িয়ে পড়লো। যদিও শাহ সম্রাটের প্রতি আতিথেয়তার কোনো কার্পণ্য করেননি, কিন্তু তিনি রীতিমতো সম্রাটের দুর্বলতার সুযোগ নিলেন। তিনি শুরুতেই সম্রাটের উপর শিয়া মতবাদ চাপিয়ে দিতে চাইলেন!
প্রথম সাক্ষাতেই তিনি সম্রাটের চুল শিয়াদের মতো কাটতে বাধ্য করলেন। আশ্রয়হীন সম্রাটের এটা করা ছাড়া কোনো উপায়ও ছিলো। দুর্লভ এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে শাহ এমনকি সম্রাটকে শিয়াদের ১২ ইমামের নামখচিত টুপিও পরতে বাধ্য করেছিলেন। সম্রাট প্রথমে এই টুপি পরতে চাননি, কিন্তু শাহের রাজ্যে শাহের সামনেই দাঁড়িয়ে রাজ্যহারা হুমায়ুন খুব সম্ভবত শেষপর্যন্ত টুপি না পরার সাহস দেখাতে চাননি।
যা-ই হোক, শাহের ইচ্ছা ছিলো সম্রাটকে শিয়া মতবাদ গ্রহণে বাধ্য করবেন। এরপর যদি সম্রাট চান, তাহলে তাকে হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধারের জন্য সেনা সহায়তা দেয়া হবে। সম্রাট যদি হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধার করতে পারেন, তাহলে নতুন হিন্দুস্তান হবে একজন শিয়া সম্রাট শাসিত!
শাহ তো একবার সরাসরি সম্রাটকে নির্দেশই দিয়েছিলেন শিয়া ধর্মমত গ্রহণ করে নেয়ার জন্য। তা না হলে সম্রাটকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। সম্রাট বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, রাজত্বের আকাঙ্ক্ষা তার শেষ হয়ে গিয়েছে। তিনি শুধুমাত্র পারস্যের ভেতর দিয়ে মক্কা চলে যাওয়ার অনুমতি চান।
যা-ই হোক, সুলতান মুহাম্মদ খোদাবন্দের বাড়িতে কাজী জাহানের আগমন থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় যা ঘটনা যা ঘটছিলো তা শাহের পরিকল্পনা অনুযায়ীই ঘটছিলো। আর শাহ একরকম বাধ্য করেই সম্রাটের মুখ থেকে শিয়া মতবাদ গ্রহনের ঘোষণাটি আদায় করে নিলেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, শাহ কি জানেন না, কোনো মতবাদ শুধু মুখে স্বীকার করলেই হয় না, তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আর আন্তরিকতা থাকা প্রয়োজন?
যা-ই হোক, কোনো কাজ না থাকায় এই ঘটনার পরের কয়েকটা দিন সম্রাট শিকারে ব্যস্ত রইলেন।
৩
উপহার দেয়া হলে এর পরিবর্তে উপহার দেয়াই নিয়ম। আর রাজা কিংবা সম্রাটদের জন্য উপহার পেলে তার পরিবর্তে উপহার না দিতে পারাটা তো রীতিমত সম্মানের প্রশ্ন।
সম্রাট হুমায়ুনের জন্য এ রীতির ব্যাতিক্রম হবে কেন? সম্রাট তো নিজেই জানতেন তিনি পারস্যে অনেকটা শরণার্থীর মতোই আশ্রয় নিয়েছেন। এ অবস্থায় নিজের সম্মান ধরে রাখার একমাত্র উপায় হচ্ছে শাহকে মূল্যবান মণি-মুক্তা উপহার দেয়া। কাজেই সম্রাট শাহের জন্য বৈরাম খানের মাধ্যমে অমূল্য কিছু রত্ন হিসেবে প্রেরণ করলেন।
ঘটনাটি জওহর আবতাবচি ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন এভাবে,
‘কয়েকদিন পর সম্রাট মহামান্য শাহকে হীরা ও মণি-মুক্তাগুলো পাঠিয়ে দিলেন। একটি থালার মাঝে সবচেয়ে বড় হীরাটি (কোহ-ই-নূর) রেখে তার চারপাশে অন্যান্য হীরা ও মণিমাণিক্য সুন্দরভাবে সাজিয়ে বৈরাম বেগের (বৈরাম খান তখনো তাঁর ‘খান’ উপাধীটি পাননি। এই ঘটনা পর্যন্ত তিনি বৈরাম বেগ নামে পরিচিত ছিলেন।) মাধ্যমে শাহ তামাস্পের কাছে পাঠানো হলো। তাকে বলে দেয়া হলো, বিশেষ করে শাহের জন্যই এসব মণি-মাণিক্য আনা হয়েছে, তা যেন আলাদা করে শাহকে জানিয়ে দেয়া হয় (সম্রাট আসলে শাহকে খুশি করতে চাইছিলেন)।’
শাহ প্রথমে এ উপহারের মূল্য বুঝতে পারেননি। তিনি উপহারের দাম জানতে চাইলেন। জওহর আবতাবচির জবানিতেই পরের ঘটনা জেনে নেয়া যাক।
‘হীরা ও মণি-মাণিক্যগুলো পাওয়ার পর শাহ মণিকারদের নিকট এগুলো সম্ভাব্য মূল্য জানতে চাইলেন। মণিকাররা পরীক্ষা করার পর মত দিলেন যে, সম্রাটের প্রেরিত উপহারগুলো এতই মূল্যবান যে এগুলোর সাথে পৃথিবীর কোনো বস্তুর বিনিময়মূল্য নির্ণয় করা সম্ভব নয়।’
মণিকারদের এ বক্তব্য শুনে শাহ অত্যন্ত খুশি হলেন। আনন্দের আতিশায্যে তিনি বৈরাম বেগকে ‘খান’ উপাধী দিয়ে দিলেন। সাথে একটি নাকারাও উপহার দিলেন। বৈরাম বেগ চিরদিনের জন্য হয়ে গেলেন বৈরাম খান।
এই ঘটনার পরবর্তী দুই মাস সম্রাটের সাথে শাহের তেমন কোনো আলাপ আলোচনা হলো না। ফলে সম্রাটও শাহের নিকট সেনা সাহায্য চাইতে পারলেন না।
৪
সম্রাটের হুমায়ুনের নামের অর্থটি ‘সৌভাগ্যবান’ হলেও তিনি জীবনের প্রতিটি পদে পদে যে দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি শরণার্থী হিসেবে পারস্যে আশ্রয় নিলেও দুর্ভাগ্য শেষ পর্যন্ত তার পিছু ছাড়েনি। পারস্যে অবস্থানের সময় সম্রাট হুমায়ুনকে এমনকি তার নিজের আমিরদের দ্বারাই শাহের সামনে অপদস্ত হতে হয়েছিলো।
ঘটনার সূত্রপাত কিছু মূল্যবান রত্ন নিয়ে। হুমায়ুন বেশ কিছু মূল্যবান রত্ন সবসময় নিজের কাছে রাখতেন। এ ব্যাপারটি সম্রাট আর তার স্ত্রী হামিদা বানু ছাড়া আর অন্য কেউ জানতেন না।
একদিন অযু করার সময় সম্রাট রত্নের থলেটি তার বিছানার উপরে রেখে যান। এদিকে ঘটনাক্রমে সম্রাটের ঘরে প্রবেশ করেন সম্রাটেরই দুই আমির আমির রওশন কোকা আর খাজা গাজি। থলেটি দেখে তার লোভ সামলাতে পারলেন না। তারা সেখান থেকে পাঁচটি রুবি সরিয়ে ফেললেন।
এদিকে সম্রাট যখন বুঝতে পারলেন যে থলে থেকে কিছু রত্ন হাওয়া হয়ে গেছে, তখন কিছুটা মন খারাপ করলেন। আর হামিদা বানু পড়ে গেলেন বিব্রতকর অবস্থায়। কারণ এই রত্নগুলোর কথা একমাত্র সম্রাট আর হামিদা বানুই জানতেন। সব ভেবে-চিন্তে হামিদা বানু রত্নগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করলেন। তিনি এই রত্ন চুরির কথা তার ভাই খাজা মুয়াজ্জেমকে বললেন।
শেষপর্যন্ত এই খাজা মুয়াজ্জেমের বিচক্ষণতায় রওশন কুকা আর খাজা গাজি ধরা পড়লেন। ব্যাপারটি তাদের জন্যও যথেষ্ট বিব্রতকর ছিলো। সম্রাট মসনদে আসীন থাকলে এই ধরনের ঘটনার জন্য এই দুজনের কঠোর শাস্তি হতো, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে নিজেদের সামগ্রিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে সম্রাট তাদের ক্ষমা করে দিলেন। এখানে আরেকটা বিষয় উল্লেখ্য যে, সম্রাট মসনদে বহাল থাকলে রওশন কুকা আর খাজা গাজির মতো উচ্চপদস্থ মুঘল কর্মকর্তার এ ধরনের চুরির কোনো প্রয়োজনও পড়তো না। অভাব মানুষকে সত্যিই পাল্টে দেয়!
যা-ই হোক, ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু রওশন কুকা আর খাজা গাজি এই অপমানের শোধ নেয়ার জন্য যা করলেন, তা কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই ক্ষমার যোগ্য না।
তারা শাহ তামাস্পের কাছে গিয়ে সম্রাট আর তার স্ত্রীর দুর্নাম করতে লাগলেন। তাদের যুক্তি ছিলো, সম্রাট যদি এত ভালো, তাহলে তার ভাইরা তাকে এভাবে বিপদের মাঝে দেখেও কেন সাহায্য করতে এগিয়ে এলো না? রওশন কুকা আর খাজা গাজির সাথে গলা মেলালেন হজ্ব পালন করে পারস্যে আসা কামরান মির্জার কিছু কর্মচারিও।
রওশন কুকা আর খাজা গাজির পথ ধরে সক্রিয় হলো হুমায়ুন বিরোধী আরও একটি জোট।
ঘটনা বেশ কয়েক বছর আগের। সম্রাট হুমায়ুন যখন গুজরাট অভিযান শেষে আগ্রায় ফিরে এসেছিলেন, তখন একদিন দরবারে মন্তব্য করেছিলেন, মুঘল সাম্রাজ্যের গৌরব আর অর্জন পারস্য সাম্রাজ্যের থেকেও অনেক বেশি।
সম্রাটের বিরুদ্ধবাদী এই জোটটি শাহ তামাস্পের কাছে এই ঘটনাটিই আরও ফুলিয়ে ফাপিয়ে বলতে লাগলেন। অন্যদিকে শাহ তামাস্প কামরান মির্জার নিকট থেকে বেশ কিছু পত্র পেয়েছিলেন, যার বিষয়বস্তু ছিলো সম্রাট হুমায়ুনের দুর্নাম করা।
রওশন কুকা আর খাজা গাজির দলটি তো আরও এক কাঠি বেশি সরেশ ছিলো। তারা বাবর আর শাহ ইসমাইলের ঘটনা টেনে এনে বলতে লাগলেন, হুমায়ুনকে সহায়তা করা মোটেও উচিত হবে না। কারণ তিনিও তার পিতার মতোই পারস্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন।
এখানে উল্লেখ্য, সম্রাট বাবর পারস্যের সাথে মোটেও বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। তিনি পারস্যের সহায়তায় সমরকন্দ উদ্ধার করেছিলেন বটে, কিন্তু বাবরের সাথে শিয়া সেনাবাহিনী দেখে সুন্নী মতালম্বী সমরকন্দবাসী আর বাবরকে বিশ্বাস করেনি। ফলে বাবরকে চিরদিনের জন্য সমরকন্দ শাসনের আশা ত্যাগ করতে হয়।
আর পারস্যের সেই সেনাবাহিনীটি ধ্বংস হয়েছিলো গাজাদোয়ান নামক একটি দুর্গ দখল করতে গিয়ে। কিন্তু পারস্যের সমকালীন ঐতিহাসিকেরা এ ঘটনার জন্য বাবরকেই দায়ী করেছিলেন।
যা-ই হোক, রওশন কুকা আর খাজা গাজি সুযোগের সদ্বব্যহার করতে ছাড়লেন না। তারা নিজেরাই শাহের নিকট থেকে সামরিক সহায়তা চাইলেন। বিনিময়ে কান্দাহার অধিকার করে তা পারস্যের সাথে একীভূত করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
শাহ তো তাদের সহায়তা দেননি, এটা ঠিক। তবে হুমায়ুনের সম্পর্কে শাহ তার মনোভাব পাল্টে ফেললেন। তিনি হুমায়ুনকে কোনো প্রকার সামরিক সহায়তা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
৫
শাহের মন পরিবর্তনের এই খবরটি জানলেন শাহেরই ভাই বাহরাম মির্জা। পারস্যে থাকাকালীন সময়ে বাহরাম মির্জার সাথে সম্রাট হুমায়ুনের বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো। তারা বেশ কয়েকবার একত্রে শিকারেও গিয়েছিলেন।
যা-ই হোক, শাহের মনোভাব পরিবর্তনের এই খবরটি শুনে তিনি বেশ কষ্ট পেলেন। নিজের এই কষ্টের কথা যেয়ে বললেন বোন সুলতানা বেগমকে।
তিনি বললেন,
‘সম্রাট হুয়ায়ুন হচ্ছেন তাইমূরের বংশধর। তিনি আজ সাহায্যের জন্য আমাদের পরিবারের কাছে এসেছেন। পরিবারের প্রাচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী আমাদের উচিত তার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। সম্রাট বাবরের মৃত্যুর সময় যেসব কিজিলবাশ আমিরের পিতা ও ভাইদের প্রতারণামূলকভাবে হত্যা করা হয়েছিলো, তারা আজ সম্রাট হুমায়ুনের বিরুদ্ধে শাহের কাছে অপবাদ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
আমি আপনাকে একটি অনুরোধই করবো, শাহের সাথে পরেরবার যখন দেখা হবে, আপনি তখন সম্রাট হুমায়ুনের জন্য সুপারিশ করবেন।’
সুলতানা বেগম তার ভাইয়ের অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। শাহের সাথে যখন পরবর্তীতে এই মহিলার সাক্ষাৎ হয়েছিলো, তখন তিনি বেশ মনোকষ্টের সাথেই শাহকে বলেছিলেন,
‘স্বার্থপর কুচক্রী লোকদের কথায় কান না দিয়ে আপনার উচিত বাদশাহ হুমায়ুনকে সৈন্য সহায়তা দেয়া, যাতে তিনি তার হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধার করে নিতে পারেন। আর এর মাধ্যমেই শাহের গৌরবের উজ্জ্বলতায় সারা বিশ্ব আলোকিত হয়ে যাবে।
শাহ তৎক্ষনাৎ কিছু বললেন না। তবে মনে মনে যে তিনি হিসাব কষছেন, তা বোঝা গেলো।
শাহ কিন্তু শেষপর্যন্ত সম্রাটকে সাহায্য করতে রাজী হয়েছিলেন। তবে এর পেছনে সূক্ষ্ম একটি কারণ ছিলো সম্রাটের লেখা একটি কবিতা।
হযরত আলী (রা) এর প্রশংসা করে লেখা এ কবিতাটি শাহ তামাস্প শুনেছিলেন তার ভাইদের কাছ থেকে। তারাই কবিতাটি পাঠ করে শাহকে শুনালেন। কবিতাটি শোনার পর শাহ তামাস্পের সমস্ত বিভ্রান্তি ঝেরে ফেলে সম্রাট হুমায়ুনকে সেনা সহায়তা দেয়ার ব্যপারে মনস্থির করে ফেললেন।
শাহের এই সামরিক সহায়তা দেয়ার পেছনে যে একমাত্র কারণ যে সম্রাট হুমায়ুন ছিলেন, তা কিন্তু না। তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে অন্যতম অনুঘটক ছিলেন সুন্নী মতাদর্শের উসমানী খিলাফতের (অটোমান এম্পায়ার) সুলায়মান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট। ঐতিহাসিক ও আদর্শিক নানা কারণেই মুসলিমদের মাঝে সুন্নী-শিয়া নামক একটা বিভেদের দেয়াল গড়ে উঠেছিলো। এই বিভেদ একপর্যায়ে যুদ্ধের ময়দান পর্যন্ত গড়ায়। এমনকি শাহ তামাস্পের পিতা শাহ ইসমাইলকে সুলায়মান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের পিতা প্রথম সেলিম ব্যাটল অফ চালদিরানের যুদ্ধে গো হারা হারিয়েছিলেন। তাই শাহ তামাস্প চাচ্ছিলেন উসমানীয়দের বিরুদ্ধে যদি কখনো সহায়তার প্রয়োজন হয়, তাহলে তা হুমায়ুনকে সাহায্য করার বিনিময়ে মুঘলদের থেকে আদায় করে নিতে পারবেন।
যা-ই হোক, হুমায়ুনকে সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর শাহ দ্রুত আরেকটি কাজ করলেন। তিনি রওশন কুকা আর খাজা গাজীকে বন্দী করার আদেশ দিলেন।
৬
কিছুদিন পরে শাহ সম্রাটকে নিয়ে সারি সারি করে সাজানো বেশ কিছু তাবুর কাছে নিয়ে গেলেন। এরপর হঠাৎ করেই প্রশ্ন করে বসলেন, বলতে পারবেন, এই তাবুগুলো কার?
সম্রাট হুমায়ুনও কিছুটা রহস্য করে জবাব দিলেন, এসব তাবু বাদশাহ হুমায়ুনের।
সম্রাটের এই উত্তর শুনে শাহ তামাস্প একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, সাহায্য আসছে।
পারস্যের শাহ এর কিছুদিন পরেই সম্রাটকে সিস্তানে অবস্থানরত ১২ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী দিয়ে বললেন, এই বাহিনী আপনাকে জমীনদাওয়ার, কান্দাহার, কাবুল আর গজনী বিজয়ে সহায়তা করবে। এই বাহিনীর সাথে আমার শিশুপুত্র মুরাদও যাবে। পারস্য বাহিনীর এ সহায়তার বিনিময়ে সম্রাট কান্দাহার দখল করে শিশু মুরাদকে কান্দাহারের মসনদে বসাবেন।
এরপর হঠাতই শাহ দাঁড়িয়ে সম্রাটকে আলিঙ্গন করে বললেন,
‘হে বাদশাহ হুমায়ুন, আমি আপনাকে যা দিলাম, তা মোটেও যথেষ্ট নয়। কিন্তু এই ক্ষুদ্র দানকেই আপনার কাজে লাগাতে হবে।’
সম্রাট হুমায়ুন বুঝে গেলেন তার পারস্য ত্যাগের সময় এসে পরেছে। এ অবস্থায় তিনি একটি বিচিত্র কাজ করলেন। তিনি শাহকে অনুরোধ করে বসলেন, পরলোকগত শাহ ইসমাইলের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ রওশন কুকাকে যেন ক্ষমা করে দেয়া হয়।
সম্রাটের এ ক্ষমাশিলতায় শাহ বিস্মিত হয়ে সম্রাটের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এরপর বললেন, রওশন কুকা আর খাজা গাজী উভয়কেই আমি আপনার হাতে সমর্পণ করে দিলাম।
অবশ্য সম্রাট হুমায়ুনের এমন বিচিত্র অনুরোধের পেছনে একটি চিঠির যথেষ্ট ভূমিকা ছিলো।
বন্দী রওশন কুকা যেকোনোভাবেই হোক, সম্রাটের নিকট একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে তিনি বলেন,
‘পাপী গুনাহগার আমরা। প্রাণভিক্ষা পাওয়ার মতো অধিকারটুকুও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তবুও বাদশাহর আশ্রয় আমাদের মাথার উপর বিরাজ করছে। শুধুমাত্র নির্বোধ লোকেরা তো অন্যায় করে। আর বাদশাহগণ সে অন্যায় ক্ষমা করে দেন।’
নিজের দুধভাইয়ের নিকট থেকে এই পত্রটি পেয়ে সম্রাট আবেগাতাড়িত হয়ে পড়লেন। যার ফলশ্রুতিতে তিনি তাদের ক্ষমা করে দিয়ে শাহের নিকট তাদের মুক্তিদানের অনুরোধ করলেন।
৭
সম্রাটকে বিদায় দেয়ার পূর্বে শাহ সম্রাটের সম্মানার্থে ৭ দিনব্যাপী একটি উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। উৎসব উপলক্ষে ৬০০টি তাবু টানানো হলো। মঞ্চ বানানো হলো ১২টি। বড় বড় সামিয়ানা টানিয়ে তার নিচে শত শত অতিথির বসার আয়োজন করা হলো। খাদ্য হিসেবে পারস্যের খাবারের পাশাপাশি হিন্দুস্তানী মুঘল খাবারও ছিলো।
উৎসবের দিনগুলোতে শাহ সম্রাটের প্রতি বেশ আন্তরিকতা দেখালেন। সম্রাটকে রাজকীয় খেলাত, তরবারি, খঞ্জর আর মূল্যবান কিছু রত্ন উপহার দেয়া হলো। শাহের দেয়া উপহারের মধ্যে আরও কিছু হিন্দুস্তান অভিমুখে অভিযান পরিচালনার জন্য অসংখ্য তাবু, সামিয়ানা, উট, খচ্চরসহ বিভিন্ন বস্তু। শাহ শুধু যে সম্রাটকে উপহার দিলেন তা না, পদমর্যাদা অনুযায়ী উপহার পেলেন সম্রাটের সাথে থাকা তার আমিররাও।
উৎসব শেষ হলো। সম্রাট এবং শাহ মিয়ানা নামক জায়গায় এসে তাবু গাড়লেন। দুজনই জানেন, এখন একে অপরকে বিদায় জানাতে হবে। শাহ একটি ফল সম্রাটের হাতে দিয়ে বললেন, আপনার শুভকামনার নিদর্শনস্বরূপ এই ফলটি আপনাকে দিলাম।
সম্রাট এবং শাহ একে অপরকে আলিঙ্গন করলেন। এরপর শাহ ছোট্ট করে বললেন, বিদায় বাদশাহ হুমায়ুন।
পথে প্রয়োজনে লাগতে পারে মনে করে বিদায়ের সময় শাহ সম্রাটকে নগদ ৩০০০ টুমান (বর্তমানে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩,৮৯৭,৬৩০ টাকা) অর্থ দিয়ে দিলেন। সাথে আরও দিলেন ঘোড়া, প্রচুর অস্ত্র আর বেশ কিছু তাবু। এসবের অর্থমূল্য ছিলো প্রায় ২০,০০০ টুমান বা ২৫,৯৮৪,২০০ টাকা।
সম্রাটকে কিছু দূর এগিয়ে দিয়ে আসার দায়িত্ব পড়লো সম্রাটের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাহের ভাই বাহরাম মির্জার উপর।
সম্রাটের সাথে বাহরাম মির্জার বিদায়ের সময়টি বেশ আবেগময় ছিলো। সম্রাটকে তার তাবুর নিকট পৌছে দিয়ে যখন বাহরাম মির্জা বিদায় নিতে যাবেন, তখন বাদশাহ হুমায়ুন একটি আংটি বের করে বাহরাম মির্জার হাতে দিয়ে বললেন,
‘এ আংটিটি আমার মায়ের স্মৃতি বহন করছে। নিজের স্মৃতি চিহ্নসরূপ এ আংটিটি আজ আমি তোমার হাতে তুলে দিলাম।’
আংটিটি দিয়ে সম্রাট তার কথা থামালেন না। তিনি বলে যেতে লাগলেন, এতদিন তুমি আমার অন্তরে শক্তি জুগিয়ে এসেছো। তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু আমি জানি তা হওয়ার নয়।
বাহরাম মির্জা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না বাদশাহ। ইন শা আল্লাহ, আপনি হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধার করতে পারবেন।
বিদায়ের মুহূর্ত চলে আসলো। সম্রাট হুমায়ুন এবং বাহরাম মির্জা একে অপরকে আলিঙ্গন করে শেষবারের মতো নিজেদের বিদায় জানালেন।
৮
সম্রাট হুমায়ুনের পারস্য জীবন ভালো-মন্দ মিশিয়ে কেটেছিলো। একজন সম্রাট হিসেবে তিনি পারস্যে যথোপযুক্ত সম্মান পেয়েছিলেন, যদিও তার অধীনে তখন কোনো ভূখন্ড ছিলো না।
তবে শাহের নিকট থেকে পেয়েছেন মিশ্র আচরণ। সম্রাট হুমায়ুন বেশ বিচিত্র চরিত্রের একজন মানুষ ছিলেন। নিজের ছোট্ট জীবনে তাকে বিচিত্র পরিস্থিতির মোকাবেলাও করতে হয়েছিলো। হিন্দুস্তানের মহান মুঘল সাম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে তিনি শাহের নিকট থেকে যেমন উপযুক্ত সম্মান পেয়েছিলেন, তেমনই মাঝে মাঝেই হতে হয়েছিলো অপমানিত। শাহ একেক সময় সম্রাটের সাথে একেক রকম আচরণ করেছিলেন। কখনো সম্রাটের সাথে এতই ভালো আচরণ করেছেন যে মনে হতো তারা যেনো পরস্পর আপন ভাই। আবার কখনো কখনো তাদের সম্পর্ক এতই খারাপ হয়ে যেত যে, তিনি সম্রাটকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিতেন! এছাড়া বিভিন্ন সময়ে অনেক ছোটখাট বিষয় নিয়েও শাহ তামাস্প সম্রাট হুমায়ুনকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে ছাড়তেন না।
হিন্দুস্তানের পরাক্রমশালী মুঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট বাবরপুত্র নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুনের সম্ভবত এসব অপমানের কিছু অংশ প্রাপ্যও ছিলো। তিনি যদি তার রাজত্বের শুরুর দিকে চরম খামখেয়ালিপনা আর আলস্য না দেখাতেন, তাহলে তাকে কোনোদিনই এভাবে অন্যের দ্বারস্থ হয়ে অপমানিত হতে হতো না।
যা-ই হোক, শাহের সাথে সম্রাট হুমায়ুনের দ্বন্দ্ব আর এর ফলশ্রুতিতে অপমানিত হওয়ার একমাত্র কারণ হলো সম্রাট হুয়ায়ুন ছিলেন একজন সুন্নী মুসলিম!
সম্রাট হুমায়ুন জানতেন পারস্য শিয়া শাসিত। আর ঠিক এ কারণেই তিনি শুরুতেই পারস্যে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তবে ভাগ্য ইচ্ছা অনিচ্ছা মানে না। রাজত্বের শুরুর দিকে নিজের চূড়ান্ত আলস্য আর খামখেয়ালিপনার দরুণ বিচিত্র এক পরিস্থিতিতে পরেই সম্রাটকে বাধ্য হতে হয়েছিলো শিয়া শাসিত পারস্যের ভূখণ্ডে যেতে ।
যে কারণে সম্রাট পারস্য যেতে অনিচ্ছুক ছিলেন, সম্রাটের সেই আশঙ্কা কিন্তু সত্য হয়েছিলো। নিজের জীবন ও সাথে থাকা সঙ্গীদের জীবনের হুমকির মুখে সম্রাটকে এই শিয়া ধর্মমত গ্রহণ করতে হয়েছিলো পর্যন্ত! তবে তা সাময়িক সময়ের জন্যই ছিলো। পারস্য ত্যাগের পরই সম্রাট হুমায়ুন তার মন থেকে এই শিয়া মত ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।
যা-ই হোক, ১৫৪৪ সালের ডিসেম্বর নাগাদ দর্স আর সব্জবার হয়ে সম্রাট হুমায়ুন মশহাদ গিয়ে পৌঁছালেন। ডিসেম্বরের ২৯ তারিখে তিনি মশহাদ থেকে জাম হয়ে সিস্তানে যেয়ে প্রবেশ করলেন। প্রতিশ্রুতির ১২,০০০ সৈন্য আর প্রয়োজনীয় রসদপত্র সম্রাটের জন্য সিস্তানে অপেক্ষা করছিলো। এসবের দায়িত্ব বুঝে নিতে নিতে আরো ১৫ দিন লেগে গেলো। ১৫৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে সম্রাট সিস্তান ত্যাগ করলেন।
আর এভাবেই পারস্য সীমান্ত ত্যাগের মাধ্যমে সম্রাট হুমায়ুনের শরণার্থী জীবনের ইতি ঘটলো। সম্রাট তার হারানো অধিকার পুনরুদ্ধার করতে পেলেন ১২,০০০ সৈন্যের একটি বাহিনী। বাহিনীটি হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধার করার মতো গুরুদায়িত্বের তুলনায় বেশ ছোটই। তবে এই ছোট বাহিনীটি নিয়েই সম্রাটকে তার জীবনের গতিপথ পরিবর্তনের কাজটি শেষ করতে হবে।
তথ্যসূত্র
১। মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৫
২। তাজকিরাতুল ওয়াকিয়াত, মূল: জওহর আবতাবচি, অনুবাদ: চৌধুরী শামসুর রহমান, দিব্য প্রকাশ, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ (চতুর্থ মুদ্রণ)
৩। হুমায়ুননামা, মূল: গুলবদন বেগম, অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, প্রকাশকাল: জানুয়ারি, ২০১৬
৪। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়, সাহাদত হোসেন খান, আফসার ব্রাদার্স, ২য় মুদ্রণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৩