টেলিভিশন অন করলে কিংবা দৈনিক পত্রিকাটা মেলে বসলে প্রায়ই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতির উপর বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন। বর্তমানে পরিকল্পিত পরিবার গঠনের লক্ষ্যে মানবজাতি বিজ্ঞানভিত্তিক নানা পদ্ধতির দ্বারস্থ হলেও প্রাচীনকালের পরিস্থিতি কিন্তু ছিলো একেবারেই ভিন্ন। তখন অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধের উদ্দেশ্যে মানুষ এমন সব উপায় অবলম্বন করতো, যা জেনে বিস্ময়ে যেমন চোখ বড় বড় হয়ে যাবে, তেমনই কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাসি আটকে রাখাও হয়ে যাবে বেশ কষ্টকর।
চাঁদের আলো
গ্রীনল্যান্ডের স্থানীয় অধিবাসীরা একসময় মনে করতো যে, নারীদের গর্ভধারণের জন্য দায়ী মূলত চাঁদ! এর হাত থেকে রক্ষা পেতে তাই তাদের নারীরা চাঁদের দিকে তাকানো থেকে নিজেদের বিরত রাখতো। আর রাতের বেলায় ঘুমের মাঝে যাতে চাঁদ গোপনে এসে তাদের গর্ভে সন্তান রেখে যেতে না পারে, সেজন্য নিজেদের থুতু পেটে ঘষে এরপরই ঘুমোতো তারা! এছাড়া চাঁদের হাতে গর্ভধারণ এড়াতে নারীদের উপুড় হয়ে ঘুমানোও ছিলো এককালের রীতি।
তবে যদি একজন নারী নিজেকে মা হওয়ার জন্য প্রস্তুত মনে করতেন, তাহলে কিন্তু পুরো পরিস্থিতিই পাল্টে যেত। তখন একজন নারী নতুন চাঁদের আগমনের সময় নিজেকে বিবস্ত্র করে নিতেন এই আশায় যে, চাঁদের বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃদ্ধি পাবে তার পেটের সন্তানও! আবার কেউ কেউ এ বিবস্ত্রকরণের কাজটি করতেন পূর্ণিমা রাতে। তাদের আশা ছিলো যে, পূর্ণিমা রাতের চাঁদের মায়াবী আলোকরশ্মিই তাদেরকে মাতৃত্বের স্বাদ দিবে!
বেজির অণ্ডকোষ
ইউরোপের অন্ধকার যুগের কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। আজকের যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানে নিজেদের ঈর্ষণীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ইউরোপীয় সমাজে তৎকালে ছিলো কুসংস্কারের একচ্ছত্র আধিপত্য। বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসাপদ্ধতির পরিবর্তে জাদুকরদের কথাকেই অন্ধভাবে মেনে চলতো অধিকাংশ মানুষ।
অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে তখনকার দিনে জাদুকররা নারীদের পরামর্শ দিতো বেজির অণ্ডকোষ নিজেদের পায়ে বেঁধে রাখতে! এতে করে নাকি সেই অণ্ডকোষের জাদুকরী ক্ষমতা তাদের গর্ভধারণের পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে।
বেজির অণ্ডকোষ আর যা-ই করুক না কেন, অন্ধকার যুগের সেসব নারীদের যে গর্ভধারণের হাত থেকে বাঁচাতে পারে নি, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে তা তো আমরা সবাই জানি। তবে এ কুসংস্কারের ফাঁদে পড়ে কতগুলো পুরুষ বেজিকে যে নিজেদের পুরুষত্ব হারাতে হয়েছিলো, সেই খবর কি কেউ রেখেছিলো?
কুমিরের মল
‘প্রাচীন মিশর’ কথাটা শুনলেই সবার আগে আমাদের মাথায় যে দুটি শব্দ চলে আসে সেগুলো হলো ‘মমি’ ও ‘পিরামিড’। তবে আরেকটি ক্ষেত্রেও নিজেদের এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে সেই সময়ের মিশরীয়রা।
একসময় তৎকালীন মিশরীয়রা বুঝতে পারলো যে, গর্ভধারণ বন্ধের উপায় হলো সঙ্গীর সাথে মিলিত হবার আগে নিজের সার্ভিক্সে কোনো প্রতিবন্ধকতা ব্যবহার করা। যেমন চিন্তা, তেমন কাজ। আর তাই প্রাচীন মিশরের নারীরা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ এড়াতে নিজেদের সার্ভিক্সে মধু মাখিয়ে নিতো। মধুর সেই প্রলেপ শুক্রাণুর গতিপথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতো।
তবে শুধু মধু ব্যবহার করলেও কথা ছিলো। তারা মধুর সাথে ব্যবহার করতো কুমিরের মলও! এরপরই সেই মিশ্রণ প্রয়োগ করতো তারা।
নেকড়ের মূত্র
মধ্যযুগে মানুষদের চিকিৎসাপদ্ধতি ও ওষুধ কতটা অদ্ভুত ছিলো তা নিয়ে আগে বেশ কিছু লেখাই লিখেছি। সেসব থেকেই তৎকালীন সমাজব্যবস্থার অনগ্রসরতা ও কুসংস্কারের রাজত্বের পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। গর্ভধারণ এড়াতে তখনকার সময়ে ব্যবহৃত নেকড়ের মূত্রও যেন এরই আরেকটি রুপ।
স্বামীর সাথে মিলনের পর তৎকালীন নারীরা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেন এবং খুঁজে খুঁজে এমন এক জায়গা তারা বের করতেন যেখানে আগেই কোনো স্ত্রী নেকড়ে মূত্র বিসর্জন করে গেছে। এরপর ঠিক ঐ জায়গাটিতে একই কাজ করতেন সেই নারী! প্রায় একইরকম আরেকটি প্রথার কথাও জানা যায় যেখানে একজন নারী কোনো গর্ভবতী নেকড়ের মূত্রের পাশে চক্রাকারে হাঁটতে থাকতেন আর বিড়বিড় করে চলতো তার মন্ত্রোচ্চারণ!
ভেজা পট্টি
হাজার বছর আগে থেকেই জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য মানুষ ব্যবহার করে আসছে বিভিন্ন ভেজা পট্টি। এ পট্টিগুলো রেশম, পশমি সুতা কিংবা প্যাপিরাস থেকে তৈরি করা হতো। এরপর সেই পট্টিকে লেবুর রস কিংবা গাম অ্যারাবিকে ভিজিয়ে নিয়ে ব্যবহার করা হতো উদ্দেশ্য সাধনে।
কোকা-কোলা
কোমল পানীয় হিসেবে কোকা-কোলার জনপ্রিয়তা আজ বিশ্বজুড়ে। জনপ্রিয় এ পানীয়টির নাম শোনে নি, এমন মানুষ বোধহয় বর্তমান দুনিয়াতে একজনও নেই। অনেকের তো ভারী খাবারদাবারের পর কিছুটা কোমল পানীয় না হলে চলেই না।
মরফিনের আসক্তি কাটাতে জন পেম্বারটন যে ফ্রেঞ্চ ওয়াইন কোকার রেসিপি উদ্ভাবন করেছিলেন, কালের পরিক্রমার কিছুটা পরিবর্তনের পর সেটাই একসময় হয়ে ওঠে আজকের কোকা-কোলা। মজার ব্যাপার হলো গর্ভধারণ প্রতিরোধকারীদের তালিকায় আছে জনপ্রিয় এ পানীয়র নামও।
কার্বনেশন ও চিনি গর্ভধারণ প্রতিরোধে সক্ষম হবে এমন আশায় এককালে অনেক নারীই মিলনের পর তাদের লজ্জাস্থানে এ কোমল পানীয়টি ব্যবহার করতেন!
কামারের পানি
শুনতে বেশ অদ্ভুত লাগলেও সত্য যে, প্রাচীন গ্রীসের মানুষেরা এককালে বিশ্বাস করতো বিভিন্ন ধাতব পদার্থ প্রস্তুতকালে একজন কামার যে পানি ব্যবহার করে থাকেন, সেই পানির মাঝে আছে গর্ভধারণ প্রতিরোধী ক্ষমতা! আরো আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, বিচিত্র এ চর্চাটি চলেছে প্রায় আঠারোশ বছর।
ঠিক কার মাথায়, কবে উদ্ভট এ আইডিয়া এসেছিলো তা আজ আর জানার উপায় নেই। তবে ধারণা করা হয় যে, সেই পানিতে মিশে থাকা সীসাকেই অনেকে গর্ভধারণ প্রতিরোধের মূল নিয়ামক ভাবতেন। কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালেও অনেক নারীই সেসব ফ্যাক্টরিতে স্বেচ্ছায় কাজ করতে চেয়েছিলেন, যেগুলোতে তারা সীসার সংস্পর্শে থাকতে পারবেন। উদ্দেশ্য একটাই, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধ!
সীসামিশ্রিত এ পানি কিংবা সীসা তাদের গর্ভধারণ রোধে কতটা কার্যকর হয়েছিলো তা জানা যায় নি। তবে এর ফলে স্নায়বিক সমস্যা, বিতৃষ্ণাবোধ, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া, কোমা, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে!
লেবু
গ্রীষ্মকালে এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর শরবত আমাদের প্রাণটাই জুড়িয়ে দেয়। গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে একটু লেবুর রস চিপে নিলে খাবারের স্বাদ যে অনেকটাই অমৃতের মতো হয়ে যায়, সেটাও কারো অজানা নয়। তবে এককালে এই লেবুও এসেছিলো গর্ভধারণ প্রতিরোধকারীদের তালিকায়।
লেবুর এমন ব্যবহারের কথা জানা যায় সতের শতকের দিকে। লেবুকে তখন ব্যবহার করা হতো একটি ডায়াফ্রাম হিসেবেই। আর এতে থাকা এসিড স্পার্মিসাইড হিসেবে কাজ করতো বলে এ উদ্দেশ্যে লেবু বেশ সফলতার পরিচয়ও দিয়েছিলো।
আফিম
লেবুর মতো ডায়াফ্রাম হিসেবে এককালে ব্যবহৃত হয়েছে আফিমও। এর ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে প্রাচীন সুমাত্রা দ্বীপের অধিবাসীদের মাঝে।
প্রাণীদের অন্ত্র ও মূত্রথলি
এতক্ষণ ধরে যেসব পদ্ধতির কথা আলোচনা করলাম, তার সবই প্রয়োগ করা হতো নারীদের উপর। তবে এবারেরটি যাবে পুরুষদের ক্ষেত্রে।
প্রাচীনকালে রোমানরা যেসব কনডম ব্যবহার করতো, সেগুলো মূলত ছাগল ও ভেড়ার অন্ত্র ও মূত্রথলি থেকেই তৈরি করা হতো। ইতিহাসের পাতা থেকে আরেক ধরনের প্রাচীন কনডমের কথা জানা যায় যা তৈরি করা হয়েছিলো শূকরের অন্ত্র থেকে। তবে এটি ব্যবহারের আগে গরম দুধে ভিজিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছিলো!
পারদ
পারদের মতো বিষাক্ত পদার্থও এককালে ব্যবহৃত হয়েছে জন্ম নিয়ন্ত্রণের কাজে। আর এর ব্যবহারকারী ছিলো প্রাচীন চীনের অধিবাসীরা। এজন্য প্রস্তুত করা হতো তেল ও পারদ দিয়ে তৈরি এক ধরনের মিশ্রণ। একজন মহিলা এরপর অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ এড়াতে সেই মিশ্রণটি খালি পেটে গলাধঃকরণ করে নিতেন।
মানবদেহের জন্য পারদ বেশ ক্ষতিকর। বারবার এটি গ্রহণের ফলে কেউ বন্ধ্যাও হয়ে যেতে পারে। হয়তো এ কারণেই চীনের লোকেরা একে এতটা কার্যকরী বলে ভেবেছিলো!
তেল
প্রাচীন গ্রীসের লোকেরা জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য অলিভ অয়েলের সাথে সীডার (Cedar) অয়েল মিশিয়ে ব্যবহার করতো। এটি তারা মূলত স্পার্মিসাইড হিসেবে ব্যবহার করতো। এরিস্টটল অবশ্য এর সাথে সীসার মিশ্রণ ব্যবহারের পরামর্শও দিয়েছিলেন!
লাফালাফি
অদ্ভুত এ পরামর্শটি এসেছিলো সরেনাস নামক প্রাচীন গ্রীসের এক অধিবাসীর কাছ থেকে। তিনি বলেছিলেন যে, মিলনের পর একজন নারী যদি কিছু সময় লাফালাফি করেন, তাহলেই তিনি সন্তান ধারণের চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। সেই সাথে তিনি হাঁচি দেয়ার পরামর্শও দিয়েছিলেন।
পেঁয়াজের জুস
চৌদ্দ শতকের ফ্রান্স ও ইতালীর নারীরা একই উদ্দেশ্যে ঢকঢক করে গিলে ফেলতেন পেঁয়াজের জুস।
বীভারের অণ্ডকোষ
ষোল শতকের কানাডার অধিবাসীরা মনে করতো যে, ছোট পশমী প্রাণীদের অণ্ডকোষ গর্ভধারণ প্রতিরোধে সক্ষম। আর এ লক্ষ্যে তাদের নজর গিয়ে পড়ে বীভারের উপর।
আগে তো তাও বেজির অণ্ডকোষ নারীরা নিজেদের পায়ে বেঁধে রাখতেন, এবার বীভারের বেলায় তা ছাড়িয়ে যায় সেই মাত্রাও। মৃত বীভারের অণ্ডকোষ শুকিয়ে একেবারে চূর্ণ করে ফেলা হতো প্রথমে! এরপর সেই অণ্ডকোষ চূর্ণকেই অ্যালকোহলের সাথে মিশিয়ে পান করতেন একজন নারী।