রাত্রির অন্ধকারে মশালের আলোয় পাহাড়ী এলাকা আলোকিত হয়ে উঠলো। বাদ্যের লয় দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। অশরীরী স্পর্শে উপস্থিত সবার শরীরে শিহরণ খেলে গেলো। বলি দেওয়া পশুর রক্ত সবার চোখে প্রতিশোধের বারুদ জ্বালিয়ে রাখছিলো। আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে নতুন পৃথিবীতে ঘটিত এই ভুডু রিচুয়াল ভয়ানক কোনো রক্তপাতের ইঙ্গিত দিচ্ছিলো। আসলে কী হয়েছিলো তা জানতে হলে তিন শতক পেছনে যেতে হবে।
সময়টা ছিলো ৫ ডিসেম্বর, ১৪৯২ সাল।
ইউরোপের পশ্চিমে, আটলান্টিক মহাসাগরের এক দ্বীপে স্প্যানিশ এক জাহাজ থেকে একজন উৎসুক অভিযাত্রী ও ভবিষ্যতের সব সাম্রাজ্যবাদীদের পথপ্রদর্শক পা রাখলেন। আদিবাসী তিয়ানো ও আরাওয়াকা জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এই দ্বীপটি তার বেশ পছন্দ হয়ে গেলো। এর নাম তিনি রাখলেন ‘লা ইসলা স্পেনোলা’, যার অর্থ ‘স্পেনীয় দ্বীপ’। পরে ল্যাটিনে যা ‘হিস্পেনিওলা’ নামে পরিচিত হয়ে উঠবে।
এই অভিযাত্রী দ্বীপটিতে ‘লা নেভিদাদ’ নামে একটি উপনিবেশ গড়ে তুললেন। সমুদ্রযাত্রায় বিধ্বস্ত জাহাজের অবশেষ দিয়েই দ্বীপটির এই প্রথম ইউরোপীয় সেটলমেন্ট নির্মিত হয়েছিলো। এই অভিযাত্রী স্পেনে ফিরে পুনরায় ১৮৯৩ সালে এসে দেখতে পান, এই সেটলমেন্ট বিধ্বস্ত এবং এর ৩৯ অধিবাসী হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। তিনি আগের অঞ্চল থেকে কিছুটা পূর্বে ‘লা ইসাবেলা’ অঞ্চলে সেটলমেন্ট সরিয়ে নেন। ১৪৯৬ সালে ‘সান্তো দোমিঙ্গো’ নামক স্থানে আলোচ্য উপনিবেশের কেন্দ্র স্থাপিত হলো।
হ্যাঁ, আমাদের এই অভিযাত্রীর নাম ক্রিস্টোফার কলম্বাস। ইউরোপের কাছে সম্পূর্ণ নতুন ও অচেনা এই ভূখণ্ডে তার আগমন পৃথিবীর ইতিহাসে সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছিলো।
দ্বীপটিতে বহিরাগত ইউরোপীয়দের আগমনে নতুন ও অপ্রতিরোধ্য রোগে আদিবাসী আরাওয়াকা জনগোষ্ঠী প্রায় শূন্যে মিলিয়ে গেলো। তিয়ানো জনগোষ্ঠীর অল্প কিছু মানুষ প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হলো। উল্লেখ্য, তিয়ানো জনগোষ্ঠী দ্বীপটিকে ‘আইতি’ সম্বোধন করতো, তা থেকেই আজকের ‘হাইতি’ নামটির উদ্ভব।
এদিকে ১৫৯২ সাল অবধি ইংরেজ নৌসেনা ও ফরাসি জলদস্যুদের আক্রমণে স্প্যানিশ উপনিবেশগুলো বেশ কয়েকবার বিধ্বস্ত হয়েছিলো। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কারণে ইউরোপের অন্যান্য শক্তির কাছে স্প্যানিশ শক্তি ক্ষীণ হয়ে এলো। তার পরিত্যক্ত স্থান দখল করতে এলো ফরাসিরা। তাদের শক্তি প্রদর্শন ১৬২৫ সাল থেকে শুরু হয়েছিলো। ফরাসিরা তাদের দখল করা এলাকাকে ‘সেন্ত দোমিং’ নাম দিয়েছিলো। ১৬৫৯ সাল থেকে শুরু হওয়া ফরাসি দখলদারিত্ব ১৬৯৭ সালের স্পেন-ফ্রান্স চুক্তির মাধ্যমে সার্থকতা পেলো।
কে জানতো, ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসকদের জন্য ভবিষ্যতে কত করুণ পরিণতি অপেক্ষা করে আছে!
১৭১১ সাল থেকে ফরাসি উপনিবেশের স্থান একরকম পাকা হয়ে গেলো। এ বছর ষোড়শ লুই পোর্ত-দ্যুঁ-পে থেকে কেপ ফ্রান্সিসে রাজধানী সরিয়ে নেন। ১৭২৬ সালে স্থাপিত হওয়া লে-কেঁয়স অঞ্চল দ্বীপটির দক্ষিণ দিকের সবচেয়ে বড় উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৭৪৯ সালে পশ্চিমাঞ্চলে স্থাপিত হয় পোর্ত অঁ-প্রিন্স উপনিবেশ। ফরাসিদের রমরমা উপনিবেশের গতি একরকম অপ্রতিরোধ্য মনে হচ্ছিলো।
১৭৫০ এর দশক থেকে সেন্ত দোমিং অঞ্চলে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসকরা চিনি ও কফি শিল্পের মাধ্যমে অভূতপূর্ব মুনাফা অর্জন শুরু করে। মাঝখানে ইউরোপে যুদ্ধের কারণে কিছুটা স্তিমিত হলেও পরে চিনির বাণিজ্যে এ অঞ্চল অদ্বিতীয় হয়ে ওঠে। ১৭৬৭ সালে এ অঞ্চল থেকে ৭২ মিলিয়ন পাউন্ড অপরিশোধিত চিনি, ৫১ মিলিয়ন পাউন্ড পরিশোধিত চিনি ও ১ মিলিয়ন পাউন্ড নীল ইউরোপে রপ্তানি করা হয়। এ অঞ্চল ফরাসি সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ধনবান এলাকা হিসেবে খ্যাত হয়ে ওঠে। এর অপর নাম হয়ে ওঠে ‘পার্ল অব দ্য এন্তিলি’স’। ১৭৮০ সালের মধ্যে সেন্ত দোমিং ইউরোপে রপ্তানিকৃত শতকরা ৪০ ভাগ চিনি ও ৬০ ভাগ কফির একমাত্র উৎস হয়ে উঠেছিলো। আমরা দেখবো, এই চিনিশিল্পই পরে হাইতির শোষিত দাসদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ বিরোধী ভুডু রিচুয়াল ও তার ফলে জন্মানো কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গের অন্যতম কারণ হয়ে উঠবে।
১৭৮০ সালের দ্বিতীয়ার্ধ অবধি সেন্ত দোমিং অঞ্চল আটলান্টিক অঞ্চলে দাস ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছিলো। এ সময় এ অঞ্চলে প্রায় ৭ লক্ষ ৯০ হাজার দাস আফ্রিকা থেকে চিনি শিল্পের জন্য আনা হয়। ১৭৬৪ থেকে ১৭৭১ সাল অবধি এ অঞ্চলে গড়ে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার দাস নিয়ে আসা হতো। দেখা গেলো, ১৭৮৭ সাল অবধি অঞ্চলটিতে বছরে প্রায় ৪০ হাজারের বেশি দাস নিয়ে আসা হচ্ছে। ১৭৮৯ সালের হিসেব অনুযায়ী, প্রায় ৫ লাখ কৃষ্ণাঙ্গ দাস মাত্র ৩২ হাজার শেতাঙ্গ প্রভুদের দ্বারা শাসিত হচ্ছিলো।
দাসপ্রথা নিঃসন্দেহে ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়। তবে তৎকালীন সেন্ত দোমিঙ্গ (আজকের হাইতি) অঞ্চলের সুগার প্ল্যান্টেশনগুলোর দাসপ্রথা কঠোর বর্ণবাদীর জন্যও সহ্য করা কষ্টকর। সামান্য ভুলত্রুটির জন্য মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা, চাবুকের প্রহার, জিভ কেটে নেওয়া, খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা, ফাঁসিতে চড়িয়ে হত্যা- কোনোটিই বাদ থাকতো না। এসব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
দাসদের আধিক্যের কারণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় মুক্ত ধনবান কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিলো। তাদের সম্পত্তির অধিকার ছাড়া অন্যান্য অধিকার কমই ছিলো। সুগার প্ল্যান্টেশনের এক-তৃতীয়াংশের মালিকানা তাদের হাতে ছিলো। কৃষ্ণাঙ্গদের বেশিরভাগ অংশকে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আনা হয়েছিলো। তারা তাদের পারিবারিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বাস সাথে করেই নিয়ে এসেছিলো। তার সাথে মিলেছিলো ক্যাথলিক বিশ্বাসের বিভিন্ন দিক ও ডাকিনীবিদ্যার চর্চা। মূলত অদৃশ্য আত্মা ‘লোয়া’কে আরাধনা, বলিদান ও বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা দ্বারা সন্তুষ্ট করাই ভুডু রিচুয়ালের মূলকথা। ১৬৮৫ সালে চতুর্দশ লুইয়ের আইনে কৃষ্ণাঙ্গদের ধর্মচর্চায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও গোপনে তাদের রিচুয়াল অব্যাহত ছিলো। নতুন ভূখণ্ডে এই ধর্মচর্চা অভিনব রূপ নিয়ে নিপীড়িত দাসদের শোষণের বিরুদ্ধে জাগ্রত করে তুলছিলো।
১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠলে হাইতির ধনবান কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বেশ উদ্দীপনার জন্ম হয়। স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের এই বিপ্লবী আবেদন কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যেও ব্যাপক আশার সঞ্চার করে। সুগার প্ল্যান্টেশন থেকে পালিয়ে আসা বঞ্চিত-লাঞ্ছিত কৃষ্ণাঙ্গরাও আশার আলো দেখতে পেয়েছিলো। ১৭৯০ সালে ফ্রান্সের বিপ্লবী ন্যাশনাল এসেম্বলি ধনী কৃষ্ণাঙ্গদের মানবাধিকারের স্বীকৃতি দিলে উদ্দীপনা আরো অধিক হয়।
তিন শতক ধরে চলে আসা নৃশংস দাসপ্রথার প্রতিশোধের দিন ঘনিয়ে আসছিলো।
১৪ আগস্ট, ১৭৯১। স্থান: বোয়া কাইমান পাহাড়ি এলাকা, সেন্ত দোমিং, বর্তমান হাইতি।
পালিয়ে আসা দাস কৃষ্ণাঙ্গদের বেশ বড় একটি দল বিশেষ উদ্দেশ্যে জড়ো হলো। তাদের সাথে ছিলো অত্যাচার আর বঞ্চনার আগুন। আগুন নেভানোর জন্য পূর্বপুরুষের নিয়ে আসা অন্ধকারকে জাগ্রত করে শক্তি সঞ্চয়ের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিলো। ভুডু পুরোহিত বুকমান দুত্তি অদৃশ্য আত্মার আবাহন করে তাদের কাছে অপার শক্তি চাইলেন। মুহূর্তেই দলের সবার মধ্যে যেন অপার উন্মাদনা তৈরি হলো। কালো শুকর বলি দেওয়া হলো। বাদ্যের তালে তালে নিবিড় অশরীরী স্পর্শ শীতল স্রোতের মত বয়ে গেলো। অদৃশ্য আত্মার স্পর্শে বয়স্ক মহিলা পাখির রক্তাক্ত দেহ মুখে নিয়ে নাচতে লাগলো। দলের বাইরের মানুষের কাছে এই দৃশ্য অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো।
বলি দেওয়া পশুর রক্ত পানের মাধ্যমে উপস্থিত দাসদের নেতারা হাইতিকে শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিকতা ও দাসপ্রথা থেকে চিরতরে মুক্ত করার শপথ নিলো। ঐতিহাসিকরা বলেন, হাইতির স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ আসলে বোয়া কাইমানে রোপিত হয়েছিলো।
২২ আগস্ট, ১৭৯১। ক্রুদ্ধ কৃষ্ণাঙ্গরা রাতের অন্ধকারে শ্বেতাঙ্গ প্ল্যান্টেশন মালিক ও শাসকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তাদের চোখেমুখে তিন শতকের বঞ্চনার তীব্র উত্তাপ আর শরীরে বোয়া কাইমানের থেকে পাওয়া অঢেল শক্তি। প্রায় ১,০০০ শ্বেতাঙ্গ দাসমালিক নিহত হলো, ১,৪০০ সুগার প্ল্যান্টেশন ধ্বংসাবশেষ হয়ে রইলো। সভ্য শ্বেতাঙ্গরা কালো মানুষের এত ভয়ানক রূপ আগে কখনও দেখেনি! রটে গেলো, বোয়া কাইমানে কৃষ্ণাঙ্গ দাসেরা আসলে খ্রিস্টীয় শয়তান লুসিফারের সাথে আত্মা বিক্রি করে দিয়েছে!
বুকমান দুত্তি শ্বেতাঙ্গ সেনানায়কদের হাতে ধরা পড়লে তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছিলো। কিন্তু বিদ্রোহ থেমে থাকলো না। ১৭৯৩ সালে ফ্রান্সের জ্যাকোবিন নেতা লেগাঁ ফেলেসিতে সেন্থোনাক্স হাইতি ভূখণ্ডে দাসপ্রথা তুলে দেবার ঘোষণা দিলেন। অবিসংবাদিত নেতা তুঁসা লুভ্যাচিউরের নেতৃত্বে উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম অব্যাহত থাকলো। তাকে কৃষ্ণাঙ্গদের জর্জ ওয়াশিংটন নামে ডাকা হয়। ১৮০৪ সালে আমেরিকা উপকূলের নতুন পৃথিবীতে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রথম স্বাধীন দেশ হিসেবে হাইতি আত্মপ্রকাশ করলো।
প্রশ্ন থেকে যেতে পারে, বোয়া কাইমানে কি সত্যিই কৃষ্ণাঙ্গ-শয়তান চুক্তি হয়েছিলো?
সভ্যতার ধ্বজাধারী ইউরোপ পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে ঔপনিবেশিকতা ও বর্ণবাদ প্রায় একত্রেই শুরু করেছিলো। বর্ণবাদীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শুধুমাত্র নিজেদের সংস্কৃতি ছাড়া অন্য সব জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে আদিম ও অসভ্য বলে দেগে দেওয়া। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে সাম্রাজ্য বিস্তার আধুনিক ইউরোপের আগেও হয়েছে, সেসময়ের বিজয়ী ও বিজেতার মধ্যকার সাংস্কৃতিক মিলন উপনিবেশবাদী ইউরোপ নিতান্তই মধ্যযুগের অন্ধকার বলে উড়িয়ে দিতো। কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের পূর্বপুরুষদের আফ্রিকা থেকে আনা হয়েছিলো। সেখান থেকে তাদের আদিবাসী সাংস্কৃতিক বিশ্বাসও এসেছিলো। মাত্রা ছাড়ানো বর্ণবাদী শোষণে কোণঠাসা হবার পর সেই আদিবাসী সংস্কৃতির পরিবর্তিত রূপ তাদের নিস্তারের পথ দেখিয়েছিলো।
উল্লেখ্য, ফরাসি ক্যাথলিক ও গোঁড়া মার্কিন ইভাঞ্জেলিক্যান পুরোহিতদের অনেকেই আজও কৃষ্ণাঙ্গ-শয়তান চুক্তিতে বিশ্বাস করেন। অনেকে বলে থাকেন, সেই অপকর্মের কারণেই আজকের দরিদ্র হাইতির এমন দুর্দশা!