উনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ড। সময়টা আরও ভালোভাবে বললে ১৮৮৫ সাল। সেই সময়ে নিজের বাসস্থান ‘দ্য গ্লেন’-এ খুন হলেন এমা কেইসি নামের একজন ধনী, অবিবাহিতা মহিলা। খুনী গলা কেটে খুন করেছে তাকে!
কে খুন করলো মিস এমাকে?
দুর্দান্ত এক থ্রিলার গল্পের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে ভেবে পাঠক হয়তো নড়েচড়ে বসেছেন। একটু পরেই হয়তো আগমন ঘটবে শার্লক হোমস অথবা অন্য কোনো গোয়েন্দার। যদিও শার্লক হোমসের আবির্ভাব হয় এর আরও দুই বছর পরে, ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’ উপন্যাসের মাধ্যমে। যা-ই হোক, একের পর এক রহস্যের জট খুলবেন গোয়েন্দাপ্রবর, খুনীও কম যাবে না। কিন্তু শেষ হাসি হাসবেন গোয়েন্দাই। সব বাধা অতিক্রম করে ঠিকই ধরে ফেলবেন খুনীকে।
পাঠককে হতাশ করতেই হচ্ছে। কারণ, এই গল্পে কোনো রহস্য নেই, কোনো টুইস্ট নেই। খুনী খুব সহজেই ধরা পড়ে গিয়েছিল, ইংরেজিতে এ ধরনের কেসকে বলা হয় ‘ওপেন অ্যান্ড শাট’ কেস। এমা কেইসির চাকর জন লি-ই ছিল আসল খুনী।
এই পর্যন্ত ঘটনাটা আর আট-দশটা খুনের গল্পের মতোই থাকে। নিজের কোনো নির্বুদ্ধিতায় ধরা পড়ে যায় খুনী, বিচারের পরে তাকে ঝুলিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। খেল খতম!
কিন্তু পাঠক বিশ্বাস করুন, আপনি যদি ভেবে থাকেন, খেল আসলেই খতম, তাহলে আপনি অনেক বড় ভুল করছেন। এরপরে জন লির সাথে যা হয়েছিল, তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। তার সবটাই আপনাদেরকে জানানো হবে, তবে তার আগে জন লি নামের খুনীর অতীতে কিছুক্ষণের জন্য হেঁটে আসা যাক।
জন লির আসল নাম জন হেনরি জর্জ লি। জন্ম ১৮৬৪ সালে। স্কুল ছাড়ার পরে এমা কেইসির বাড়িতে চাকরের কাজ নেয় সে। ‘দ্য গ্লেন’ ছিল বাবাকম্ব নামের এক সাগরের নিকট এক গ্রামে। সেখানে বেশ কিছুদিন কাজ করে সে, তারপরে নৌবাহিনীতে যোগ দেয়। সেখানে তিন বছর কাটানোর পরে ইনজুরির অজুহাত দেখিয়ে তাকে বিদায় করে দেয় নৌবাহিনী কর্তৃপক্ষ। বিপদে পড়ে যায় জন, রোজগারের ব্যবস্থা না থাকায় খুব কষ্টে জীবন কাটাতে হচ্ছিল তাকে। তবে কর্নেল ব্রাউনলো নামের এক সামরিক কর্মকর্তার বাড়িতে একটা কাজ জুটিয়ে ফেলে সে। কিন্তু মাথায় বদবুদ্ধি চাপলে যা হয়, কুড়ি পাউন্ড চুরি করে বসে। ধরাও পড়ে যায়, ফলে এক্সেটার জেলে ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয় জন।
জেল থেকে বেরিয়ে কী করবে ভাবতে ভাবতে আবার ‘দ্য গ্লেন’এ হাজির হয় সে। পুরোনো চাকর আবার কাজে বহাল হতে চায় জেনে আপত্তি করেননি মিস কেইসিও।
এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। ঝামেলাটা শুরু হয় সেদিন, যেদিন বাড়ির রান্নাঘরে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় মিস কেইসিকে। বীভৎসভাবে কেটে ফেলা হয়েছে মহিলার গলা, যেন তার উপরে প্রচণ্ড রাগ ছিল খুনীর। শুধু তা-ই নয়, আগুনও লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল রান্নাঘরে, যেন পুড়ে বিকৃত হয়ে লাশটা।
সবার সন্দেহ যায় জনের দিকে, কারণ, খুনের সময়ে বাড়িতে জন ছাড়া বাড়িতে ছিল না অন্য কোনো পুরুষ। আর খুনী যে একজন শক্তিশালী পুরুষ, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল প্রায় সবাই-ই। কিছুদিন আগে বেতন কমানোর কারণে মিস কেইসির উপরে খুব নাখোশ ছিল জন। আর হাতে একটা জখম ছিল তার, এই জখমের কারণ জানতে চাইলে সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারেনি সে। সেই সাথে আগের ক্রিমিনাল রেকর্ডের কারণে জন লি পরিণত হয় জন ‘বাবাকম্ব লি’তে।
মিস এমা কেইসি খুন হন ১৮৮৪ সালের ১৫ নভেম্বর। বিচার হয় পরের বছরের ২রা ফেব্রুয়ারি। নিরেট কোনো প্রমাণ ছিল না জনের বিপক্ষে, তাই প্রায় ২৫ জনের সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ শেষে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেয় আদালত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জনের সৎ বোনও এমার বাড়িতে কাজ করতো, সে জনের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেয়। এই পুরো সময়টা জন নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছিল, এমনকি তাকে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে, এমন অসম্ভব দাবি করতেও ভুল হয়নি তার। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের প্রলাপ ভেবে তার কথায় গুরুত্ব দেয়নি কেউই।
জনের ফাঁসি কার্যকরের সিদ্ধান্ত হলো ২৩ ফেব্রুয়ারি। সেদিন সকালে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে আসা হলো জনকে। জল্লাদের নাম ছিল জেমস ব্যারি, সে নির্বিকার মুখে জনকে ট্র্যাপডোরের উপরে দাঁড় করিয়ে গলায় দড়ি পরিয়ে দিল। তারপর হাত বাড়ালো লিভারের দিকে।
সেই মুহূর্তে জনের মাথায় কী চলছিল, তা আর আজ জানা সম্ভব নয়। হয়তো সারাজীবনের স্মৃতি ভেসে উঠেছিল তার সামনে, অথবা অপেক্ষা করছিল চোখের সামনে একটা কালো পর্দা নেমে আসার। কিন্তু এসব কিছুই ঘটলো না! লিভার টেনে ধরলো জেমস, অন্য সময় সাথে সাথে খুলে যায় ট্র্যাপডোর, ঝুলে যায় অপরাধী। কিন্তু সবাইকে অবাক করে এবার আর খুললো না জনের পায়ের নিচের দরজা!
বিরক্ত মুখে সামনে এগিয়ে এলো জেমস, ফাঁসির মঞ্চে কোনো সমস্যা হলো কি না দেখতে চায়। কাজের সময় এমন সমস্যা ভালো লাগে? সরানো হলো জনকে, তারপরে আবার লিভার টানা হলো। দিব্যি খুলে গেল ট্র্যাপডোর। কয়েকবার এরকম করার পরে আর কোনো সমস্যা নেই বুঝতে পেরে জনকে নিয়ে আসা হলো আবার।
দ্বিতীয়বারের মতো লিভার টানা হলো, এবং দ্বিতীয়বারের মতো বন্ধ থাকলো ট্র্যাপডোর!
আবার এগিয়ে এলো জেমস। এবার আর বিরক্ত নয় সে, এবার সে হতভম্ব। হচ্ছেটা কী? ট্র্যাপডোর খুলছে না কেন? লোকটা কি আসলেই নিরপরাধ?
আবার সরানো হলো জনকে। এবার দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে খতিয়ে দেখা হলো ফাঁসিকাঠ। কোনো যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এমনটা হচ্ছে কি না- দেখা হলো সেটাও। তা-ও না। জনের শরীরের ওজনের সমপরিমাণ বস্তা দিয়ে পরীক্ষা করা হলো, চমৎকার কাজ হলো। অর্থাৎ, জনকে সরিয়ে লিভার টানা হলেই খুলে যাচ্ছে দরজা।
আরেকবার মঞ্চে আনা হলো জনকে, এবারই শেষ। পরপর তিনবার ফাঁসির মঞ্চ থেকে কেউ বেঁচে গেলে তাকে সেদিন আর ফাঁসিতে ঝোলানো যাবে না। ফাঁসির দণ্ডও মওকুফ করা যায় কি না, তা ভেবে দেখবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
শেষবারের মতো লিভার টানলো জেমস ব্যারি, এবং এবারও জনের পায়ের নিচের দরজা খুললো না!
তাজ্জব এই খবর নিয়ে একজন দূত গেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে, যখন সে ফিরলো, তখন তার হাতে জনের সাজা মওকুফের চিঠি। মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে তাকে।
নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে গেল জন ‘বাবাকম্ব লি’! টানা ২২ বছর জেলে কাটিয়ে ১৯০৭ সালে যখন সে মুক্তি পায়, তখন তার বয়স ৪২। মুক্তির পরে তারকায় পরিণত হয় সে, পরিচিতি পায় ‘দ্য ম্যান দে কুড নট হ্যাং’ হিসেবে।
জনের এক সৎ বোনের কথা বলা হয়েছিল। লেখাটা শেষ করার আগে সেই সৎ বোনের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। তার নাম ছিল এলিজাবেথ হ্যারিস। বিচার চলাকালে জনের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিল সে, জন বারবার দাবি করেছিল, নিজের প্রেমিককে বাঁচাতেই এই কথা বলছে এলিজাবেথ। এবং জনের আরেক দাবি অনুযায়ী, পরবর্তীতে এলিজাবেথ যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন নাকি এমাকে খুন করার কথা নিজ মুখে সে স্বীকার করে যায় জনের কাছে!
আসলেই কি জন খুন করেছিল মিস কেইসিকে? নাকি খুনি এলিজাবেথ ও তার প্রেমিক? ফাঁসি থেকেই বা জন বেঁচে গেল কীভাবে? এ কি একজন নিরাপরাধের প্রতি ঈশ্বরের আশীর্বাদ, নাকি অন্য কারো সাথে যোগসাজস করে ফাঁসির মঞ্চে ‘কিছু একটা’ করেছিল সে? নাকি ফাঁসির মঞ্চের ত্রুটি শুধুমাত্র যান্ত্রিক ত্রুটিই?
কালের অতলে হারিয়ে যাওয়া এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আর কোনোদিনই পাওয়া যাবে না। ফাঁসির মঞ্চ থেকে জন বাবাকম্ব লির বেঁচে ফেরাটা তাই টিকে আছে এক অমীমাংসিত রহস্য হিসেবেই।