অ্যাপোলো-১৩ চন্দ্রাভিযান : দুর্ঘটনা মোকাবেলার গল্প (পর্ব ১) এর পর থেকে।
১৩ এপ্রিল সাউলিয়েটিস ও তার সহযোগীরা সাদা চাকতিটি দেখার আধ ঘণ্টা আগে ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা তাদের রুমে একটা বড় প্রজেক্টর স্ক্রিনে টেলিভিশন শো দেখছিলেন। এই শোটি স্পেসক্রাফট থেকে নভোচারীরা সম্প্রচার করছিলেন। দুর্ঘটনা ঘটার সময় আমেরিকার বড় তিন টেলিভিশন নেটওয়ার্কের কোনোটিই সরাসরি সম্প্রচার করছিল না। যদিও তারা পরবর্তীতে রেকর্ড করা অংশ প্রচার করার কথা ছিল। দুর্ঘটনার মাত্র দশ মিনিট আগে টেলিভিশনে প্রচার করা বন্ধ করা হয়। যদি সেটা চলমান থাকত, তাহলে হয়তো ইতিহাসের নাটকীয় যেকোনো পারফরম্যান্সের সাথে তুলনীয় কিছু সরাসরি দেখতে পেত দর্শকরা।
ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা তাদের চেয়ারে বসে হেলান দিয়ে স্ক্রিনে দেখছিলেন। তাদের কাছে মনে হচ্ছিল নভোচারীরা আনন্দেই আছেন সেখানে। ৪২ বছর বয়সী কমান্ডার ক্যাপ্টেন লাভেল ছিলেন অ্যাপোলো-১৩ মিশনের সরাসরি সম্প্রচারের ক্যামেরাম্যান ও ঘোষক। তিনি ১৯৫২ সালে অ্যানাপোলিস থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। দশ বছর আগে নভোচারী হিসাবে যোগ দেন। তিনি প্রথমে ক্যামেরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ধূসর কমান্ড মডিউলের ভেতরের অংশ দেখাচ্ছিলেন। কমান্ড মডিউল ছিল মোচাকৃতির, যার ভূমির ব্যাস ছিল ১৩ ফুট ও উচ্চতা ছিল ১০.৫ ফুট। এটি ছিল ছোটখাট স্টেশন ওয়াগন গাড়ির ভেতরের অংশের সমান। কিন্তু সেখানে ভেসে থাকা নভোচারীদের কাছে এটা তুলনামূলক ছোট মনে হচ্ছিল।
মাঝখানে থাকা কাউচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন লাভেল। তার নিচে ছিল সার্ভিস মডিউল, যেখানে অন্যান্য জিনিসের সাথে ছিল বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা, যার মাঝে ছিল অক্সিজেনের দুটো বড় ট্যাংক। মোচকাকৃতির কমান্ড মডিউলের সাথে বেলনাকৃতির সার্ভিস মডিউল এক প্রান্তে একত্রে একটি ইউনিট গঠন করে। এগুলোর সামনে যুক্ত ছিল লুনার মডিউল। স্পেসক্রাফটের মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৬০ ফুট। লাভেলের মাথার উপরে কোণকের চূড়ায় একটি গোলাকার হ্যাচ ছিল, যার সরু টানেলের মাধ্যমে লুনার মডিউলে যাওয়া যেত।
লাভেল এর আগে মহাকাশে আরো তিনবার অভিযানে গিয়েছিলেন। চাঁদের উদ্দেশ্যে এটি ছিল তার দ্বিতীয়বারের ভ্রমণ। এর আগে ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে চাঁদের চারপাশ প্রদক্ষিণ করা অ্যাপোলো-৮ মিশনের সদস্য ছিলেন। এই অভিজ্ঞতাগুলো হয়তো তাকে পেশাদার অনুষ্ঠান উপস্থাপকের মতো কাব্যিক ঢঙে কথা বলতে সাহায্য করেছিল। তিনি বলেছিলেন,
“আমরা আজ আপনাদেরকে একটি মহাকাশযানের অভিযান দেখানোর পরিকল্পনা করেছি। আপনাদেরকে ওডিসি থেকে টানেলের মধ্য দিয়ে অ্যাকুয়ারিয়াসে নিয়ে যাব”।
এখানে ‘ওডিসি’ ছিল কমান্ড মডিউলের সাংকেতিক নাম এবং ‘অ্যাকুয়ারিয়াস’ ছিল লুনার মডিউলের সাংকেতিক নাম।
লাভেল লুনার মডিউলের পাইলট হাইসের দিকে ক্যামেরা তাক করলেন। হাইস তখন হ্যাচের পাশে ভাসছিলেন। লুনার মডিউল পরিচালনা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তিনিও অন্যদের মতো সাদা আবরণীতে বেষ্টিত ছিলেন। হাইসকে দেখে চেনা যাচ্ছিল না। কারণ টেলিভিশন রিলে স্পষ্ট ছিল না। হাইস ছিলেন মিসিসিপির বিলোক্সি থেকে আসা গাঢ় বাদামি চুল আর বর্গাকার চোয়ালবিশিষ্ট একজন হালকা মানুষ। কথা বলতেন কিছুটা ধীর গতিতে। তিনি মাত্র চার বছর আগে নভোচারী হিসাবে যোগ দেন এবং এটা ছিল মহাশূন্যে তার প্রথম মিশন। কিন্তু তিনি লাভেল ও অ্যাপোলো-৮ মিশনের অন্যান্য নভোচারীদের এতটাই মুগ্ধ করেন যে, তার নামে চাঁদের একটি গর্তের নামও রাখেন তারা।
হাইস ওই মুহূর্তে ব্যস্ত ছিলেন না। লুনার মডিউল চালু করার কথা চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছানোর পর, যা ছিল আরো এক দিনের দূরত্বে। তাই লাভেল তাকে প্ররোচিত করেন তার লুনার মডিউলে ভ্রমণের গাইড হিসাবে কাজ করার জন্য। হাইস টানেলের মধ্য দিয়ে সাঁতরে লুনার মডিউলে ঢুকেন। লাভেল বাহুর সমান একটি টিভি ক্যামেরা নিয়ে হাইসকে অনুসরণ করেন। হাইস তখন লুনার মডিউলে থাকা বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দেন, যা চাঁদে নামার পর ব্যবহার করা হবে। এগুলোর মধ্যে ছিল আয়তাকার একটি ব্যাগ, যাকে ‘গঙা ডিন’ নামেও ডাকা হতো। হাইস ও লাভেল চাঁদে নামার সময় হেলমেটের ভেতর এই ব্যাগ রাখার কথা ছিল। এর মাধ্যমে তারা চাঁদের ফ্রা অঞ্চলে হাঁটার সময় পানীয় পান করার কথা ছিল। লাভেল এ সম্পর্কে বলেন,
আপনারা যদি চাঁদে হাঁটার সময় টেলিভিশনে কোনো হাস্যকর শব্দ শুনতে থাকেন, সেটা সম্ভবত এই পানীয়র ব্যাগের কারণেই হবে।
হাইস তখন লুনার মডিউলে কিছু একটা করছিলেন, যা ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল। ক্যাপকম তখন প্রশ্ন করেন হাইস খাবারের লকার খুলে ফেলছেন কিনা। ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা সবাই একসাথে হেসে উঠলেন। তারা জানতেন হাইসের খাবারের প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল। হাইস তখন জানান তিনি ঘুমানোর জন্য হ্যামক প্রস্তুত করছেন। ক্যাপকম তখন বলেন, “রজার। আগে ঘুম, তারপর খাওয়া।”
হাইসকে লুনার মডিউলে রেখে লাভেল তখন টানেল পার হয়ে আবার কমান্ড মডিউলে ফিরে আসেন। তখন তাদের তৃতীয় সদস্য কমান্ড মডিউলের পাইলট সুইগহার্টকে খোঁজেন। তখন ক্যাপকম বলে উঠেন, “এই তো ও! আমরা তাকে দেখতে পাচ্ছি!”। সুইগহার্ট তখন স্পেসক্রাফটের কন্ট্রোলের সামনে নভোচারীদের তিনটি আসনের মাঝেরটিতে বসা ছিলেন। সুইগহার্টের তিন দিকে নয়টি ড্যাশবোর্ড প্যানেল ছিল।
সুইগার্ট ১৯৩১ সালে কলোরাডোর ডেনভারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাইসের সাথে ১৯৬৬ সালে নভোচারী হন। হাইসের মতো তার জন্যও এটা ছিল মহাশূন্যে প্রথম অভিযান। কিন্তু তিনি আরো বেশি চাপ অনুভব করছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন কেবল বিকল্প কমান্ড মডিউল পাইলট। তিনি মহাকাশযান ছাড়ার মাত্র এক দিন আগে আনুষ্ঠানিকভাবে এই মিশনে যুক্ত হন। কারণ মূল ক্রু জার্মান মিজেলস বা হামে আক্রান্ত হওয়ায় দেখা যায় কমান্ড মডিউলের মূল পাইলট সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। লাভেল সুইগার্টকে নিয়ে অভিযানে যেতে সম্মত হওয়ার আগে টানা দুই দিন বিরতিহীন কাজ করেন তাকে নিয়ে। সুইগার্ট এতটাই ব্যস্ততার মধ্যে ছিলেন যে, চার দিন পর মেয়াদ শেষ হতে যাওয়া ১৯৬৯ সালের ইনকাম ট্যাক্স জমা দেওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। এটা তার মনে পড়ে চাঁদের উদ্দেশ্যে এক-চতুর্থাংশ পথ পাড়ি দেওয়ার পর! লাভেল যখন ক্যামেরা নিয়ে তার সামনে আসেন, তখন তিনি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেওয়া ছাড়া আর কিছু বলার সময় পাননি।
অভিযানের প্রথম ৫৫ ঘণ্টায় সুইগহার্টকে ছোটখাট কিছু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। এর মাঝে একটি ছিল ট্যাংকে থাকা অক্সিজেনের পরিমাণ স্পষ্ট দেখতে না পারা। এর আগে ওদিন ক্যাপকম তাকে একবার বলেছিলেন তিনি পৃথিবী থেকে বারবার ট্যাংকের পাখাগুলো চালানোর অনুরোধ শুনতে পারেন, যেন ট্যাংকে থাকা অক্সিজেনগুলো নাড়ানো যায়। একে বলা হয় ‘ক্রায়োজেনিক আলোড়ন’। এটা করা হয় সঠিক পরিমাণ দেখার উদ্দেশ্যে।
এদিকে টেলিভিশন শো চলতে থাকে। একসময় সুইগহার্টের সময় মেলে কমান্ডারের দিকে ক্যামেরা তাক করে ধরার জন্য। লাভেল তখন প্রথম বারের মতো স্ক্রিনে আসেন। লম্বা সুদর্শন লাভেলের মুখে তখন ছিল প্রশস্ত হাসি। তিনি একটা টেপ রেকর্ডার প্রদর্শন করেন, যাতে বেশ কয়েকটি গান ছিল। এর মাঝে ছিল অ্যাকুয়ারিয়াস এবং রিচার্ড স্ট্রাউসের ‘দাস স্পেক যারাথুস্ত্রা’, যা স্ট্যানলি কিউব্রিকের ‘২০০১ : আ স্পেস ওডিসি’ মুভিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। অবশেষে ক্যাপকম লাভেলকে পরামর্শ দেন অনুষ্ঠান সমাপ্ত করার জন্য।
কমান্ডার তখন জবাব দেন,
“রজার। উত্তম প্রস্তাব। আমি অ্যাপোলো-১৩ এর একজন ক্রু বলছি। আপনাদের সবাইকে জানাই শুভ সন্ধ্যা। আমরা অ্যাকুয়ারিয়াস পরিদর্শন করা সমাপ্ত ঘোষণা করছি। আপনাদের সবাইকে এই অভিযানের আরেকটি মনোরম সন্ধ্যার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি। শুভ রাত্রি।”
তখন বাজে রাত ৯টা।
এরপর দেখুন- অ্যাপোলো-১৩ চন্দ্রাভিযান: দুর্ঘটনা মোকাবেলার গল্প (পর্ব ৩)