পৃথিবীতে অনেক দেশ ও রাজত্ব শতাব্দীর পর শতাব্দী নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে সগৌরবে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই এমন কিছু রাষ্ট্র আছে, যাদের ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন ছিল না। এমন অনেক রাষ্ট্র আছে যেগুলোর আয়ুষ্কাল ছিল এক বছর বা কয়েক মাস, এমনকি কয়েক দিন। একদিন স্থায়ী রাষ্ট্রের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এর বেশিরভাগের নামই আমরা হয়ত জানি না, সৃষ্টি ও ধ্বংসের কাহিনী দূরে থাকুক। সংখ্যায় প্রায় একশ’ এমন রাষ্ট্রের পেছনের কাহিনী বলাও বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই ক্ষণস্থায়ী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যেগুলো সময়ের হিসেবে বেশিদিন স্থায়ী ছিল, তাদের নেপথ্যের কিছু ঘটনা জেনে নেওয়া যাক।
তাঙ্গানিকা (২ বছর ১৩৭ দিন)
দশম শতাব্দীর দিকে এলাকাটিতে বসতি স্থাপনের প্রমাণ মিললেও ১৮৮০ সালের দিকে জার্মান উপনিবেশে এবং ১৮৯১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয় এটি। এটি ছিল মূলত জার্মান-পূর্ব আফ্রিকার অংশ, বর্তমানে যা রুয়ান্ডা, তানজানিয়ার মূল ভূখণ্ড এবং মোজাম্বিকের কিছু অংশ দ্বারা পরিবেষ্টিত। ভূখণ্ডটি বর্তমান জার্মানির চেয়ে প্রায় তিনগুণ বড় ছিল। জার্মান ঔপনিবেশিক একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্থানীয় বিদ্রোহের কারণে জার্মানরা এসে আনুষ্ঠানিকভাবে এলাকাটির দায়িত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটেন দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তারাই ১৯২০ সালে এটিকে তাঙ্গানিকা রাজ্য নাম দেয়। এই নতুন রাজ্যের নামকরণ হয়েছিল সোয়াহিলি শব্দ ‘জাহাজযাত্রা’ (sail) ও ‘জনহীন প্রান্তর’ (wilderness) থেকে, যা সম্ভবত ঐ রাজ্যে যে হ্রদটি আংশিকভাবে পড়েছে, তার উপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছিল।
ব্রিটেন তাঙ্গানিকার স্বাধীনতাও মঞ্জুর করে, যেমনটা করেছিল তার পূর্ববর্তী বেশ কিছু উপনিবেশের ক্ষেত্রে। তবে এই নতুন প্রজাতন্ত্র বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সরকার তৎকালীন জানজিবারের সাথে যুক্ত হবার সিদ্ধান্ত নেয় একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করতে, যা বর্তমানে তানজানিয়া নামে পরিচিত।
ইতালিয়ান রিজেন্সি অফ কার্নারো (১ বছর ১০৯ দিন)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯১৯ সালে বর্তমানে ক্রোয়েশিয়ার অন্তর্গত ফিউম শহরে অরাজকতা বিরাজ করছিল, কেননা প্যারিস শান্তি সম্মেলনে ইতালি, হাঙ্গেরি ও ক্রোয়েশিয়ার মধ্যে ভূখণ্ডটির অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। ফিউম ইতালিকে না দিতে চাওয়ায় ইংরেজ, ফরাসি ও আমেরিকানদের উপর রাগান্বিত হয়ে গ্যাব্রিয়েল দা’ন্নুন্সিও নামে এক ইতালীয় কবি কিছু দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সাহায্যে শহরটি দখল করতে যায়।
পরদিন গ্যাব্রিয়েল ইংরেজ, ফরাসি ও আমেরিকান সৈন্যদের কাছ থেকে শহরটির দখল নেয়। ফিউম শহরকে ইতালিয়ান রিজেন্সি অফ কার্নারো নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে এবং একটি ভোটের আয়োজন করে, যাতে দেশটির ইতালির অন্তর্ভুক্ত থাকার পক্ষে ব্যাপক ভোট পড়ে। কিন্তু ইতালি তার মিত্র দেশগুলোর চাপের মুখে এই অন্তর্ভুক্তিকরণ বাতিল ঘোষণা করে ও প্রক্রিয়াটিকে রদ করে দেয়।
১৯২০ সালের সেপ্টেম্বরে গ্যাব্রিয়েল দেশটির সংবিধান উন্মোচন করেন। যাতে দেশটিকে কর্পোরেট ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার রূপরেখা টানা হয়, যেমন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল মুসোলিনি। রাষ্ট্রের পতন আসে ১২ই নভেম্বর র্যাপেলোর চুক্তির সাথে, যখন ইতালি ও যুগোস্লাভিয়া ফিউমকে পৃথক রাষ্ট্র নয় বরং একটি শহর হিসেবে চিহ্নিত করে। রাগান্বিত হয়ে ডিসেম্বরের ৩ তারিখ দা’ন্নুন্সিও ইতালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং খুব দ্রুতই সেই মাসের ৩০ তারিখ পরাজিত হন। এর সাথে বিলুপ্তি ঘটে তার রাষ্ট্রেরও।
মারকোভ প্রজাতন্ত্র (২৪৮ দিন)
প্রথম রাশিয়ান বিপ্লবটি ১৯০৫-০৭ সাল পর্যন্ত রাশিয়ান সাম্রাজ্যকে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার দিকে পরিচালিত করে। সেই সময়ে মস্কো থেকে ১০০ মাইল দূরে মারকোভ গ্রামের লেখক সারজেই সেমেনোভ মস্কো সরকারকে তাদের দাবি দাওয়া সংক্রান্ত একটি চিঠি লিখে পাঠান। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে সেই চিঠির কোনো উত্তর আসেনি। ফলশ্রুতিতে কৃষক সংঘ নামে একটি রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয় মারকোভ গ্রামে।
১৯০৫ সালের ৩১ অক্টোবর তারা নিজেদের মারকোভ প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। পি এ বারশিন নামে গ্রামের এক বয়োজ্যেষ্ঠকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। নতুন এই রাষ্ট্র রাশিয়ার সার্বভৌম সরকারের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে এবং গণতান্ত্রিক পরিষদের মাধ্যমে ছোট আরও কিছু গ্রামের প্রতিনিধিত্ব করে। মাত্রই জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রটিকে সাহায্য করতে শিকাগো থেকে একজন অধ্যাপক আসেন। তার সাথে সার্বভৌম সরকারকে প্রতিরোধ ও গণতন্ত্র দাবি করায় প্রজাতন্ত্রটি দ্রুতই খ্যাতি অর্জন করে। ১৯০৬ সালের জুলাইয়ে দেশজুড়ে চলা বিপ্লব সামগ্রিকভাবে পরাজিত হলে সার্বভৌম সরকারের বাহিনী মারকোভ প্রজাতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হয়। সরকার ভেঙে, নেতাদের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে প্রজাতন্ত্রকে আবার রাশিয়ান সাম্রাজ্যে ফিরিয়ে আনা হয়।
লিথুয়ানিয়া রাজ্য (১৯৪ দিন)
১৯১৮ সালে ব্রেস্ট-লিটভস্কের চুক্তির পর জার্মানি যখন লিথুয়ানিয়ার নিয়ন্ত্রণ পায়, তখন স্থানীয় সরকার একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের অবস্থান সংরক্ষণ করতে চেয়েছিল। জার্মানি চেয়েছিল লিথুয়ানিয়া ও প্রুশিয়াকে একত্র করে একটি বৃহৎ রাষ্ট্র গঠন করতে। তাই লিথুয়ানিয়ার স্থানীয় সরকার নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় দ্বিতীয় কাইজার ভিলহেল্মের নিয়ন্ত্রাধীন জার্মান সাম্রাজ্যকে শান্ত করার প্রক্রিয়া খুঁজতে থাকে। সরকারের একটি বড় অংশের আপত্তির বিরুদ্ধে গিয়ে লিথুনিয়ার মন্ত্রীপরিষদ ‘তারিবা’ উরাখের ডিউক ভিলহেল্মকে রাজা হিসেবে নির্বাচিত করে।
তাকে ১২ দফার একটি প্রস্তাব দেওয়া হয় রাজা হওয়ার জন্য এবং সাংবিধানিক রাজতন্ত্র গঠন করা হয়। নবীন এই রাজা কখনো লিথুয়ানিয়ায় পা রাখেননি, কেবল গ্রীষ্মকালীন অবকাশের সময়টায় তিনি লিথুয়ানিয়ান ভাষা শিখতেন। কেননা সেটি তার রাজা হবার প্রস্তাবের একটি আবশ্যিক শর্ত ছিল। উপরন্তু জার্মানির একটি নিজস্ব ধারণা ছিল যে, দেশ তার নিজস্ব নেতা নির্বাচন করতে পারবে না। তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ স্তিমিত হবার সময়েও লিথুয়ানিয়ার স্বাধীন প্রাদেশিক সরকারের ধারণায় জার্মানীর পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত ছিল। এসবের প্রেক্ষিতে ১৯১৮ সালের ২ নভেম্বর তারিবা, উরাখের ডিউকের প্রতি তাদের নিমন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নিয়ে সরকারের বিলুপ্তি ঘটায় এবং এভাবেই ১৯৪ দিনের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে।
ইজো প্রজাতন্ত্র (১৮৪ দিন)
১৮৫০ সালে জাপান যাওয়ার পর কমোডর ম্যাথু পেরি প্রথম আমেরিকান কর্মকর্তা হিসেবে জাপানের লোকদের সাথে প্রকৃতপক্ষে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। এমনকি আমেরিকান ও জাপানিজ সরকারের মধ্যে বাণিজ্য শুরুর পেছনেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। যেখানে বেশিরভাগ আমেরিকানের চোখে ম্যাথু পেরির এই কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল সাফল্য, সেখানে আদান-প্রদানের ব্যাপারগুলোয় তোকুগাওয়া সরকারের অবস্থান নিয়ে জাপানের জনসাধারণের একটি বড় অংশের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। এর সূত্র ধরে প্রায় এক দশক পরে যে সকল শক্তি ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় ছিল তারা বংশানুক্রমিক সম্রাট ‘তোকুগাওয়া শোগুনেট’ (জাপানের সামরিক সরকার, যার প্রধানকে ‘শোগুন’ বলা হত) উৎখাতের একটি পরিকল্পনা করে। এর সূত্র ধরে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের সূচনা হয় (বশিন যুদ্ধ), যেটি শেষ হয় সম্রাট-বিরুদ্ধ বাহিনীর জাপানের অধিকাংশ নিজেদের দাবি করা ও তোকুগাওয়ার শোগুনকে রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে অপসারণ করার মাধ্যমে।
তোকুগাওয়ার প্রাক্তন শোগুনের নৌবাহিনীর একটি অংশ অ্যাডমিরাল এনোমোটো টাকিয়াকি ও তার ফরাসি সামরিক উপদেষ্টাগণের নেতৃত্বে প্রধান দ্বীপ থেকে পালিয়ে, ইজো নামক (বর্তমানে যা হোক্কাইডো নামে পরিচিত) জনবিরল ও অনুন্নত দ্বীপে বসতি স্থাপন করে। এনোমোটো তৎকালীন সার্বভৌম আদালতের কাছে হোক্কাইডোকে উন্নত করে সামুরাইদের ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য একটি আবেদন করেন। কিন্তু আদালত তার আর্জি খারিজ করে দেয়। এরপর ১৮৬৯ সালে টাকিয়াকি ইজো প্রজাতন্ত্র নামে একটি পৃথক রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। এই নতুন দেশের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল পুরনো সামুরাই পদ্ধতিগুলো সংরক্ষণ এবং সমাধিকারে বিশ্বাসী সরকার গঠন করা।
ইজো সরকারই সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আয়োজন করে, যেখানে তাদের সরকারের পরিকল্পনাগুলো ছিল ফরাসি ও আমেরিকান দর্শনের উপর ভিত্তি করে। তবে শান্তি বেশিদিন ছিল না। শীঘ্রই সার্বভৌম সরকারের বাহিনী দ্বীপে তাদের জায়গা দৃঢ় করতে লাগল। আধুনিক জাপানি বহর ব্যবহার করে তারা সামুরাইদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে জয়লাভ করে। এক সপ্তাহের মধ্যে সামরিক বাহিনী গোরিওকাকুর প্রধান দুর্গ ঘিরে ফেলে এবং টাকিয়াকিকে তার বাহিনীসহ আত্মসমর্পণ করতে বলে।
ইজো প্রজাতন্ত্র ভেঙে যায়, সেই সাথে সামুরাই ঐতিহ্যের সমাপ্তি ঘটে। এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি ক্ষণস্থায়ী হলেও জাপানের উপর এর বেশ প্রভাব ছিল। যে গণতান্ত্রিক আদর্শ ইজোতে অনুশীলন করা হয়েছিল, তা পরবর্তীতে জাপান সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখনো পর্যন্ত সেই প্রজাতন্ত্রকে জাপানি সংস্কৃতিতে সামুরাই উপাখ্যানের শেষ গৌরব মনে করা হয়।
সাসকাচেওয়ানের প্রাদেশিক সরকার (৬২ দিন)
কানাডাকে যদিও গৎবাঁধা চিন্তায় শান্তিপ্রিয় ও কারো সাতে-পাঁচে না থাকা দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবু তাদের ইতিহাসও একদম সাদা নয়। কম পরিচিত কিন্তু বেশ প্রভাব বিস্তারকারী যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটি ছিল ১৮৮৫’র সংক্ষিপ্ত উত্তর-পশ্চিমা বিদ্রোহ। বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব লিউ রিয়েলের নেতৃত্বে স্থানীয় ‘মেটিস’ ও ‘ক্রি’ জাতির লোকজনের দুর্দশার প্রেক্ষাপটে এই যুদ্ধ শুরু হয়। ইউরোপিয়ান এবং পূর্ব-উত্তর আমেরিকাবাসীর বিরুদ্ধে স্থানীয়দের খেপিয়ে তোলার ব্যাপারে রিয়েল আগে থেকেই সচেষ্ট ছিল। রিয়েল তার সবচেয়ে বড় বিদ্রোহটি শুরু করেন ১৮৮৫ সালে। তার মতে, এই বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল স্থানীয় জনগণকে তাদের মূল জীবনধারা ফেরত দেওয়া ও কানাডীয় সরকারের আধিপত্য হ্রাস করা। বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ক্ষুদ্র কিছু খণ্ডযুদ্ধের মাধ্যমে, কিন্তু ১৮৮৫ এর মার্চেই রিয়েল তার বড় চালটি চালেন বাটোচের সাসকাচেওয়ানে প্রাদেশিক সরকার গঠনের মাধ্যমে একে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দিয়ে।
রিয়েল চেয়েছিলেন সাসকাচেওয়ানের স্থানীয় লোকজন এবং সেখানে বসবাসকারী শ্বেতাঙ্গ অধিবাসীদের তার নতুন সরকারের পতাকাতলে আনতে। দুর্ভাগ্যবশত রিয়েলের পরিকল্পনা কখনোই বাস্তবায়িত হতো না, কারণ, কানাডীয় সরকার রাজ্যের মাঝে বিশেষ প্রদেশের স্বাধীনতা কখনোই মঞ্জুর করতো না। সরকারের নির্দেশে ফ্রেডরিক মিডেল্টনের নেতৃত্বে প্রায় এক হাজার মিলিশিয়া এবং সাধারণ সৈন্য বাটোচের রাজধানী ঘিরে ফেলে এবং টানা দু’দিন একের পর এক আক্রমণ পরিচালনা করে। প্রায় তিন-চতুর্থাংশ লোকের পলায়ন, আহত হওয়া ও মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বাটোচের প্রতিরক্ষা এই আক্রমণের কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে। ১২ই মে মিডেলটন, রিয়েলকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ এবং বিদ্রোহের সমাপ্তি টানেন। নভেম্বরে রিয়েলকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
আইসল্যান্ড ভূখণ্ড (৫৮ দিন)
নেপোলীয় যুগের ড্যানিশ অনুসন্ধানকারী জর্জেন জরগেন্সনের বৈচিত্র্যময় ও বিপজ্জনক অ্যাডভেঞ্চারে ভরা জীবন-গল্পের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অধ্যায় সম্ভবত প্রায় দুই মাসের জন্য আইসল্যান্ডের একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের শাসক হওয়া। নেপোলীয় যুদ্ধে কোপেনহেগেনের উপর ব্রিটিশ বোমারুদের হামলার সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। ক্ষোভে জর্জেন নৌবাহিনীতে যোগ দেন এবং ‘এডমিরাল হাল’ নামে শত্রু জাহাজ আক্রমণকারী বেসরকারি জাহাজের নেতৃত্বে নিযুক্ত হন।
পরপর কয়েকটি সফল অভিযানের পর এইচ.এম.এস স্যাফোর (ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির চারটি জাহাজকে একত্রে এই নামে ডাকা হতো) কাছে ধরা পড়ে এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। ইংরেজ নৌবাহিনী তাকে লন্ডনে নিয়ে যায় এবং বেশ কয়েক মাস কারাগারে রাখে। প্যারোলে বের হয়ে জর্জেন জাহাজের একজন ইংরেজ ক্যাপ্টেনকে আইসল্যান্ডে বাণিজ্য অভিযানের জন্য রাজি করান, যা ড্যানিশ বাণিজ্যের সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যাপক খাদ্য সংকটে ভুগছিল। ১৮০৯ এর মার্চে জর্জেন আইসল্যান্ডে যান এবং সেখানকার অধিবাসীদের সাথে ডেনমার্কের শাসকগোষ্ঠীর ব্যবহার দেখে ব্যথিত হন। এর কয়েক মাস পর জর্জেন আবার আইসল্যান্ডে যান আরেকটি বাণিজ্য অভিযানে, তবে এবার স্থানীয় সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা নিয়ে। আইসল্যান্ডের নগরাধ্যক্ষকে গ্রেফতারে তাকে সাহায্য করতে তিনি ইংরেজ নাবিকদের রাজি করিয়ে ফেলেন। নগরাধ্যক্ষকে রাস্তা থেকে সরিয়ে জর্জেন আইসল্যান্ডের রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি আইসল্যান্ডকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন এবং ঐতিহাসিক আইসল্যান্ডীয় সংসদ ‘অলটিং’ পুনঃনির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন।
জর্জেনের বেশ কিছু বড় পরিকল্পনা ছিল আইসল্যান্ডবাসীদের নিয়ে, কিন্তু যখনই ড্যানিশ সরকারের কানে এই ঘটনার খবর পৌঁছে, তারা পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ইংরেজ সরকারের সাহায্য প্রার্থনা করেন। দু’মাস আইসল্যান্ডে শাসন করার পর এইচ.এম.এস তালবট সেখানে পৌঁছায় এবং জর্জেনের রাজত্ব উৎখাত করে। ভাবলেশহীন আইসল্যান্ডিক জনতা তাদের স্ব-ঘোষিত রক্ষকের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। আইসল্যান্ড আবার ড্যানিশ শাসনের অধিভুক্ত হয়। তবে জর্জেনের এই কর্মকাণ্ডগুলো পরবর্তীতে আইসল্যান্ডের স্বাধীনতা লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখনও পর্যন্ত জর্জেন ‘ডগ-ডে’স কিং’ বা ‘দুঃসময়ের রাজা’ নামে পরিচিত।
ফিচার ইমেজ- Wikimedia Commons