১৯৪৭ সালের পূর্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এক সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে প্রশ্ন করেছিলেন; গ্রামে, পাড়ায় কিংবা মহল্লায় হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই মিলেমিশে থাকে। এদের মধ্যে ব্যাপক পরিমাণে সম্প্রীতিও পরিলক্ষিত হয়। তারপরও তাদেরকে আপনি হিন্দু-মুসলিম দুই জাতি হিসেবে আলাদা করছেন কেন? প্রশ্নটির উত্তরে জিন্নাহ বলেছিলেন, যেখানে এবং যেভাবেই তারা থাকুক না কেন, তারা বাস করে দুটি আলাদা জাতি হিসেবে। তারা একসাথে থাকলেও তারা এক নয়। তারা ভিন্ন, তারা স্বতন্ত্র। আলাদা জাতি হিসেবে পাশাপাশি বাস করার বিষয়টা এখনো রয়ে গেছে তবে তা হিন্দু-মুসলিম হিসেবে আলাদা নয়।
দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রবক্তা
সৈয়দ আহমদ খান সর্বপ্রথম দ্বি-জাতি তত্ত্বের ধারণা জনসমক্ষে নিয়ে আসেন বলে ধারণা করা হয়। যখন সমগ্র ভারত স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতীয়তাবাদী রূপ নিচ্ছে, তখনই তিনি মুসলমানদের আলাদা জাতি হিসেবে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার আহ্বান জানান এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হতে নিরুৎসাহিত করেন। সেসময় তার এই প্রচারকে সানন্দে গ্রহণ করে তৎকালীন শাসকেরা। কেননা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন রুখতে এটিই ছিল অন্যতম ট্রাম্প কার্ড।
পরবর্তীতে কবি ও দার্শনিক মুহাম্মদ ইকবাল মুসলিম জাতীয়তাবাদের ধারণা সামনে নিয়ে আসেন। মুহাম্মদ ইকবাল ১৯৩০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের এক অধিবেশনে তার ধারণা পেশ করতে গিয়ে বলেন যে, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মাঝে মাত্র আট কোটি মুসলমানের নিরাপত্তা প্রদান করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সমাধান হিসেবে হয়তো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনতা মেনে নেয়া অথবা সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা হয়ে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করা।
১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগের সম্মেলনের সভাপতির বক্তব্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার ধারণা ধারণা বা আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেন। বক্তব্যে তিনি বলেন,
“এটা মেনে নিতে কষ্ট হয় যে, কেন আমাদের হিন্দু বন্ধুগণ ইসলাম ও হিন্দু মতবাদের মূল প্রকৃতি অনুধাবন করতে অপারগ হচ্ছেন। তারা কঠোর অর্থে ধার্মিক নন, অথচ পৃথক ও সুনির্দিষ্ট সামাজিক বিন্যাসের ক্ষেত্রে তারা ধার্মিক হিসেবে প্রতীয়মান হন। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায় একত্রে একটি সাধারণ জাতীয়তাবাদী ভিত্তি গড়ে তোলার বিষয়টি আসলে একটা স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয় এবং আমরা যদি সময় থাকতে আমাদের জাতিকে গড়ে তুলতে বিফল হই, তবে ‘এক ভারতীয় জাতি’ নামক এই ভুল ধারণাটি পূর্বেও যেরূপ সমস্যার সৃষ্টি করেছে, ভবিষ্যতেও তা ভারতকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিবে। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই পৃথক ধর্মীয় দর্শন, সামাজিক রীতি, সাহিত্য প্রভৃতির ক্ষেত্রে দু’টি পৃথক প্রকৃত অবস্থার মধ্যে অবস্থান করে।
তারা কখনো নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে না বা একসঙ্গে কোনো অনুষ্ঠানও করে না, এবং প্রকৃত অর্থেই তারা পারস্পরিক দ্বন্দ্বপূর্ণ ধারণা ও পরিকল্পনার উপর নির্ভরশীল দু’টি পৃথক মেরুতে অবস্থানকারী পৃথক দু’টি জাতি। জীবন ও জীবনধারণ সম্পর্কে তাদের ধারণাও ভিন্ন। এটা সুস্পষ্ট যে, হিন্দু ও মুসলমানগণ ইতিহাসের পৃথক পৃথক উৎস থেকে প্রেরণা আহরণ করেছে। তাদের রয়েছে পৃথক মহাকাব্য, পৃথক জাতীয় বীর ও পৃথক উপাখ্যান। প্রায়ই দেখা গিয়েছে যে, এক জাতির নায়ক অন্য জাতির খলনায়ক এবং অনুরূপভাবে একের বিজয়গাথা অন্যের পরাজয়কে চিহ্নিত করে। এভাবে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হিসেবে দু’টি জাতিকে এক আঙ্গিকে একটি একক রাষ্ট্রের অধীনে আনার যেকোনো প্রয়াসের ক্ষেত্রে অসন্তোষ দেখা দিবে এবং এ ধরনের যেকোনো প্রয়াসই চূড়ান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে”।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ
জিন্নাহ’র দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রস্তাবনার পর আরও নানান ঘটনা ঘটতে থাকে ভারতীয় উপমহাদেশে। ১৯৪২ এ ১৯৪৬ সালে লন্ডন থেকে আগত দু’টি মিশনের মূল লক্ষ্যই ছিল ভারতকে স্বাধীনতা দিলেও তারা যেন কমনওয়েলথের অধীনে থাকে, তা নিশ্চিত করা। যদিও তাদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল যে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করতেই এসেছেন।
পরবর্তীতে ব্রিটিশদের প্ররোচনায় এ অঞ্চলে সাম্প্রদায়িকতা আরও প্রকট আকার ধারণ করলে ক্যাবিনেট মিশন ভারতীয় উপমহাদেশকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করার চিন্তার দিকে এগোচ্ছিল। হিন্দু-মুসলিম হিসেবে ভাগ করার পাশাপাশি বঙ্গভঙ্গ এবং বঙ্গভঙ্গ রদের কথাও তাদের মাথায় ছিল। লর্ড মাউন্টব্যাটন ধারণা করেছিলেন, সকলে সম্মত হলেও বাংলা স্বতন্ত্র ‘ডোমিনিয়ান’ হিসেবেই থাকতে চাইবে। তবে বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা!
ভারত ভাগ করতে গিয়ে সবচেয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছিল বাংলা ও পাঞ্জাব অঞ্চলকে নিয়ে। ভারত এবং পাকিস্তান উভয়েই চেয়েছিল এই দুটো অঞ্চল তাদের সঙ্গে থাকুক। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে সবটুকু রাখাও সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয়েই বাংলা ও পাঞ্জাবভাগের পক্ষে সম্মত হলেন। ইংল্যান্ড থেকে উড়িয়ে আনা হলো ব্যারিস্টার র্যাডক্লিফকে। কখনো ভারতবর্ষের মাটিতে পা না রাখাই র্যাডক্লিফের যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হলো। তারপর বাংলা ও পাঞ্জাবের প্রায় নয় কোটি মানুষের ভাগ্য তিনি পেন্সিল দিয়ে কেটে ভাগ করে দিলেন। হয়তো এ কারণে তিনি মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্তও হয়েছিলেন। ১৯৪৭ তাদের ১৩ই অগাস্ট ভারত ত্যাগ করেন র্যাডক্লিফ আর ১৬ই অগাস্ট লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত ও পাকিস্তানের মানচিত্র উন্মুক্ত করেন সকলের সামনে। এভাবে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে গেল একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী।
দেশভাগের পর
দেশভাগের পরেও দেখা গেলো, অনেক মুসলমান ভারতে রয়ে গেছে। পরবর্তীতে দেখা গেলো, পাকিস্তানে অবস্থানরত মুসলমানের তুলনায় ভারতেই মুসলমানের সংখ্যা বেশি! তবে দেশভাগের পরপরই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ফিরে গেলেন তার প্রথম জীবনের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানে। পাকিস্তানে এসেই তিনি ঘোষণা দিলেন, এখানকার সবাই এখন থেকে পাকিস্তানী। সে হোক হিন্দু কিংবা মুসলিম, বাঙালি কিংবা পাঞ্জাবী সকলেই পাকিস্তানী। আবার যে সংখ্যক মুসলিম ভারতে অবস্থান করছিল, তারা সকলেই হয়ে যায় ভারতীয়! অর্থাৎ যে সংস্কৃতি ও বৈপরীত্যের দোহাই দিয়ে ভারতকে বিভক্ত করা হলো, সে বৈপরীত্য নিয়েই বিভক্ত দুই রাষ্ট্র আবারও চলতে শুরু করে।
পাকিস্তান কিংবা ভারতে হিন্দু-মুসলমান সবাই যদি সমানই হবে, তবে দেশভাগের প্রয়োজন কী ছিল? শুধুই কি ক্ষমতার লোভ, নাকি ইংরেজদের ষড়যন্ত্র? কিন্তু তারপরেও কী সবাই সমান হতে পেরেছিল? সাতচল্লিশের পূর্বে যেমন দাঙ্গা হতো, দেশভাগের পরেও তেমনি দুই দেশেই দাঙ্গা হতে থাকলো। সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হল না।
পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের মানুষেরা ভেবেছিল, পাকিস্তান হলেই মুক্তি। কিন্তু তখন বিভাজন দেখা গেলো বাঙালি-অবাঙালি প্রশ্নে। অর্থাৎ উভয়েই মুসলিম হলেও সাংস্কৃতিক বৈপরীত্যের ফলে একসাথে চলা সম্ভব হচ্ছিল না। ১৯৫২ সালে প্রথমেই আঘাত এলো সংস্কৃতির ওপরে। সে আঘাতের জের ধরেই তৈরি হয় ‘৬২, ‘৬৬, ‘৬৯, ‘৭১ এর পটভূমি। দাবিটা কিন্তু বাঙালিয়ানার ছিল না, ছিল অধিকারের। কথা ছিল স্বাধীন রাষ্ট্রে আমরা বৈষম্যের স্বীকার হবো না। কিন্তু বৈষম্য পিছু ছাড়েনি। তাই বিভক্ত হতে হলো আবারও। মাঝে ৩০ লাখ লোককে প্রাণ দিতে হল, দুই লাখ মা-বোনকে হারাতে হল তাদের সম্ভ্রম। তারপর এলো বাংলাদেশ।
সাম্প্রতিক চিত্র
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও দ্বি-জাতি তত্ত্ব ঠিকই বিদ্যমান রয়েছে গেছে। শুরুতেই বলা হয়েছিল, জাতি হিসেবে হিন্দু-মুসলিম পাশাপাশি বাস করা সমস্যা নয়। সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ধনী-গরিব দু’টি আলাদা জাতির অবস্থান। জাতি হিসেবে ধনী-গরিব পাশাপাশি বাস করলেও তারা সর্বদাই আলাদা।
বিগত বিশ বছরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পাঁচ শতাংশের বেশি হলেও সাধারণ মানুষের জীবন মান তেমন উন্নত হয়নি। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, ক্রয়ক্ষমতার সমতা (পিপিপি) অনুসারে যাদের আয় এক ডলার নয় সেন্টিগ্রেডের কম, তারা হতদরিদ্র। ২০১৬ সালের হিসেবে পিপিপি অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি ডলারের মূল্য ৩২ টাকা। বর্তমানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় প্রায় দু হাজার ডলারের কাছাকাছি হিসেব করা হলেও দেশের প্রায় দুই কোটি ৪১ লাখ মানুষ বাস করছে অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে। সহজভাবে বললে, এই দুই কোটি ৪১ লাখ জনগণ প্রতিদিন ৬১ টাকা উপার্জন করতেও সমর্থ হন না।
নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের জনগণের পিপিপি নির্ধারন করা হয়েছে তিন দশমিক দুই ডলার। সে হিসেবে বাংলাদেশের আট কোটি ৬২ লাখ মানুষ প্রতিদিন তিন দশমিক দুই পিপিপি বা ১০২.৪০ টাকা উপার্জন করতে পারে না। পরিসংখ্যানের হিসেবে বাংলাদেশে তাহলে দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় ৫২.৯ শতাংশে।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়,
“গত বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স বলেছে, অতি ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ প্রথম। এ বছরের জানুয়ারি মাসে একই প্রতিষ্ঠান আরেকটি প্রতিবেদনে বলেছে, ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ তৃতীয়। আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশের ধনী মানুষের সংখ্যা ১১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে”।
দ্বি-জাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রথমে ভারত-পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ ভাগ হয়েছে। কিন্তু মূল যে দু’টি জাতি- ধনী এবং গরিব, সে সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি, সে বৈষম্যের ঘটেনি কোনো তারতম্য। ধর্মের ভিত্তিতে এই উপমহাদেশ ভাগ হলেও, ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ তিনটি দেশেই হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশেই বাস করছে। কিন্তু ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থে ভাগ করেছে এই কোটি কোটি জনগণকে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্য দিয়ে শেষ করছি,
“বৈষম্য নিরসনের এক দফা এক দাবির পক্ষে আন্দোলন গড়াটা সহজ নয়। অর্থ পাওয়া যাবে না, ধনীরা দেবে না। প্রচার করাও কঠিন হবে, সরকারি গণমাধ্যম তো বটেই বেসরকারী গণমাধ্যমও এগিয়ে আসবে না। হুজুগ সৃষ্টি সহজ হবে না, মোটেই। কিন্তু এই আন্দোলন না করলেই নয়। বৈষম্য আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করছে এবং যতই দিন যাবে, ততই তা মারাত্মক আকার ধারণ করবে। একে রোখা চাই। পারলে এখনই। কারণ বিলম্ব হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই”।