যেসব দেশ বর্তমানে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও গণতন্ত্র অনুসরণ করছে, তাদের অনেকের কাছেই তাইওয়ান বর্তমানে এক রোল মডেল। রুগ্ন অর্থনীতি, লাগামহীন দুর্নীতি, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া একটি দেশ যেভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বিশ্ববাণিজ্যে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, তা যেকোনো দেশের জন্যই ঈর্ষণীয়। এশিয়ার চারটি দেশকে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও সক্ষমতা বিবেচনায় ‘এশিয়ান টাইগার্স’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, যার একটি তাইওয়ান। অর্থনীতিবিদরা তাইওয়ানের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উত্থানকে আখ্যায়িত করেছেন ‘তাইওয়ান মিরাকল’ হিসেবে। তাইওয়ানের তথ্যপ্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশের বাজারেই শক্ত অবস্থান তৈরিতে সমর্থ হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা থাকার পরও যে অর্থনীতির শক্ত ভিত গড়া সম্ভব, সেটি তাইওয়ান চমৎকারভাবে বিশ্ববাসীকে দেখিছে।
কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠও রয়েছে। তাইওয়ানের অর্থনৈতিক উত্থানের উপর যেভাবে আলোকপাত করা হয়, তার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় দেশটির রাজনীতির কালো অধ্যায়। তাইওয়ানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই নিয়ন্ত্রিত উপায়ে দেশীয় বাজার বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছিল। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি গ্রহণ করা হয়। এর ঠিক বিপরীত ঘটনা ঘটে তাইওয়ানের রাজনীতিতে। ক্রমেই গণতন্ত্রের মূলনীতিগুলো থেকে সরে যাচ্ছিল দেশটি। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাগরিকদের যে সমস্ত অধিকার দেয়া হয়, সেগুলো ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছিল দেশটিতে। যে সময় তাইওয়ানে শিল্পবিপ্লব ঘটছিল, হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছিল শিল্পকারখানাগুলোতে, সেসময় চিয়াং কাই শেকের নেতৃত্বাধীন কুয়োমিনতাং সরকার অসংখ্য মানুষকে ‘রাষ্ট্রের জন্য হুমকি’ আখ্যা দিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে। অনেকে কোনো অপরাধ ছাড়াই জেল খাটে বছরের পর বছর।
কীভাবে তাইওয়ানের জনগণের ঘাড়ের উপর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্যের মতো কুয়োমিনতাং সরকারের নিপীড়নমূলক শাসন চেপে বসলো– সেটা জানার জন্য একটি ভুলে যাওয়া গণহত্যার কথা জানতে হবে। ‘টুুটুয়েন্টিএইট ম্যাসাকার’ (228 Massacre) নামের সেই গহত্যার মাধ্যমে কুয়োমিনতাং সরকারের নিপীড়নের শুরু। গণহত্যা শুরুর একদিন আগে, ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ সালে, তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেই শহরের এক চায়ের দোকানের সামনে একজন স্থানীয় মাঝবয়সী বিধবা নারী অননুমোদিত সিগারেট বিক্রি করছিলেন। কিছুক্ষণ পর তামাক কোম্পানির কয়েকজন প্রতিনিধি এসে সেই মহিলার কাছ থেকে জোরপূর্বক সিগারেট ও অর্থ ছিনিয়ে নেয়। তিনি তৎক্ষণাৎ তাদের আচরণের প্রতিবাদ করেন, সিগারেট ও অর্থ ফেরত চান। কিন্তু এতে তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা আরও ক্ষিপ্ত হয় এবং একপর্যায়ে তাদের মধ্যে একজন হাতে থাকা রিভলবারের বাট দিয়ে সেই মহিলার মাথায় আঘাত করে।
এই ঘটনায় বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়। যখন তামাক কোম্পানির প্রতিনিধি মহিলার মাথায় আঘাত করে, তখন জড়ো হওয়া মানুষেরা ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তারা প্রতিনিধিদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে এবং বলপ্রয়োগের জন্য কৈফিয়ত চায়। অবস্থা বেগতিক দেখে তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা পালিয়ে যায়। তবে যাওয়ার সময় তারা হাতে থাকা রিভলবার দিয়ে জড়ো হওয়া মানুষের দিকে গুলি ছোড়ে। গুলির আঘাতে একজন পথচারী মারা যায় ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। এই ঘটনায় তাইপেই শহরের স্থানীয়রা বেশ ক্ষিপ্ত হয়। তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা ছিল চীনের মূল ভূখন্ডের বাসিন্দা ও তাদের এই বলপ্রয়োগের ঘটনা স্থানীয়দের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। কিন্তু সেদিনের মতো তারা ফিরে যায় এবং পরদিনের আন্দোলনের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ধ্বংসসাধন, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির জন্য তাইওয়ানের সাধারণ মানুষ তৎকালীন কুয়োমিনতাং সরকারের প্রতি মোটেও সন্তুষ্ট ছিল না। সরকারের বিরুদ্ধে যে জনগণ আন্দোলনের নেমে পড়বে– এটা অনুমিতই ছিল। সেই নারী ও তামাক প্রতিনিধিদের ঘটনা আগুনে ঘি ঢালে। পরদিন অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে তাইপেই শহরের অসংখ্য বাসিন্দা তামাক কোম্পানির অফিস অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। তাদের দাবি ছিল- যে প্রতিনিধি আঘাত করেছিল, তাকে ফাঁসি দিতে হবে এবং এবল কোম্পানির পরিচালককে পদত্যাগ করতে হবে। যাত্রাপথে তারা দুজন তামাক কোম্পানির এজেন্টকে ধরে ফেলে। ক্ষিপ্ত জনতার হাতে অতিরিক্ত প্রহারে তাদের মৃত্যু ঘটে। এরপর যখন আন্দোলনকারী জনতা তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে তাইওয়ানের গভর্নর জেনারেলের বাসভবন ঘেরাও করে, তখন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সশস্ত্র সৈন্যরা গুলি চালালে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী নিহত হয়। পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠতে শুরু করে।
মার্চ মাসের ১ তারিখে তাইওয়ানের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে উক্ত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। সাত দিন তদন্তের পর এই কমিটি সরকারের কাছে ৩২ দফা দাবি পেশ করে। এসব দাবির মধ্যে ছিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণে জোর দেয়া, মতামতের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া ইত্যাদি। অনেকে বলেন, আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা জর্জ ওয়াশিংটন স্বাধীনতার জন্য ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় জর্জের কাছে যে দাবিগুলো পেশ করেছিলেন, সেগুলোর সাথে তাইওয়ানের নাগরিক কমিটির পেশ করা দাবিগুলোর বেশ মিল পাওয়া যায়। কিন্তু গভর্নর জেনারেলে চেন ইর পক্ষ থেকে এসব দাবি মানার কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়নি। উল্টো রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসবাদ প্রয়োগের জন্য সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করা হয়।
তাইওয়ানের নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে যেদিন দাবি দেয়া হয়, ১৯৪৭ সালের ৭ মার্চ, এর পরদিন চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে অসংখ্য সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আনা হয়। তদন্ত চলার সময়ই তাইওয়ান সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত সেনাবাহিনীর গাড়ি টহল দিচ্ছিল এবং দেখামাত্র নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হতাহত করছিল। মূল ভূখণ্ড থেকে আরও বেশি সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আসার পর সারা দেশে সেনাবাহিনী টহল দিতে শুরু করে। তাইওয়ানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল চেয়েছিলেন অস্ত্রের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা কিংবা গণহারে গ্রেফতারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে পারলে হয়তো দানা বেধে ওঠা আন্দোলন দমন করা সহজ হবে– এটাই ভেবেছিল তাইওয়ানের সরকার। তাইওয়ানের সমাজ থেকে অসংখ্য মানুষ রাতারাতি হারিয়ে যেতে শুরু করে, যাদেরকে আর কখনোই ফিরে পাওয়া যায়নি।
১৯৪৯ সালে কুয়োমিনতাং সরকার সামরিক আইন জারি করে। এর মাধ্যমে সরকারের যাবতীয় সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের আইনগতভাবে বৈধ করার একটা চেষ্টা করা হয়। ‘টুটুয়েন্টিএইট ম্যাসাকার’-এর মাধ্যমে কুয়োমিনতাং সরকারের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের যে সূত্রপাত ঘটে, তা স্থায়ী হয় প্রায় চার দশক। বামপন্থী, বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্র ও শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তথা তাইওয়ান সমাজের শিক্ষিত মানুষদের টার্গেট করা হতো। এরপর হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রাতের বেলা তাদের বাড়িতে হানা দিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে যেত। যাদেরকে গ্রেফতার করা হতো, তাদের বেশিরভাগ মানুষকে আর কখনও ফিরে পাওয়া যায়নি। সামরিক আইন জারির ফলে সমস্ত জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়। এমনও হয়েছে যে, কোনো ক্লিনিকে হয়তো কয়েকজন ডাক্তার একসাথে দুপুরের খাবার খেতে বসেছেন, এমন সময় কুয়োমিনতাং সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসে হানা দিয়েছে এবং ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ করার দায়ে তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
তাইওয়ানে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করার জন্য গ্রেফতারকৃতদের ভয়াবহ শাস্তি দেয়া হতো। খুব সামান্য কারণে গ্রেফতার হলেও দশ-পনের বছরের শাস্তি ছিল নিয়মিত ঘটনা। সামরিক আইন জারির পর থেকে তাইওয়ানের অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হন, যেগুলো তাদের চেপে যেতে হয়। কথিত আছে, অনেক জেলখানার বন্দীকে চোখ বেঁধে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। এরপর তাদেরকে নদীর পাশে দাঁড় করিয়ে সোজা নদীর বুকে ধাক্কা মারা হতো। এতে তাদের বুলেট বেঁচে যেত। এছাড়াও অসংখ্য মানুষের মাথা দেহ থেকে আলাদা করে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হতো, যাতে অন্য মানুষেরা সেগুলো দেখে ভয় পায়।
তাইওয়ানের নতুন প্রজন্মের নাগরিকরা কুয়োমিনতাং সরকারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের সেই সময়ের কীর্তিকলাপ নিয়ে বেশ সোচ্চার। ‘হোয়াইট টেরর’-এর এই সময় নিয়ে তাইওয়ানের গণমাধ্যমে নিয়মিত লেখালেখি হয়, বিভিন্ন চলচ্চিত্রে নিয়মিত এই ঘটনা চলে আসে। ইদানীং আমেরিকায় বর্ণবাদের সাথে জড়িত অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির ভাস্কর্যে যেমন কালি মেখে দেয়া হচ্ছে কিংবা ভেঙে ফেলা হচ্ছে, তাইওয়ানেও একই ধরনের ঘটনা ঘটছে বর্তমানে। তাইওয়ানের বর্তমান মন্ত্রীসভার অনেক সদস্যের পূর্বপুরুষরা ‘হোয়াইট টেরর’-এর শিকার, এবং তারা এটা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করেন। কুয়োমিনতাং সরকারের অপকর্ম নিয়ে নিয়ে আলোচনা করলে এখন আর কোনো আইনের জন্য গ্রেফতার হতে হয় না। তাইওয়ানের ইতিহাসে ‘হোয়াইট টেরর’ জনগণের কাছে ভুলে যাওয়ার মতো এক ঘটনা, যদিও বিভিন্ন প্রসঙ্গে বারবার এটি সামনে চলে আসে।