হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ‘দ্য মমি: টম্ব অফ এ ড্রাগন এম্পায়ার’ এর কথা মনে আছে? মাটির নিচে টেরাকোটার হাজার হাজার সৈন্যবাহিনীর কথা তাহলে নিশ্চই মনে পড়ছে। চীনের প্রথম রাজা কিন শি হুয়ান মৃত্যুর আগেই নিজের সমাধিতে তৈরি করে গিয়েছিলেন এই বিশাল সৈন্যবাহিনী এবং রাজপ্রাসাদ।
পটভূমি
চীনের প্রথম সম্রাট ‘কিন শি হুয়াং ডি’ মাত্র ১৩ বছর বয়সে কিন প্রদেশের রাজা হিসেবে সিংহাসনে পদার্পণ করেন। এর ২৫ বছর পর ২৪৬ খ্রিস্টপূর্বে তিনি প্রতিবেশী ছয়টি দেশ এবং সংযুক্ত চীন জয় করেন। সিংহাসন অভিগমনের অল্প কিছু সময় পর তিনি নিজেই তাঁর কবর তৈরি করেন এবং কবরে তাঁর নিরাপত্তা এবং পরজন্মে শাসন করার লক্ষ্যে মাটির তৈরি বা টেরাকোটার একটি বিশাল এবং মানুষের মতো পূর্ণাকার সৈন্যবাহিনী তৈরি করেন। ৭ লক্ষেরও বেশি শ্রমিক খাঁটিয়ে ৩৬ বছর সময় ধরে তিনি ৮ হাজার সৈনিকের একটি সৈন্যদল নির্মান করেন। চীনের ইতহাসে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিখ্যাত এই সম্রাটের উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো চীনা অক্ষরের প্রমিতকরণ, মুদ্রা এবং পরিমাপক ব্যবস্থার একটি মানদণ্ড প্রণয়ন, কৃষি ব্যবস্থার সংস্কার এবং চীনের দক্ষিণ সীমান্ত অঞ্চলে আত্মরক্ষামূলক দুর্গ নির্মাণ, যা কিনা গ্রেট ওয়াল অফ চায়না নামে পরিচিত।
টেরাকোটা সৈন্যবাহিনী আবিষ্কার এবং খনন
প্রাচীন সভ্যতার অনন্য নিদর্শন এই টেরাকোটা সৈন্যবাহিনী নির্মাণের পর প্রায় ২,০০০ বছর কেটে গেছে এগুলোকে আবিষ্কার করতে। ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে চীনের রাজকীয় শহর জি’আন এর জিইয়াং অঞ্চলের কয়েকজন কৃষক কৃষিকাজের জন্য পানি উত্তোলনের আশায় শক্ত মাটির আবরণে আবৃত একটি জায়গায় এসে দাঁড়ায়। সেখানে তারা মাটির তৈরি হাত-পা এবং ব্রোঞ্জের তৈরি তীরের ফলার সন্ধান পায়। এরপর এই জায়গাটি খনন করে পূর্ণ আকারের বিশাল সেনাবাহিনীর কিছু অংশের সন্ধান পায় প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা অনুসারে বোঝা যায়, এই মহামূল্যবান সৈন্যবাহিনী রাজা কিন শি হুয়াং ডির সময়ে বিনির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে খননকার্য চালিয়ে তারা সম্রাট কিন শির সমাধি সহ মনুষ্য আকারের, একেবারে মানুষের মতো দেখতে হাজার হাজার পোড়ামাটির তৈরি সৈন্য এবং ঘোড়ার মূর্তি আবিষ্কার করেন। সমাধিটি এখনো অক্ষত অবস্থায় রয়েছে এবং ইতোমধ্যে খননকৃত নিদর্শনগুলোর সঠিক তদন্ত সম্পূর্ণ হবার পর চীনা প্রত্নতাত্ত্বিকরা কবরটি খনন করবে। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ইউনেস্কো এই বিশাল সমাধি এবং এর ভেতরের মাটির তৈরি সব সৈন্যমূর্তিগুলোকে ওয়ার্ল্ড কালচারাল হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
মনোমুগ্ধকর স্মারক সমাধি
রাজা কিন শির সমাধিটি শানজি প্রদেশের জি’আন অঞ্চলের কাছাকাছি লিংটনে অবস্থিত। সম্রাট নিজেই এই জায়গাটি তাঁর নিজের সমাধি নির্মাণের জন্য নির্বাচন করেছিলেন, কারণ এই জায়গাটির আশেপাশে ভূগর্ভে প্রচুর স্বর্ণ এবং মূল্যবান পাথরের বিশাল সমাহার ছিলো। সমাধিটির আয়তন প্রায় ৫৬ বর্গ কিলোমিটার। ঐতিহাসিক বিভিন্ন প্রামাণ্য দলিলাদি গবেষণা করে জানা যায়, সমাধিতে হাজারো টেরাকোটা সৈন্যের সাথে চুয়ান্নটি মালগাড়ীর একটি পুরো বহরও রয়েছে। ধারণা করা হয়, এই সমাধি এবং সমাধির আশেপাশে মোট ৮১টি মালগাড়ীর একটা বহর এখনো ভূগর্ভে অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। সমাধিটি কেবল সম্রাটের সৈন্যবাহিনী এবং কবরের স্থাপত্যের নিদর্শন নয়। ইতিহাসবিদ সিমা কিয়ানের ধারাবিবরণী অনুসারে, এই সমাধিতে একটি পূর্ণ মন্দির, ধনদৌলত সহ পারদের হ্রদ এবং বহমান নদীও থাকতে পারে।
সমাধিটি তিনটি ভাগে বিভক্ত
টেরাকোটার এই সেনা জাদুঘরে একটি প্রদর্শনী কক্ষসহ আরো তিনটি কক্ষ বা ভল্ট রয়েছে। পুরো সমাধির বিন্যাস একেবারে প্রাচীন চীনা যুদ্ধশৈলীর সাথে মিলে যায়। সমাধিটি পশ্চিম দিকে মুখ করা, কারণ কিন অঞ্চলের শত্রুরা সেই অঞ্চলের পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়েছিল। সমাধির সামনের দিকে ডান পাশে প্রথম কক্ষ, বাম পাশে দ্বিতীয় কক্ষ এবং প্রথম ও দ্বিতীয় কক্ষের পেছনের দিকে মাঝামাঝি অবস্থানে তৃতীয় কক্ষটি বিদ্যমান।
প্রথম কক্ষ
সমাধির প্রথম কক্ষটি সবচাইতে বড় এবং গভীর। বলতে গেলে একটি ঢাউস আকারের বিমান ঘর বা এয়ারক্রাফট গ্যারেজের সমান। কক্ষটিতে মাটির তৈরি হাজার হাজার হাজার সৈন্যমূর্তি রয়েছে। এটি বিশ্বাস করা হয় যে, এই কক্ষটিতে মোট ৬ হাজার সৈন্য এবং ঘোড়ার মূর্তি বিদ্যমান। প্রতিটি সৈন্য পূর্বদিকে মুখ করে কোণাকুণি ভাবে দাঁড়িয়ে আছে এবং প্রত্যেক সৈন্যর হাতে কোনো না কোনো অস্ত্র রয়েছে। সম্মুখ সারির সৈন্যরা পুরো সেনাবাহিনীর একেবারে পূর্বদিকে তিনটি সারিতে বিন্যস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক এর পেছনেই রয়েছে সমরাস্ত্র সজ্জিত মূল সেনাবাহিনী এবং ৩৮টি ঘোড়াচালিত রথ। উত্তর, দক্ষিণ এবং পশ্চিমদিকে সৈন্যদের একটি করে সারি মূল সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা দেয়াল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৭৯ সালে এই কক্ষটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। কক্ষটি ২১০ মিটার লম্বা, ৬২ মিটার চওড়া। কক্ষটির উচ্চতা এর ভেতরের অবস্থানভেদে সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৬ মিটার।
দ্বিতীয় কক্ষ
প্রথম এবং দ্বিতীয় কক্ষের খনন কাজ এখনো প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় রয়েছে। দ্বিতীয় কক্ষটির খনন কাজ শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। এটি প্রথম কক্ষ থেকে প্রায় ২০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। পুরো সমাধিসৌধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এই কক্ষটি, প্রাচীন চীনের সুবিন্যস্ত সেনাবাহিনীর রহস্য উন্মোচন করে। ৬ হাজার বর্গ মিটার জুড়ে অবস্থিত এই কক্ষটি মোট চারটি ইউনিটে বিভক্ত এবং পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণে যথাক্রমে ৯৪ মিটার এবং ৮৪ মিটার লম্বা। প্রথম ইউনিটে রয়েছে সারিবদ্ধ তীরন্দাজ বাহিনী। দ্বিতীয় ইউনিটটি যুদ্ধবাজ রথ। তৃতীয় ইউনিটে পদাতিক সেনাবাহিনী, অশ্বারোহী বাহিনী এবং রথের মিশ্র বিন্যাস। এ ইউনিটে দেখা যায় অসংখ্য সামরিক বাহিনী অস্ত্র হাতে কোণাকুণিভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আর এই চারটি ইউনিট মিলে একত্রে একটি বিধ্বংসী যুদ্ধ বিন্যাস তৈরি করে।
তৃতীয় কক্ষ
তিনটি কক্ষের মধ্যে তৃতীয়টি সর্বাপেক্ষা ছোট। এই কক্ষে কেবলমাত্র ৬৮টি মূর্তি পাওয়া গেছে এবং বেশ কিছু মূর্তির মাথা বিচ্ছিন্ন। এটি সুস্পষ্ট যে, এই কক্ষটিতে নেতৃত্বদানকারী যোদ্ধাদের অবস্থান ছিল।
সৈন্য মূর্তিগুলোর শ্রেণীবিভাগ
এখন পর্যন্ত খনন করে, যে কয়টি মাটির তৈরি সৈন্যমূর্তি উত্তোলন করা হয়েছে তাদেরকে তিনটি প্রদান ভাগে ভাগ করা যায়-
- পদাতিক বাহিনী
- অশ্বারোহী বাহিনী এবং
- রথী বাহিনী
পদাতিক বাহিনীকে আবার কয়েকটি উপস্তরে ভাগ করা যায় । উচু, মধ্যম এবং নিচুশ্রেণীর সেনানায়কসহ হালকা অস্ত্রসজ্জিত বাহিনী, ভারী অস্ত্রসজ্জিত পদাতিক বাহিনী এবং হাটু গেড়ে বসা ও দাঁড়ানো তীরন্দাজ বাহিনী। রথী বাহিনীকে আরো দুটি ভাগে ভাগ করা যায়- রথচালক এবং রথযোদ্ধা।
মূর্তিগুলোর বৈশিষ্ট্য
মুখাবয়ব: প্রতিটি সৈন্যমূর্তি একটি থেকে অপরটি অনন্য
প্রতিটি মূর্তির মুখাবয়বে পদমর্যাদা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি, পোশাকআশাক এবং চুলের গড়ন দেখা যায়। মূর্তিগুলোকে বিশ্লেষণ করে দেখাযায় যে, মোটামুটি আট ধরনের মুখাবয়ব বিদ্যমান। এবং এই আট মুখাবয়ব চীনা বর্ণমালার আটটি বর্ণ 目, 国, 用, 甲, 田, 由, 申, এবং 风 এর অনুরূপ। উদাহরণস্বরূপ ‘目’ আকৃতির মুখগুলি অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ এবং লম্বা।
এই বিপুল পরিমাণ মাটির তৈরি সৈন্যবাহিনী যদি আপনাকে অবাক করতে না পারে, তাহলে অবাক হবার জন্য মূর্তিগুলোর দিকে একটু কাছে থেকে দৃষ্টি রাখতে হবে। এই হাজার হাজার মূর্তিগুলোর মধ্যে প্রত্যেকটি মূর্তিই অনন্য এবং একটির সাথে অপরটির পুরোপুরিভাবে কোনো মিল নেই। মৃৎশিল্পের এরকম অনন্য নিদর্শন দেখে বিস্মিত হতে হয়।
চুলের ধরণ
প্রাচীনকালে বিভিন্ন রকম চুলের বিন্যাস কেবলমাত্র জীবনযাপনের অংশই ছিল না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামাজিক মর্যাদার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হত। মাটির তৈরি এই মূর্তিগুলো বিশ্লেষণ করে দুই রকমের চুলের ধরণ এবং গড়ন লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, মূর্তিগুলোর চুল খোপা করে মাথার ডান পাশে গচ্ছিত রাখা এবং অপর শ্রেণীর চুল অনেকটা দড়ির মতো পেচিয়ে তারপর খোপা করে মাথার ঠিক উপরের দিকে বাঁধা এবং একটি কাপড়ের আবরণে আবৃত। চুল বাঁধার জন্য চুলের কাঁটা, রাবার ব্যান্ড এবং ফিতার ব্যবহারও দেখা যায়।
পোশাকআশাক বা সাজসজ্জা
মাটির তৈরি এসব সৈন্যবাহিনী পোশাক এবং সাজসজ্জার বিভিন্নতা এতটাই সুনির্দিষ্ট যে পোশাক দেখেই একটি মূর্তির সামরিক মর্যাদা এবং অস্ত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ- প্রধান সেনাপতির গায়ে দুই স্তরের একটি বহির্বাস দেখা যায় এবং উপরে একটি লোহার বর্ম যা আক্রমণের হাত থেকে তাঁর বুক এবং কাঁধকে রক্ষা করে। পায়ে চারকোণা আকৃতির এবং সামনের দিকে একটু উচু জুতা পরিহিত। সশস্ত্র যোদ্ধাদের পোশাক বেশ ভারী এবং সারা শরীর বলতে গেলে গলবদ্ধ, সামনে-পেছনে শক্ত বর্ম দিয়ে আবৃত, যা তাদের বুক-পিঠ এবং কাঁধের সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়।
অশ্বারোহী বাহিনীর পোষাক পরিচ্ছদ আবার আলাদা। তাদের মাথায় পিলবক্স টুপি, গলায় স্কার্ফ এবং বুকের সামনে এবং পিঠে হালকা বর্ম দেখা যায়। তাদের জুতোগুলো নরম এবং সামনের দিকে গোলাকার যাতে ঘোড়ায় ওঠার সময় কোনরূপ আহত হতে না হয়। রথ নিয়ন্ত্রণের খাতিরে রথচালকদের জন্য অধিক সুরক্ষাযুক্ত পোশাক পরিচ্ছদের ব্যবস্থা ছিল। তারা তাদের ঘাড়ের পেছনের দিকের সুরক্ষার জন্য হেলমেট পরতো।
অস্ত্রশস্ত্র
কোনো কোনো মূর্তির হাতে তৎকালীন সময়ের প্রাচীন এবং আসল অস্ত্র ধরে থাকতে দেখা যায়। যেমন, ব্রোঞ্জের তলোয়ার, তীর-ধনুক, বর্শা এবং ছোঁরা ইত্যাদি। সেসময়ে এসব অস্ত্রশস্ত্র মরিচা পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল। এজন্য সমাধীস্থ হবার ২,০০০ বছর পরেও সেগুলো এখনো ঝকঝকে রয়ে গেছে।
শুধু সৈন্যবাহিনী নয়, আছে পশুপাখির মূর্তিও
টেরাকোটা সৈন্যবাহিনীর এই যাদুঘরে যে কেবল সৈন্যবাহিনীর মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে তা নয়। প্রায় ৮,০০০ সৈন্যবাহিনীর সাথে এই সমাধিতে এখন পর্যন্ত ১৩০টি রথ এবং ৬৭০টি ঘোড়া আবিষ্কৃত হয়েছে। টেরাকোটার তৈরি সঙ্গীতশিল্পী, মল্লযোদ্ধা এবং নর্তকীর মূর্তি পাওয়া যায়। এছাড়া কিছু সারস এবং হাঁসের মূর্তিও পাওয়া গিয়েছে। বিশ্বাস করা হয় যে, রাজা কিন শি বেঁচে থাকার সময়ে যেমন রাজকীয় জীবনযাপন করতেন, মৃত্যুর পরেও তিনি ঠিক সেরকম একটি রাজকীয় সুযোগসুবিধা ভোগ করতে চেয়েছিলেন।
যদিও রাজা কিন শির সমাধির কিছু অংশ এখনো অক্ষত অবস্থায় আছে এবং এখনো খনন কাজ শুরু হয়নি। কিন্তু প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে আরো উন্নয়ন না হলে এর খনন কাজ শেষ হতে আরো শত বছর লেগে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা।
Feature Image: nationalgeographic.com