শিরোনাম দেখে হয়ত ভাবছেন, এ সেতুর ‘অজানা’ ইতিহাস কেন বলা হচ্ছে? কারণটা হলো, অনেকেই এটাকে আদম সেতু বলে জানে, কিন্তু জানে না, এটা যে বহু মানুষের কাছে রাম সেতু নামে পরিচিত। আবার অনেকে চেনে রাম সেতু নামে, অথচ এটা যে অনেক আগে থেকে আদম সেতু নামে খ্যাত সেটা তাদের অজানা। এই জানা-অজানার ঘোরপ্যাঁচে এই সেতুর ইতিহাসটাই জানা হয় না। তাছাড়া ‘রাম’ আর ‘আদম’ নাম থাকায় ধর্মীয় পরিচয়ও এখানে চলে আসে, আর সেই সাথে ধর্মীয় অনুভূতি। কিন্তু ইতিহাস কী বলে? ভারত থেকে শ্রীলংকা সংযোগকারী রহস্যময় এ প্রাচীন সেতুর কথাই আজ বলা হবে।
ভারতের তামিলনাড়ুর দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে রামনাথপুরাম জেলার একটি দ্বীপ পাম্বান (Pamban)। এটি রামেশ্বরম দ্বীপ নামেও পরিচিত। এখান থেকে শ্রীলংকার উত্তর-পশ্চিমের মান্নার দ্বীপ পর্যন্ত অগভীর চুনাপাথরের একটি সেতু চলে গিয়েছে সমুদ্রের বুকে। ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এটি একসময় ভারত আর শ্রীলংকাকে যোগ করে রেখে ছিল স্থলপথে। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৩০ মাইল বা ৪৮ কিলোমিটার। সবচেয়ে অগভীর জায়গাতে চুনাপাথরের গভীরতা আসলে ১ মিটারের বেশি না। তবে অন্য জায়গায় ৩০ ফুট পর্যন্তও দেখা যায়। এর ফলে সেখানে সেচ কাজ করা যায় না।
এখন এই সেতু দিয়ে চলাচল করা না গেলেও, পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত একদম পায়ে হেঁটে যাবার অবস্থাই ছিল, মানুষ যেতে পারত। মন্দিরের নথি অনুযায়ী, ১৪৮০ সালে এক ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল, যার ফলে এই সেতু ভেঙে যায়। বিভিন্ন ঝড়ের ফলেও তলিয়ে যাচ্ছিল সেতুটি।
সেতুটি যেহেতু আদম সেতু বা রাম সেতু উভয় নামেই পরিচিত, এ থেকেই বোঝা যায় দু’ধর্মের সাথেই এর সম্পর্ক আছে কোনোভাবে। আদম সেতু নামটি কীভাবে এলো? Adam’s Peak নামের একটি পর্বত রয়েছে মধ্য শ্রীলংকায়, যার উচ্চতা ৭,৩৫৯ ফুট। সেখানে রয়েছে ‘শ্রীপদ’ নামের এক পবিত্র পায়ের ছাপ, চূড়ার ঠিক কাছে। সেই ছাপের দৈর্ঘ্য ১.৮ মিটার (৫ ফুট ১১ ইঞ্চি)।
যদিও কোনো প্রমাণিত হাদিস বা কুরআনের আয়াতে এর উল্লেখ নেই, তবুও কথিত আছে, দীর্ঘদেহী হযরত আদম (আ) যখন দুনিয়াতে আসেন, তখন তিনি শ্রীলংকায় পতিত হন। তিনি অনুতপ্ত হয়ে এই পর্বতচূড়ায় টানা এক হাজার বছর প্রার্থনা করেন এক পায়ে দাঁড়িয়ে। সেই পায়ের ছাপই এটি। এছাড়া এরকমও বর্ণিত আছে, তিনি পতিত হবার সময় যে প্রচণ্ড বল নিয়ে ভূমিতে প্রথম পায়ে আঘাত করেন, সেটির কারণেই এই পায়ের ছাপ সৃষ্টি হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, তিনি এই চূড়া থেকে নেমে স্থলপথে এ সেতু অতিক্রম করে চলে যান ভারতে এবং একসময় আরাফাতের ময়দানে পৌঁছান, যেখানে জেদ্দায় পতিত বিবি হাওয়ার সাথে পুনর্মিলিত হন তিনি। অন্য একটি মতবাদ অনুযায়ী, তিনি ভারত থেকে এই সেতু পেরিয়ে এই পর্বতের চূড়ায় অনুতাপ করতে গিয়েছিলেন। তবে এ কাহিনীগুলোর প্রামাণ্য কোনো রেফারেন্সের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে কোনো কাহিনীতে এটার উল্লেখ নেই এই সেতুটি সেখানে আগে থেকেই কীভাবে ছিল, বা কীভাবে বানানো হয়েছিল। এই সরু রাস্তাটি কি আগে থেকেই সেখানে ছিল, যা আদম (আ) সমুদ্র পার হবার জন্য ব্যবহার করেন? তবে এ কাহিনী থেকে এ সেতুর নাম হয়ে যায় আদম সেতু।
তবে Adam’s Peak এর সেই পায়ের ছাপ হযরত আদম (আ) এর বলে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিশ্বাস থাকলেও, তামিল হিন্দুগণ একে শিবের পায়ের ছাপ বলে মনে করেন। আবার বৌদ্ধগণ মনে করেন, এ পায়ের ছাপটি গৌতম বুদ্ধের বাম পায়ের, যখন তিনি শ্রীলংকা এসেছিলেন সেই সময়ের।
এবার আসা যাক সনাতন ধর্মের ক্ষেত্রে। প্রাচীন সংস্কৃত মহাকাব্য বাল্মীকি রচিত রামায়ণে এ সেতুর উল্লেখ পাওয়া যায়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে, এর নাম হলো রাম সেতু। রামায়ণ অনুযায়ী, রামের স্ত্রী সীতাকে লংকার রাজা রাক্ষস রাবণ অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং রাম তাঁকে উদ্ধার করতে এ সেতু বানাবার নির্দেশ দেন। বানর সেনাদের সহায়তায় রামের নামখচিত পাথরগুলো সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা হয় এবং সেগুলো ভেসে ওঠে। একে নল সেতুও বলা হয়, কারণ নল নামের একজনের কাছ থেকেই এ সেতু নির্মাণের ব্যাপারে সহায়তা নেন রাম। বলা হয়, মাত্র ৫ দিনে এ সেতুটি নির্মিত হয় লংকা যাবার জন্য। রামায়ণের ২-২২-৭৬ শ্লোকে একে সেতুবন্ধনম ডাকা হয়েছে।
এবার আসা যাক ইতিহাসবিদ, মানচিত্রবিদ বা পরিব্রাজকদের লেখায়। Thanjavur Saraswathi Mahal Library-তে একজন ডাচ মানচিত্র নির্মাতার মানচিত্র পাওয়া যায়, যেখানে তিনি ১৭৪৭ সালে একে Ramancoil নামে অভিহিত করেছেন। শব্দটি তামিল Raman Kovil থেকে এসেছে, যার মানে রামমন্দির। একই গ্রন্থাগারে পাওয়া যায় J. Rennel নামের একজনের মুঘল আমলের করা মানচিত্র। ১৭৮৮ সালের সে মানচিত্রে এ এলাকাকে তিনি ‘রামমন্দির এলাকা’ নামে চিহ্নিত করেছেন। শোয়ার্টজবার্গের ঐতিহাসিক অ্যাটলাসে এবং পরিব্রাজক মার্কো পোলোর ভ্রমণ লেখনিতে এ জায়গাকে সেতুবন্ধ রামেশ্বরম ডাকা হয়েছে। তবে মার্কো পোলো একে আদম সেতুও ডেকেছেন।
পশ্চিমা বিশ্ব প্রথম এ সেতুর কথা জানতে পারে ইবনে খোরদাদবেহের লেখা Book of Roads and Kingdoms বই থেকে। বইটি আনুমানিক ৮৫০ সালের দিকে বের হয়। সেই নবম শতকে এ সেতুর নাম তিনি সেতবান্ধাই (‘সমুদ্রের সেতু’) নামে লিপিবদ্ধ করেছেন। পরবর্তীতে আলবিরুনিও এ সেতুর কথা বর্ণনা করেন। একজন ব্রিটিশ মানচিত্রবিদের ১৮০৪ সালের মানচিত্রে আমরা এ সেতুর নাম দেখতে পাই ‘আদম সেতু’।
এ সেতুর উৎপত্তি আজও বিতর্কিত। ভূতাত্ত্বিকেরাও এ ব্যাপারে একমত নন। কারো মতে, ধীরে ধীরে সমুদ্রের বুকে চর জেগে এই সেতু তৈরি হয়েছে। আবার কারো মতে, শ্রীলংকা যখন ভারতের স্থলভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে চলে যাচ্ছিল, তখনই এ সেতুর জন্ম হয়। যে চারকোনা পাথরগুলো দেখা যায়, সেগুলো সময়ের সাথে সাথে তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে, এরকম মতও কেউ কেউ দিয়েছেন।
সরাসরি সেতু পরীক্ষা না করে স্যাটেলাইট রিমোট সেন্সিং ডেটা ব্যবহার করে Indian Space Research Organisation (ISRO) এর Marine and Water Resources Group of the Space Application Centre (SAC) এ উপসংহারে আসে যে, সেতুটি ১০৩টি অংশ বা ‘প্যাচ রিফে’ বিভক্ত।Geological Survey of India (GSI) প্রজেক্ট রামেশ্বরম নামে একটি গবেষণা চালায় যার উপসংহার ছিল যে, রামেশ্বরম দ্বীপ গঠিত হতে শুরু করে ১ লাখ ২৫ হাজার বছর আগে। কিন্তু কার্বন ডেটিং অনুযায়ী, রামেশ্বরম ও তালাইমান্নারের মাঝের অংশটা সমুদ্র থেকে উঠতে শুরু করে ৭,০০০ থেকে ১৮,০০০ বছর আগের কোনো এক সময়।
যদি এই সেতু এলাকা না থাকত তবে এর মাঝ দিয়ে শর্টকাট দিয়ে জাহাজ পেরিয়ে যেতে পারত, কিন্তু এখন বেশ ঘুরে যেতে হয়, যেমনটা নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে।
এজন্য ভারত সরকার Sethusamudram Shipping Canal Project নামের একটি মাল্টিমিলিয়ন ডলার প্রজেক্ট হাতে নেয় ২০০৫ সালে, যার উদ্দেশ্য ছিল একটি শিপ চ্যানেল তৈরি করা, কিন্তু সেটি করতে হলে আদম সেতু বা রাম সেতুর বেশ বড় অংশ ক্ষতি করতে হবে। তখন বিজেপিসহ ভারতের নানা রাজনৈতিক ও হিন্দু সংগঠন ধর্মীয় কারণে এর বিরোধিতা করে। তখন Archaeological Survey of India ও ভারত সরকার সুপ্রিম কোর্টকে ২০০৭ সালের এফিডেভিট দিয়ে জানায় যে, রাম কর্তৃক সেতু নির্মাণের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। ২০০৮ সালের কোর্ট কেসে সরকার পক্ষের একজন দাবি করেন, রাম নাকি এ সেতু ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। তবে এ দাবিটি প্রত্যাখ্যান করা হয়। পরে মাদ্রাজ হাই কোর্ট রায় দেয় যে, রাম সেতু প্রাকৃতিক নয়, বরং নির্মিত। ২০০৭ সালে ভারতের ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং এজেন্সির একটি প্রকাশনাতে বলা হয়, সেতুটি মনুষ্যনির্মিত হতে পারে। তবে Archaeological Survey of India থেকে এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ডিস্কভারি কমিউনিকেশন্স এর সায়েন্স চ্যানেলের What on Earth নামের একটি প্রোগ্রামের একটি পর্বে (‘Ancient Land Bridge‘) রাম সেতুর উৎপত্তি উন্মোচন করা হবে বলে একটি প্রোমো দেখানো হয়। সেখানে দেখা যায়, নাসার স্যাটেলাইট ইমেজ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের গবেষণা অনুযায়ী, রাম বা আদম সেতুর বালি ৪,০০০ বছর পুরনো হলেও উপরের পাথর ৭,০০০ বছরের পুরনো। ভিডিওতে প্রত্নতত্ত্ববিদ চেলসি রোজ, ভূতত্ত্ববিদ ড. অ্যালান লেস্টারের বক্তব্য দেখানো হয়েছে। তাদের মতে, সেতুটি ৫,০০০ বছর আগে নির্মিত। পুরো গবেষণাটি জানা যাবে পর্বটি প্রচারিত হলে।
তবে শত শত বছর ধরে এ সেতুটি রহস্যে আবৃত ছিল এবং এখনো আছে, সে যে নামেই হোক না কেন। পাঁচশ কি ছয়শ বছর আগে এ সেতুর প্রাণবন্ত রূপ দেখতে কেমন ছিল সেটা জানবার কোনো উপায় আমাদের আর নেই।