দীর্ঘায়ু লাভের আশায় মানুষ কতকিছুই না করছে প্রতিনিয়ত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উত্তরোত্তর উন্নতি এবং নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে মানুষের আয়ুষ্কালও খানিকটা বেড়েছে। পৃথিবীর কোনো কোনো উন্নত দেশে মানুষের গড় আয়ু প্রায় নব্বইয়ের কাছাকাছি। শুধু জাপানেই শতবর্ষী মানুষের সংখ্যা ষাট হাজার ছাড়িয়েছে। শতবর্ষী মানুষের কথা তো আমরা অনেক শুনেছি কিন্তু এই লেখায় এমন একজনের কথাই বলা হবে, অনেকের মতে যিনি বেঁচে ছিলেন ২৫৬ বছর। হ্যাঁ ঠিকই শুনছেন,দুইশত ছাপ্পান্ন বছর বেঁচে ছিলেন তিনি!
সাত ফুট উচ্চতার চীনা গুল্মবিদ লি চিং ইউয়েন মৃত্যুবরণ করেন ১৯৩৩ সালে, কিন্তু তিনি যে কবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তার কোনো সঠিক হিসেব পাওয়া যায়নি।
লি চিং ইউয়েন কি সত্যিই ২৫৬ বছর বেঁচে ছিলেন?
লি চিং ইউয়েন যে সত্যিই ২৫৬ বছর বা কাছাকাছি সময় পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন, তার স্বপক্ষে নিচের যুক্তিগুলো বহুল আলোচিত–
১৯৩০ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনে চীনের সিচুয়ান প্রদেশের চাংদু ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসরের বরাতে জানা যায়, চীনের রাজকীয় সরকারী নথিপত্রে প্রমাণ মেলে লি চিং ইউয়েনের জন্মদিনের। ১৮২৭ সালে চিং সাম্রাজ্যের শাসনামলে লি চিং ইউয়েনকে ১৫০ তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো হয়, সেই হিসেবে তার জন্মসাল ১৬৭৭!
লি চিং ইউয়েনের প্রতিবেশী বা পরিচিতদের ভাষ্যমতে, তাদের বাপ-দাদারাও লি চিং ইউয়েনকে বড় হতে দেখেছেন। অর্থাৎ বৃদ্ধদের পরলোকগত বাপ-দাদারাও লি চিং ইউয়েনকে যুবক অবস্থায় দেখেছেন।
তার পারিবারিক দলিলপত্র অনুসারে তার জন্ম ১৬৭৭ সালে চীনের সিচুয়ান প্রদেশে। সে অনুযায়ীও বলা যায়, তিনি ১৯৩৩ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ২৫৬ বছর বেঁচে ছিলেন। এছাড়াও, চীনা ইতিহাসবিদরা তো বটেই, ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর অনেক পশ্চিমা ইতিহাসবিদও লি চিং ইউয়েনের বয়সের সত্যতা স্বীকার করেন।
লি চিং ইউয়েনের দীর্ঘ জীবনের রহস্য
পেশা: লি চিং ইউয়েন জীবিকা নির্বাহের জন্য দেশে-বিদেশে চীনা ভেষজ ঔষধ বিক্রি করতেন। ১০ বছর বয়স থেকে তিনি বিভিন্ন ধরনের ঔষধি এবং ভেষজ গাছপালা সংগ্রহ এবং বিক্রির সাথে জড়িত। ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এ কাজ করেছেন। এছাড়াও পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ মার্শাল আর্ট শিল্পী এবং প্রশিক্ষক।
লি চিং ইউয়েন ৭১ বছর বয়সেও সেনাবাহিনীতে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন, যা যেকোনো সাধারণ মানুষের জন্য কল্পনাতীত। কিন্তু লি, সেই ৭১ বছর বয়সেও সেনাবাহিনীতে একজন মার্শালআর্ট পরীক্ষক হিসেবে যেকোনো যুবকের সমতুল্য বা তার চেয়ে বেশিই দক্ষ ছিলেন। শরীরের বয়স বাড়লেও কঠোর শারীরিক কসরত এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন তার মনের বয়স কমিয়ে রেখেছিল, যা তাকে দীর্ঘায়ু লাভে সহায়তা করেছিল বলে মনে করা হয়।
খাদ্যাভাস: লি তার দীর্ঘ জীবনের রহস্য হিসেবে পরিমিত ও সুষম খাদ্যাভাস এবং তার সংগৃহীত চীনা ঔষধের গুণাবলির কথাই উল্লেখ করতেন। অন্যান্য ভেষজ উদ্ভিদ এবং ঔষধের পাশাপাশি মাশরুমের উপযোগিতার প্রতি তার ছিল চরম বিশ্বাস। তিনি নানা ধরনের বন্য মাশরুম সংগ্রহ করতেন এবং সেগুলোকে আরও নানা ভেষজ উদ্ভিদের সাথে মিলিয়ে খেতেন। চীনা লোকবিদ্যাতত্ত্ব অনুসারে, মাশরুমের আছে বহুবিধ গুণাবলী। ভালো জাতের মাশরুম শক্তিবর্ধক হিসেবে কাজ করে, ক্যান্সারের সাথে লড়াই করার শক্তি যোগায়, ব্লাড সুগার কম রাখে এবং রক্ত সঞ্চালনে সহায়ক ভূমিকা রাখে। আধুনিক বিজ্ঞানেও মাশরুমের অনেক গুণাবলীই প্রমাণিত।
দীর্ঘ জীবনের মূলমন্ত্র প্রাপ্তি: কিংবদন্তী রয়েছে, একবার ৫০০ বছর বয়সী এক মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল লি চিং ইউয়েনের। সেই লোকের কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন দীর্ঘায়ু লাভের নানা উপায়। নানারকম যোগ ব্যায়াম ও শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন। লি বিশ্বাস করতেন, অন্তরের প্রশান্তি, সাথে নির্মল শ্বাসগ্রহণ মানুষকে দীর্ঘজীবনের পথ বাতলে দিতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাসের নানারকম ব্যায়াম করতেন তিনি নিয়মিতভাবে। তাছাড়া জীবনের বেশিরভাগ সময় লি কাটিয়েছেন গ্রামীণ পরিবেশে, তাই শহরের দূষিত বাতাস তাকে খুব একটা স্পর্শ করতে পারেনি। এসব মিলিয়েই তার এই দীর্ঘজীবন প্রাপ্তি বলে অনেকের বিশ্বাস।
জীবন সম্পর্কে লি চিং ইউয়েনের দর্শন: চীনের ন্যাশনালিস্ট পার্টির শাসনামলের একজন সেনাপতি ছিলেন উই পাইফু। তিনি একবার লি চিং ইউয়েনের সাথে দেখা করতে যান। তার ভাষ্যমতে তিনি যখন লি চিং ইউয়েনের কাছে যান এবং দীর্ঘায়ু লাভের মন্ত্র জানতে চান তখন লি বলেন, “তোমার হৃদয়কে পানির মত শান্ত করো, কচ্ছপের মতো বসো, পায়রার মতো হাঁটো এবং কুকুরের মতো ঘুমাও।” কোনো উক্তিকে ভাষান্তর করা হলে সেটি তার নিজস্ব সৌন্দর্য অনেকটাই হারিয়ে ফেলে, এ ক্ষেত্রেও অনেকটা তা-ই! তবে লি চিং ইউয়েনের এই উপদেশমূলক উক্তিটি খুবই সুন্দর ছিল। এর দ্বারা তিনি বুঝিয়েছিলেন, জীবনে বেঁচে থাকার জন্য খুব বেশি কিছু দরকার নেই, শুধু নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, নিজের শরীরের যত্ন এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত থাকলেই দীর্ঘজীবন প্রাপ্তি সম্ভব।
লি চিং ইউয়েনের শেষ কথা
কথিত আছে, লি চিং ইউয়েন বিয়ে করেছিলেন তেইশবার এবং জীবদ্দশায় তিনি দু’শরও বেশি সন্তানের জনক হয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার উত্তরসূরির ১১তম প্রজন্ম পর্যন্ত দেখে যেতে পেরেছিলেন। লি চিং ইউয়েনের মৃত্যু হয়েছিল স্বাভাবিক বার্ধক্যজনিত কারণে।মৃত্যুর আগপর্যন্তও তার দৃষ্টিশক্তি ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
এত শত যুক্তিতর্কের পরেও একটা মানুষ যে ২৫৬ বছর বেঁচে থাকতে পারে এ কথা অনেকেই মেনে নিতে পারে না। তারা আরও ভালো যুক্তি-প্রমাণ চায়। অনেকে আবার এটাকে ইন্টারনেট দুনিয়ার ধাপ্পাবাজি বলে উড়িয়েই দেয়। যে লোক প্রায় ৯০ বছর আগে মারা গেছে, তার সত্যিকার জন্মসাল এখন আর ঠিকঠাকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব নয়, যেহেতু তার জীবনের গল্পে নানা ধরনের অসংলগ্নতা রয়েছে! তাই লি চিং ইউয়েনের বয়স নিয়ে রহস্য আর আলোচনার স্থায়ী সমাধান হয়তো আর সম্ভব নয়। তবু, একজন মানুষের আয়ু দুইশত বছরেরও বেশি এমন অলৌকিক ঘটনা বিশ্বাস করতে খারাপ লাগে না। আমরা সবাই দীর্ঘ জীবনের জাদুর কাঠির খোঁজে ছুটে মরছি, আর কেউ একজন যদি সেই জাদুর কাঠির খোঁজ পেয়েই থাকেন, তবে তা খারাপ কী!