সৌন্দর্যের কোনো বিশ্বজনীন সংজ্ঞা নেই। যুগে যুগে, দেশে দেশে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়। কিন্তু কেউ যদি নিচের ভদ্রমহিলার ছবিটি দেখিয়ে দাবি করে, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের পারস্যের এই গোঁফ বিশিষ্ট পুরুষালি চেহারার রাজকন্যাই ছিলেন তৎকালীন সমাজের দৃষ্টিতে সেরা সুন্দরী, আপনি কি বিশ্বাস করবেন? আপনি বিশ্বাস না করলেও বিশ্বের হাজার হাজার মানুষ ঠিকই বিশ্বাস করেছে। গত কিছুদিন ধরে ইন্টারনেটে মিম (Meme) আকারে এই ছবিটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে দাবি করা হচ্ছে, প্রিন্সেস কাজার নামের এই ভদ্রমহিলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ১৩ জন পুরুষ আত্মহত্যা করেছিল।
এ জাতীয় মিমগুলো সাধারণত যেরকম হয়ে থাকে, সেরকম এই মিমের সাথেও কোনো ঐতিহাসিক সূত্র দেওয়া নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্ভবত বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অধিকাংশ মানুষের কাছে ‘হাস্যকর’ মনে হওয়ার কারণেই মিমটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। অনেকেই কোনো অনুসন্ধান ছাড়াই দাবিটি বিশ্বাস করে নিয়েছেন এবং সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছেন। কেউ কেউ অবশ্য ছবিটির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, একে ফটোশপ করা ছবি কিংবা সিনেমার শ্যুটিংয়ের অংশ বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আসলেই কি তা-ই? চলুন জেনে নিই, কে ছিলেন এই প্রিন্সেস কাজার? কেন তার জন্য ১৩ জন পুরুষ আত্মহত্যা করেছিল? অথবা, আদৌ কি করেছিল?
ছবিটি (উপরে প্রদর্শিত) যে ফটোশপ করা কিংবা সিনেমার শ্যুটিংয়ের দৃশ্য না, তার প্রমাণ ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়। তবে মিমটিতে যেরকম দাবি করা হয়েছে, ছবির ভদ্রমহিলার নাম ‘প্রিন্সেস কাজার’ নয়। তার প্রকৃত নাম ফাতেমা খানম এবং তার উপাধি ইসমত উদ্দৌলা, যিনি সংক্ষেপে প্রিন্সেস ইসমত নামেই অধিক পরিচিত। প্রিন্সেস ইসমত ছিলেন তৎকালীন পারস্যের কাজার রাজবংশের রাজা নাসিরউদ্দিন শাহ কাজার এবং তার স্ত্রী তাজ উদ্দৌলার দ্বিতীয় কন্যা। কাজার রাজবংশের রাজকন্যা হওয়ার কারণেই মিমটিতে তাকে প্রিন্সেস কাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও এর ফলে তার প্রকৃত পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
কাজার রাজবংশ ছিল পারস্যের দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশগুলোর মধ্যে একটি। তুর্কি বংশোদ্ভূত কাজার গোত্রের এ রাজবংশীয় শাসন স্থায়ী হয় ১৭৮৫ সাল থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত। এ রাজবংশের তৃতীয় রাজা ছিলেন শাহেনশাহ নাসিরউদ্দিন শাহ কাজার। তিনি তার পিতা মোহাম্মদ শাহ কাজারের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতা লাভ করেন। তার শাসনকাল ছিল পারস্যের ইতিহাসের তৃতীয় দীর্ঘস্থায়ী শাসনকাল। ১৮৪৮ সাল থেকে ১৮৯৬ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রায় অর্ধ শতাব্দী ব্যাপী তিনি পারস্যের শাসনকর্তা ছিলেন। তাকে কাজার রাজবংশের সবচেয়ে যোগ্য এবং সফল শাসক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার সময়ে পারস্যের ব্যাপক আধুনিকায়ন হয়, যদিও এর ফলে পারস্যে ইউরোপীয়দের প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক বৃদ্ধি পায়।
নাসিরউদ্দিন শাহ কাজারের ১১ পুত্র এবং ১০ কন্যা ছিল। তাদেরই একজন ছিলেন ইসমত উদ্দোলা। প্রিন্সেস ইসমত ১৮৫৫ অথবা ১৮৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯০৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। নাসিরউদ্দিন শাহের সময় পারস্যের আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগে তার রাজ দরবারেও। প্রিন্সেস ইসমত এবং তার সৎ বোন প্রিন্সেস তাজ আস্-সুলতানা ছিলেন সে সময়ের তুলনায় বেশ আধুনিক দুই নারী। প্রচলিত রীতি ভঙ্গ করে প্রিন্সেস ইসমত পিয়ানো বাজানো শিখেছিলেন, তার ছবি তোলার শখ ছিল এবং তার ব্যক্তিগত একটি স্টুডিও পর্যন্ত ছিল।
প্রিন্সেস ইসমতের যে ছবিটি ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছে, সেটি ফটোশপ করা বা কোনো অভিনয় শিল্পীর ছবি না। সেটি প্রিন্সেস ইসমতের নিজেরই ছবি, যে ছবিটি তুলেছিলেন তার স্বামী দাস্ত মোহাম্মদ খান। তবে ছবিটি আসল হলেও এর দাবিটি যে ভিত্তিহীন, তা অনেকভাবেই বোঝা যায়। প্রথমত, মিমগুলোতে দাবি করা হয়, ‘প্রিন্সেস কাজার’ ছিলেন বিংশ শতাব্দীর পারস্যের সৌন্দর্যের প্রতীক। কিন্তু বাস্তবে প্রিন্সেস ইসমত বিংশ শতাব্দীর খুব কমসময়ই জীবিত ছিলেন। তার মৃত্যু হয়েছিল ১৯০৫ সালে, যখন যৌবন পেরিয়ে তার বয়স ৫০ বছরে পা দিয়েছিলেন। আর এই ছবিটির সাথের বর্ণনা থেকেও জানা যায়, ছবিটি তার স্বামী তুলেছিলেন বিংশ নয়, উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের কোনো একসময়।
দ্বিতীয়ত, মিমটিতে প্রিন্সেস ইসমতের প্রকৃত নাম ব্যবহার না করাও সন্দেহের উদ্রেক করে। যদি সত্যি সত্যিই তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে একজন, দুইজন না, তেরজন পুরুষ আত্মহত্যা করত, তাহলে ইতিহাসে তার নামটি বেশ পরিচিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মিমটিতে তার প্রকৃত নাম উল্লেখ না করে ‘প্রিন্সেস কাজার’ উল্লেখ করা হয়েছে, যা থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা সম্ভব না যে এখানে ঠিক কোন প্রিন্সেসের কথা বলা হচ্ছে। এরফলে অনেকেই ছবিটিকে ইসমতের সৎ বোন জাহারা খানম তাজ আস্-সুলতানার ছবি বলে ভুল করেছেন। সম্ভবত এই মিমটি যিনি তৈরি করেছেন, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ধোঁয়াশা সৃষ্টির জন্য ইসমতের প্রকৃত নাম উল্লেখ না করে তাকে শুধু প্রিন্সেস কাজার হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যেন আগ্রহীদের পক্ষে এর প্রকৃত ইতিহাস খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়।
কাজার সাম্রাজ্যের উপর ফারসি ভাষায় বেশ কিছু বই আছে। নাসিরউদ্দিন শাহের শাসনামল নিয়েও ইতিহাস রচিত হয়েছে। এমনকি, কাজার সাম্রাজ্যের নারীদের পোশাক-আষাক এবং গোঁফ রাখার অদ্ভুত সংস্কৃতির উপরেও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানি অধ্যাপক ড. আফসানেহ নাজমাবাদির একটি বই আছে, যার শিরোনাম Women with Mustaches and Men without Beards: Gender and Sexual Anxieties of Iranian Modernity। কিন্তু এই বইয়েও প্রিন্সেস ইসমত বা অন্য কোনো রাজকন্যার জন্য ১৩ জন পুরুষের আত্মহত্যার কোনো ঘটনা উঠে আসেনি। এমনকি, এগুলোতে প্রিন্সেস ইসমতকে অত্যন্ত গুণী এবং প্রভাবশালী হিসেবে উল্লেখ করলেও তিনি সৌন্দর্যের প্রতীক ছিলেন, কিংবা পারস্যের পুরুষরা তার জন্য পাগল ছিল, এমন কোনো দাবি করা হয়নি।
তবে এই মিমটিতে উল্লিখিত দাবি, অর্থাৎ ইসমতকে বিয়ে করতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আত্মহত্যা করার দাবিটি যে বানোয়াট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তার পক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে, ইসমতের বিয়ে হয়েছিল বাল্যকালে। ১৮৬৬ সালে, যখন তার বয়স মাত্র ১০ বছর, তখন প্রায় সমবয়সী দাস্ত মোহাম্মদ খানের সাথে তার বিয়ে হয়। সে সময় পারস্যে বাল্য বিবাহ ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। ইসমতের সৎ বোন তাজ আস-সুলতানারও বিয়ে হয়েছিল মাত্র ৯ বছর বয়সে। কাজেই ইসমতের রূপ দেখে যদি মানুষ মুগ্ধ হয়ও, তবুও একজন বিবাহিতা রাজকন্যাকে পুনরায় বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়টি সে সময়ের পারস্যের সমাজের প্রেক্ষিতে খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
পুরো দাবিটির মধ্যে যে একমাত্র বিষয়টির সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তা হলো, সে সময় পারস্যে আসলেই নারীদের গোঁফ রাখার প্রচলন ছিল এবং সেটিকে নারীর সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ড. আফসানেহ নাজমাবাদির মতে, ঊনবিংশ শতাব্দীর পারস্যের কাজার গোত্রের শৌখিন নারীরা সৌন্দর্যচর্চার অংশ হিসেবে হালকা গোঁফ রাখতে পছন্দ করতেন। কিন্তু তার বর্ণনা থেকেই দেখা যায়, এই মিমটিতে যেরকম দাবি করা হয়েছে, শখটি বিংশ শতাব্দীর নয়, বরং ঊনবিংশ শতাব্দীর।
নাসিরউদ্দিন শাহের রাজ দরবারের প্রিন্সেস ইসমতের দায়িত্ব ছিল বিদেশী নারী অতিথিদের আপ্যায়ন করা। ড. আফসানেহ তার বইয়ে ১৮৭৭ সালে পারস্যে বেড়াতে যাওয়া সেরেনা নামের এক বেলজিয়ান নারীর সাথে ইসমতের সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করেন। সেরেনার বর্ণনা অনুযায়ী, ইসমতের ঠোঁটের উপর পাতলা গোঁফ তার চেহারার মধ্যে পুরুষালি ভাব এনে দিয়েছিল। কিন্তু তার রূপে পারস্যের পুরুষরা মুগ্ধ ছিল কিনা, কিংবা কেউ তার জন্য আত্মহত্যা করেছিল কিনা, এমন কিছু সেখানে উঠে আসেনি।
অনেকে যে সন্দেহ করেছেন, প্রিন্সেস কাজার বলতে আসলে ইসমত না, বরং তার সৎ বোন তাজ আস্-সুলতানাকে বোঝানো হয়েছে, তার পেছনেও একটা কারণ আছে। আধুনিক মাপকাঠিতে তাজ আস্-সুলতানাকে ইসমতের তুলনায় অনেক বেশি সুন্দরী বলে মনে হতে পারে। এছাড়া তাজ আস্-সুলতানা ছিলেন একইসাথে নারীবাদী ও জাতীয়তাবাদী। তিনি নিজে হিজাব পরিত্যাগ করেছিলেন, নারীদের আধুনিক শিক্ষা ও চাকরি এবং পারস্যের সংবিধান সংশোধনের পক্ষে মতামত গড়ে তুলেছিলেন। তবে তার ব্যাপারেও ইতিহাসে ১৩ জনের আত্মহত্যা সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া এই মিমটি সম্ভবত মজা করার উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু যারা এর সত্যতা অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন, তাদের সামনে উঠে এসেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর দুই নারীর জীবনী, যাদের সৌন্দর্যের চেয়ে অন্যান্য কর্মকাণ্ডই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইতিহাসবিদ ড. স্টাসি জেম শেউইলারের মতে, তাদের সময়ে ইসমত এবং তাজ তাদের সৌন্দর্যের জন্য খুব বেশি পরিচিত ছিলেন না। বরং তারা তাদের মেধা ও যোগ্যতাই ছিল তাদের মূল পরিচয়।
ফিচার ইমেজ- qajarwomen.org