দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে ১৯৮৮ সালের ৩ নভেম্বর বিদ্রোহীরা আক্রমণ অভ্যুত্থান ঘটায়৷ যার নেতৃত্বে ছিলেন ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ। মাত্র ৮০ জন সশস্ত্র যোদ্ধা নিয়ে পুরো মালে শহর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতি মামুন আবদুল গাইয়ুমকে ক্ষমতাচ্যুত করা। ভাগ্যক্রমে তিনি নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে সক্ষম হন।
এরপর পররাষ্ট্র সচিবের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিছু দেশ মালদ্বীপ থেকে দূরে হওয়ায় তারা সাহায্য করতে অপারগ ছিল। আর কিছু দেশ সরাসরি নাকচ করে দেয়। একমাত্র ভারত মালদ্বীপের ডাকে সাড়া দেয়, যার নাম ছিল ‘অপারেশন ক্যাকটাস‘। কেমন ছিল ভারতের সেই অভিযান? তারই শেষ পর্ব থাকছে আজ।
সাউথ ব্লকে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক
মালদ্বীপ ছোট রাষ্ট্র হলেও ভারতের কাছে তার গুরুত্ব অনেক। কেননা মালদ্বীপের উপকূলের কাছে দিয়েই ভারতের অধিকাংশ বাণিজ্যিক জাহাজগুলো চলাচল করে। ফলে এই অঞ্চলে অন্য কোনো দেশের প্রভাব তৈরি হোক সেটা ভারত কখনোই চায় না।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ভারত সবসময়ই নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করে আসছে। মালদ্বীপও এর ভিন্ন ছিল না। এছাড়া প্রতিবেশী একটি দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তার জন্য ভারতেও প্রভাব পড়বে। এই কারণে মালদ্বীপের আহ্বানে ভারত সাড়া দিতে দেরি করেনি। কিন্তু কীভাবে তারা সাহায্য করবে সেটা নির্ধারণ করাই ছিল প্রথম কাজ।
মালদ্বীপ থেকে অভ্যুত্থানের খবর আসার পরপরই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব কুলদীপ শাহদেব ফোন করেন প্রধানমন্ত্রীর যুগ্ম সচিব রোনেন সেনকে। এর আধা ঘণ্টা পর শাহদেবকে ফোন করেন মালেতে থাকা ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার। তখন তিনি এক মুহূর্ত দেরি না করে এয়ার ভাইস মার্শাল ডেনজিল কিলোরকে ফোন করে বিমান বাহিনীর একটি দলকে প্রস্তুত করতে বলেন। শাহদেব এর আগে বিমান বাহিনীর সাথে শ্রীলঙ্কায় কাজ করেছেন। ফলে তার সাথে বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাদের বোঝাপড়া বেশ ভালো ছিল।
এরপর সেদিন সকালেই শাহদেবকে ফোন করে দিল্লির সাউথ ব্লকের বৈঠক ডাকতে বলেন রোনেন সেন। সেই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নিজেও যোগ দেবেন। তিনি তখন কলকাতায় রাজনৈতিক সফর শেষ করে দিল্লি ফিরছিলেন।
কিছু সময় পর রাষ্ট্রদূত এ কে ব্যানার্জি শাহদেবকে ফোন করে বিষয়টি জানাতে গিয়ে বুঝতে পারেন ইতোমধ্যে সকলেই জেনে গেছে। তখন শাহদেব তাকে বৈঠকে যোগ দেওয়ার কথা বলেন।
৩ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৮টায় অপারেশন, ট্রান্সপোর্ট ও হেলিকপ্টার বিভাগের ক্যাপ্টেন অশোক গোয়েলকে ডেকে পাঠান বিমান বাহিনীর ভাইস-চিফ এয়ার মার্শাল এনসি সুরি। গোয়েলের কাছে তিনি পরিবহন বিমানের বিষয়ে তথ্য চান।
গোয়েল তখন সুরিকে জানান, আগ্রায় তাদের পাঁচটি আইএল-৭৬ এবং ১৬টি এএন-৩২ আছে। এছাড়া আসামের জোড়হাট থেকে ১৪টি এএন-৩২ আছে, সেখান থেকে দুপুর একটার মধ্যেই আগ্রায় নিয়ে আসা যাবে। গোয়েলকে মালদ্বীপে অভিযানের জন্য পরিবহন বিমান প্রস্তুত করার পাশাপাশি বৈঠকে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন এয়ার মার্শাল সুরি।
সাউথ ব্লকের আর্মি অপারেশন রুমে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, রোনেন সেন, কুলদীপ শাহদেব, তিন বাহিনীর প্রধান, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) এর প্রধান, প্রতিরক্ষা সচিবসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন।
বৈঠকের শুরুতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পি চিদাম্বরম মালে শহরে ভারতের নতুন গঠিত ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড (এনএসজি) এর কমান্ডোদের পাঠানোর প্রস্তাব দেন। এই বাহিনী তার অধীনে ছিল। কিন্তু তার এই প্রস্তাব সেনাবাহিনী নাকচ করে দেয়।
গোয়েন্দা বাহিনী ‘র’ কাছে মালদ্বীপের ঘটনা সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য ছিল না। ‘র’ প্রধান বৈঠকে মালদ্বীপের নতুন তৈরি হুলহুলে বিমানবন্দর বিদ্রোহীদের দখলে আছে বলে জানান। কিন্তু সেই তথ্য মিথ্যা ছিল।
তখন তাকে চুপ করিয়ে দেন রোনেন সেন। কারণ তার কাছে মালদ্বীপ সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য ছিল। বৈঠকে আসার আগে তিনি মালদ্বীপের পররাষ্ট্র সচিবের সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলেছেন। জাকি তাকে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছেন।
বিদ্রোহীরা মালদ্বীপের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিস ঘিরে ছিল তখন। রোনেন তখন জাকিকে ফোন কেটে দিতে নিষেধ করেন। এরপর জাকি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী অফিসের সাথে অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেলিফোন সংযোগ চলমান ছিল। যা মালদ্বীপে ভারতের অভিযান পরিচালনা করতে বাড়তি সুবিধা দিয়েছিল।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর মিশন ইম্পসিবল
প্রধানমন্ত্রীর সাথে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বৈঠকে মালদ্বীপে অভিযান পরিচালনা করার জন্য প্যারাট্রুপারদের পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্যারা কমান্ডোদের চেয়ে দক্ষ সেনা আর নেই।
বৈঠকে আরো দুটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথমত, দিয়েগো গার্সিয়াতে থাকা মার্কিন সেনাদের জানিয়ে অভিযানে যাওয়া। এবং দ্বিতীয়ত, মালদ্বীপে পৌঁছানোর আগে সংবাদমাধ্যমে কোনো তথ্য না দেওয়া।
শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যম নয়, শুরুতে যেসব সেনা মালদ্বীপে যাবেন তারা নিজেরাও জানতেন না তারা কোথায় যাচ্ছেন। স্কোয়াড্রন ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার মালে যাওয়ার জন্য তিনটি বিমান নির্ধারণ করেছিলেন। সেই বিমানগুলোর ক্রুরাও জানতেন না তারা কোথায় অভিযানে যাচ্ছেন। তখন ব্রিগেডিয়ার ভিপি মালিক ফোন করেন মেজর ভিনোদ ভাটিয়ার কাছে। তিনি ষষ্ঠ প্যারা ব্রিগেডের পাশাপাশি মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং দলকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন।
কিন্তু ষষ্ঠ প্যারা ব্রিগেডের সব সদস্য আগ্রায় ছিল না। মাত্র দুই কোম্পানি তখন সেখানে ছিল। কিন্তু তারা আগ্রার সেন্ট্রাল অর্ডিন্যান্স ডিপোর নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল। ফলে বাবিনা থেকে টেন গার্ড ব্যাটালিয়ন না আসা পর্যন্ত তাদের সেখান থেকে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু সে অনুযায়ী কাজ করলে একদিন অপেক্ষা করতে হবে, যা সেই মুহূর্তে একদমই সম্ভব ছিল না।
মেজর ভিনোদ ভাটিয়া দুপুর দুটোর মধ্যে ব্রিগেডিয়ার সুভাস যোশির সাথে সিক্স প্যারা কমান্ডারের হেডকোয়ার্টারে আসার নির্দেশ দেন। কিন্তু আগ্রার সেন্ট্রাল অর্ডিন্যান্স ডিপোর কর্মকর্তারা প্যারা কমান্ডারদের ছাড়ার বিষয়ে প্রথমে রাজি ছিলেন না। পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার যোশি তাদের বলেন বাধা দিলে কমান্ডাররা গুলি চালিয়ে নিজেদের রাস্তা তৈরি করে নেবে। পরবর্তীতে প্যারা কমান্ডারদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু এরপর যে সমস্যা দেখা দেয় তা হলো বিমানের পর্যাপ্ত জ্বালানি। আগ্রার বিমান ঘাঁটিতে থাকা বিমানগুলোতে ভারতের যেকোনো জায়গায় যাওয়ার মতো জ্বালানি ছিল। কিন্তু তারা যেহেতু মালে যাবে, সে কারণে তাদের বাড়তি জ্বালানি প্রয়োজন ছিল, যা প্রতিটি বিমানের জন্য ২০-২৫ হাজার লিটার।
সব মিলিয়ে তিনটি বিমানের জন্য কমপক্ষে ৬২ হাজার লিটার তেলের প্রয়োজন ছিল। যা অল্প সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা করা একেবারে সহজ ছিল না। কিন্তু এরপরও তৎকালীন চিফ ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার গুরুরানি এক ঘণ্টার মধ্যে তিনটি বিমানে ৬২ টন তেল ভর্তি করে দেন। এটি ছিল সেই অভিযানের প্রথম অবিশ্বাস্য এক ঘটনা।
এরপর প্রতিটি বিমানে প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি ভর্তি করা হয়। বিকাল পৌনে চারটার দিকে দিল্লি থেকে সেনা ও বিমান বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি দল আগ্রায় এসে পৌঁছায়। তারা ব্রিফিং রুমে এসে কমান্ডোদের সাথে কৌশল ও পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করে।
এই অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়ার ভার পড়ে ব্রিগেডিয়ার এফসি বালসারার উপর। আর কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয় সুভাস যোশিকে। অভিযান নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে কোনো একজন কর্মকর্তা নাম প্রস্তাব করেন ‘অপারেশন ক্যাকটাস’। এর কারণ হলো পানির নিচে থাকা প্রবাল, ভূমির উপরের ক্যাকটাসের মতোই ধারালো। সেই ভাবনা থেকেই এই নাম দেওয়া হয়।
প্রায় ৪০০ জনের দলকে দুবারে মালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সমস্যা হলো যে, তারা অবতরণ করবে কোথায়? তাদের কাছে পর্যটন মানচিত্র ছাড়া আর কোনো নকশা ছিল না। এছাড়া তাদের ধারণা ছিল হুলহুলে বিমানবন্দর বিদ্রোহীদের দখলে। কিন্তু ভারতীয় আর্মি যে নকশা দেখে এমন ধারণা পেয়েছিল তা সঠিক ছিল না। এ কে ব্যানার্জি সেটি দেখার পর বলেন এই নকশা ভুল। তখন ব্রিগেডিয়ার বালসারা, ব্যানার্জিকে তাদের সাথে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কারণ মালে সম্পর্কে তার পরিষ্কার ধারণা ছিল।
ব্যানার্জি তখন বালসারাকে দুটি শর্ত দেন। সবার প্রথমে সরকার বলে রাজি করাতে হবে। সরকার যদি অনুমতি দেয় তাহলে তিনি যাবেন। দ্বিতীয়ত, তাকে শেভ করার জন্য একটি রেজার দিতে হবে। পরবর্তীতে সরকার তাকে অনুমতি দেয়।
এদিকে বিমান বাহিনী থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তারা কোথায় যাচ্ছেন এ খবর কাউকে বলবেন না। এমনকি বিমান উড্ডয়নের কাগজপত্রে তারা লেখেন যে নিয়মিত ফ্লাইট হিসেবে তারা আগ্রা থেকে ত্রিবানদ্রাম যাচ্ছেন। কারণ তারা যদি লেখেন আগ্রা থেকে মালদ্বীপ যাচ্ছেন। তাহলে আরো অনেক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে যা করতে গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হবে।
ভারতীয় বিমানগুলো আগ্রা ছেড়ে প্রথমে ত্রিবানদ্রামের পথে যাত্রা শুরু করে। পথে বিমানের ন্যাভিগেশন লাইট বন্ধ করে রাখা হয়। এবং ত্রিবানদ্রাম যাওয়ার পথে পাইলটরা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) এর সাথে পুরো পথ কোনো কথা বলেননি।
ত্রিবানদ্রামের কাছাকাছি এসে তারা এটিসির কাছে থেকে অনুমতি নিয়ে মালদ্বীপের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। কিন্তু পথে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি বিমান তাদের যাত্রাপথে আসলে ভারতের অভিযানের বিষয়টি আর গোপন থাকেনি। তাদের সূত্র ধরে ২০ মিনিট পরেই বিবিসি খবর প্রকাশ করে যে মালদ্বীপকে সহায়তা করার জন্য ভারতের সেনাবাহিনী রওনা দিয়েছে।
ভারতীয় সেনারা মালদ্বীপের হুলহুলে বিমানবন্দরে নামার আগে একটি কৌশল অবলম্বন করেছিল। আগে থেকেই বিমানবন্দরে তাদের লোক ছিল। বিমানবন্দর তাদের জন্য নিরাপদ তা দুটো সংকেতের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে। প্রথমে রান-অফের বাতি একবার অন করে, আবার অফ করা হবে।
দ্বিতীয়বার সেখানকার এটিসি থেকে যদি একটি নির্দিষ্ট পাসওয়ার্ড বলা হলে তবেই বিমান অবতরণ করবে। নয়তো ৬০ জন প্যারা ট্রুপার বিমান থেকে প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে নামবে। যদি পরিকল্পনামাফিক অবতরণ করতে পারে তাহলে তারা কয়েকটি ধাপে কাজ সম্পূর্ণ করবে।
ভারতীয় সেনারা যখন হুলহুলে বিমানবন্দরে অবতরণ করে তখন বিদ্রোহীরা টের পেয়ে যায়। তারা মনে করেছিল প্রায় ১,৬০০ সেনা সেখানে অবতরণ করেছে। কিন্তু তাদের ধারণার চেয়ে অনেক কম ভারতীয় সেনা সেখানে গিয়েছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মোট ১,৬০০ জন সেনা নিয়ে অভিযানের অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এত সংখ্যক সেনার প্রয়োজন হয়নি।
রাষ্ট্রপতি গাইয়ুমের সাহায্য প্রার্থনার নয় ঘণ্টার মধ্যে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ব্রিগেডিয়ার বালসারার নেতৃত্বে প্রায় ২,৫০০ কিলোমিটার রাস্তা পার দিয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৪৪ স্কোয়াড্রনের তিনটি বিমানে করে ৩৫৮ জন কমান্ডো হুলহুলে বিমানবন্দরে অবতরণ করে। পুরো অভিযানের টার্নিং পয়েন্ট ছিল অরক্ষিত হুলহুলে বিমানবন্দর।
সেখানে বিমান থেকে নামার পরই ২৭ জনের একটি দলকে নৌকায় করে মালের দিকে পাঠানো হয়। যার দূরত্ব ছিল মাত্র ৪.৫ কিলোমিটার। এরপর ৫১ জনের আরেকটি দলকে মেরিন ড্রাইভ জেটির দিকে পাঠানো হয়। সেখানে বিদ্রোহীরা জেটি দখল করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। ২৭ জনের দলের জন্য আগে থেকেই একজন গাইড ঠিক করা ছিল। সেই গাইড তাদের উপ-প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইলিয়াস ইব্রাহিমের বাড়িতে নিয়ে আসে। সেখান থেকে গাইডের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাদের রাষ্ট্রপতি গাইয়ুমের গোপন আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু সেখানকার নিরাপত্তা কর্মীরা তাদের ভারতের সেনা হিসেবে বিশ্বাস করতে পারছিল না। পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার বালসারা প্রয়োজনে গুলি করে সেখানে প্রবেশ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ এর মধ্যে ভারতীয় সেনার মধ্যে কয়েকজন শিখকে দেখতে পেয়ে গাইয়ুমের নিরাপত্তাকর্মীরা আশ্বস্ত হন। তারা বুঝতে পারেন এরা বিদ্রোহী হতে পারেন না। পরবর্তীতে তারা বাসার ভেতরে গিয়ে গাইয়ুমকে আশ্বস্ত করেন যে, তিনি এখন নিরাপদ। আপাতত তার কোনো ভয় নেই।
রাষ্ট্রপতি নিরাপদে উদ্ধার হলেও মালে শহরের বিভিন্ন অংশ তখনো বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। এর মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী আহমেদ মুজতবা এবং তার শাশুড়িকে অপহরণ করে লুথিফি। শিক্ষামন্ত্রীর শাশুড়ি ছিলেন সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। কিন্তু এদিকে লুথিফির কোনো খোঁজ মিলছিল না।
অপরদিকে হুলহুলে থেকে মালের দিকে নোঙর করা জাহাজগুলোর দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন হাইকমিশনার ব্যানার্জি। সেখানকার জাহাজের বাতিগুলো তখন মিটমিটিয়ে জ্বলছিল। ব্যানার্জির মনে হয়েছিল সেখানে বিদ্রোহীরা থাকতে পারেন৷ হঠাৎ করেই এমভি প্রোগ্রেস লাইট নামে একটি জাহাজ চলতে শুরু করে। তখন ব্যানার্জির আর বুঝতে অসুবিধা হয়নি। সাথে সাথে সেখানে থাকা ব্রিগেডিয়ার বালসারাকে বিষয়টি জানান।
ব্রিগেডিয়ার বালসারা সাথে সাথে জাহাজে আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। তখন সেনারা রকেট লঞ্চার, এমএমজি ও অন্যান্য ছোট অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। অনেকগুলো আক্রমণ চালানোর পর একটি গোলা লুথিফির জাহাজের স্টিয়ারিং সিস্টেমকে অকেজো করে দেয়। ফলে লুথিফির পক্ষে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
কিন্তু যেকোনো মূল্যে মালাক্কা প্রণালি যাওয়ার আগেই জাহাজটিকে আটকাতে হবে। কেননা প্রণালিতে জাহাজের ভিড়ে লুথিফির জাহাজ খুঁজে বের করা খু্বই কঠিন হয়ে পড়বে। জাহাজে তখন ৭০ জন বিদ্রোহী ও ৭ জন অপহৃত নাগরিক ছিলেন। এদের মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী ও তার শাশুড়িও ছিলেন।
লুথিফির জাহাজকে আটকানোর জন্য কোচি থেকে ভারতীয় নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধজাহাজ আইএনএস বেতওয়া ও আইএনএস গোদাবাড়ি রওনা করে। তার সাথে দুটি সি কিং এমকে-৪২ অ্যাটাক হেলিকপ্টারও পাঠানো হয়। ৪ নভেম্বর এক হেলিকপ্টার লুথিফির জাহাজ এমভি প্রোগ্রেস লাইটকে দেখতে পায়। কাছাকাছি স্থানেই ভারতের দুই যুদ্ধজাহাজ ছিল। ভারতীয় নৌসেনারা লুথিফির জাহাজকে ধাওয়া করে। বিদ্রোহীদের জাহাজটি পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যায়।
এর আগেই বিদ্রোহীরা অপহৃত কয়েকজনকে হত্যা করে। তখন ভারতীয় সেনারা জাহাজে কামান দিয়ে হামলা করে জাহাজের সামনের অংশ ধ্বংস করে দেয়। উপর থেকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমেও হামলা করা হয়। তখন বিদ্রোহীরা নিজেরাই জাহাজ থেকে সাগরে লাফিয়ে পড়তে শুরু করে।
তখন হেলিকপ্টারের মাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রী ও তার শাশুড়িকে উদ্ধার করা হয়। ৫ নভেম্বর লুথিফি ধরা পড়েন। তাকে মালদ্বীপ সরকারে হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রথমে তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হলেও রাষ্ট্রপতি মামুন আবদুল গাইয়ুম তা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
মূলত দুই শ্রেণীর লোক রাষ্ট্রপতি গাইয়ুমকে সরানোর পরিকল্পনা করেছিল। প্রথমত, মালদ্বীপের লুথিফি ও তার কিছু অনুসারী, যারা রাষ্ট্রপতিকে পছন্দ করতেন না। দ্বিতীয়ত, তামিল বিদ্রোহীরা। তারা চেয়েছিল মালদ্বীপে লুথিফিকে বসিয়ে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় অস্ত্র, মাদক ও চোরাচালানের ব্যবসা করবেন। প্লট নেতা উমা মাহেশ্বরান লুথিফিকে ক্ষমতার লোভ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতের তিন বাহিনীর সমন্বিত আক্রমণের মুখে পরাজিত হয়।
অপারেশন ক্যাকটাসে ভারতীয় কোনো সেনা প্রাণ হারাননি। কিন্তু বিদ্রোহীদের আক্রমণে মালদ্বীপের ১৯ জন নিহত হন। এদের মধ্যে ৮ জন ন্যাশনাল সিকিউরিটি সার্ভিসের সদস্য। এছাড়া ২৭ জন অপহৃত নাগরিকের মধ্যে ২০ জনকে ভারতীয় সেনারা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। বাকি ৭ জনের মধ্যে চার জনকে হত্যা করা হয়। আর ৩ জনের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এছাড়া অনেক বিদ্রোহী মারা যান এবং অনেকেই ধরা পড়েন।
অপারেশন ক্যাকটাস ভারতীয় সেনার ইতিহাসে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানের একটি৷ তবে এই অভিযান ভারতকে আঞ্চলিক প্রভাব সৃষ্টি এবং নিজেদের সামরিক শক্তির প্রমাণ দিতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। অভিযান ক্যাকটাস শেষ হলেও পরবর্তী একবছর সিক্স প্যারা ব্রিগেড মালদ্বীপ থেকে যায়। যাতে নতুন করে আবার এমন ঘটনার সৃষ্টি না হয়। ভারতের সহায়তায় ক্ষমতায় টিকে যাওয়ার পর আরো ২০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন মামুন আবদুল গাইয়ুম। সবশেষে ২০০৮ সালের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর মালদ্বীপের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে যান তিনি।