ইমোটিকন বা ইমোজি শব্দটি এসেছে জাপানি শব্দ ‘ই’ (ছবি) ও‘মোজি’ (অক্ষর)থেকে। এর আক্ষরিক অর্থ হলো চিত্রলিপি। এর থেকেই ইংরেজি সমার্থক শব্দ Emotion এবং Emoticon সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে ইন্টারনেটের জগতে আমাদের অনুভূতি প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হয়ে দেখা দিয়েছে এই ইমোটিকন। মনের ভাব প্রকাশের জন্য এখন আর একগাদা শব্দ বা বাক্য লেখার প্রয়োজন পড়ে না। শুধু একটি ইমোজি দিয়েই কথা সেরে ফেলা যায়।
প্রযুক্তিবিষয়ক ম্যাগাজিন ‘দ্য ভার্জ’ এর নিবন্ধ অনুসারে, ফেসবুক থেকে শুরু করে টুইটার, স্ন্যাপচ্যাটের ৮০ শতাংশেরও বেশি ব্যবহারকারী ইমোটিকন ব্যবহার করে। কিন্তু কিভাবে আসলো সহজে অনুভূতি প্রকাশের এই মাধ্যম? কিভাবে হলো এর প্রচলন? আর কে-ইবা আবিষ্কার করলো এটা?
পিটসবার্গের কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্কট ফাহলমান ১৯৮২ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বরতার কম্পিউটার বিজ্ঞানের বুলেটিন বোর্ডে এই ইলেকট্রনিক বার্তাটি পোস্ট করেছিলেন।
19-Sep-82 11:44 Scott E Fahlman : – )
From: Scott E Fahlman
I propose that the following character sequence for joke markers:
: – )
Read it sideways. Actually, it is probably more economical to mark
things that are NOT jokes, given current trends. For this, use
: – (
হ্যাঁ, এটাই ছিল প্রথম হাসিমুখে মুখোমুখি ব্যবহৃত কয়েকটি সাংকেতিক চিহ্ন, যা এখন ইমোটিকন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ফাহলমানের এই বার্তাটি কম্পিউটার বুলেটিন বোর্ডের ডাটা স্টোর থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। বছরখানেক আগে ব্যাকআপ টেপ থেকে উদ্ধার করার আগ পর্যন্ত এই বার্তাটি হারিয়ে গেছে বলে মনে করা হতো। ফাহলমানের সেদিন ব্যবহৃত তিনটি বিরাম চিহ্নের সংমিশ্রণের তাৎপর্য যে এতটা সুদূরপ্রসারী হবে তা কি কেউ আঁচ করতে পেরেছিল?
তবে ফাহলমানের এই বার্তা প্রেরণের আগেও অ্যামব্রোস বায়ারেস নামক এক ব্যক্তি ১৮৮৭ সালে একইরকম ধারণা দিয়েছিলেন। ‘ব্র্যাভিটি এবং ক্ল্যারিটি’ নামক একটি প্রবন্ধে অ্যামব্রোস ‘প্রথম বন্ধনী’ ব্যবহার করে লেখেন যা পরবর্তীতে ‘The Collected Works of Ambrose Bierce, Vol. XI: Antepenultimata (1912)’ বইটি থেকে নেয়া হয়।
ইমোটিকন সম্পর্কিত অজানা ১২টি তথ্য
১। ‘সোশ্যাল নিউরোসায়েন্স’-এর এক সাম্প্রতিক গবেষণা মতে, আপনার মস্তিষ্ক ইমোটিকনগুলোর প্রতি ঠিক এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যেন অপর প্রান্তের মানুষটি আপনার সামনেই বসে কথা বলছে আপনার সাথে।
২। প্রথম স্মাইলি প্রেরণ করা হয়েছিল ১৯৮২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টা ৪ মিনিটে।
৩। ইমোটিকন সম্বলিত প্রথম প্রেরিত সেইবার্তাটি কম্পিউটারের মেমরি থেকে হারিয়ে যাবার ২০ বছর পর উদ্ধার করা হয়।
৪। স্কট ফাহলমান ইমোটিকনের প্রথম ব্যবহারকারী এবং তিনিই ‘কোলন-ড্যাশ’ এর প্রচল করেন।
৫। মূলত কোনো বার্তা ‘গুরুতর নয়’ লেখার মাধ্যমে তা প্রকাশ করার জন্যই ইমোটিকনের পথচলা শুরু হয়।
৬। ইমোজি প্রথম জনপ্রিয়তা লাভ করে ২০১২ সালে। ২০১২ সালে অ্যাপল তাদের আইফোনে প্রথম ইমোজিব্যবহার করলে তা জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছায়।
৭। ২০১৪ সাল থেকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ইমোজির দাপট শুরু হয়।
৮। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে প্রথম ইমোজি ব্যবহার করে টুইটার।
৯। ২০১৩ সালে ‘ইমোজি’ শব্দটিকে তাদের অভিধানে স্থান দেয় অক্সফোর্ড ডিকশনারি।
১০। আমেরিকার বাস্কেটবল প্লেয়ার মাইকেল স্কট এবং পপ তারকা মাইলি সাইরাস প্রথম ইমোজির ট্যাটু এঁকেছিলেন তাদের শরীরে।
১১। কেবল ২০১৪ সালের জুন মাসেই ২৫০টি নতুন ইমোজির প্রচলন হয়।
১২। ইমোজি নিয়ে ইতোমধ্যে একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের সিনেমাও তৈরি হয়েছে।
১৯৬২ সালে ভিক্টর হুগো তার প্রকাশককে টেলিগ্রামে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন এটা জিজ্ঞাসা করার জন্য যে তার নতুন বই ‘লা মিজারেবল’ এর বিক্রি কেমন চলছে। তিনি চিঠিতে শুধুমাত্র একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন “?” দিয়েছিলেন। প্রকাশকও কম চতুর ছিলেন না। তিনিও বার্তার উত্তরস্বরূপ টেলিগ্রামে ভিক্টর হুগোর মতোই একটিমাত্র সাংকেতিক চিহ্ন পাঠান- “!”।
এ থেকে বোঝা যায়, ইমোটিকন প্রচলনের অনেক আগে থেকেই মানুষ তাদের অনুভূতির প্রকাশ সংক্ষেপে করার জন্য সংকেত ব্যবহার করতো। পছন্দ, ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা, হাহা, ওয়াও, দুঃখ আর রাগ এই সাতটি ইমোটিকন দিয়েই ফেসবুকের যেকোনো লেখা বা ছবিতে আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করা হয়।
২০১৪ সালে করা এক জরিপ থেকে জানা যায়, ইমোটিকন ব্যবহারকারীদের ৫৪ শতাংশই হুটহাট আবেগ প্রকাশ করতে ইমোটিকন ব্যবহার করে। গত জানুয়ারিতে সায়েন্স ডেইলি জানিয়েছে, অনলাইনে ৯০ শতাংশের বেশি ব্যবহারকারী প্রতি পাঁচ ঘণ্টায় একবার কোনো না কোনো ইমোটিকন ও ইমোজি ব্যবহার করে থাকেন।
প্রথমদিকের ইমোজি এনকোডিং
NTT DoCoMo এর আই-মোডে প্রতিটি ইমোজি ১২×১২ পিক্সেল গ্রিডে আঁকা থাকে। ট্রান্সমিট করা হলে চিহ্নগুলো দুই বাইট ক্রমানুযায়ী আসে-ইউনিকোড ক্যারেক্টার স্পেসে E63E থেকে E757 প্রাইভেটইউজ রেঞ্জের মধ্যে, আর শিফ্ট জেআইএস-এ F89F থেকে F9FC-এর মধ্যে। প্রাথমিকভাবে এতে ১৭০৬টি চিহ্ন আছে।কিন্তু যেসব ফোন C-HTML 4.0 সাপোর্ট করে, সেগুলোতে ৭৮টি বেশি যোগ করা যেতে পারে।
ইমোজির জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে যায় যে, আন্তর্জাতিক বাজার বিভিন্ন সংস্কৃতি-সম্পর্কিত ইমোজি যোগ করার জন্য ইউনিকোড স্ট্যান্ডার্ডকে চাপ দিতে থাকে। ইউনিকোড ৭.০-তে প্রায় ২৫০টি ইমোজি যোগ করা হয়, বেশিরভাগই ওয়েবডিংস ও উইনডিংস ফন্ট থেকে। জাপান, ইয়াহু ও এমএসএন মেসেঞ্জারের প্রাক-ইউনিকোড মেসেঞ্জার সিস্টেমের কিছু অক্ষরকে এখন ইমোজি হিসেবে গণ্য করা হয়। ইউনিকোড ৮.০-তে ক্রিকেট ব্যাটের মতো কিছু খেলার সরঞ্জাম, খাবার (ট্যাকো), রাশিচক্রের চিহ্ন, নতুন কিছু মুখভঙ্গি এবং উপাসনা-গৃহ ইত্যাদি নিয়ে মোট ৪১টি নতুন ইমোজি যোগ করা হয়।
সাংস্কৃতিক প্রভাব
অক্সফোর্ড ডিকশনারী ‘Face With Tears of Joy’-কে ২০১৫ ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অক্সফোর্ড এটাও উল্লেখ করেছে যে, ২০১৫ সালে বিশ্বে ‘ইমোজি’শব্দটির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে আর জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে এর বেশ প্রভাব দেখা যায়। SwiftKey লক্ষ্য করেছিল ‘Face With Tears of Joy’ ইমোজিটি বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইমোজি। মার্কিন উপভাষা সংস্থা তাদের ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার নির্বাচনের ভিত্তিতে এই ইমোটিকনটিকে ২০১৫ সালের ‘সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইমোজি’ হিসেবে ঘোষণা করে।
কিছু ইমোজি আছে যেগুলো সম্পূর্ণ জাপানি সংস্কৃতিনির্ভর; যেমন-জাপানি নতজানু সম্ভাষণ, মুখোশপরা মুখ, সাদা ফুল (‘অসাধারণ হোমওয়ার্ক’ অর্থে ব্যবহৃত) কিংবা জনপ্রিয় জাপানি খাবার: রামেন নুডল্স, ডাংগো, ওনিগিরি, জাপানি তরকারি আর সুশি। ইউনিকোড কনসর্টিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক ডেভিস ইমোজির ব্যবহারকে গঠনরত ভাষার সাথে তুলনা করেছেন। কিছু ভাষাবিদ ইমোজি ও ইমোটিকনকে ভাব প্রকাশের উৎকৃষ্ট মাধ্যম বলেছেন।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে প্রথম ইমোজিসম্বন্ধীয় এক কনফারেন্সে দেখা যায়, কিকা ইমোজি কিবোর্ড দিয়ে ৪২ কোটিরও বেশি ইমোজি পাঠানো হয়েছে এবং আবারও ‘Face With Tears of Joy’ ইমোজিটি সর্বাধিক জনপ্রিয় হিসেবে স্থান পায়। Heart এবং Heart Eyes ইমোজি দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করে। গবেষণায় এটাও দেখা গেছে, ফরাসিরা প্রেম-সম্বন্ধীয় ইমোজিগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে। যেসব দেশের মানুষের দেহে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের মাত্রা অনেক বেশি, সেখানকার মানুষ আনন্দের ইমোজিগুলো বেশি ব্যবহার করছে; যেমন-অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স এবং চেক প্রজাতন্ত্র। কিন্তু মেক্সিকো, কলম্বিয়া, চিলি ও আর্জেন্টিনার মতো দেশগুলো রক্ষণশীল সংস্কৃতির অধিকারী। তাই এখানে দুঃখবাচক ইমোজির চল বেশি।
ইমোজিকে এখন অনেকে পূর্ণাঙ্গ ভাষা হিসেবে গণ্য করছেন। এমনকি আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনা চলছে যে, আদালতে একে গ্রহণযোগ্য করা যায় কিনা। এছাড়াওইমোজি ‘চিহ্নের ভাষা’ হিসেবে পরিণত হওয়ার সাথে সাথে ইমোজির ‘উপভাষা’ তৈরির প্রবণতাও দেখা দিচ্ছে। এজন্য ইমোজি ব্যবহারের সংজ্ঞা দিন দিন বদলাচ্ছে।