মানুষের যতগুলো অনুভূতি আছে তার একটি প্রতিশোধের অনুভূতি। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, তা সুস্থ মস্তিষ্কের ভাবনার বাইরে। ইতিহাসের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে প্রতিশোধ। কখনো অর্থ, কখনো রাজ্য, কখনো নারী, কখনো বা সম্মানের দাবিতে আদায় করা এই প্রতিশোধ ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছে।
৬. জুলিয়াস সিজার
প্রচলিত আছে, জুলিয়াস সিজারের বয়স যখন ২৫, সাগরে ভাসমান জাহাজ থেকে এক জলদস্যুর দল তাকে অপহরণ করে নেয়। প্রথমে তারা আটক সিজারের কাছে ২০ ট্যালেন্ট (রৌপ্যখণ্ড) মুক্তিপণ দাবি করে। কিন্তু জুলিয়াস সিজার নিজের মুক্তিপণ হিসেবে এত কম রূপা দিতে অপমানবোধ করছিল। সে দস্যুদলকে তাদের মুক্তিপণ বাড়িয়ে নিতে বলে। দস্যুদল সানন্দে তাদের দাবিকে ২০ ট্যালেন্ট থেকে ৫০ ট্যালেন্টে নিয়ে যায়। সিজারের সহকারীরা মুক্তিপণ পরিশোধ করে সিজারকে মুক্ত করে নিয়ে যায়। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার আগে সিজার জলদস্যুদের খুঁজে বের করে ক্রুশবিদ্ধ করার হুমকি দিয়ে রেখে গেলেন। এরপর শুরু হল সিজারের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রস্তুতি। ছোটখাটো সৈন্যবাহিনী তৈরি করে তিনি পৌঁছালেন জলদস্যুদের দ্বীপে। নিজেদের দুর্ভাগ্যক্রমে দস্যুরা সিজারের কথা উপহাস করে উড়িয়ে দিয়েছিল। ফলাফল, সবাইকে একে একে ক্রুশবদ্ধ করে নিজের অর্থ আর অঙ্গীকার দুটোই রক্ষা করলেন তরুণ জুলিয়াস সিজার!
৫. প্রথম পিটার
মধ্যযুগে রাষ্ট্রগুলোর ভেতর একের পর এক সম্পর্ক বদলের দোলাচলে যুদ্ধ লেগেই থাকত! এসব থেকে রক্ষা পেতে ১৩৪০ সালে পর্তুগালের রাজা চতুর্থ আলফানসো নিজের ছেলে প্রথম পিটারকে ভিয়েনার রাজকুমার জোয়ান ম্যান্যুয়েলের মেয়ে কসটানযার সাথে বিয়ে দিয়ে সম্পর্ক ভালো করার বন্দোবস্ত করে ফেললেন। কসটানযার সাথে অনেক অনেক উপহারের ভেতর এলো তার পরিচারিকা ইনেস ডি ক্যাস্ট্রো। আর রাজকুমার পিটার প্রেমে পড়লেন তার। ১৩৪৫ সালে কসটানযা মারা যাওয়ার পরও যখন পিটার ইনেস ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিলেন না, তখন ক্ষেপে গেলেন রাজা আলফানসো। তিনি রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিলেন ইনেসকে। কিন্তু পিটারের পণ, ইনেসকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবেন না। এবার রাজা আরো কঠোর হলেন, ১৩৫৫ সালে ইনেসকে মারতে তিনজন ঘাতক পাঠালেন তিনি। তারা ইনেসকে শিরশ্ছেদ করে হত্যা করল। রাগে দুঃখে বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসলেন পিটার। কিন্তু পরাজিত হয়ে মুখ বন্ধ রাখতে হল তাকে বাধ্য হয়েই! কিন্তু পিটারের দিনও ফিরছিল। আলফানসো মারা গেলেন ১৩৫৭ সালে। সিংহাসনে বসেই খুঁজে বের করলেন ইনেসের হত্যাকারীদের, তারপর তাদের জনসম্মুখে এনে বিচার আর শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। শাস্তিস্বরূপ পিটার খালি হাতে তাদের বুক চিরে হৃদপিণ্ড বের করে এনেছিলেন।
৪. এনরিকো ডান্ডালো
দ্বাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পূর্ব ইউরোপে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল একমাত্র পরাশক্তি। ভেনিস ১১৭১ সাল পর্যন্ত মোটামুটি নিরাপদেই ছিল। কিন্তু বাইজান্টাইন শাসকদের ইচ্ছা হলো ভেনিসবাসীর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করবে। এই সিদ্ধান্তের পর ভেনিস থেকে প্রতিনিধি হিসেবে ৬০ বছরের এনরিকো ডান্ডালোকে বাইজান্টাইনদের কাছে পাঠানো হল। তিনি সমঝোতা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লাভ হলো না। উল্টো এনরিকোর চোখ অন্ধ করে দিয়ে তাকে নিয়ে অনেক ধরনের মজা করা হলো। দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর এনরিকো ভেনিসীয় সেনাবহর নিয়ে কনস্টান্টিপোল পৌঁছালেন। রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের পর এই শহরের পতন ঘটে তারই নেতৃত্বে। এনরিকো প্রতিশোধ সম্পন্ন করলেন দৃষ্টিশক্তিহীন অবস্থায় ৯০ বছর বয়সে!
৩. পিয়েরে পিকাড
পিয়েরে পিকাড ছিলেন ফ্রান্সের একজন স্বচ্ছল জুতা নির্মাতা। সুখেই দিন কাটছিল তার, শীঘ্রই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল প্রেমিকার সাথে। কিন্তু বাদ সাধল নিয়তি। পিকাডের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের তিনজন দিনে দিনে ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, এদের ভেতর একজন, লুপিয়ান চাইতো পিকাডের প্রেমিকাকে বিয়ে করতে। এই তিন ঈর্ষাকাতর বন্ধু পরিকল্পনা করে স্বর্ণ চুরি ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে জেলে পাঠালো পিকাডকে। জেলের ভেতর পিকাডের বন্ধুত্ব হয় এক পাদ্রীর সাথে, যে মৃত্যুর আগে সব সম্পত্তি পিকাডকে দিয়ে যায়। জেল থেকে বের হওয়ার পর পাদ্রীর সম্পত্তি নিয়ে আগের চেয়েও বেশি স্বচ্ছল হয়ে ওঠেন তিনি। বদলে ফেলেন নিজের নাম। তারপর এক দশক ধরে শুধু এই তিন বন্ধুকে কীভাবে শাস্তি দেবেন সেই পরিকল্পনা করে কাটান। প্রথম দুই বন্ধুকে সাধারণভাবে হত্যা করলেও সবচেয়ে বড় শাস্তি অপেক্ষা করছিল লুপিয়ানের জন্য, যে পিকাডের হবু বউকে নিয়ে সংসার পেতেছে এতদিনে। প্রথমে পিকাড লুপিয়ানের মেয়েকে প্ররোচিত করলেন এক লম্পটকে বিয়ে করতে। বিয়ের পর সেই লম্পটকে জেলে পাঠালেন তিনি। শোকে-দুঃখে মারা গেলো লুপিয়ানের মেয়ে। এরপর লুপিয়ানের ছেলেকে প্ররোচিত করলেন সোনা চুরি করতে, সেই একই কাজ, যার অভিযোগে পিকাডের বন্ধুরা জেলে পাঠিয়েছিল তাকে। জেলে গেলো লুপিয়ানের ছেলেও। লুপিয়ানের রেস্তোরাঁ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলেন পিকাড। ছোরা দিয়ে পাগলপ্রায় লুপিয়ানকে খুন করে তিনি নিজের প্রতিশোধ শেষ করলেন। গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু পিকাডের চতুর্থ একজন বন্ধু ছিল। সে লুপিয়ানদের এই দুরভিসন্ধির কথা আগে থেকে জানলেও পুলিশকে কিছুই জানায়নি। পিকাডের একের পর এক প্রতিশোধে সে ভয় পেয়ে গেল। ভাবলো, তাকেও হয়তো শাস্তি দেবে পিকাড। তাই পিকাড কিছু করার আগেই নিজেই পিকাডকে খুন করে ফেলল সে। আর এই ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের গল্প বেরিয়ে আসে তার মৃত্যুশয্যায়, যখন পাদ্রীর কাছে সে জীবনের সব পাপ স্বীকার করে নিচ্ছিল।
২. চেঙ্গিস খান
খোয়ারিজমি সাম্রাজ্যের নাম শুনেছেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তর আসবে ‘না’। এতটাই প্রবল ছিল চেঙ্গিস খানের প্রতিশোধ, যে ইতিহাসের পাতাতেও খুব কমই জায়গা নিতে পেরেছে এই সাম্রাজ্য! ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের সাথে একই জায়গায় একটি সীমান্ত ছিল খোয়ারিজমি সাম্রাজ্যের। বেশিরভাগ মানুষই অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী, দিগ্বিজয়ী মঙ্গোলদের এত কাছাকাছি থাকাকে অশুভ বলে দেখত। তাই চেঙ্গিস খান যখন ৫০০ মানুষের ক্যারাভান খোয়ারিজমিদের কাছে পাঠালেন, খোয়ারিজমিদের শাহ্ এই উপহারকে সহজভাবে নেননি। তিনি ৫০০ জনকেই গ্রেফতার করলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, চেঙ্গিস খানের কোনো দুরভিসন্ধি ছিল না। তিনি বাণিজ্য আর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ঠিক রাখতেই এমন করেছিলেন। চেঙ্গিস খান শাহ্কে নিজের ভুল বোঝাতে দুজন মঙ্গোল ও একজন মুসলিম দূত প্রেরণ করলেন। কিন্তু শাহ্ এবারও খারাপ প্রত্যুত্তর দিলেন। মঙ্গোল দুজনের মাথা টাক করে, মুসলমান দূতের শিরশ্ছেদ করলেন। তার এই প্রত্যুত্তর দেওয়ার ধরন দেখে দিগ্বিজয়ী চেঙ্গিস একটি পুরো সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বিলীন করে দিলেন দু’বছরেরও কম সময়ে!
১. ৪৭ রোনিন
১৭০১ সালে দুই সামন্তপ্রভু আসানো নাগানোরি ও ক্যামেই কোরেচিকা এডো প্রাসাদে সম্রাটের দূতের আগমন উপলক্ষে বিভিন্ন আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন। তাদের সাথে ছিল তাদের সামুরাই বাহিনী। তাদের দরবারের নিয়মকানুন, আদবকায়দা শেখানোর জন্য সেখানে উপস্থিত ছিল সম্রাটের কর্মকর্তা কিরা ইয়োশিনাকা। কিরা আসানোকে তিরস্কার করতে লাগলেন, অপমান করতে লাগলেন বিভিন্নভাবে, যতক্ষণ না তাকে ঘুষ দেওয়া হলো। কিন্তু নিজের এই অপমান মেনে নিতে পারেননি আসানো। ছোরা দিয়ে আঘাত করলেন কিরাকে। যদিও আঘাত এমন কিছু গুরুতর ছিল না, তবে এই আঘাত এডো প্রাসাদের নিয়মের বহির্ভূত ছিল। শাস্তি হিসেবে আসানোর কপালে জুটলো সেপ্পুকু (প্রথাগতভাবে আত্মহত্যা করা)। তার সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে, তার পরিবারকে নিঃস্ব করে দেওয়া হল। তার অনুসারীদের করা হল রোনিন (দলপতিহীন)। রোনিনদের ৪৭ জন গোপন এক প্রতিজ্ঞা করল, পরিণাম মৃত্যু হলেও আসানোর প্রতি হওয়া এই অন্যায়ের প্রতিশোধ তারা নেবে। কিরা আর তার লোকেদের নিরাপদ অনুভব করাতে দু’বছর ধরে তারা সামুরাইয়ের সকল নিয়মকানুন ছেড়ে ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরল। তারপর এক রাতে কিরার বাসভবন আক্রমণ করল ৪৭ রোনিন। কিরার শিরচ্ছেদ করে তারা সেই মাথা আসানোর কবর দেওয়া মন্দিরে অঞ্জলি দিল। তারপর সবাই মিলে আত্মসমর্পন করল। ৪৬ জনকে সেপ্পুকু আর একজনকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। ৪৭ রোনিনের প্রতিশোধের এই গল্প থেকে তৈরি হয়েছে অনেক চলচ্চিত্র।
ফিচার ইমেজ- Wallpaper Abyss