মার্কো পোলো: প্রাচ্যকে পাশ্চাত্যের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন যিনি

পৃথিবী সম্বন্ধে মানুষের ধারণা সবসময় একরকম ছিল না। বর্তমান সময়ে পুরো পৃথিবীটাই আপনার হাতের মুঠোয়। আপনি চাইলেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেকোনো দেশ সম্পর্কে ঘরে বসেই জানতে পারেন। বাংলাদেশের কোনো এক ছোট শহরে বা গ্রামে বসেই আপনি আফ্রিকার কোনো দেশের ভূগোল, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা সম্পর্কে জানতে পারেন। এমনকি আটলান্টিক মহাসাগর বা প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট কোনো দ্বীপ সম্পর্কেও জানতে চাওয়াটা খুব কঠিন কিছুই নয়।

কিন্তু একসময় ইউরোপের মানুষ ভারত (উপমহাদেশ) সম্পর্কে খুব বেশি জানত না বা চীনের মানুষ ভারত সম্পর্কে খুব বেশি জানত না। ভারতের মানুষও অন্যান্য দেশ সম্পর্কে খুব বেশি জানত না। আসলে মানুষ তার বসবাসের জায়গা ও আশেপাশের যতটুকু জানত, তাকেই পুরো পৃথিবী মনে করত।

তখন পর্যটক ও অভিযাত্রীরা পৃথিবীকে জানার স্পৃহা থেকে বেরিয়ে পড়তেন, পাড়ি জমাতেন অজানার উদ্দেশে। বণিকরাও ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে অন্যত্র যেত। বংশানুক্রমে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করত, তাদেরই কেউ কেউ দল বেঁধে বেরিয়ে পড়তো দেশের বাইরে রোজগারের চেষ্টায়। পর্যটক ও ব্যবসায়ীরাই নিয়ে আসত দূর-দেশান্তরের শিল্পকলা, সংস্কৃতি, ধন-সম্পত্তি, আচার-ব্যবহারের খবরাখবর।

মার্কো পোলো; Image source: National Geographic

এমনই এক সাহসী ও সম্ভ্রান্ত পরিবার ছিল ভেনিসের (ইতালির উত্তর পূর্বাঞ্চলের একটি উপকূলীয় শহর) পোলো পরিবার। সে পরিবারেই ১২৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সাহসী পর্যটক, অভিযাত্রী ও বণিক মার্কো পোলো। তিনি ১২৭১ থেকে ১২৯৫ সাল পর্যন্ত ইউরোপ থেকে সিল্ক রোডে এশিয়া ভ্রমণ করেন। এবং তার এই ভ্রমণকাহিনী নিয়ে পরবর্তীতে তিনি একটি বই লেখেন, যা ইংরেজিতে ‘দ্য ট্রাভেলস অভ মার্কো পোলো’ নামে অধিক পরিচিত । মার্কো পোলো প্রথম ইউরোপীয় ছিলেন না, যিনি প্রাচ্য ভ্রমণ করেন; কিন্তু, তিনি প্রথম ইউরোপীয় ছিলেন, যিনি প্রাচ্যকে পাশ্চাত্যের কাছে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন। এর আগে দূরপ্রাচ্য বা চীন সম্পর্কে ইউরোপের মানুষ খুব বেশি জানত না।

তখন ১২৯৮ সাল, ইতালির উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় শহর ভেনিসের সাথে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর জেনোয়ার তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই এই দুই শহরের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল।

ভেনিস ও জেনোয়ার মধ্যে তুমুল যুদ্ধে ভেনিসের পক্ষে একটি যুদ্ধজাহাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মার্কো পোলো; Image source: heritage-history.com

 

এ যুদ্ধে ভূমধ্যসাগরে ভেনিসের পক্ষে একটি যুদ্ধজাহাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মার্কো পোলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মার্কোর জাহাজটি জেনোয়ার সৈন্যবাহিনীর কাছে ধরা পড়ে এবং মার্কো পোলোকে জেনোয়ার কারাগারে পাঠানো হয়। এ কারাগারেই বন্দি ছিলেন রাস্টিশিয়ানো, পিসা শহরের এক পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি কয়েক বছর আগে জেনোয়া ও পিসার (ইতালির একটি শহর) মধ্যে যুদ্ধে বন্দি হয়েছিলেন। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হতে বেশি দিন লাগেনি। দুজনে প্রায়ই একত্রে বসে গল্পগুজব করতেন।

কথায় কথায় একদিন মার্কো তার চীন ভ্রমণের কথা, চীনে তার অভিজ্ঞতার কথা বন্ধুকে বললেন। রাস্টিসিয়ানো মার্কো পোলোকে এই ভ্রমণকাহিনী লিখতে বললেন। কিন্তু মার্কো খুব বেশি লেখালেখি করতে পারতেন না। অপরদিকে রাস্টিসিয়ানো ছিলেন লেখক মানুষ। তাই দুজনে এই ভ্রমণকাহিনী লিখতে সম্মত হলেন। মার্কো বলে যেতেন, আর রাস্টিশিয়ানো লিখে যেতেন। এভাবেই শুরু হয়ে গেল এক বিচিত্র ভ্রমণকাহিনী লেখা।

১২৬০ সাল, তখন ইউরোপ ও এশিয়ার বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কনস্টান্টিনোপল, যা বর্তমান তুরস্কের বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুল।

পৃথিবীর বহু দেশ থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে এসে নানা জিনিস নিয়ে জমায়েৎ হতো, বেচা-কেনা করত। তখন দুই ভেনেশিয়ান বণিক নিকোলো পোলো ও মেফিয়ো পোলো নামে দুই মুক্তা ব্যবসায়ী ভাই কনস্টান্টিনোপলে ব্যবসার জন্য আসেন। দুর্ভাগ্যবশত তখন কনস্টান্টিনোপলে মুক্তার ব্যবসায় ব্যাপক মন্দা চলছিল, মুক্তার দাম পাওয়া যাচ্ছিল না। তারা ভাবলেন, কম দামে মুক্তা বিক্রি করা বোকামি হবে।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর কনস্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) শহর; image source: pinterest.com

পোলোরা এবার আরো পূর্বদিকে মধ্য এশিয়ায় মুক্তা বিক্রির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। মধ্য এশিয়ার ভোলগা নদীর মোহনায় তখন ছিল চেঙ্গিস খানের নাতি বারকা খানের রাজত্ব। বারকা খান ছিলেন এই অঞ্চলের সর্বময় কর্তা এবং মূল্যবান মণি-মাণিক্যের বিখ্যাত খরিদ্দার। পছন্দসই জিনিস পেলে যেকোনো দামে তিনি কিনতেন। পোলোরা কনস্টান্টিনোপল থেকে বারকা খাঁর দরবারে হাজির হলেন। বারকা খানের কাছে পোলোরা ভালো দামেই জিনিসপত্র বিক্রি করে নানা উপহারসামগ্রী নিয়ে যখন ফিরে আসছেন, তখন পথে এসে দেখলেন এক বিরাট বিপদ!

বারকা খানের সঙ্গে পারস্যের শাসনকর্তা আলু খানের ঘোরতর লড়াই শুরু হয়েছে। এ অঞ্চলের শাসনকর্তাদের সবাই প্রধানত মঙ্গোল বংশের হলেও তারা ছিলেন বিভিন্ন ছোট-বড় রাজ্যের স্বায়ত্তশাসিত অধিপতি। নিজেদের রাজ্য বিস্তারের জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রায়ই যুদ্ধে লিপ্ত হতেন তারা। নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে তারা মঙ্গোল সাম্রাজ্যের অধীনে স্বায়ত্তশাসন লাভ করতেন। এই রাজ্যগুলোর সর্বময় কর্তা ছিলেন মঙ্গোল অধিপতি সম্রাট কুবলাই খান।

কুবলাই খান তৎকালীন পৃথিবীর বৃহত্তম সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। এদিকে বারকা খান ও আলু খানের মধ্যে যুদ্ধের ফলে পোলোদের ঘরে ফেরার আশা ত্যাগ করতে হলো। এ অবস্থায় তারা অবশিষ্ট মালপত্র নিয়ে কুবলাই খানের মূল রাজ্যের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এ সময় আলু খানের এক প্রতিনিধি কুবলাই খানের দরবারে যাচ্ছিলেন। যাত্রাপথে এই প্রতিনিধির পোলোদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। পোলোদের ব্যক্তিত্ব ও ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাদের অনুরোধে পথ দেখিয়ে কুবলাই খানের দরবারে হাজির করেন ।

সম্রাট কুবলাই খান; Image source: BBC

 

কুবলাই খান প্রথম কোনো ইউরোপীয় ও খ্রিস্টান ব্যক্তি দেখে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তাদের স্বাগত জানান। সম্রাট ইউরোপ ও খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কে জানতে পোলোদের বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। পোলোরা সব প্রশ্নের উত্তর এত সুন্দর ও পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিতে থাকেন যে সম্রাট তাদের প্রতি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি বহুদিন থেকেই খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে দারুণ আগ্রহী ছিলেন। পোলোরা ছিল ব্যবসায়ী মানুষ, ধর্ম সম্পর্কে খুব বেশি জানতেন না। তাই সম্রাট পোলোদের নিজের প্রতিনিধি করে ইউরোপে পাঠান। পোপের কাছে এক চিঠির মাধ্যমে সম্রাট ১০০ জন পাদ্রী পাঠাতে অনুরোধ করেন, সেই সাথে যিশুর সমাধিতে যে প্রদীপ জ্বলে, সে প্রদীপের তেল আনতে অনুরোধ করেন।

এরপর একদিন সম্রাটের আদেশ শিরোধার্য করে তারা রোম ও জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন পোলো ভ্রাতৃদ্বয়। নানা জলপথ ও স্থলপথ পেরিয়ে নানা প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে প্রায় তিন বছর পর তারা প্যালেস্টাইনের একার বন্দরে এসে পৌঁছেন। কিন্তু প্যালেস্টাইনে এসে বিশেষ সুবিধা হলো না ।

১২৬৮ সাল, খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ চতুর্থ ক্লেমেন্ট ইতোমধ্যে দেহত্যাগ করেছেন। নতুন পোপ এখনও নির্বাচিত হননি। পোপ নির্বাচন নিয়ে ধর্মগুরুদের মধ্যে একপ্রকার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। নতুন পোপ নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত সম্রাটের বক্তব্য সম্বন্ধে কিছুই ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়।

পোপ চতুর্থ ক্লেমেন্ট (১২৬৫-১২৬৮); Image source: Papal Artifacts

 

পোলোরা অত্যন্ত মর্মাহত হলেন, তবে এই ভেবে সান্ত্বনা পেলেন যে, এ সুযোগে তারা তাদের পরিবারের সাথে দেখা করতে পারবেন। তারা এবার ভেনিসের দিকে যাত্রা করলেন। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তারা বাড়ির বাইরে। অবশ্য তখনকার এই ব্যবসায়ীরা গৃহ-সংসারের মায়া ত্যাগ করেই দেশান্তরী হতো। কিন্তু তবুও বাড়ির দিকে মন পড়ে থাকত সবার। সবাই চাইত, মোটা অঙ্কের অর্থ রোজগার করে একেবারে ঘরে গিয়ে বসবে, যাতে পরবর্তী জীবন কিছু না করলেও স্ত্রী-সন্তানসহ স্বাচ্ছন্দ্যে চলে যেতে পারে ।

এবার বন্দর একার থেকে জাহাজে চড়ে দুই ভাই দীর্ঘদিন পর ভেনিসের বন্দরে এসে পৌঁছেন। কিন্তু ততদিনে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। এ সময়ের মধ্যে নিকোলোর স্ত্রী দেহত্যাগ করেছেন। তার সন্তান মার্কো পনের-ষোলো বছরের কিশোরে পরিণত হয়েছে। মায়ের মৃত্যুর পর আত্মীয়রা মার্কোকে লালন পালন করে। দীর্ঘদিন পরে মাতৃহীন কিশোর মার্কো নিজের বাবা-চাচাকে কাছে পেয়ে এতই অনুরক্ত হয়ে ওঠে যে কিছুতেই তাদের কাছছাড়া হতে চায় না। সবটা সময় এ দুজনের সাথে মিশে থাকে।

তাদেরকে একের পর এক প্রশ্ন করে যেতে থাকে। তারা কোথায় কোথায় গিয়েছিল, কী কী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, যেখানে গিয়েছিল সেখানকার মানুষ কেমন, তাদের ভাষা কেমন, তাদের সংস্কৃতি কেমন- এমন সব প্রশ্ন দিনরাত করতে থাকে মার্কো। নিকোলো ও মেফিয়ো-ও প্রশ্নগুলোর উত্তর সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতেন তাকে। আর এসব গল্প শুনে ক্রমেই মার্কো বিদেশ সম্পর্কে আকৃষ্ট হতে থাকে। সুদূর সমুদ্রযাত্রার কথা, প্রাচ্যের পথঘাট, পাহাড় পর্বতের কথা, বিচিত্র দেশ দেশান্তরের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার গল্প শুনে মার্কো যেন অন্য এক জগতে হারিয়ে যেতে থাকে।

দেখতে দেখতে ভেনিসে পোলোদের প্রায় দু’বছর কেটে গেল। নিকোলো ও মেফিয়ো দুজনেই ঠিক করলেন, আর দেরি করা উচিত হবে না; সম্রাট হয়তো অসন্তুষ্ট হবেন আর ইতোমধ্যেই হয়তো নতুন পোপ নির্বাচিত হয়ে গেছেন। তারা আবার যাত্রা শুরু করলেন। তবে এখন তারা শুধু দুই ভাই নন, তাদের সাথে মার্কোও রয়েছে। মাতৃহীন সন্তানকে ছেড়ে যেতে চাইলেন না তারা, এছাড়া মার্কোও এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে। মার্কোকে নিয়েই যাত্রা শুরু হলো। প্রথমেই তাদের সম্রাটের আদেশমতো যেতে হবে পোপের প্রতিনিধির কাছে এবং তারপর আনতে হবে জেরুজালেমে যিশুর সমাধিপ্রদীপের তেল। যে করেই হোক, এই দুটি জিনিসের ব্যবস্থা না করে গেলে তারা কুবলাই খানের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না।

ভেনিস থেকে একার বন্দরে এসে তাদের জাহাজ ভিড়ল। এখানে এসে শুনলেন, এখনো নতুন পোপ নির্বাচিত হননি। জেরুজালেমে এসে একজন ধর্মগুরুর সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়। তিনি যিশুর সমাধিপ্রদীপ থেকে তেল নেওয়ার অনুমতি তো দিলেন, কিন্তু পোপের আদেশ ব্যতিরেকে তিনি ১০০ জন পাদ্রী তাদের সাথে পাঠাতে পারবেন না। তাই শুধু প্রদীপের তেল নিয়ে পাদ্রী ছাড়াই রাজদরবারের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। অনেকটা পথ যখন চলে এসেছেন, তখন তাদের কাছে এক সুসংবাদ গেল। যে ধর্মগুরু তাদের যিশুর সমাধির তেল নিতে অনুমতি দিয়েছিলেন, তিনিই নতুন পোপ নির্বাচিত হয়েছেন এবং ‘দশম গ্রেগরি’ নাম গ্রহণ করে রোমের পোপ হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন ।

পোপ দশম গ্রেগরি (১২৭১-১২৭৬); Image source: geni.com

নতুন পোপ নির্বাচনের খবর পেয়ে পোলোরা অত্যন্ত খুশি হলেন। তবে, নতুন পোপ দশম গ্রেগরি তাদের ১০০ পাদ্রীর পরিবর্তে মাত্র দুজন ধর্ম প্রচারক পাঠালেন। কিন্তু এবার হলো আরেক সমস্যা। পোপ যে পাদ্রীদের পাঠিয়েছেন, তারা অত্যন্ত ভীতু। তারা মঙ্গোল সম্রাটের দরবারে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। কোন অচেনা দেশে যাচ্ছেন তারা, কেমন লোক কুবলাই খান, তাদের শূলে ছড়াবেন নাকি জীবন্ত দগ্ধ করবেন- এমন দুশ্চিন্তাতেই তারা আধমরা হয়ে গেলেন। মার্কো ভাবলেন, এরা এত ধর্মবিশ্বাসী, অথচ এত ভয়! এবার মার্কো যাজকদের সাথে বসে গল্পগুজব করতে করতে তাদের মনে সাহস দিতে চাইলেন। মার্কো বললেন, যার মনে ঈশ্বরের ভয় আছে, সে অন্য কিছুকে ভয় করে না। কুবলাই খানের যে গুণগান তিনি তার বাবা-চাচার থেকে শুনেছিলেন, তা তিনি যাজকদের বললেন। যাজকরা মনে কিছুটা সাহস পেলেন।

পোলোরা এবার ককেশাস অঞ্চলের দিকে যাচ্ছেন। ককেশাসের পাদদেশে, বর্তমান আর্মেনিয়ায় এসে তারা কিছুদিনের জন্য তাঁবু স্থাপন করলেন। কয়েকটি ঘোড়া, মাল বইবার জন্য কয়েকটি গাধা, আরো কিছু জিনিস কেনাকাটা করতে হবে। এরই মাঝে আবার এক বিপত্তি ঘটল। চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ল, ব্যাবিলনের রাজা সিরিয়ার অনেকাংশ দখল করে আর্মেনিয়া আক্রমণ করেছেন এবং তিনি অত্যন্ত খ্রিস্টান বিদ্বেষী। এ খবর শুনে দুই যাজকের অবস্থা আরো খারাপ! তারা সুযোগ বুঝে এখান থেকে পালিয়ে গেলেন। পোলোরা এবার পাদ্রীদের ছাড়াই কুবলাই খানের দরবারে যাওয়ার কথা ভাবলেন ।

মার্কো পোলোর ২৪ বছরের (১২৭১-১২৯৫) ভ্রমণপথ; Image source: Britannica

আর্মেনিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে কুর্দিস্থান অবস্থিত। কুর্দিস্থানের দুর্গম পাহাড় পর্বতের পথ পেরিয়ে পারস্যের দিকে আসতে হবে। কুর্দিস্থানের সংকীর্ণ পর্বতের পথ দিয়ে আসার সময় তাদের দলের সাত-আটজন একেবারে ঘোড়া-গাধা সহ কয়েকশো ফুট নিচে পড়ে প্রাণ হারায়। এদিকে আবার পারস্যের কেরমান শহরে আসার পথে তাদের দল দস্যুদের কবলে পড়ে। কয়েকজনের প্রাণহানীসহ বহু মূল্যবান জিনিসপত্র তাদের হারাতে হয়। পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী বন্দর আব্বাসে তখন উট ও নানা পশুর বিরাট হাট-বসত। এখানে থেকে কয়েকটি উট ও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে তারা মরুভূমির পথে চীনের দিকে যাত্রা শুরু করলেন।

মরুভূমির অত্যন্ত গরম আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে শুষ্ক-রুক্ষ বালুর উঁচু নিচু পথ ভেঙে চলল মার্কোদের দল। পারস্যের মরুভূমির পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে চলছেন তারা। পথিমধ্যে তারা আবার দস্যুদের কবলে পড়েন। এবার বড় ক্ষতি হয়েছে, দলের অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের বিশ্বস্ত পরিচারক কুল্লাউ নিখোঁজ হয়েছেন। মার্কো এবং তার বাবা ও চাচা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন। আরো যে কয়েকজন বেঁচে ছিল, তাদের নিয়েই আবার যাত্রা শুরু হলো ।

দলবলসহ পোলোদের চীন যাত্রা; Image source: Britannica

এবার তাদের খোরাসান ও নিশাপুরের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের উত্তর সীমানা পেরিয়ে যেতে হবে। হিন্দুকুশ ও কারাকোরাম পর্বতমালার উপর দিয়ে পৃথিবীর ছাদ খ্যাত পামীর মালভূমি, খাশগর ও ইয়ারখন্দ প্রভৃতি ছোট-বড় হরেক রকমের শহর, গ্রাম, পর্বত, মরু ও নদনদী পেরিয়ে যেতে হবে। মাঝেমধ্যে কয়েকদিন বিশ্রাম, আবার অবিরাম পথচলা। অসাধারণ কষ্ট-সহিষ্ণুতা, মানসিক বল ও ধৈর্য ছাড়া এসব দুর্গম ও বিপদসংকুল পথযাত্রা মোটেই সম্ভব নয়। এভাবেই নানা বিপদ আর বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে চলছে তাদের অভিযাত্রা ।

অবশেষে দীর্ঘ মরুপথ ও পর্বতমালার নানা জটিল পথ অতিক্রম করে নানা জায়গার নানা জলবায়ুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে তারা বর্তমানে উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত জিনজিয়াং প্রদেশে এসে পৌঁছেন। তারপর গোবি মরুভূমি পেরিয়ে কয়েকমাস পর কুবলাই খানের খাশ রাজ্যের সীমান্তে এসে পৌঁছেন ।

দুর্গম হিন্দুকুশ, কারাকোরাম ও পামীর মালভূমি অতিক্রম করে চীনের মূলভূখন্ডে গোবি মরুভূমিতে প্রবেশ করে পোলোরা ; Image source: whatshowto.com

কিন্তু তারা এই দীর্ঘ ও দুর্গম যাত্রায় অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আবার সীমান্তরক্ষীরা তাদের সম্রাটের অনুমতি ছাড়া রাজ্যে প্রবেশে বাধা দিচ্ছিল। সম্রাটের আমন্ত্রণেই তারা যাচ্ছে বললেও রক্ষীরা তা মানতে নারাজ। সীমান্তরক্ষীরা পোলোদের সমস্ত বর্ণনা দিয়ে সম্রাটের কাছে লোক পাঠাল। তারা ক্লান্ত শরীরে এখানে কিছুদিন বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পেলেন। নানা কারণে এখানেই তাদের প্রায় এক বছর থাকতে হলো। এ সময় মার্কো প্রায়ই স্থানীয়দের সাথে মিশে তাদের ভাষা, আচার আচরণ, সংস্কৃতি আয়ত্ত করতে লাগলেন। মেধাবী মার্কো অল্পদিনেই অনেক কিছু শিখে নিতে সক্ষম হন।

ইতিমধ্যে সম্রাটের কাছ থেকে ছাড়পত্র এসে পৌঁছল তাদের কাছে। সম্রাট তাদের সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পথকষ্ট ও অনাবশ্যক দেরির জন্য আন্তরিক সমবেদনা জানিয়ে তাদের জন্য লোকবল ও খাদ্যাদির ব্যবস্থা করে পাঠিয়েছেন সম্রাট। এভাবে কয়েক সপ্তাহ চলার পর তাদের অবিশ্রাম চলার অবসান হলো। সম্রাটের প্রাসাদে এসে পৌঁছলেন তারা। সবাই পথকষ্ট ভুলে গিয়ে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। মার্কো, নিকোলো ও মেফিয়ো সম্রাটের জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদের দিকে এগিয়ে চলছেন।

বিরাট আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানানো হলো। সম্রাটের সামনে কীভাবে থাকতে হবে, তা আগেই মার্কোকে জানিয়ে দিয়েছেন নিকোলো। তিনজনেই মাথা নিচু করে সম্রাটের দরবারে উপস্থিত হলেন। এখানেই সভাসদসহ বসে আছেন বিশাল মঙ্গোল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর কুবলাই খাঁ। কুবলাই খাঁর সিংহাসনের কাছে গিয়ে তিনজনেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। রীতি অনুযায়ী তাদের কাঁধে সম্রাট হাত দিলেন এবং সকলেই উঠে দাঁড়ালেন। পোলোরা সম্রাটের জন্য যে উপহার নিয়ে এসেছিলেন, তা সম্রাটকে একে একে দেওয়া হলো।

নিকোলো এবার মার্কোকে সম্রাটের কাছে পরিচয় করিয়ে দিলেন। নিকোলো বললেন প্রভু, “এ আমার পুত্র, আপনার দাস”। সম্রাট আগ্রহের সাথে মার্কোর সাথে কথা বলতে লাগলেন। মার্কোও সুন্দরভাবে, সাবলীলভাবে সম্রাটের সাথে আলাপ চালিয়ে গেলেন। সম্রাট মার্কোর কথাবার্তা, ব্যবহার, বিনয়, মেধা, আচার আচরণ দেখে মার্কোর প্রতি মুগ্ধ হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে মার্কো দেশীয় ভাষা শিখে নিয়েছেন। মার্কোর মুখে স্থানীয় ভাষা শুনে সম্রাট অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। মার্কোও সম্রাটের ব্যবহার দেখে আনন্দিত হলেন।

সম্রাটের মর্মরপ্রাসাদের কাছেই দারু প্রাসাদে পোলোদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। মার্কো প্রায়ই প্রাসাদের ভেতরে ও বাইরের মানুষদের কাছে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলতেন, ক্রমেই আশেপাশের মানুষদের সাথে মার্কোর ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের কাছ থেকে সে দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদি আরো আয়ত্ত করতে থাকেন। প্রাসাদের ভেতরের অনেকের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে সম্রাটের খেয়াল-খুশি, ভালো লাগা-মন্দ লাগা, সভাসদ-মন্ত্রীদের চরিত্র, তাদের ব্যবহার সম্পর্কে জেনে নেন মার্কো। ক্রমশ রাজদরবারের সমস্ত কর্মচারীর মধ্যে মার্কো অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠলেন। তার স্বভাবের নম্রতা, আলাপের মাধুর্য ও বুদ্ধি বিবেচনা সকলের কাছে লক্ষণীয় হয়ে উঠল।

সম্রাট মার্কোকে এতই ভালোবেসে ফেললেন যে তাকে নিজের প্রাসাদে নিয়ে আসেন। নিজের সন্তানের মতো হয়ে উঠলেন মার্কো। সম্রাট নানা যুক্তি-পরামর্শ করেন তার সাথে। সম্রাটের অধীনস্থ রাজ্যসমূহের মধ্যে অভ্যন্তরীণ নানা গণ্ডগোলের ব্যপারে তার পরামর্শ নেওয়া হয়। প্রয়োজন হলে মধ্যস্থতা করার জন্য তাকে পাঠানো হয়। এছাড়াও সম্রাট মার্কোকে বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতেন। মার্কো বিভিন্ন সময়ে ক্যাথি (উত্তর চীন) থেকে মানজি (দক্ষিণ চীন) ভ্রমণ করেন। তিনি বর্তমান মায়ানমারের উত্তরাঞ্চলেও সাম্রাজ্যের কাজে ভ্রমণ করেছিলেন। কিছু মতানুসারে, মার্কো কয়েক বছর ইয়াংজু শহরের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। এভাবে সম্রাটের অধীনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন পোলো পরিবার।

দেখতে দেখতে প্রায় দুই যুগ কেটে গেল। মার্কোর বাবা ও চাচা দুজনেরই অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে। অনেকদিন বাড়ির বাইরে থাকতে থাকতে তাদের মন ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। এছাড়া সম্রাটেরও বয়স হয়ে গিয়েছে, যেকোনো সময় হয়তো তিনি দেহত্যাগ করবেন। আর সম্রাটের মৃত্যুর পর তারা হয়তো আগের মতো থাকতে পারবেন না, নতুন রাজত্বে হয়তো তাদের অবস্থা খারাপ হতে পারে। তাই তারা মার্কোকে ডেকে বাড়ি ফেরার জন্য সম্রাটের কাছে আবেদন জানাতে বললেন। মার্কো সম্রাটের কাছে বললে সম্রাট বিভিন্ন অজুহাতে তা ফিরিয়ে দেন। এভাবে আরো অনেকদিন চলে গেল।

১২৯২ সালে একবার এক সুযোগ হাজির হলো তাদের সামনে। কুবলাই খানের সম্পর্কীয় এক ভাইপো ছিলেন পারস্যের শাসক আরগন খাঁ। কিছুদিন আগেই আরগন খানের স্ত্রী মারা গেছেন, মারা যাওয়ার সময় তার শেষ ইচ্ছা ছিল তিনি যদি পুনরায় বিয়ে করেন, তবে যেন কুবলাই খানের পছন্দ করা কোনো মঙ্গোল যুবতীকেই বিয়ে করেন। স্ত্রীর শেষ ইচ্ছা জানিয়ে আরগন খান, কুবলাই খানকে তিনজন দূতসহ এক চিঠি প্রেরণ করেন। পোলোরা এই সুযোগে সম্রাটের কাছে দূতদের সাথে পারস্য সম্রাটের জন্য স্ত্রী নিয়ে যেতে এবং তারপর নিজেদের বাড়িতে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। সম্রাট নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের বাড়ি যেতে অনুমতি দিলেন। এবার তাদের সমুদ্রপথে পারস্য যাবার কথা ঠিক হলো ।

চীন থেকে ভেনিসের পথে পোলোরা ; Image source: heritage-history.com

 

বহু মালপত্র সহ সম্রাটের নিকট থেকে অনেক উপহারসামগ্রী গ্রহণ করে চৌদ্দটি জাহাজ নিয়ে তারা পারস্যের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এ যাত্রায় তাদের সাথে প্রায় ৬০০ ভৃত্য ও নাবিক ছিল। সমুদ্রপথে চলতে চলতে তারা দক্ষিণ চীন সাগর অতিক্রম করে জাভা সাগরের ভেতর দিয়ে সুমাত্রা এবং তারপর মালাক্কা প্রণালীর মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে প্রবেশ করেন। তারপর বঙ্গোপসাগরের ভেতর দিয়ে সিংহল (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) হয়ে ভারতের কালিকট বন্দরে পৌঁছেন । কালিকট থেকে আরব সাগর অতিক্রম করে হরমুজের বন্দরে এসে হাজির হন; তখন ১২৯৩ সাল।

চীন থেকে পারস্য পর্যন্ত প্রায় দীর্ঘ দেড় বছরের সমুদ্র ভ্রমণে তাদের দলের অর্ধেকেরও বেশি নানা প্রতিকূল পরিবেশে প্রাণ হারিয়েছেন। পারস্যে এসে দেখেন, এরই মাঝে আরগন খান মৃত্যুবরণ করেছেন। আরগন খানের সুযোগ্য পুত্র সিংহাসনে বসেছেন। আরগন খানের পুত্র সেই মঙ্গোল কুমারীকে বিয়ে করেন। পারস্যে থাকাকালে একসময় সম্রাট কুবলাই খানের মৃত্যু সংবাদ তাদের কানে এসে পৌঁছে। এ সংবাদে পোলোরা অত্যন্ত মর্মাহত হন। এবার পারস্য থেকে তারা ভেনিসের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ১২৯৫ সালের কোনো এক সময়ে পোলোদের জাহাজ ভেনিসের বন্দরে এসে ভিড়ল। বহুদিন পর নিজেদের জন্মভূমি দেখে তারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন।

এই দীর্ঘ ২৪ বছরের নানা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন মার্কো পোলো, আর রাস্টিশিয়ানো লিখছেন। এভাবে কিছুদিনের মধ্যেই জেলে বসে দুজন ভ্রমণকাহিনী লিখে ফেললেন। কিছুদিন পর, ১২৯৯ সালে ভেনিস ও জেনোয়ার মধ্যে শান্তিচুক্তি হওয়ার ফলে মার্কো মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে ভেনিসে গিয়ে বিয়ে করে সংসারজীবন শুরু করেন। এর প্রায় ২৫ বছর পর ১৩২৪ সালে, ৭০ বছর বয়সে মার্কো শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।

মৃত্যুকালে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “আপনি কি যা দেখেছেন, তা-ই লিখেছেন?”

মার্কোর উত্তর ছিল, “আমি যা দেখেছি, তার অর্ধেকও লিখিনি।”

ত্রয়োদশ শতকে কয়েকজন ইউরোপীয়ের সিল্ক রোড দিয়ে ভ্রমণ ও তাদের অভিজ্ঞতার কথা অসাধারণভাবে বইটিতে ফুটে উঠেছে। আর এই বই দ্বারা পরবর্তী সময়ে বহু নাবিক ও অভিযাত্রীরা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। বলা হয়, ক্রিস্টোফার কলম্বাস মার্কো পোলোর ভ্রমণকাহিনী দ্বারা অনেকাংশে অনুপ্রাণিত হন।

Related Articles

Exit mobile version