পশ্চিম আফ্রিকার দুর্গম মরু অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধশালী নগরী। এই নগরী একদিকে ছিল ধনসম্পদের আখড়া, অন্যদিকে ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার আদর্শ প্রাণকেন্দ্র। এখানে রাজত্ব করেছেন তর্কসাপেক্ষে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মানসা মুসা। এখানে গড়ে উঠেছে মাটির তৈরি তিনটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। একসময় এই নগরীর রুট দিয়ে লেনদেন হতো সহস্র-লক্ষাধিক মুদ্রার বাণিজ্যিক পণ্যের। কিন্তু সেই মধ্যযুগীয় অতীত যেন এখন অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো ঠেকে। বলছিলাম আফ্রিকা মহাদেশের ঐতিহাসিক নগরী ‘তিম্বাকতু’র কথা। ১৩শ থেকে ১৫শ শতক পর্যন্ত এটি আফ্রিকা তথা সারাবিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়েছিল। এখানে গড়ে উঠেছিল একাধিক শিক্ষাকেন্দ্র। সেখানের গবেষণালদ্ধ জ্ঞানসম্বলিত পাণ্ডুলিপিগুলো আজও জ্ঞানীদের নিকট সমাদৃত হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে সেখানে সেই নগরীর হৃত গৌরবের ছিটেফোঁটাও নেই।
তিম্বাকতু কী?
পশ্চিম আফ্রিকার বর্তমান মালি নামক রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত অঞ্চল সেই মধ্যযুগের তিম্বাকতু। একসময় মালি সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র থাকা এই নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১২শ শতকের দিকে। আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির সাথে নাইজার নদীর কেন্দ্রীয় অঞ্চলের সংযোগ ঘটিয়েছে এই তিম্বাকতু। ১৪শ শতকের দিকে আফ্রিকার বাজারে সবচেয়ে মূল্যবান পণ্য ছিল সোনা, ক্রীতদাস এবং হাতির দাঁত। ভূমধ্যসাগরীয় আফ্রিকান অঞ্চল থেকে এসব পণ্য তিম্বাকতু হয়ে আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চলে রপ্তানি করা হতো। তাছাড়া লবণ এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য তিম্বাকতু থেকে দক্ষিণাঞ্চলে রপ্তানি করা হতো।
এই নগরীর প্রতিপত্তি মালি সাম্রাজ্যের সময় তুঙ্গে ছিল। তবে সাম্রাজ্যের পতনের বহু বছর পরেও এটি স্বমহীমায় টিকে ছিল। তুয়ারেগ, সোংঘাই, মরোক্কান পাশাসহ বহু বিদেশি শক্তি বিভিন্ন সময়ে তিম্বাকতুর ক্ষমতা দখল করেছিল। অবস্থানের কারণে দুর্গম হওয়ায় তিম্বাকতু নগরী ইউরোপীয়দের নিকট ছিল এক রহস্যময় ধাঁধা। এর ধনসম্পদের প্রাচুর্যের গল্প শুনে তারাও তিম্বাকতুর দিকে হাত বাড়িয়েছিল। তিম্বাকতুর ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে ইউনেস্কো একে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছে।
বাকতু বুড়ির কুয়া
তিম্বাকতুর ভৌগোলিক অবস্থান বেশ সুবিধাজনক। এখানে নাইজার নদীর গুরুত্বপূর্ণ পথের সাথে ভূমি এসে মিলিত হয়েছে। এই অঞ্চল পরখ করে এর অপার সম্ভাবনার কথা প্রথম যাদের মাথায় এসেছিল, তারা ছিল একদল রাখাল। দক্ষিণ সাহারা অঞ্চলে এক যাযাবর জাতি তুয়ারেগ। এদের প্রধান পেশা ছিল পশুপালন করা। তিম্বাকতু অঞ্চলে নগরীর গোড়াপত্তন করার প্রাথমিক উদ্যোগ নিয়েছিল তুয়ারেগের রাখালরা। আঞ্চলিক লোকগাথা অনুযায়ী, তুয়ারেগ রাখালরা এই অঞ্চলে একটু কুয়া নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে বহুদূর থেকে এখানে এসে বিশ্রাম নেওয়ার বন্দোবস্তও হবে, আবার কুয়ার মালিকানা অনুযায়ী জায়গার দখলও তাদের হাতে থাকবে। কুয়া নির্মাণ শেষে এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তারা স্থানীয়দের মধ্য থেকে এক বুড়িকে দায়িত্ব প্রদান করে। সেই বুড়ির নাম ছিল বাকতু। তুয়ারেগদের কথ্য ভাষা তামাশেক অনুযায়ী, ‘তিন’ বা ‘তিম’ শব্দের অর্থ স্থান বা জায়গা। কুয়ার অভিভাবক বাকতুর নামানুসারে তারা এই জায়গাকে তিন-বাকতু বা তিম্বাকতু নামে ডাকতো। সেই থেকে এই স্থানের নাম তিম্বাকতু হিসেবে সুপরিচিত হয়েছে। আবার আধুনিক তত্ত্ব অনুযায়ী, তিম্বাকতু শব্দের অর্থ ‘দুই মরুর মিলনস্থল’। নগরীর দুই দিকে মরুভূমি থাকায় এমন নাম হয়েছে বলে ধারণা করেন বহু ইতিহাসবিদ। আনুমানিক ১১০০ খ্রিস্টাব্দে গোড়াপত্তন হয় এই নগরীর।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের হিসাবমতে, নব্য-প্রস্তর যুগ থেকে এই অঞ্চলে মানুষের বাস। এখানে কয়েকটি পরিত্যক্ত গ্রাম থেকে লৌহযুগের বহু নিদর্শনও খুঁজে পাওয়া গেছে। ভরা মৌসুমে নাইজার নদীর পানি কূল ছাপিয়ে তিম্বাকতুতে বন্যার সৃষ্টি করতো। বন্যার পানি নদীর তলদেশ থেকে বয়ে আনতো মূল্যবান পলি। যার ফলে তিম্বাকতুর মাটি কৃষিকাজের জন্য উর্বর হয়ে উঠে। প্রায় ৩,৫০০ বছর আগে এই অঞ্চলে কৃষিকাজ শুরু হয়। আফ্রিকান লাল-চালসহ বহু স্থানীয় শস্য উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত হওয়ায় এখানে কৃষিপ্রধান জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে। তাছাড়া এখানে রয়েছে তাম্রখনি। খ্রিস্টাব্দ প্রথম সহস্র থেকেই তিম্বাকতুতে তাম্র নির্মিত হাতিয়ার এবং অন্যান্য সরঞ্জামের বিপণনকেন্দ্র গড়ে উঠে। কথিত আছে, এখানে সোনার খনি ছিল। তবে ঐতিহাসিক প্রমাণের অভাবে এই ধারণা অনেকেই উড়িয়ে দেন।
মালি সাম্রাজ্যের অধীনে
তিম্বাকতু নগরী প্রতিষ্ঠার পর তা নিকটবর্তী শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোর নজর কাড়তে সক্ষম হয়। এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে, সেই আফ্রিকার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। ১৩শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই নগরীকে শক্তিশালী মালি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। সম্ভাবনাময় তিম্বাকতু মূলত মালি সাম্রাজ্যের অধীনে আফ্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে রূপান্তরিত হয়েছিল। মালির প্রতিষ্ঠাতা সানদিয়াতা কেইতার নেতৃত্বে ১২৩০ সালে ঘানা থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল মালি। এরপর তার দক্ষ নির্দেশনায় একসময় মালি হয়ে ওঠে ক্ষমতাধর সাম্রাজ্য। মালির প্রতিপত্তি এতটাই বেড়ে যায় যে, স্বয়ং ঘানা সাম্রাজ্য মালির অধীনস্থ হয়ে পড়ে। তিম্বাকতু নগরীর সাহায্যে মালি হয়ে ওঠে পশ্চিম আফ্রিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ধনী সাম্রাজ্য। আটলান্টিকের কূল থেকে ওয়ালাতা, তাদমেক্কা এবং সোংঘাই সাম্রাজ্যের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল মালি।
মালির শাসকগণ আরব বণিকদের সাথে সম্প্রীতির কারণে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অবহিত হন। ইসলামের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে মালির স্থানীয় শাসকগণ এই ধর্ম গ্রহণ করে প্রচার করতে থাকেন। এই কারণে আফ্রিকার বুকে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে মালির শাসকগণ। বিশেষ করে, তিম্বাকতুসহ অন্যান্য নগরীর বাসিন্দারা ইসলাম গ্রহণ করার ফলে শক্তিশালী মুসলিম সমাজ গড়ে ওঠে। তিম্বাকতু থেকে বিশাল বহর নিয়ে প্রতিবছর আরবের মক্কা নগরীতে হজ পালন করতো মালিয়ানরা।
তিম্বাকতুর মাধ্যমে তখন আফ্রিকার সকল সোনা লেনদেন হতো। ব্ল্যাক ভোল্টা (বর্তমান বারকিনা ফাসো), আকান অরণ্য (বর্তমান ঘানায়) স্বর্ণখনি আবিষ্কারের ফলে আফ্রিকায় তখন সোনার বাণিজ্য ছিল সবচেয়ে লাভজনক পেশা। আর সেই লাভের অর্থে ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে তিম্বাকতু নগরী। তাছাড়া সাহারায় প্রাপ্ত খনিজ লবণ তিম্বাকতুতে বিক্রি হতো। লবণের বিনিময়ে স্বর্ণ গুঁড়ো লেনদেন করতো বণিকরা। উত্তর এবং পশ্চিম আফ্রিকার বাণিজ্যের সিংহভাগ তিম্বাকতুর মাধ্যমে হয়ে থাকতো। এই নগরীর নদীপথে চালান করা ৯০ কেজি লবণের মূল্য প্রায় ৪৫০ গ্রাম সোনার সমপরিমাণ ছিল। হাতির দাঁত, বস্ত্র, ঘোড়া, কাঁচ, হাতিয়ার, চিনি, বাদাম, শস্য, মশলা, পাথর, হস্তশিল্পের পণ্য এবং ক্রীতদাস ছিল তিম্বাকতুর মাধ্যমে বিক্রি হওয়া বিশাল পণ্য তালিকার একাংশ। এখানে মুদ্রা হিসেবে তামা, সোনা এবং পারস্য থেকে আনা কড়ির প্রচলন ছিল। তবে লবণ বা হাতির দাঁতের বিনিময়েও লেনদেন করার সুবিধা ছিল।
নান্দনিক মসজিদের নগরী
তিম্বাকতুতে গড়ে ওঠা মুসলিম সমাজের ইবাদতে জন্য বেশ কয়েকটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তিম্বাকতুকে অনন্য করে রেখেছে এর মাটির তৈরি বিশাল মসজিদগুলো। মাটির দেয়াল ভেদ করে বের হয়ে আসা কাঠের খুঁটিওয়ালা মসজিদগুলো দেখলেই যেন তিম্বাকতুর স্বর্ণযুগের ইতিহাসে হারিয়ে যায় দর্শণার্থীরা। স্থাপত্যশিল্পের নৈপুণ্য এবং নান্দনিক গঠনের কারণে এই মসজিদগুলো যুগ যুগ ধরে তিম্বাকতুর প্রধান দর্শনীয় স্থানে রূপান্তরিত হয়েছে। বিখ্যাত গবেষক জোনাথান ব্লুম এবং শিলা ব্লেয়ারের মতে, ১৩২৫ সালে তৎকালীন মালির ধনকুবের শাসক মুসা কেইতা (মানসা মুসা) পবিত্র হজ পালন শেষে তিম্বাকতু ফিরে আসেন। হজফেরত মুসা নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে একটি মসজিদ নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। মসজিদের নকশা করার ভার দেন বিখ্যাত কবি এবং স্থপতি আবু ইশাক আল-সাহেলির উপর। তার নকশায় নির্মিত হয় ‘দ্য গ্রেট মস্ক অফ তিম্বাকতু’। যার স্থানীয় নাম জিঙ্গুয়েরে বার। আগ্রহী পাঠকগণ ধনকুবের মানসা মুসাকে নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে রোর বাংলার ‘মানসা মুসা: বিশ্বের সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তি‘ প্রবন্ধে একবার ঢুঁ মেরে আসুন।
কাদামাটি এবং পাথর দ্বারা নির্মিত এই মসজিদে ১৬ মিটার উঁচু মিনার রয়েছে। তাছাড়া চুনাপাথরে নির্মিত তোরণ, মোচাকৃতির টাওয়ার এই মসজিদকে অনন্য করে তুলেছে। এই মসজিদটি ১৬শ শতকে পুনঃনির্মিত হয়। এরপর ১৯শ শতকে মসজিদটির আরেক দফা সংস্কার সাধিত হয়। পরবর্তীতে নগরীর উত্তরদিকে সাঙ্কোরে নামক আরেকটি মাটির মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এই মসজিদের ভেতরের দেওয়াল পবিত্র কাবাঘরের আদলে নকশা করা হয়েছে। এই মসজিদটি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত ছিল।
ইসলামি শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র
ইসলাম ধর্ম বিকাশের কারণে এখানে গড়ে ওঠা মুসলিম সমাজের একাংশ ধর্ম গবেষণা এবং চর্চায় মননিবেশ করেন। সাঙ্কোরে মসজিদ হয়ে ওঠে তাদের প্রাণকেন্দ্র। এখানে গড়ে ওঠে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে সুদূর বাগদাদ থেকে আসা পণ্ডিতগণ অধ্যাপনা করতেন। তবে তিম্বাকতুর গৃহগুলোতেও ইসলামিক জ্ঞানচর্চা করা হতো। বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যান্য শিক্ষাকেন্দ্র এবং পাঠশালাগুলোতে পণ্ডিতদের প্রদত্ত বিবৃতি লিখিত আকারে সংরক্ষিত হতে থাকে এই নগরীতে। সেসব বিবৃতি এবং মধ্যপ্রাচ্যের পণ্ডিতদের পাণ্ডুলিপি নকল করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তাছাড়া এখানে গবেষণার জন্য বেশ কয়েকটি পাঠাগার গড়ে ওঠে।
বাণিজ্যিক দিক থেকে বিচার করলে তিম্বাকতুর সবচেয়ে মূল্যবান পণ্য ছিল সোনা। কিন্তু ইতিহাস এবং শিক্ষার দিক থেকে তিম্বাকতু ছিল বই এবং পাণ্ডুলিপির বিশাল খনি। আর এসব বই-পুস্তক রচনা করার জন্য মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং আফ্রিকার পণ্ডিত, ধর্মপ্রচারক এবং বিচারকগণ তিম্বাকতু আসতেন। তিম্বাকতুর শাসকগণ এসব জ্ঞানী ব্যক্তিদের উপযুক্ত অর্থ এবং উপঢৌকনের মাধ্যমে সমাদর করতেন এবং তাদের পাণ্ডুলিপি রচনার জন্য সম্মানিত করতেন। ১৬শ শতকে লিও আফ্রিকানাস নামক এক পণ্ডিত লিখেছেন,
“তিম্বাকতুতে আরব এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে আনা হতো এবং বিক্রি করা হতো। এখানে বিক্রি হওয়া মূল্যবান পাণ্ডুলিপিগুলো প্রশ্নাতীতভাবে যেকোনো মূল্যবান পাথর বা অলঙ্কার থেকে বেশি দামি”।
তিম্বাকতুর পতনের পর বহু পাণ্ডুলিপি এবং বই নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। তারপরেও বিভিন্ন গবেষকদের প্রচেষ্টায় বেশ কিছু পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপির সংখ্যা হাজার থেকে লাখের ঘরে গিয়ে পৌঁছাবে। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এখানে রচিত মোট পাণ্ডুলিপির সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়ে যাবে। শত-সহস্র বছরের চর্চাকৃত জ্ঞানের ভাণ্ডার হিসেবে এই পাণ্ডুলিপিগুলো আজ বড় বড় জাদুঘর এবং তিম্বাকতুর স্থানীয় সংরক্ষণাগারে শোভা পাচ্ছে।
তিম্বাকতুর পতন
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা- কোনোকিছুই অবিনশ্বর নয়। চিরন্তন নশ্বরতা তিম্বাকতুর ভাগ্যেও লেখা ছিল। একসময়ের প্রতাপশালী মালি সাম্রাজ্যের নগরী তিম্বাকতুর পতন ঘটেছিল ১৬শ শতকে। মালি সাম্রাজ্যের পতনের পর সোংঘাই শাসকদের অধীনে চলে আসে এই নগরী। ১৪৬৮ সালে তিম্বাকতু দখল করেন তৎকালীন সোংঘাই শাসক সুন্নি আলি। তিনি তিম্বাকতুর ইসলামি পণ্ডিতদের ভালো চোখে দেখতেন না। তাই বিভিন্ন প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে তার সাথে পণ্ডিতদের মতবিরোধ দেখা দিতে থাকে। তবে তার উত্তরসূরি হিসেবে তিম্বাকতুর মসনদে বসেন আস্কিয়া বংশের প্রথম শাসক প্রথম মুহাম্মদ আস্কিয়া। তার সময়ে ইসলামিক পণ্ডিতদের প্রতি রাজ্যের বিরূপ মনোভাব বদলে যায়। তিনি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত উপনীত হতে তাদের সাহায্য এবং উপদেশ গ্রহণ করতেন। আস্কিয়া বংশের শাসনামলে তিম্বাকতুর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মর্যাদা বহুগুণে বেড়ে যায়। এ সময়ে বর্তমান লিবিয়া থেকে বণিকরা তিম্বাকতু থেকে দাস এবং সোনা ক্রয় করতো।
১৫৯১ সালে প্রতাপশালী মরক্কোর হাতে সোংঘাই-আস্কিয়াদের পতন ঘটে। এরপরই তিম্বাকতুর বুকে বিশৃঙ্খলার অভিশাপ নেমে আসে। ১৫৯৩ সালে দেশদ্রোহিতার সন্দেহে তিম্বাকতুর পণ্ডিতদের গ্রেপ্তারের নির্দেশনা দেন মরক্কান শাসকবৃন্দ। এর ফলে শাসকদের সাথে পণ্ডিতদের সহিংসতার ঘটনা ঘটতে থাকে। বেশ কয়েকজন পণ্ডিত এই সংঘাতে নিহত হন। বাকিদের মরক্কোতে নির্বাসিত করা হয়। এ সময়ে নগরীর প্রতিরক্ষা বিভাগ সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। ফলে বহিঃশত্রুদের ক্রমাগত আক্রমণে নগরীর সম্পদ লুট হতে থাকে। মরক্কানদের পতনের পর একে একে বামবারা, ফুলানি এবং তুয়ারেগদের হাতে ক্ষমতাবদলের পর তিম্বাকতু নগরী সম্পূর্ণরূপে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। হারিয়ে যায় এককালের ধনী তিম্বাকতু।
ইউরোপীয়দের হাতে নগরী
তিম্বাকতুর গৌরবোজ্জ্বল দিন আর নেই। কিন্তু তারপরেও এই নগরীর প্রতি আগ্রহ একটুও কমেনি ভিনদেশিদের। এর উদাহরণস্বরূপ ১৯শ শতকে এই নগরীতে পদার্পণ করেন প্রথম ইউরোপীয় নাগরিক গর্ডন লাইং। ১৮২৬ সালে এই স্কটিশ পরিব্রাজক স্বর্ণনগরী তিম্বাকতুর সন্ধানে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে নগরীতে পৌঁছান। এর দুই বছর পর এখানে ফরাসি নাগরিক অগাস্ত কেইলি আসেন। কেইলি নিজে ইসলাম এবং আরবি ইতিহাসে পণ্ডিত ছিলেন। এক আরব বণিকের ছদ্মবেশে তিনি তিম্বাকতুর সন্ধানে বের হয়েছিলেন। নগরীতে ২ সপ্তাহ অবস্থানের পর তিনি ইউরোপে ফিরে যান। তিনিই প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে তিম্বাকতুর চাক্ষুস অভিজ্ঞতা নিয়ে মহাদেশে ফিরে যান। ১৮৫৩ সালে ২য় ব্যক্তি হিসেবে তিম্বাকতু হয়ে ইউরোপ ফিরে যান জার্মান ভূগোলবিদ হেনরিক বার্থ। তার আফ্রিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তিনি বই আকারে ‘Travels and Discoveries in North and Central Africa: Timbúktu, Sókoto, and the Basins of the Niger and Bénuwé’ নামে প্রকাশ করেন।
১৮৯৪ সালে তিম্বাকতু দখল করে ফরাসিরা। নগরীতে এটিই প্রথম ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের শাসন। এসময়ে তারা বহু নিদর্শন পুনঃনির্মাণ করে। ফরাসিদের অধীনে তিম্বাকতু পরাধীন থাকে ৬৬ বছর। ১৯৬০ সালে মালি স্বাধীনতা লাভ করলে তিম্বাকতুকে নতুন প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বর্তমানে তিম্বাকতু
ঐতিহাসিক তিম্বাকতু আর নেই। কিন্তু বিশ্ব মানচিত্রে তা আজও টিকে আছে। বাকতু বুড়ির কুয়া থেকে যেই নগরীর যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা এখন মালি প্রজাতন্ত্রের একটি প্রশাসনিক নগরী হিসেবে পরিচিত। মালি সরকার ৯০-এর দশকে নগরীর মাটির মসজিদগুলো সংস্কার এবং পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল। মূলত মরুঝড় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে মসজিদের বহু স্থানে ক্ষয় দেখা দিয়েছিল। ২০১২ সালে তিম্বাকতুর বুকে ফের বিপদ নেমে আসে। সেবছর তুয়ারেগ বিপ্লবীরা নগরী আক্রমণ করে বসে এবং এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তুয়ারেগের পর আনসার-ই-দ্বীন নামক এক সশস্ত্র বাহিনী তিম্বাকতু আক্রমণ করে। এ সময়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংস করা হয়। সিদি ইয়াহিয়া মসজিদে থাকা মাজারগুলো গুঁড়িয়ে দেয়া হয়।
২০১৩ সালে জঙ্গি দলকে উৎখাত করে সরকার পুনরায় নগরীর নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়। এরপর নগরীর বিভিন্ন নিদর্শন পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত এই তিম্বাকতুকে টিকিয়ে রাখতে বর্তমানে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে মালি সরকার এবং অন্যান্য সহযোগী সংগঠন।