অক্টোবর, ১৯৭৩। মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হয়েছে আরেকটি আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধ। মিসরীয় সেনাবাহিনী সুয়েজ খাল অতিক্রম করেছে এবং সুয়েজ খালের পূর্ব তীরে ৩০ কোটি (বা ৩০০ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত ইসরায়েলের দুর্ভেদ্য ট্যাঙ্কবিরোধী প্রতিরক্ষা সীমা ‘বার–লেভ লাইন’ মাত্র ২ ঘণ্টায় অতিক্রম করে ইসরায়েল–অধিকৃত সিনাই উপদ্বীপে অগ্রসর হচ্ছে। সিরীয় সেনাবাহিনীর সেরা ইউনিটগুলো ১৯৬৭ সালের যুদ্ধবিরতি রেখা অতিক্রম করে ইসরায়েল–অধিকৃত গোলান মালভূমিতে অগ্রসর হয়েছে। শত শত ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক মিসরীয় ও সিরীয় সৈন্যদের সোভিয়েত–নির্মিত ট্যাঙ্ক–বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধের প্রথম তিন দিনেই মিসরীয় ও সিরীয় সৈন্যরা সোভিয়েত–নির্মিত গতিশীল ‘এসএ–৬’ ও কাঁধে বহনযোগ্য ‘এসএ–৭’ বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘জেডএসইউ–২৩–৪’ বিমান–বিধ্বংসী কামান ব্যবহার করে ৫০টিরও বেশি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। মিসরীয় ও সিরীয় যুদ্ধবিমান অবিরাম বোমাবর্ষণ করছে ইসরায়েলি বিমানঘাঁটি, রাডার স্থাপনা আর ক্ষেপণাস্ত্র সাইটগুলোর ওপরে।
ইসরায়েলিরা তীব্র বিস্ময় আর আতঙ্কের সঙ্গে মিসরীয় ও সিরীয় সৈন্যদের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করছিল। মাত্র ৬ বছর আগে ১৯৬৭ সালের ৫–১০ জুনে ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল মিসর, জর্দান আর সিরিয়ার সমন্বয়ে গঠিত আরব জোট। এই যুদ্ধে দুই পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পর্যালোচনা করলেই ইসরায়েলের সামর্থ্যের একটি স্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠবে।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ১৮,২০৬ জন আরব (১৫,০০০ মিসরীয়, ৬৯৬ জন জর্দানীয়, ২,৫০০ সিরীয় ও ১০ জন ইরাকি) সৈন্য নিহত অথবা নিখোঁজ হয়েছিল, এর বিপরীতে ইসরায়েলি সৈন্য নিহত হয়েছিল ৭৭৬ থেকে ৯৮৩ জন। এই যুদ্ধে ৫,৪৬২ জন (৪,৩৩৮ জন মিসরীয়, ৫৩৩ জন জর্দানীয় ও ৫৯১ জন সিরীয়) সৈন্য ইসরায়েলিদের হাতে বন্দি হয়েছিল, এর বিপরীতে আরবদের হাতে ইসরায়েলি সৈন্য বন্দি হয়েছিল মাত্র ১৫ জন। এই যুদ্ধে আরবরা ৪৫২টিরও বেশি বিমান হারিয়েছিল, আর ইসরায়েল হারিয়েছিল মাত্র ৪৬টি বিমান। সর্বোপরি, এই যুদ্ধে ইসরায়েল মিসরের কাছ থেকে সিনাই উপদ্বীপ (প্রায় ৬০,০০০ বর্গ কি.মি.) ও গাজা উপত্যকা (৩৬৫ বর্গ কি.মি.), জর্দানের কাছ থেকে পূর্ব জেরুজালেম–সহ সমগ্র পশ্চিম তীর (৫,৬৫৫ বর্গ কি.মি.) এবং সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান মালভূমি (প্রায় ১,৮০০ বর্গ কি.মি.) দখল করে নিয়েছিল।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলিদের তুলনায় আরবদের ১৮.৫ গুণ বেশি সৈন্য নিহত ও ৩৬৪ গুণ বেশি সৈন্য বন্দি হয়েছিল! যুদ্ধে আরবদের হারানো বিমানের সংখ্যা ছিল ইসরায়েলিদের হারানোর বিমানের প্রায় ১০ গুণ! তদুপরি, এই যুদ্ধে ইসরায়েল দখল করে নিয়েছিল প্রায় ৬৭,৮২০ বর্গ কি.মি. ভূমি, যা ইসরায়েলের বর্তমান আয়তনের তিনগুণেরও বেশি! এই যুদ্ধের ফলে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ইসরায়েলের ‘কৌশলগত গভীরতা’ (strategic depth) দক্ষিণ দিকে ৩০০ কি.মি., পূর্ব দিকে ৬০ কি.মি. এবং উত্তর দিকে ২০ কি.মি. বৃদ্ধি পেয়েছিল!
এত বড় বিজয় অর্জনের ফলে ইসরায়েলিরা, বিশেষত ইসরায়েলি সরকার ও সশস্ত্রবাহিনী, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। আরব রাষ্ট্রগুলোর সৈন্যসংখ্যা থেকে শুরু করে অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণ সবকিছুই ছিল ইসরায়েলের তুলনায় অনেক বেশি, কিন্তু ইসরায়েলিদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, তাদের উন্নততর প্রযুক্তি, দ্রুততর সৈন্য সমাবেশের ক্ষমতা এবং উন্নত অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে আরবদের যেকোনো আক্রমণ তারা সহজেই প্রতিহত করতে পারবে।
কিন্তু ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পরবর্তী বছরগুলোতে আরব রাষ্ট্রগুলো (প্রধানত মিসর ও সিরিয়া) ইসরায়েলের কাছ থেকে দখলকৃত ভূমি উদ্ধারের উদ্দেশ্যে তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করে। সোভিয়েত সামরিক উপদেষ্টাদের সহায়তায় মিসরীয় ও সিরীয় সৈন্যদের প্রশিক্ষিত করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসর ও সিরিয়াকে ৬০০টিরও বেশি অত্যাধুনিক বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, ৩০০টি ‘মিগ–২১’ যুদ্ধবিমান, ১,২০০টি ট্যাঙ্ক এবং আরো লক্ষ লক্ষ টন যুদ্ধসামগ্রী সরবরাহ করে। ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবরে যখন ইসরায়েলিরা ইহুদিদের ধর্মীয় উৎসব ‘ইওম কিপুর’ (Yom Kippur) উদযাপন করছিল, মিসরীয় ও সিরীয় সৈন্যরা একযোগে ইসরায়েলের দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে আক্রমণ চালায়।
যুদ্ধের প্রথম তিন দিনে মিসরীয় ও সিরীয় বাহিনীর বিস্ময়কর সাফল্য এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ইসরায়েলিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ইসরায়েলি সরকারকে আতঙ্কিত করে তোলে। এই তিন দিনে উভয় পক্ষেরই প্রচুর যুদ্ধসামগ্রী ধ্বংস হয়ে গেলেও আরবদের তুলনায় ইসরায়েলিদের ট্যাঙ্ক, বিমান বা অন্যান্য যুদ্ধসামগ্রীর মজুদ ছিল অত্যন্ত কম। এমতাবস্থায় ইসরায়েলের বেশি দিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না এবং ইসরায়েলিরা আশঙ্কা করছিল যে, আরবরা এই যুদ্ধে বিজয়ী হলে ইসরায়েলকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।
এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে সহায়তা প্রার্থনা করে, কিন্তু তেলসমৃদ্ধ আরব রাষ্ট্রগুলো হুমকি দিয়েছিল যে, যেসব রাষ্ট্র ইসরায়েলকে সহযোগিতা করবে তাদের ওপর ‘তেলঅস্ত্র’ ব্যবহার করা হবে, অর্থাৎ তাদেরকে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হবে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলকে সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও গড়িমসি করতে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে ৮ অক্টোবর ইসরায়েল মরিয়া হয়ে মিসর ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রস্তুতি নেয় এবং এই উদ্দেশ্যে ১৩টি ২০ কিলোটন ওজনের পারমাণবিক বোমা প্রস্তুত করে। ‘জেরিকো–১’ স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র ও পারমাণবিক বোমা বহনকারী ‘ম্যাকডোনেল ডগলাস এফ–৪ ফ্যান্টম’ যুদ্ধবিমানের মাধ্যমে এই বোমাগুলো মিসরীয় ও সিরীয় লক্ষ্যবস্তুতে নিক্ষেপ করা হত। এছাড়া, সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসের ওপরে কামানের সাহায্যে পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপের প্রস্তুতিও নেয়া হয়।
কিন্তু সত্যিকার অর্থে মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করার কোনো ইচ্ছে ইসরায়েলের ছিল না, কারণ ইসরায়েল মিসর বা সিরিয়ার ওপর পারমাণবিক আক্রমণ চালালে মিসর ও সিরিয়ার মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ইসরায়েলে পাল্টা পারমাণবিক আক্রমণ চালাতে পারে এমন সম্ভাবনা ছিল। অর্থাৎ, সেসময় ইসরায়েলের দৃষ্টিতে পরিস্থিতি ছিল এরকম: পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করলে আরবরা ইসরায়েলকে ধ্বংস করে ফেলবে, আর পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে আরবদের মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ইসরায়েলকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। এমতাবস্থায় ইসরায়েলের সামনে একটি মাত্র পথ খোলা ছিল, সম্মুখযুদ্ধে আরবদের পরাজিত করা। আর এজন্য প্রয়োজন ছিল অস্ত্রের, যা ইসরায়েলের মজুদে ছিল না।
এজন্য চতুর ইসরায়েলিরা এমনভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে সহায়তা করতে বাধ্য হয়। ইসরায়েলি সরকার গোপনে মিসর ও সিরিয়ার ওপর পারমাণবিক আক্রমণের প্রস্তুতি নেয় ঠিকই, কিন্তু এই খবরটি ইচ্ছাকৃতভাবে গণমাধ্যমে ফাঁস করে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনোমতেই মধ্যপ্রাচ্যে একটি পারমাণবিক যুদ্ধ চাচ্ছিল না, কারণ ইসরায়েল মিসর বা সিরিয়ার ওপর পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে আরবদের বিশ্বে মার্কিন প্রভাব রাতারাতি বিলুপ্ত হয়ে যেত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেত। এজন্য ওয়াশিংটন ইসরায়েলকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
অবশ্য এই সিদ্ধান্তের পিছনে আরো কারণ ছিল। মিসরীয় ও সিরীয় বাহিনী সোভিয়েত–নির্মিত অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করত, আর ইসরায়েলি বাহিনী ব্যবহার করত মার্কিন–নির্মিত অস্ত্রশস্ত্র। মিসর ও সিরিয়ার কাছে ইসরায়েল পরাজিত হলে এর অর্থ হতো সোভিয়েত অস্ত্রের কাছে মার্কিন অস্ত্রের পরাজয়, যা বিশ্বব্যাপী মার্কিন অস্ত্রব্যবসায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারত। ফলে ওয়াশিংটন তেল আভিভকে সামরিক সহায়তা প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসরায়েলের ভৌগোলিক দূরত্বের প্রেক্ষাপটে নৌ ও আকাশপথে ইসরায়েলকে সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রথমে ইসরায়েলি বেসামরিক বিমান সংস্থা ‘এল আল ইসরায়েল এয়ারলাইন্স লিমিটেডে’র (সংক্ষেপে ‘এল আল’) বিমানে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসরায়েলে সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো হয়। ১০ অক্টোবর ‘এল আল’–এর ৮টি বিমান ৫,৫০০ টন সামরিক সরঞ্জাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসরায়েলে পৌঁছে দেয়।
কিন্তু ‘এল আল’–এর ধারণক্ষমতা ছিল সীমিত, এজন্য ইসরায়েলিরা মার্কিন বেসামরিক বিমান সংস্থাগুলোর সহযোগিতা চেয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েলকে সহযোগিতা করলে আরবদের বিশ্বে এই বিমান সংস্থাগুলোর ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এই আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বেসামরিক বিমান সংস্থা ইসরায়েলকে সহযোগিতা করতে রাজি হয়নি।
এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসর ও সিরিয়াকে নৌ ও আকাশপথে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করতে শুরু করেছিল। ফলে ইসরায়েলকে সহায়তা করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় এবং মার্কিন সরকার মার্কিন বিমানবাহিনীকে ইসরায়েলে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করার নির্দেশ দেয়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন এ ব্যাপারে নির্দেশ দেন, ‘Send everything that can fly!’
মার্কিন বিমানবাহিনীর মিলিটারি এয়ারলিফট কমান্ডকে (বর্তমান এয়ার মোবিলিটি কমান্ড) এই অভিযান পরিচালনা নির্দেশ দেয়া হয়। এই অভিযানের নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন নিকেল গ্রাস’ (Operation Nickel Grass)। এসময় মিলিটারি এয়ারলিফট কমান্ডের কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল লেস্টার টি. কিয়ার্নি জুনিয়র এবং ভাইস–কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কেল্টন এম. ফারিস। আর অপারেশন নিকেল গ্রাসের সার্বিক পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল এডওয়ার্ড জে. নাশ।
মার্কিন বিমানবাহিনীর ‘লকহিড সি–১৪১ স্টারলিফটার’ ও ‘লকহিড সি–৫ গ্যালাক্সি’ মডেলের পরিবহন বিমান এই এয়ারলিফটে ব্যবহার করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে ২০টিরও বেশি রসদ ঘাঁটি থেকে যুদ্ধসামগ্রী এই বিমানগুলোতে তোলা হয় এবং সেগুলোকে ইসরায়েলে প্রেরণ করা হয়। এসব সরঞ্জামের একাংশ সরাসরি মার্কিন যুদ্ধ–রিজার্ভ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
১৪ অক্টোবর রাত ১০টা ১ মিনিটে একটি মার্কিন ‘সি–৫’ পরিবহন বিমান ৯৭ টন কামানের গোলা নিয়ে ইসরায়েলের রাজধানী তেল আভিভের লোদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এরপর থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত টানা ৩২ দিন ধরে মার্কিন ‘সি–১৪১’ ও ‘সি–৫’ পরিবহন বিমানগুলো অবিরাম ইসরায়েলে যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে অবতরণ করতে থাকে। প্রতি ২ ঘণ্টায় ৩টি ‘সি–১৪১’ বিমান এবং প্রতি ৪ ঘণ্টায় ৪টি ‘সি–৫’ বিমান এভাবে অবিরত ইসরায়েলকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করতে থাকে।
প্রাথমিক পর্যায়ে ১২টি ‘সি–১৪১’ এবং ৪টি ‘সি–৫’ বিমান এই কাজে নিয়োজিত ছিল। ২১ অক্টোবরের পর থেকে এয়ারলিফটে নিয়োজিত বিমানের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয় এবং ১৭টি ‘সি–১৪১’ ও ৬টি ‘সি–৫’ বিমান এতে অংশ নেয়।
‘সি–১৪১’ ও ‘সি–৫’ বিমানগুলোর সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসরায়েলে পৌঁছানোর সক্ষমতা ছিল না। বিমানগুলোতে মাঝপথে জ্বালানি পূর্ণ করার (refueling) প্রয়োজন হতো। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপের কোনো রাষ্ট্রই আরব তেল অবরোধের ভয়ে মার্কিন বিমানগুলোকে তাদের বিমানঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি। অবশেষে বহু দর কষাকষির পর পর্তুগাল তাদের বিমানঘাঁটিতে মার্কিন বিমানগুলোতে জ্বালানি ভরার অনুমতি দেয়।
মার্কিন ‘সি–১৪১’ ও ‘সি–৫’ বিমানগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসরায়েলের জন্য সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে পর্তুগালের আজোরেস দ্বীপে অবস্থিত লাজেস বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড থেকে লাজেস বিমানঘাঁটির আকাশপথে দূরত্ব ৩,২৯৭ মাইল। লাজেস বিমানঘাঁটিতে জ্বালানি পূর্ণ করার পর সেখান থেকে মার্কিন বিমানগুলো পৌঁছত ইসরায়েলের তৎকালীন রাজধানী তেল আভিভে অবস্থিত লোদ কিংবা বেন–গুরিয়ন বিমানঘাঁটিতে। লাজেস বিমানঘাঁটি থেকে তেল আভিভের আকাশপথে দূরত্ব ৩,১৬৩ মাইল। অর্থাৎ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসরায়েলে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করতে মার্কিন বিমানগুলোকে অতিক্রম করতে হত মোট ৬,৪৬০ মাইল দীর্ঘ পথ!
লাজেস বিমানঘাঁটি থেকে ইসরায়েল পর্যন্ত পথ মার্কিন বিমানগুলোর জন্য নিরাপদ ছিল না। মার্কিন বিমানগুলো কী করছে সেটা আরবরা ভালোভাবেই জানত এবং মার্কিনদের আশঙ্কা ছিল, আরব যুদ্ধবিমান ভূমধ্যসাগরের ওপরে মার্কিন বিমানগুলোকে আক্রমণ করতে পারে। এজন্য লাজেস বিমানঘাঁটি থেকে মার্কিন ৬ষ্ঠ নৌবহর এই বিমাষগুলোকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসত এবং ইসরায়েলের ২০০ মাইলের কাছাকাছি আসার পর ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো মার্কিন পরিবহন বিমানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করত।
এই এয়ারলিফট পরিচালনা করতে গিয়ে মার্কিন মিলিটারি এয়ারলিফট কমান্ডের সমস্ত নিয়ম-কানুন শিথিল করা হয়েছিল। অবিরাম চলাচলের কারণে বিমানগুলোর ক্রুরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পায়নি, বিমানগুলোতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত সরঞ্জাম তোলা হত, বিমানগুলোর দৈনন্দিন সর্বোচ্চ ব্যবহারের সীমা মানা হয়নি এবং বিমানগুলোর দৈনন্দিন রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত নিয়মকেও উপেক্ষা করা হয়েছিল। এরপরও বিমানগুলো মোট ৫৬৭টি ‘মিশন’ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করে। এই বিমানগুলোতে যেসব ক্রু কাজ করত তারা ইসরায়েলে লাল গালিচা অভ্যর্থনা পেয়েছিল।
এয়ারলিফটের মাধ্যমে যেসব সামরিক সরঞ্জাম ইসরায়েলকে সরবরাহ করা হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে ছিল ‘এম–৬০’ ট্যাঙ্ক, ‘এম১০৯’ ১৫৫ মি.মি. স্বয়ংক্রিয় ক্ষুদ্র কামান (howitzer), ‘এজিএম–৬৫ মাভেরিক’ আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, ‘বিজিএম টো–৭১’ ট্যাঙ্ক–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ভূমিভিত্তিক রাডার ব্যবস্থা, গতিশীল ট্র্যাক্টর ইউনিট, ‘সিএইচ–৫৩ সি স্ট্যালিয়ন’ হেলিকপ্টার এবং ‘এ–৪ স্কাইহক’ যুদ্ধবিমানের অংশ। এভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বমোট ২২,৩৯৫ টন সামরিক সরঞ্জাম ইসরায়েলের নিকট হস্তান্তর করে।
এই এয়ারলিফটের মাধ্যমে সরবরাহকৃত অস্ত্রশস্ত্রের যুদ্ধের চাকা ঘুরিয়ে দেয়। ইসরায়েলিরা যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের হারানো অস্ত্রশস্ত্র এগুলোর দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে এবং মিসরীয় ও সিরীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে। মার্কিন–নির্মিত মাভেরিক ও টো ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইসরায়েলিরা মিসরীয় ও সিরীয় সাঁজোয়া বহরগুলোকে বিধ্বস্ত করে ফেলে। মার্কিন–নির্মিত বৈদ্যুতিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা (electronic countermeasures) ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলোকে বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। এর ফলে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী মিসরীয় ও সিরীয় বাহিনীর ওপর পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়।
২৫ অক্টোবরের মধ্যে ইসরায়েলি সৈন্যরা মিসরীয় বাহিনীকে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করে এবং সুয়েজ খাল অতিক্রম করে খালটির পশ্চিম তীরে চলে এসে মিসরের ১,৬০০ বর্গ কি.মি. ভূমি দখল করে নেয়। মিসরীয় সেনাবাহিনীর ৩য় সৈন্যদল (3rd Army) ইসরায়েলি সৈন্যদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং ইসরায়েলি সৈন্যরা মিসরের রাজধানী কায়রো থেকে মাত্র ১০০ কি.মি. দূরে ছিল। সিরীয় রণাঙ্গনে ইসরায়েলি সৈন্যরা গোলান মালভূমি থেকে সিরীয় সৈন্যদের বিতাড়িত করে এবং সিরিয়ার মূল ভূখণ্ডের ৫০০ বর্গ কি.মি. অঞ্চল দখল করে নেয়। এসময় তারা সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাস থেকে মাত্র ৩০ কি.মি. দূরে ছিল। অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়।
১৯৭৩ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইসরায়েল গুরুতর সামরিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি এসময় এয়ারলিফটের মাধ্যমে ইসরায়েলকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ না করত, ইসরায়েল এই যুদ্ধে পরাজিত হতো এবং ইসরায়েলের অস্তিত্ব নিয়েও শঙ্কা দেখা দিত। এজন্য মার্কিন ম্যাগাজিন রিডার্স ডাইজেস্টের মতে, অপারেশন নিকেল গ্রাস ছিল এমন একটি এয়ারলিফট যেটি ইসরায়েলকে রক্ষা করে।
অপারেশন নিকেল গ্রাস ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় একটি সাফল্য। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযান থেকে কয়েকটি শিক্ষা লাভ করে।
প্রথমত, পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর আচরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারে যে, বিশ্বব্যাপী সামরিক শক্তি প্রয়োগের সামর্থ্য বজায় রাখতে হলে তাদের অন্য কোনো রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করা যাবে না। এজন্য মার্কিন বিমানবাহিনী আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় যুদ্ধবিমানে জ্বালানি পূর্ণ করার জন্য একটি বিমানবহর মোতায়েন করে।
দ্বিতীয়ত, এই অভিযানের আগপর্যন্ত মার্কিন গণমাধ্যমে ‘সি–৫’ পরিবহন বিমানগুলোকে অকার্যকর ‘সাদা হাতি’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছিল। এই অভিযানে সেটি ভুল প্রমাণিত হয় এবং মার্কিন বিমানবাহিনী একটি ‘সি–৫’ বিমানবহর গড়ে তোলে।
সর্বোপরি, এই অভিযানে মার্কিন বেসামরিক বিমান সংস্থাগুলো মার্কিন সরকারকে সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানায়। এজন্য পরবর্তীতে এরকম পরিস্থিতি যেন না হয় সেজন্য মার্কিন সরকার ‘সিভির রিজার্ভ এয়ার ফ্লিট’ আইন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়, যার মাধ্যমে বেসামরিক বিমান সংস্থাগুলো সরকারের নির্দেশ মানতে বাধ্য হয়। এর ফলে ১৯৯০–১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিন বেসামরিক বিমান সংস্থাগুলো মধ্যপ্রাচ্যে সৈন্য ও রসদপত্র পরিবহন করতে বাধ্য হয়।
তবে অপারেশন নিকেল গ্রাস ইসরায়েলকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করলেও ইসরায়েলকে সহায়তা করার কারণে তেলসমৃদ্ধ আরব রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্ষুব্ধ হয় এবং তেল অবরোধ আরোপ করে। এর ফলে ১৯৭৩ সালের জ্বালানি সঙ্কট আরম্ভ হয়।
সবশেষে একটি তথ্য উল্লেখ না করলেই নয়। অপারেশন নিকেল গ্রাস কিন্তু ১৯৭৩ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধের একমাত্র এয়ারলিফট বা অস্ত্র সরবরাহ ছিল না। এসময় সোভিয়েত ইউনিয়নও ‘আন্তোনভ আন–১২’ এবং ‘আন্তোনোভ আন–২২ আন্তেই’ পরিবহন বিমানের মাধ্যমে প্রায় ১৫,০০০ টন সামরিক সরঞ্জাম মিসর ও সিরিয়াকে সরবরাহ করে। এছাড়া, সমুদ্রপথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে ৩৩,২১০ টন সামরিক সরঞ্জাম এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসর ও সিরিয়াকে ৬৩,০০০ টন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে।