৬ই সেপ্টেম্বর। রাত ১১টা। আমেরিকান সার্জেন্ট এজরা লি তখন কচ্ছপ আকারের সাবমেরিন ‘দ্য আমেরিকান টার্টেল’ এর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মিশন লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে নিউ ইয়র্ক বন্দরে থাকা ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল রিচার্ড হাওয়ার্ডের ফ্ল্যাগশিপ Eagle জাহাজটিতে টাইম বোমা যুক্ত করে ধ্বংস করা এবং দ্রুতই নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছানো। কিছুটা দ্বিধান্বিত তিনি। মাত্র কিছুদিন আগে আবিষ্কৃত নতুন সাবমেরিনটি দিয়ে এই গুরুদায়িত্ব কী আসলেই তিনি পালন করতে পারবেন?
আপনাকে যদি অনুমান করতে বলা হয় কাহিনীর সময়কাল বা যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় বিশ্বের সর্বপ্রথম সাবমেরিন ‘দ্য আমেরিকান টার্টেল’ কবে আবিষ্কৃত হয় আর আপনার যদি উত্তরটি জানা না থাকে, তাহলে অনুমানবশত আপনি বলবেন হয়তো প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। কিন্তু অবাক করা উত্তরটি হলো, তারও প্রায় ১৫০ বছর আগে অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকেই পৃথিবী দেখেছিল চমকে দেওয়ার মতো নতুন এক যুদ্ধ হাতিয়ার, যা কিনা পানির নীচে চলে। এই হাতিয়ারকে পুঁজি করেই আমেরিকানরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য চলা Revolutionary War এ যুদ্ধের নতুন নকশা আঁকে।
যদিও প্রথম সাবমেরিনটি আরো ১০০ বছর আগে সপ্তাদশ শতাব্দীর দিকে কর্নেলিয়াস ভ্যান ড্রেবেল নামক ডাচ উদ্ভাবক কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছিলো। কিন্তু আরো ১৫০ বছর সময় লেগে যায় সাবমেরিনকে যুদ্ধে ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে, আর কাজটি করেছিলেন আমেরিকান উদ্ভাবক ডেভিড বুশনেল। ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন সময়েই তিনি সাবমেরিন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পানির নীচে ব্যবহার্য বোমা বিষয়ক গুরু ডেভিড কীভাবে তার তৈরি বোমা যুদ্ধক্ষেত্রে বিনা বাধায় পৌঁছাতে পারবেন তা নিয়ে চিন্তা করতে করতেই আবিষ্কার করে ফেলেন ‘দ্য আমেরিকান টার্টেল’। বোমা বিজ্ঞানের গুরু হলেও দেশপ্রেমিক উপাধিটাও যেন তাকে মানায়।
আমেরিকান টার্টেলের গঠন
টার্টেল বা কচ্ছপ নামটির পেছনে কারণটা হচ্ছে এর গঠন। সাবমেরিনটি বানানো হয়েছিলো দুটো শেল বা খোলসের জোড়া লাগিয়ে, সেই সাথে যেহেতু এটি পানির নীচে অপারেশনে অংশ নিত তাই নাম দেয়া হয় আমেরিকান টার্টেল। লম্বায় ১০ ফুট ও ৩ ফুট প্রশস্ত এই সাবমেরিনে ১ জন অপারেটর বসার মতো জায়গা ছিল, সাথে ছিল একটি রাডার নেভিগেশনের জন্য। ওক কাঠ ও উত্তপ্ত আলকাতরার সমন্বয়ে তৈরি এই সাবমেরিনটি হাত দিয়ে পরিচালিত প্রোপেলার (Hand-cranked Propeller) দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেত। গঠনটির চারপাশে ছিল স্টিলের শক্ত আবরণ যা পানি ভেতরে ঢোকা প্রতিরোধ করত।
পানির নীচে ডুবে যাওয়ার জন্য এর সাথে লাগানো স্টিলের ভেসেলকে প্রথমে পানিপূর্ণ করা হতো। আবার ভেসে উঠতে চাইলে ধীরে ধীরে হাত দিয়ে ক্র্যাঙ্ক ঘুরিয়ে পাম্পের সাহায্যে পানি বের করে দেয়া যেত। Air Tight বা বায়ুনিরুদ্ধ সাবমেরিনটিতে ১ জন অপারেটরের মাত্র ৩০ মিনিট শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করার ব্যবস্থা ছিল।
আবার যদি কখনো বাইরের স্টিলের আস্তরণে ফাটল ধরে জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হতো তার জন্যও ব্যবস্থা রেখেছিলেন বুশনেল। ফাটল দিয়ে পানি ঢুকছে টের পেলে আলগা লাগানো ২০০ পাউন্ডের লেড ধাতুর বারটি খুলে ফেলার জন্য অপারেটরকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিলো। বারটি খুলে গেলে ধীরে ধীরে টার্টেলও ওপরে উঠে আসত।
আলোর জন্য উপরের পৃষ্ঠে কাঁচের আস্তরণ ছিল। যেহেতু বেশিরভাগ অপারেশেন রাতে ছিল , তাই আলোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছিলো এমন কিছু শৈবাল যা অন্ধকারে জ্বলে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Bioluminescent শৈবাল। এককথায় সময়ের তুলনায় বহুগুণে এগিয়ে ছিল কাঠের তৈরি এই সাবমেরিনটি। পদার্থবিজ্ঞানের মূল কিছু নীতি কাজে লাগিয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীতে বানানো এই সাবমেরিনটির জন্য বুশনেল অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
আমেরিকান টার্টেলের প্রথম অপারেশন
মার্কিন স্বাধীনতা যুদ্ধ বা মার্কিন বিপ্লবী যুদ্ধ (১৭৭৫-১৭৮৩) হলো গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আমেরিকার তেরটি উপনিবেশের বিদ্রোহ যার ফলে গঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমে এই লড়াই শুধু উপনিবেশগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ফরাসি ও স্প্যানিশদের আগমনের ফলে তা কানাডা, ভারত, ক্যারিবীয় ও ইস্ট ইন্ডিজে ছড়িয়ে পড়ে।
বুশনেলের আবিষ্কৃত সাবমেরিনটির অস্তিত্ব গোপন রাখার কথা থাকলেও কংগ্রেসম্যান জেমস ডাউনের পক্ষে কাজ করা গুপ্তচরের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য তিনি জানিয়ে দেন প্রদেশের গভর্নরকে। কানেক্টিকাট ও অফ লং আইল্যান্ডে সাবমেরিনটির কার্যক্ষমতা সরেজমিনে পরীক্ষা করে হাডসন নদীতে টার্টেলকে পাঠানো হয়েছিলো Demo-attack এর জন্য।
অবশেষে ১৭৭৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ‘দ্য আমেরিকান টার্টেল’-কে এর প্রথম আক্রমণের জন্য তৈরি করা হয়।
মিশন কি সফল হয়েছিলো?
সেই গ্রীষ্মকালীন রাতটিতে ম্যানহাটন দ্বীপের দক্ষিণে রাখা Eagle জাহাজটিকে লক্ষ্য করে যাত্রা শুরু করেন লি। কিন্তু মিশনটি প্রায় পণ্ড হওয়ার জোগাড়। যতই চেষ্টা করেন না কেন কিছুতেই সাবমেরিনটিকে জাহাজের কাছে নিতে পারছিলেন না। অবশেষে স্রোত অনুকূলে বইতে শুরু করলে সাবমেরিনটি ধীরে ধীরে ব্রিটিশ অধ্যুষিত এলাকায় পৌঁছায়।
জাহাজটি দৃশ্যমান হলে তিনি টার্টেলকে জাহাজের একদম কাছাকাছি স্থাপন করেন। জাহাজটিতে যাতে বিস্ফোরক প্যাকেজটি সংযুক্ত করতে পারেন তার জন্য যুদ্ধ জাহাজটির গায়ে ড্রিল করে ছিদ্র করার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু কোনোভাবেই ধাতুর অপ্রতিরোধ্য বাঁধা ভাঙ্গতে পারলেন না। শেষমেশ সাবমেরিনটি সম্পূর্ণ ডুবিয়ে জাহাজের সরাসরি নীচে গিয়ে বোমা সংযুক্ত করার চেষ্টাও ব্যর্থ হলো, কেননা সাবমেরিনটির সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো এটি এক জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।
এভাবে মিশনে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছিলেন তিনি। ফিরে আসার পথে তিনি যখন সাবমেরিনটি নিয়ে ভেসে উঠেছিলেন তখন ব্রিটিশদের চোখে পড়লেও তারা বুঝতে পারেনি এমন অদ্ভুত দেখতে জিনিস আসলে কী। বুঝতে পারলে হয়তো সেই যাত্রায় এজরা লি বাঁচতে পারতেন না।
টার্টেলের পরবর্তী মিশন
৫ অক্টোবর সাবমেরিনটি নিয়ে আরেকটি প্রচেষ্টা চালান সার্জেন্ট লি। একই ধরনের বিস্ফোরক নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ব্রিটিশদের একটি মাঝারি আকৃতির রণতরীকে লক্ষ্য করে। কিন্তু ব্রিটিশ আর্মির চোখে পড়ে যাওয়ায় মিশনটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন তিনি।
তারও কিছুদিন পর ফোর্ট লি এর যুদ্ধে অদ্ভুত দেখতে এই হাতিয়ারটি ব্রিটিশ আর্মির চোখে আবার ধরা পড়লে তারা ধারণা করতে পারেন যে, এটা নিশ্চয়ই যুদ্ধের সাথে জড়িত। তাই এবার আর রক্ষা মেলেনি ‘দ্য টার্টেল’ এর। শত্রুপক্ষের ছুঁড়ে দেয়া বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় সাবমেরিনটি, যদিও এবার সাবমেরিনটি সরাসরি কোনো মিশনে যুক্ত ছিল না।
আমেরিকান টার্টেল শেষ পর্যন্ত একটি ব্যর্থতার গল্প হলেও জর্জ ওয়াশিংটন এই প্রচেষ্টাকে effort of a genius হিসেবে আখ্যা দেন এবং যুদ্ধের পর বুশনেল ওয়েস্ট পয়েন্ট আমেরিকান আর্মির কমান্ডার হয়ে যোগদান করেন।
সাবমেরিন ব্যবহার করে শত্রুপক্ষের জাহাজ ধ্বংসের প্রচেষ্টায় সফল হতে আমেরিকানদের অপেক্ষা করতে হয়েছিলো আরও ১০০ বছর এবং সাবমেরিন অ্যাটাকের প্রথম বলি হয় ১৮৬৪ সালে গৃহযুদ্ধে ব্যবহৃত যুদ্ধ জাহাজ এইচ. এল. হানলি।
আমেরিকান টার্টেল একটি ব্যর্থ মিশনের আত্মকথা হলেও আমেরিকানদের মনে সাবমেরিনের প্রতি অসীম ভালোবাসার জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়। আর এই ভালোবাসার বন্ধন যে এখনো অটুট আছে তা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত অত্যন্ত উন্নতমানের সাবমেরিনগুলো দেখলেই বোঝা যায়।