আধুনিক প্রযুক্তির যেসব আবিষ্কার মানুষের জীবনকে সবচেয়ে বেশি সহজ করেছে তার মধ্যে মোবাইল ফোনের সাথে হয়তো অন্য কিছুর তুলনা চলে না। মোবাইল ফোন বা সেলফোন ছাড়া বর্তমান যুগের একটি দিনও যেন কল্পনা করা যায় না। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই প্রয়োজন হয় ছোট্ট এই ডিভাইসটির।
সর্বপ্রথম মোবাইল ফোন তৈরি করা হয়েছিল আমেরিকার নিউ ইয়র্কে। ১৯৭৩ সালে এই মোবাইল ফোনটি তৈরি করেছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ার মার্টিন কুপার। তাকেই বলা হয় মোবাইল ফোনের জনক।
বর্তমান বিশ্বের বিখ্যাত প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মটোরোলা তখন ছিল ছোট্ট একটি টেলিকম কোম্পানি। সেই কোম্পানিতেই চাকরি করতেন কুপার। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। তিনি ভাবতেন, এমন একদিন আসবে, যখন সবার হাতেই তার নিজস্ব মোবাইল থাকবে। সেই মোবাইলের মাধ্যমে সব সময়, যেকোনো মানুষের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে। সেসময় সাধারণ মানুষের কাছে তার এই স্বপ্ন ছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো।
মার্টিন কুপার যখন ঠিক এই চিন্তা করছিলেন, তার পূর্বে প্রায় ১০০ বছর ধরে ফোন মানেই ছিল ল্যান্ডফোন বা টেলিফোন। এর মাধ্যমে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ যেমন রাখা সম্ভব নয়, তেমনি এটা বহনযোগ্যও ছিলনা। কুপার ভাবতেন, এমন একটি যন্ত্র তৈরি হওয়া প্রয়োজন যার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা যাবে। যেটা বহনযোগ্য হবে এবং সবসময় কাছে রাখা সম্ভব হবে।
ষাটের দশকে স্টারট্রেক নামক একটি টিভি শো আমেরিকায় খুব জনপ্রিয় ছিল। এই টিভি শো-র চরিত্রদের ক্ষেত্রে দেখা যেত- প্রায়ই তারা হাতে একটি কমিউনিকেটর নামক যন্ত্র ব্যবহার করতেন, যার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। এই জিনিসটি ছিল আকারেও বেশ ছোট এবং সহজেই বহনযোগ্য। অনেকেই বলে থাকেন, কমিউনিকেটর নামক সেই যন্ত্রটিই কুপারকে মোবাইল ফোন বানাতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
কুপার অবশ্য বলেছেন ভিন্ন কথা। আমেরিকার কমিক স্ট্রিপ ডিক ট্রেসি চরিত্রেরা পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগের জন্য হাতঘড়ির মতো টু ওয়ে রিস্ট রেডিও ব্যবহার করতেন, যা ছিল সহজেই বহনযোগ্য, সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখাও সম্ভব ছিল। কেননা এটা ঘড়ির মতো হাতে পরা থাকত। এই ডিভাইসটি দেখেই সর্বপ্রথম তিনি মোবাইল ফোন তৈরির কথা চিন্তা করেন।
১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে নিউ ইয়র্কে কুপার এবং তার দল পৃথিবীর প্রথম মোবাইল ফোনের প্রোটোটাইপ উপস্থাপন করেন। সেটা কিন্তু দেখতে একদমই অন্যরকম ছিল। আজকের মোবাইল ফোন বা সেল ফোনের সাথে এর কোনো তুলনাই চলে না।
পৃথিবীর প্রথম তৈরি সেই মোবাইল ফোনটি ছিল লম্বায় প্রায় ১০ ইঞ্চি এবং প্রস্থে ২ ইঞ্চির মতো। এই বিশালাকৃতির জন্য এটি ওজনেও ছিল বেশ ভারী, প্রায় দেড় কেজির মতো। শুধু তা-ই নয়, মাত্র ২০ মিনিট কথা বললেই ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে যেত। তারপর আবার চার্জে দিয়ে দিয়ে রাখতে হতো কয়েক ঘন্টা। সেই ফোন দেখে কত লোকই না তামাশা করেছিল! আসলে তখনকার পরিস্থিতিতে এর চেয়ে ভালো কিছু করা হয়তো সম্ভব ছিল না।
৩ এপ্রিল, ১৯৭৩; নিউ ইয়র্কের সিক্সথ অ্যাভিনিউ থেকে মার্টিন কুপার মোবাইল ফোনে সর্বপ্রথম কলটি করেন। সেসময় নিউ ইয়র্কের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন তিনি। তার বন্ধু ছিল এটিঅ্যান্ডটি কোম্পানির একজন ইঞ্জিনিয়ার, নাম জোয়াল ইঙ্গল। কুপার তার তৈরি প্রথম মোবাইল ফোন দিয়ে ইঙ্গলকে কল করেন।
এটিঅ্যান্ডটি তখন ভবিষ্যতের আধুনিক মোবাইল নির্মাণের চিন্তা-ভাবনাই করছিল। সেলুলার টেকনোলজি নামক একধরনের প্রযুক্তি তারাই প্রথম উদ্ভবন করে। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে একাধিক সেলের নেটওয়ার্কের মধ্যে বার্তা বিনিময়ের এ প্রযুক্তি দিয়ে তারা মোবাইল ফোন নির্মাণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ছোট্ট টেলিকম কোম্পানি মটোরোলা তাদেরকে টপকে আগেই মোবাইল ফোন নির্মাণ করে ফেলল।
আসলে এটিঅ্যান্ডটি চেয়েছিল সেলুলার প্রযুক্তিকে গাড়িতে ফোন সংযুক্ত করার জন্য ব্যবহার করবে। গাড়ি বাদেও সার্বক্ষণিক সঙ্গে মোবাইল ফোন বহন করা যে সম্ভব হবে, তা তাদের ভাবনাতে ছিল না। কুপারের দল আরেকটি বিষয়ে জানতেন। আমেরিকার ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশনারদের কাছে এটিঅ্যান্ডটি ধর্না দিয়েছিল, যেন তাদেরকে রেডিও স্পেকট্রাম ব্যবহারের একচেটিয়া অনুমতি দেয়া হয়। এর মাধ্যমে তারা আমেরিকার লক্ষ লক্ষ গাড়িকে সেলুলারে সংযুক্ত করবে এবং তাতে টেলিফোন সংযোগ দিতে পারবে।
মটোরোলা জানতো, যদি এটিঅ্যান্ডটি একবার এই অনুমতি পেয়ে যায়, তাহলে তারা তাদের তৈরিকৃত ফোনের জন্য আর রেডিও স্পেকট্রাম পাবে না। এটিঅ্যান্ডটি ছিল তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় টেলিকম কোম্পানি। ওয়াশিংটনে তাদের একাধিক লবিয়িস্টও ছিল। এমনকি ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশনারদের সাথে ভালো যোগাযোগও ছিল তাদের। ফলে মটোরোলা জানতো কমিউনিকেশন কমিশনারদের প্রভাবিত করতে হলে তাদের অনেক বড় কিছু করতে হবে। ভবিষ্যতের ফোন কেমন হবে এবং এমন একটি ফোন তাদেরকে তৈরি করে দেখাতে হবে। এই ফোন তৈরির জন্য তাদেরকে সময় দেয়া হয়েছিল মাত্র তিন মাস।
প্রথম মোবাইল ফোন তৈরি করতে কাজ করে ২০ জন। কিন্তু তাদেরকে সেল ব্যবহার করে এমন একটি রেডিও স্টেশন বানাতে হয়েছিল যার জন্য কাজ করে আরো প্রায় ৩০ জন। নিউ ইয়র্কে ফোনটা কীভাবে কাজ করবে তা দেখানোর জন্য কাজ করেছিল আরো অনেকে। সবাইকেই দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল।
অবশেষে মার্টিন কুপার যে ফোনটি তৈরি করেন তাতে সর্বমোট ৩০টি ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট ব্যবহার করা হয়। ওজন ছিল একটা চিনির প্যাকেটের চেয়েও বেশি। সাংবাদিকদের দেখানোর জন্য ১৯৭৩ সালে এই মোবাইলের দুটি প্রোটোটাইপ তৈরি করা হয়। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে ১৫-২০ জনের বেশি সাংবাদিক উপস্থিত ছিল না। কারণ, ছোট্ট একটি টেলিকম কোম্পানিকে সেভাবে সাংবাদিকেরা গুরুত্ব দেননি। কিন্তু যখন দেখানো হলো এই মোবাইলটি কীভাবে কাজ করে, তখন সারা পৃথিবীতেই এই ফোনের খবর প্রচারিত হয়ে গেল।
তবে ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশনারদের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহারের অনুমতি পেতে আরো কয়েক বছর লেগে যায়। অবশেষে মটোরোলা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহারের অনুমতি পায়। এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখেন তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগ্যানও। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৩ সালে বাজারে আসে মটোরোলা কর্তৃক নির্মিত পৃথিবীর সর্বপ্রথম DynaTAC 8000X মডেলের মোবাইল ফোনটি।
সেসময় অধিকাংশ মানুষই ভেবেছিল এই ফোন ব্যবহার করার আর্থিক সঙ্গতি তাদের কখনোই হবে না। কেননা, সেসময় এই ফোনের দাম ছিল তৎকালীন হিসেবে ৪ হাজার ডলার। তাছাড়া এতে কথা বলার খরচও ছিল অনেক বেশি। সেসময় এটা যেন ধনী ব্যক্তিদের খেলনা বা ঘর সাজানোর জিনিসে পরিণত হয়েছিল। তখন সাড়া জাগানো কিছু হলিউড মুভিতেও এই ফোনের ব্যবহার দেখানো হয় এবং প্রায়ই টিভি শো-তে এই ফোনগুলো ব্যবহার করা হতো। আকার-আকৃতিতে এটি ছিল বড় জুতার মতো। এজন্য এই ফোনকে অনেকেই মজা করে শু-ফোন বলে ডাকত।
প্রথম প্রথম এই মোবাইল ফোনগুলোর দাম বেশি থাকার কারণে খুব বেশি মানুষ কিনতে পারত না। তাছাড়া ফ্রিকোয়েন্সির অভাবে সব জায়গা থেকে এটা ব্যবহারও করা যেত না। বেশ কয়েক বছর পর যখন সাশ্রয়ী দামে এই ফোনগুলো বাজারে আসলো তখন যেন মোবাইল ফোন বিপ্লব ঘটে গেল। মোবাইল ফোনের দোকানগুলোর সামনে লম্বা লাইন লেগে থাকত। বিশ্বব্যাপী ল্যান্ডফোনের জায়গা দখল করে নিল এই মোবাইল ফোনগুলো। ধীরে ধীরে এর প্রচলন শুরু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও। এমনকি নব্বইয়ের দশকেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তারওয়ালা ফোনগুলোর তুলনায় মোবাইল ফোনের প্রচলন বেশি দেখা যায়।
মার্টিন কুপারের বয়স বর্তমানে ৯০ পেরিয়েছে। মোবাইল ফোনের এই জনক বর্তমানে বসবাস করেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। বার্ধক্যের এই দিনগুলোতে এসেও তিনি স্বপ্ন দেখেন এমন একটি মোবাইল ফোন তৈরি হবে যা মানুষের কানের মধ্যেই স্থান করে নিতে পারবে। এমনকি এই ফোনগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের উপরও নজর রাখতে পারবে।