২০১২ সালের ১৩ জানুয়ারী, ঘড়িতে তখন সময় রাত নয়টা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ গিগলিও’র পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে বিশাল এক প্রমোদতরী। দেখে মনে হচ্ছে সমুদ্রের জলে ডানা ভিজিয়ে ভেসে চলেছে এক সাদা দানবীয় রাজহাঁস। শান্ত সমুদ্র, আকাশ একটু মেঘলা। হাসি গানে মেতে আছে বিশাল প্রমোদতরীর যাত্রীরা। এমন সময় হঠাৎ প্রবলভাবে কেঁপে উঠলো গোটা জাহাজটি। হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়ে গেলেন অনেক যাত্রী। বিস্ময়ের রেশ কাটতে না কাটতেই জাহাজের এক পাশ কাত হয়ে যেতে লাগলো। অন্ধকারে ডুবে গেলো বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল আলো ঝলমলে এই বিশাল প্রমোদতরী।
কস্টা কনকর্ডিয়া ছিল ‘কনকর্ডিয়া’ সিরিজের প্রথম প্রমোদতরী। ২০০৪ সালে এই বিশাল ও রাজকীয় প্রমোদতরীটি তৈরি করা হয়। প্রায় ৫৭০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার ব্যয় হয় এই জাহাজটি নির্মাণে। পাঁচ বছর আগে ২০১২ সালের ১৩ জানুয়ারী এই বিশাল জাহাজটি ইতালির গিগলিও দ্বীপের কাছে পানির নিচে লুকিয়ে থাকা এক শিলার আঘাতে উল্টে যায়। নিহত হয় জাহাজের ৩২ জন মানুষ। পরে জাহাজটিকে মেরামতের অযোগ্য ঘোষণা করা হয় এবং এটিকে টেনে জেনোয়া বন্দরে নিয়ে আসা হয়। এ বছরের জানুয়ারী মাস অবধি সেখানেই পরিত্যক্ত হিসেবে পড়ে ছিল বিশাল এই প্রমোদতরীটি।
জনাথন ডানকো কেইলকোস্কি নামক এক জার্মান ফটোগ্রাফার গত বছর প্রবেশ করেন সেই ভুতুড়ে পরিত্যক্ত জাহাজটিতে। তিনি তুলে আনেন পরিত্যক্ত জাহাজটির অসাধারণ সব ছবি। ধ্বংস হয়ে যাওয়া জাহাজটির অতীতের আনন্দময় মুহূর্ত ও জীবনের চিত্র কিছুটা হলেও আঁচ করা যায় তার ছবিগুলো থেকে। চলুন দেখে নেই সেই অসাধারণ ছবিগুলো। সেই সাথে জেনে নেই ঠিক কী ঘটেছিল ১৩ জানুয়ারির রাতে।
বিশাল প্রমোদতরী কস্টা কনকর্ডিয়ার যাত্রা শুরুর সময় জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন ফ্রান্সিস্কো চেটিনো। যাত্রার কয়েক ঘণ্টা পর জাহাজটি ইতালির পশ্চিম উপকূলেআইসোলা ডেল গিগলিও দ্বীপের কাছে দুর্ঘটনার শিকার হয়। পানির নিচে লুকিয়ে থাকা ডুবন্ত শিলার আঘাতে জাহাজটির গায়ে ৬০ ফুট চওড়া এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সমস্ত ইঞ্জিনরুমে পানি ঢুকে প্লাবিত হয় সমুদ্রজলে। ফলে জাহাজের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং ইঞ্জিন থেমে যায়।
ধীরে ধীরে পানিতে ডুবে যেতে থাকা জাহাজটি কাত হয়ে যাওয়ার ফলে তা দুর্ঘটনার স্থান থেকে ৫০০ মিটার দূরে সরে যায় এবং জাহাজের ডান দিকটি পানির নিচে সম্পূর্ণ ডুবে গিয়ে স্থির হয়।
এমন বিপদজনক পরিস্থিতিতে অস্থির হয়ে উঠে পুরো জাহাজের লোকজন। কিন্তু শান্ত সমুদ্র হতে তীরের কাছাকাছি স্থানে ধীরে ধীরে জাহাজটি সমুদ্রে ডুবতে থাকা সত্ত্বেও দুর্ঘটনার সাথে সাথে জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেননি জাহাজের ক্যাপ্টেন। বরং দুর্ঘটনার প্রায় এক ঘন্টা পর এই নির্দেশ দেওয়া হয়। ততক্ষণে জাহাজটি ধীরে ধীরে কাত হয়ে যায় এবং জাহাজের অর্ধেক অংশ ডুবে যায় পানির নিচে। জাহাজের বাকি অর্ধেক অংশ পানির উপরে থাকলেও ২৩০ ফুট পানির নিচে যেকোনো সময় ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে ছিল জাহাজটি।
আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অনুযায়ী, জাহাজ ত্যাগের নির্দেশের ৩০ মিনিটের মধ্যেই সকল যাত্রীকে জাহাজ ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু কস্টা কনকর্ডিয়ার যাত্রীদের প্রাথমিক উদ্ধার কাজ সম্পন্ন করতে লেগে যায় প্রায় ছয় ঘন্টা এবং এই উদ্ধারকাজ চলে কয়েক মাস পর্যন্ত। তবুও সব যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি সেদিন। ৩,২২৯ জন যাত্রী ও ১,০২৩ জন নাবিককে জীবিত উদ্ধার করা হয় এবং ৩২ জনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও দুজন নিখোঁজ হন।
২০১২ সালের ১৪ থেকে ৩০ জানুয়ারী পর্যন্ত উদ্ধারকারী ডুবুরী দল জাহাজটিতে নিখোঁজ যাত্রীদের খোঁজ চালায়। তারা ধারণা করেন, এখনও জাহাজের মধ্যে জীবিত যাত্রী রয়ে গেছে। এ সময় সমুদ্রের পানির সীমারেখা থেকে দুই ডেক উপরের এক কেবিন থেকে সদ্য বিবাহিত এক কোরিয়ান দম্পতিকে উদ্ধার করে উদ্ধারকারী দল। এছাড়াও তারা জাহাজের এক জীবিত কর্মচারীকে খুঁজে পায় যার একটি পা ভেঙ্গে গিয়েছিল। জীবিতদের পাশাপাশি উদ্ধারকারী দল ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে বের করে নিয়ে আসে একের পর এক মৃতদেহ।
ঘটনার দুই দিন পর ১৫ জানুয়ারী উদ্ধারকারী দল দুটি মৃতদেহের খোঁজ পেয়েছে বলে ধারণা করে। নিখোঁজ দুজনের একজন ছিলেন এক ভদ্রমহিলা এবং অন্যজন ছিলেন জাহাজের কর্মচারী। তবে তাদের মৃতদেহ এমন স্থানে ছিল যে, জাহাজটিকে সোজা না করে তা উদ্ধার করা ছিল অসম্ভব। এরপর ২৮ জানুয়ারী জাহাজের ডুবে যাওয়া একটি অংশ থেকে ১৭ তম মৃতদেহটি উদ্ধার করা হয়। মৃতদেহটি ছিল জাহাজে কর্মরত এক মহিলা নাবিকের।
এভাবে কয়েক মাস ধরে উদ্ধার কাজ চালায় ডুবুরিরা। এরপর ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর অর্ধেক ডুবে যাওয়া এই জাহাজটিকে সোজা করা হয়। আবার শুরু হয় দুইটি নিখোঁজ মৃতদেহের খোঁজ। নয় দিনের মাথায় জাহাজের কেন্দ্রীয় অংশে পচন ধরা কয়েকটি মৃতদেহ পায় উদ্ধারকারী দল। এদের কাউকেই শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না। পরবর্তীতে এই মৃতদেহগুলো ডিএনএ টেস্টের জন্য ল্যাবে পাঠানো হয় যাতে তাদের পরিচয় জানা যায়। ২৬ অক্টোবর ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে একটি মৃতদেহের পরিচয় জানা সম্ভব হয় যিনি ছিলেন নিখোঁজ ইতালিয়ান যাত্রী মারিয়া গ্রাজিয়া। বাকি একজন যাত্রীর খোঁজ আজও মেলেনি।
বিশাল প্রমোদতরী কস্টা কনকর্ডিয়ার এই বিপর্যয়ের পেছনে দায়ী করা হয় জাহাজের ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস্কো চেটিনোকে। ক্যাপ্টেন চেটিনো জানান, দ্বীপের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় তিনি জাহাজের কম্পিউটারের নেভিগেশন সিস্টেম বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “কম্পিউটারের হাতে নিয়ন্ত্রণ না দিয়ে আমি নিজের দৃষ্টিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে জাহাজ চালাচ্ছিলাম, কারণ এখানকার সমুদ্রের তলদেশ আমার নখদর্পণে। পানির নিচের ডুবন্ত শিলাটি এখানে থাকার কথা নয়। মেরিটাইম চার্টেও এই পথে কোনো ডুবন্ত শিলার উল্লেখ ছিল না।” তিনি তদন্তকারী দলকে জানান, শেষ মুহুর্তে বিপদ বুঝতে পেরে দ্বীপের কাছাকাছি এসে তিনি জাহাজকে হঠাৎ করেই অন্যদিক ঘুরাতে যান। এ সময় জাহাজের একটি দিক দ্বীপের প্রবাল প্রাচীরের দিকে সরে যায়। তিনি বলেন, “সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আমি দেরি করে ফেলেছিলাম। এর দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে।”
এছাড়াও জাহাজ দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার সত্ত্বেও তিনি এক ঘণ্টা পর সবাইকে জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন এবং সমস্ত যাত্রী উদ্ধার হওয়ার আগেই নিজে জাহাজ থেকে পালিয়ে যান। এ কারণে পরবর্তীতে তাকে মানুষ হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় এবং তার ১৬ বছরের জেল হয়। দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ হিসেবে কস্টা কনকর্ডিয়া কর্তৃপক্ষ জাহাজের প্রত্যেক যাত্রীকে এগারো হাজার ইউরো প্রদানের প্রস্তাব করে। তবে মাত্র তিন ভাগের একভাগ যাত্রী এ ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করেন।
২০১৫ সালে বিশাল এই জাহাজটি ভেঙ্গে এর বিভিন্ন অংশ আলাদা করার কাজ শুরু হয়, যা শেষ হয় এ বছরের জুলাই মাসে। সমস্ত প্রক্রিয়া শেষে বিলাসবহুল সুন্দর এই প্রমোদতরীটি পরিণত হয় ভাঙ্গাচোরা লোহালক্কড়ের স্তুপে।
ফিচার ইমেজ – mirror.co.uk