কর্মক্ষেত্র হিসেবে কেমন ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি?

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী বহুজাতিক কর্পোরেশন কোম্পানি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৬০০ সালে ৩১ জুলাই ব্রিটেনের রানি প্রথম এলিজাবেথ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে রয়্যাল চার্টার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করবার পাশাপাশি তাদের এশিয়ায় ব্যবসা করার জন্য সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছিলেন।

কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসার বিস্তৃতি ছিল দক্ষিণ-পাশ্চাত্যের চিলির কেপহর্ন থেকে দূরপ্রাচ্যের সুদূর চীন পর্যন্ত। সিঙ্গাপুর ও পেনাংয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মালিকানাধীন সমুদ্র বন্দর ছিল। এছাড়া ভারতের বর্তমান মুম্বাই, চেন্নাই ও কলকাতা শহরের উন্নয়নে ব্রিটিশ এই কোম্পানির বড় ভূমিকা ছিল। কিন্তু সেটি ছিল নিছকই ব্যবসার সুবিধার্থে।

কর্মী সংখ্যার দিক থেকে ব্রিটেনে তখনকার সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল সবার উপরে। দেশীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর পাশাপাশি তারা হাজারো বিদেশি কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিল। যেমন- ভারতে তাদের দু’ লক্ষ ষাট হাজার সৈন্যের বিশাল এক বাহিনী ছিল। যার প্রায় অধিকাংশ ছিলেন ভারতীয়। বিশেষ করে সিপাহি হিসেবে যারা কাজ করতেন, তাদের প্রায় সবাই ছিলেন ভারতীয়।

এই বিশাল বাহিনী দিয়েই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের অর্থসম্পদ ও প্রভাব প্রতিপত্তিকে অকল্পনীয় পর্যায়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল। ভারতে ব্যবসা করে তারা ইংল্যান্ড থেকে শুরু করে পুরো ইউরোপের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছিল। ইউরোপিয়ানদের সকালের চা থেকে শুরু করে পরিধানের কাপড়, সবই ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মকর্তা তার পদাতিক সৈন্য ও ভারতীয় চারকদের সাথে; Image Source: Heritage Image Partnership Ltd/Alamy 

এবার বিশ্ব জুড়ে গুগল, ফেসবুক কিংবা অ্যামাজনের প্রভাবের কথা বিবেচনা করুন। বর্তমান বিশ্বের এই টেক জায়ান্টগুলো সরকারি সুবিধা নিয়ে প্রায় পুরো বিশ্বকে নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। এদের ব্যবসার ধরনের সাথে অনেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিল খুঁজে পান।

ইস্ট ইন্ডিয়া যেমন তার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই নিজেদের বাহিনীর গঠনের পাশাপাশি ব্রিটিশ সেনা ও নৌবাহিনীর সুবিধা নিয়ে ভারত দখল করেছিল, ঠিক তেমনি বর্তমান বিশ্বের টেক জায়ান্টগুলো নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে নিজ দেশের কূটনৈতিকদের পাশাপাশি গোয়েন্দা বাহিনীর সুবিধা নিয়ে আসছে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিয়ে দ্য কর্পোরেশন দ্যাট চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড নামে একটি বই লিখেছেন নিক রবিন্স। তিনি সেখানে লিখেছেন,

তহবিল গঠন, পরিচালনা কাঠামো ও ব্যবসায়ীক মডেলের দিক থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিঃসন্দেহে এক আধুনিক কোম্পানি ছিল।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়িক প্রতিপত্তি থেকে এবার তাদের কোম্পানির ভেতরের দিকে নজর দেওয়া যাক। বিশেষ করে এই কোম্পানির পরিচালনা পদ্ধতি এবং তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচন। এছাড়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের কর্মচারীদের জন্য কেমন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করেছিল, সেসব সম্পর্কেও জানা প্রয়োজন।

এই কোম্পানিকে তুলনা করা হয় বর্তমান বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি গুগল, ফেসবুক কিংবা অ্যামাজনের সাথে। তুলনা বললে ভুল হবে। বলা হয়, এসব টেক জায়ান্টরা বরং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে অনুসরণ করছে। তাহলে কি ইস্ট ইন্ডিয়ার কোম্পানির ফেসবুকের মতো সুবিশাল প্রধান কার্যালয় ছিল? কিংবা গুগলের মতো অসাধারণ পার্ক? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি করা কি গুগল কিংবা ফেসবুকের মতো আকর্ষণীয় ছিল? চলুন তাহলে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজ করা যাক।

কর্মী নির্বাচন

বর্তমান বিশ্বের টেক জায়ান্টদের মতো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুধুমাত্র বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী কোম্পানি ছিল না, পাশাপাশি চাকরি করার জন্য এই কোম্পানির যেকোনো পদ ছিল লোভনীয়। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একেকটা নিয়োগ ছিল যুদ্ধ জয়ের সমকক্ষ। কিন্তু সবসময় তা মেধা ও যোগ্যতার বলে হয়েছে, তা বলা যায় না।

এই কোম্পানির অধিকাংশ পদে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের আধিপত্য ছিল। গৃহকর্মী ছাড়া আর কোনো পদে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল না। এমন তথ্যই তুলে ধরেছেন ব্রিটিশ লাইব্রেরির ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রেকর্ডসের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক মার্গারেট মেকপিস।

ঊনিশ শতকের মাঝামাঝিতে লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ডকইয়ার্ডে জাহাজ থেকে চা খালাস করছেন শ্রমিকরা; Image Source: North Wind Picture Archives/Alamy

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মী নিয়োগ করার জন্য প্রতি বছর ২৪ জন শেয়ার হোল্ডারের একটি পরিচালনা কমিটি তৈরি করা হতো। কোম্পানিতে যাদের কমপক্ষে দু’ হাজার পাউন্ডের শেয়ার ছিল, তারাই এই কমিটিতে জায়গা পেতেন। কোম্পানির গুদামের সাধারণ শ্রমিক থেকে শুরু করে লন্ডনের প্রধান কার্যালয়ের একজন কেরানি নিয়োগের ভার ছিল এই কমিটির উপর। এই কমিটির সুপারিশ ছাড়া কোনো কর্মী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ পেতেন না।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নতুন নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণা দিলে লন্ডনের চাকরির বাজারে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হতো। নির্দিষ্ট সংখ্যক পদের বিপরীতে আবেদন সংখ্যা থাকত কয়েক গুণ। এমন তথ্য উঠে এসে এসেছে মার্গারেট মেকপিসের লেখা দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিস লন্ডন ওয়ার্কারস বইতে। তিনি তার বইতে লিখেছেন,

কোম্পানির পদসংখ্যার বিপরীতে চাকরি প্রার্থীদের আবেদন সংখ্যা থাকতো বহুগুণ বেশি। ফলে অসংখ্য আবেদনকারীকে নিরাশ করতে হতো পরিচালনা কমিটিকে।

তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরির জন্য পরিচালনা কমিটির সুপারিশ লাভের অন্য উপায়ও ছিল। স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ছিল কোম্পানির পরিচালনা কমিটির বিরুদ্ধে।

হিউ বোয়েন তার বিজনেস অভ এম্পায়ার বইতে লিখেছেন,

“চূড়ান্তভাবে সাফল্য নির্ভর করতো চাকরি প্রার্থীর সাথে কোম্পানির লোকদের সুসম্পর্ক ও প্রভাবের ওপর। যদি তার নির্ধারিত পদের জন্য দক্ষতা ও যোগ্যতা নাও থাকে তবু তারা চাকরি লাভ করতেন।”

অবৈতনিক ইন্টার্নশিপ

আজকের দিনে বিনামূল্যে কোনো চাকরির কথা কল্পনাই করা যায় না। এমনকি কখনো বেতনভুক্ত কর্মকর্তা কর্মচারীদের তোপের মুখে পড়ত হয় কোম্পানিকে। ফ্রান্সের কন্ডে নাস্তের মতো অনেক মিডিয়া কোম্পানি রয়েছে, যাদের অবৈতনিক ইন্টার্নশিপের কারণে জরিমানা গুনতে হয়েছে। একই কাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি করেছে। তবে এর জন্য তাদের কোনো জরিমানা গুনতে হয়নি।

১৮৪৪ সালের দিকে চীনের ক্যান্টনে ব্রিটিশ ও যুকরাষ্ট্রের দূতাবাসের পাশে ডেনমার্ক ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য কুঠি; Image Source: Granger,NYC./Alamy

ইস্ট ইন্ডিয়াতে কোম্পানির চাকরিতে প্রবেশের আগে একজন কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারীকে বিভিন্ন অঙ্কের বন্ড প্রদানের পাশাপাশি বিনামূল্যে পাঁচ বছর মেয়াদে ইন্টার্নশিপ করতে হতো। ১৭৭৮ সালে ইন্টার্নশিপের মেয়াদ কমিয়ে তিন বছর করা হয়। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে এসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের ইন্টার্নশিপে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সারা বছরের জন্য মাত্র ১০ পাউন্ডে ভাতা প্রদান করতো, যা বর্তমান সময়ে ১২,৩৫০ পাউন্ডের সমান।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইন্টার্নশিপে প্রবেশের জন্য প্রত্যেক কর্মচারীকে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ বন্ড বা বন্ধক রাখতে হতো। পদ যত ওপরে, বন্ধকের পরিমাণ ছিল তত বেশি। কখনো কখনো তা ৫০০ পাউন্ড স্পর্শ করতো। যা আজকের দিনে ৩৬,০৫০ পাউন্ড বা ৫১,৮০০ ডলারের সমান। টাকার হিসেবে যা প্রায় ৪৪ লাখ!

১৬৮০ এর দিকে ইস্ট ইন্ডিয়ার অধীনস্থ বিদেশি কোনো কারখানার প্রধানকে পাঁচ হাজার পাউন্ড বন্ধক রাখতে হতো। যা এখনকার সময়ে ৩,৬০,৫০০ পাউন্ডের সমান। বন্ধক রাখার পাশাপাশি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে নিয়োগ পাওয়ার জন্য আচার-আচরণকে গুরুত্বের সাথে দেখা হতো। সবমিলিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরির জন্য বন্ড, ব্যবহার ও ইন্টার্নশিপের পারফরম্যান্স ছিল মূল নির্ণায়ক। এই তিন ক্যাটাগরিতে যারা ভালো করতে পারতেন, তারাই পরবর্তী সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে স্থায়ীভাবে নিয়োগ পেতেন।

প্রশিক্ষণ

১৮০০ সালের দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা লক্ষ করলেন, তারা যে সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ দিয়েছেন, তারা সাম্রাজ্য পরিচালনা করার মতো দক্ষ নন। তখন তারা এর সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন। পরবর্তী সময়ে তারা যে সমাধান বের করলেন, তা ছিল এক ধরনের ‘এমপ্লয়ি বুট ক্যাম্প’।

১৮০৬ সালে স্থপতি উইলিয়াম উইলকিন্সের করা নকশায় হেইলিবারিতে ৬০ একর জমির উপর কোম্পানির অর্থায়নে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজ চালু করা হয়৷ এই কলেজে মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।

হেইলিবারিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজ, যার বর্তমান নাম ইমপেরিয়াল সার্ভিসেস কলেজ; Image Source: Julia Catt Photography/Alamy

হেইলিবারির প্রশিক্ষণের পাঠ্যক্রমে ছিল ইতিহাস, আইন, হিন্দি, ফারসি, তেলেগু ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা৷ মোটের উপর ভারতীয় উপমহাদেশে কোম্পানির শাসনকার্য পরিচালনা করার জন্য যা জানা অত্যাবশ্যক, তার সবই এই কলেজে পড়ানো হতো।

সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে। ফলে ১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজও বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে অবশ্য এই কলেজ পুনরায় চালু করা হয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘হেইলিবারি অ্যান্ড ইমপেরিয়াল সার্ভিসেস কলেজ’।

প্রধান কার্যালয়

ক্যালিফোর্নিয়ার মেনলো পার্কে ফ্রাঙ্ক গেরির নকশায় চার লাখ ত্রিশ হাজার বর্গফুটের সুবিশাল প্রধান কার্যালয় তৈরি করেছে ফেসবুক। যার ছাদে রয়েছে নয় একরের বিশাল বাগান। বর্তমান বিশ্বে ফেসবুকের প্রধান কার্যালয় সর্ববৃহৎ ওপেন ফ্লোর বিল্ডিং। গুগলেরও রয়েছে বিশাল আয়তনের প্রধান কার্যালয়, যার মধ্যে ফিটনেস সেন্টারই আছে সাতটি।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডনের প্রধান কার্যালয়ে সুবিশাল ছাদ কিংবা বাগান না থাকলেও তাদের কোম্পানির পরিচালকরা জাঁকালো ও চিত্তাকর্ষক এক ভবন তৈরি করেছিলেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান কার্যালয় ইস্ট ইন্ডিয়া হাউস; Image Source: Heritage Image Partnership Ltd/Alamy

১৭৯০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন তাদের প্রধান কার্যালয় ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসকে নতুনভাবে তৈরি করে, তখন বিশ্ব জুড়ে নব্য ক্লাসিসিজমের উন্মাদনা। তার সাথে মিল রেখে ভবনের প্রবেশমুখে ছ’টি বিশাল কলামের বারান্দা তৈরি করা হয়। এর ওপরের টিমপেনামে রাজা তৃতীয় জর্জের একটি প্রতিকৃতি ছিল, যার মাধ্যমে বোঝানো হয়- ইস্ট ইন্ডিয়ার ব্যবসাকে তিনি রক্ষা করছেন। মূলত এটি ছিল কোম্পানির কর্পোরেট ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ।

ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসের অন্দরসজ্জা ছিল অনিন্দ্যসুন্দর। কার্যালয়ের মূলকক্ষে ছিল মার্বেল পাথরের তৈরী ব্রিটেনের কল্পপ্রতিমা ‘ব্রিটানিয়া’, যা ঘিরে রয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা ও ভারতের মানচিত্র। দরজার প্যানেলগুলোতে লাগানো ছিল বোম্বের মতো কোম্পানির অধীনস্থ বিভিন্ন বন্দরের ছবি। এছাড়া কার্যালয়ের বিক্রয়কক্ষগুলোতে মার্বেল পাথরে তৈরি ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের মূর্তি বসানো ছিল।

ভারতের পাটনায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আফিম কারখানা; Image Source: Contraband Collection/Alamy

কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে একটি জাদুঘর ছিল। সেখানে মহীশুরের রাজা টিপু সুলতানের রত্নখচিত সিংহাসন থেকে বিভিন্ন যুদ্ধ থেকে ব্রিটিশ সৈন্যদের লুট করা গুরুত্বপূর্ণ রত্ন প্রদর্শন করা হতো। এমনকি কোম্পানির সাধারণ গুদামঘরও ছিল সুসজ্জিত।

কোম্পানির এসব আয়োজন ছিল লন্ডনের ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে মুগ্ধ করার এক প্রচেষ্টা মাত্র। যাতে তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিয়ে গর্ব করেন, পাশাপাশি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন।

ঘুমানোর সুযোগ

বর্তমানে বিশ্বের অনেক কোম্পানি তাদের কর্মীদের অফিসে ঘুমানোর সুযোগ দিয়ে থাকে। পাশাপাশি অফিসের মধ্যেই পরিবার নিয়ে থাকার সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। এই ‘অফার’ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অনেক আগেই দিয়ে এসেছে!

১৭৯০ সালের আগে থেকেই লন্ডনের লিডেনহল স্ট্রিটে ও লাইম স্ট্রিটের কোম্পানির ক্যাভেন হাউসে অনেক কর্মী তাদের পরিবার নিয়ে থাকার সুযোগ পেতেন। তাও একদম বিনামূল্যে। চাইলে তারা অফিস চলাকালীন বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারতেন। কিন্তু এই সুযোগের অপব্যবহার যে হয়নি, তা বলা যায় না৷ বর্তমানে যেমন ঘুমানোর সুযোগ পেয়ে তার অপব্যবহার করছেন অনেক কর্মী, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতেও তেমন ছিল। কিন্তু নিয়মের বাইরে গেলে কঠিন শাস্তি পেতে হতো।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডাইনিং; Image Source: Dinodia Photos/Alamy

যেসব কর্মী কোম্পানির জন্য পরিবার ছেড়ে দূরে কোথাও কাজ করতেন, তাদের জন্যও থাকার ব্যবস্থা ছিল। সে কারণে কোম্পানির গুদাম ঘরগুলো ছিল দৈত্যাকার। সেখানে কর্মীরা কাজ, খাওয়া দাওয়া, প্রার্থনা ও ঘুমানো সহ সবই করতেন।

এসব সুবিধা প্রদান করে কোম্পানি আরো বেশি লাভবান হয়েছে৷ কর্মীরা পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতেন। পাশাপাশি কর্মীদের ওপর খুব সহজে নজরদারি করা যেতো। ইস্ট কোম্পানির অনেক কারখানায় সুন্দর বাগানের পাশাপাশি আরো অনেক সুবিধা ছিল৷ যেমন- সুরাটে পাঠাগার, গোসলখানা ও ভজনালয়ের সুবিধা ছিল। আবার হিরাডোতে ফলের বাগান, ফুলের বাগান, পুকুর ও জাপানিজ হট বাথ করার সুযোগ ছিল।

খাবারের ব্যবস্থা

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান কার্যালয়সহ অন্যান্য অফিস ও কারখানায় কর্মীদের খাবারের ব্যবস্থা ছিল। প্রধান কার্যালয়ে কোনো কর্মী নির্ধারিত সময়ে আগে আসলেই তাদের বিনামূল্যে সকালে নাস্তা দেওয়া হতো। এছাড়া ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়ার যেসব কারখানা ছিল, সেখানে বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হতো। তবে তা কখনোই অবজ্ঞামিশ্রিত ছিল না, নিম্নমানের তো নয়ই নয়। অত্যন্ত যত্নসহকারে সবার কথা বিবেচনা করে রান্না করা হতো।

১৬৮৯ সালে সুরাটে কোম্পানির কারখানা পরিদর্শনে এসেছিলেন জন ওভিংটন নামের এক যাজক। তিনি সেখানে রান্নার জন্য একজন করে ইংরেজ, পর্তুগিজ ও ভারতীয় রাঁধুনিকে নিয়োজিত দেখেছিলেন। একসাথে তিনজন রাঁধুনির রাখার উদ্দেশ্য ছিল- কর্মীদের তাদের নিজেদের দেশীয় খাবারের স্বাদ দেওয়া।

লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডকইয়ার্ড; Image Source: Lordprice Collection/Alamy

খাবার হিসেবে থাকতো পোলাও, কিশমিশ, কাঠবাদাম, পাখির মাংস, গরুর মাংসের রোস্ট, ওয়াইন ও দেশি ভাং। এছাড়া রবিবার ও অন্যান্য ছুটির দিনে খাবার পদসংখ্যা কখনো ষোলোতে পৌঁছে যেতো। যার মধ্যে থাকতো ময়ূরের মাংস, খরগোশের মাংস, হরিণের মাংস, পেস্তাবাদাম, খোবানি (অ্যাপ্রিকট), চেরিসহ আরো অনেক খাবার। কর্মীদের খাবারের পেছনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে৷ কিন্তু ১৮৩৪ সালে কোম্পানি এই খাতে ব্যয় কমিয়ে দেয়।

ওপেন বার

কর্মীদের জন্য ড্রপবক্সের ‘হুইস্কি ফ্রাইডে’ কিংবা ফেসবুকের ‘ককটেইল আওয়ার’ এর কথা শুনেছেন। এসব অনুষ্ঠানে মূলত বিয়ার সহ অন্যান্য মদ জাতীয় পানীয় পরিবেশন করা হয়৷ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের কর্মীদের দুপুর ও রাতের খাবারে মদ পরিবেশন করতো। পাশাপাশি যারা ব্রিটেনের বাইরে কাজ করতেন, তারা প্রচুর পরিমাণ মদ সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারতেন।

ভারতের উপকূলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ; Image Source: World History Archive/Alamy

এক বছর সুমাত্রায় কোম্পানির কারখানার ১৯ জন কর্মী ৭৪.৫ ডজন ওয়াইন, ৫০ ডজন ফ্রেঞ্চ ক্লারেট, ২৪.৫ ডজন বার্টন অ্যালে, ৪২ গ্যালন মাদেইরা, ২৭৪ বোতল টোডি এবং ১৬৪ গ্যালন গোয়া অ্যারাক খেয়েছিলেন। কোম্পানির হাতে যখন মদের দোকানের বিল পৌঁছায়, তখন তারা কর্মীদের উদ্দেশ্য লিখেছিল,

অবাক করা বিষয় হচ্ছে আপনারা যদি ছয়মাস অবধি বেঁচে থাকেন, আর আপনাদের কারো মধ্যে যদি কোনো ঝগড়া বিবাদ না থাকে, তাহলে যে পরিমাণে মদের টাকা দাবি করা হয়েছে, তার অর্ধেক মদ খেয়েই সারা বছর কাটাতে পারতেন।”

লন্ডনে অফিসের পাশাপাশি কর্মীদের জন্য বারের ব্যবস্থা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। সেখানে নামমাত্র মূল্যে বিভিন্ন ধরনের বিয়ার বিক্রি করা হতো। পাশাপাশি এসব বার থেকে যেন মদ চুরি না হয়, সেদিকে কোম্পানির নজর ছিল। কেননা এসব বারে কোম্পানি প্রচুর পরিমাণ মদ মজুত ছিল। সেসব দেখভাল করার জন্য আলাদা লোক ছিল।

কোম্পানি কার্ড

বর্তমানে অনেক কোম্পানি তাদের কর্মীদের জন্য নিজস্ব কার্ড দিয়ে থাকে। এসব কার্ড দিয়ে কর্মীরা ভালো রেস্তোরাঁয় ডিনার করার সুযোগসহ আরো বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকে৷ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতেও এই কার্ডের সুবিধা ছিল। ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে কোম্পানি তাদের অনেক কর্মকর্তার জন্য প্রতি বছর ডিনার বাবদ ৩০০ পাউন্ড খরচ করতো, যা বর্তমান সময়ে ১৯ হাজার পাউন্ডেরও বেশি। সেই সময় কোম্পানির চেয়ারম্যান বিনোদনের জন্য ২০০০ হাজার পাউন্ড ভাতা লাভ করতেন।

কোম্পানির কর্মকর্তাদের জন্য নাচগানের আয়োজন; Image Source: Heritage Image Partnership Ltd/Alamy

১৮৩৪ সালে এই খরচ সমূহ কোম্পানি কমিয়ে দেওয়ার পরও কোম্পানির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিনোদনের জন্য যে বাড়তি অর্থ পেতেন, তা যথেষ্ট ছিল। ব্রিটেনের বাইরে কোম্পানির যেসব কারখানা ছিল, সেখানকার একজন সিনিয়র ক্যাপ্টেনের জন্য কোম্পানি প্রতি বছর হাতখরচ বাবদ ৫০০ পাউন্ড প্রদান করতো।

এত সব সুবিধার পরও কোম্পানি তার দক্ষ ও সফল কর্মীদের বিভিন্ন দামি উপহার সামগ্রী পাঠাত। তবে ভারতে থাকা বড় বড় কর্মকর্তারা কোম্পানির পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে অনেকের কাছে থেকে উপহার পেতেন। কিন্তু এই উপহার এক সময় কর্মকর্তাদের দুর্নীতি জড়াতে সহায়ক হয়ে উঠলে ১৮৭৪ সালে কোম্পানির পক্ষ থেকে উপহার সামগ্রী গ্রহণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। যাকে বলা হয় প্রথম কর্পোরেট কোড অব এথিকস।

বেতন

অষ্টাদশ শতকের শেষ এবং ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনেক কর্মকর্তার বেতন ছিল ব্রিটেনের সর্বোচ্চ বেতনভুক্তদের তালিকায়৷ কোম্পানিতে যে যত বছর চাকরি করতেন, সে অনুপাতে বেতন বাড়ত৷

কোম্পানির একজন কর্মী শুরুতে বাৎসরিক ৪০ পাউন্ড বেতনে চাকরিতে যোগদান করতেন। যা বর্তমান সময়ের প্রায় ৩০ হাজার পাউন্ডের সমান। এরপর ১০-১৫ বছর চাকরি করার পর বেতন বেড়ে দাঁড়াত ২২০ পাউন্ডে। আর কেউ যদি ৪০ বছর চাকরি করেন, তাহলে তার শেষদিকে বেতন বৃদ্ধি পেয়ে বছরে ৬০০ পাউন্ড হয়ে যেত।

লক্ষ্ণৌতে মোরগলড়াই দেখছেন কোম্পানির এক কর্নেল; Image Source: The Print Collector/Alamy

১৮৪০ সালে কোম্পানির একজন কেরানির বেতন অন্যান্য খাতের একজন শ্রমিকের চেয়ে ১২ গুণ বেশি ছিল। এছাড়াও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মীদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থাও ছিল। কেউ যদি কোম্পানিতে ৪০ বছর কাটান, তাহলে তার চাকরি জীবনের বেতনের চারভাগের তিনভাগ পরিমাণ এককালীন অর্থ নিয়ে অবসরে যেতে পারতেন।

এছাড়া কোম্পানির উচ্চ পর্যায়ে যারা চাকরি করতেন, তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা ছিল আরো বেশি। পরিচালকদের মাসিক বেতন ৩০০-৫০০ পাউন্ড ছিল৷ যা বর্তমান সময়ের দুই লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ পাউন্ডের বেশি।

ব্যক্তিগত জীবন ও কর্মজীবনের সাথে ভারসাম্য রাখার সুযোগ

বর্তমানে নেটফ্লিক্স, ভার্জিন গ্রুপ, টুইটার, ফেসবুক কিংবা গুগল তাদের কর্মীদের পর্যাপ্ত ছুটি দিয়ে থাকে। তবে কর্মীরা সবসময় যে এই ছুটি নেওয়ার সুযোগকে অপব্যবহার করেন তেমন না। কিন্তু কর্মজীবনে সাফল্য পেতে হলে ব্যক্তিজীবনে সুখ প্রয়োজন। আর সে কারণেই আধুনিক কোম্পানিগুলো তাদের কর্মীদের ছুটি নিয়ে পরিবারসহ ঘুরে বেড়ানোর পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা প্রদান করছে। মাইক্রোসফট পরীক্ষামূলকভাবে তাদের কর্মীদের ছুটি কমিয়ে দেওয়ার পরও তাদের উৎপাদন বেড়েছে। যা বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছে।

ছুটির দিনে কোম্পানির কর্মীরা অবসর সময় কাটাচ্ছেন; Image Source: The Art Archive/Alamy

কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে ছুটি কাটানোর সুযোগ খুবই কম ছিল। কোম্পানির শুরুর দিকে বছর শেষে কোনো ছুটি দেওয়া হতো না। এমনকি কোনো কেরানির ব্যক্তিগত ছুটির জন্য কোম্পানির পরিচালকদের অনুমতি নিতে হতো। তবে সেই সময় আজকের তুলনায় অনেক বেশি সরকারি ছুটি ছিল, যে কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের কর্মীদের বাড়তি ছুটি দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।

কিন্তু ১৮১৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুধুমাত্র বড়দিনের সময় একনাগাড়ে কয়েকদিন ছুটি কাটানোর সুযোগ দিয়ে অন্যান্য ছুটি বাতিল করে দেয়। পরবর্তী সময়ে কর্মীদের দাবির মুখে তারা ছুটি বাড়ায়৷ কিন্তু সেটি ছিল প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রতুল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসে কেরানি হিসেবে যারা কাজ করতেন, অন্যান্য পদের কর্মীদের তুলনায় তাদেরকে অনেক বেশি কাজ করতে হতো। সপ্তদশ শতকের শেষের দিক এবং অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে তাদের রবিবার বাদে প্রায় প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করতে হতো। মাঝখানে দুপুরে দু’ ঘণ্টা খাবারের বিরতি দেওয়া হতো।

সেদিক থেকে গুদামঘরের শ্রমিকদের কাজ করতে হতো অনেক। তাদের প্রতিদিন গড়ে ছ’ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। এর মধ্যে ৩০ মিনিট করে বিরতি নিয়ে কাজ করতেন। তারা কাজ করতের সোম থেকে শনিবার। সুরাটের কারখানায় যারা কাজ করতেন, তারা খুব ভোরে উঠে প্রার্থনা করতেন৷ এরপর সকালের খাবার শেষ করে কাজ শুরু করতেন সকাল ১০টায়। ১২টা পর্যন্ত কাজ করার পর লম্বা বিরতি দিয়ে বিকাল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত কাজ করতেন।

সবশেষে পরিতৃপ্তি কেমন ছিল?

যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা পঞ্চাশভাগ কর্মী তাদের চাকরি নিয়ে সন্তুষ্ট। ফ্রান্স ও জার্মানিতে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৪৩ ও ৩৪ শতাংশ। বর্তমান বিশ্বে চাকরি ক্ষেত্রে সন্তুষ্টির যে অভাব- তা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। এই সমস্যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতেও ছিল। কোম্পানির কোনো কর্মী বেতন ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে চাকরিতে সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু চাকরিতে নিজের সুখ খুঁজে পাননি। বিশেষ করে যারা কোম্পানির হয়ে ভিনদেশে চাকরি করতে যেতেন।

জাহাজ দুর্ঘটনায় অসংখ্য কর্মীর মৃত্যু হয়েছে; Image Source: William Daniell/Lebrecht Music and Arts Photo Library/Alamy

কোনো কোনো সমুদ্রযাত্রা দু’ বছরের বেশি সময় লাগত। যার ৫ শতাংশ কোনো কোনো দুর্ঘটনার কবলে পতিত হতো। এর ফলে কোম্পানির অসংখ্য কর্মীকে সমুদ্রেই মৃত্যুবরণ করতে হতো। এছাড়া যারা নিরাপদে বন্দরে পা ফেলতেন তাদের জন্য অপেক্ষা করতো নতুন আবহাওয়ার কোনো রোগ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এশিয়ায় তাদের যতজন কর্মী নিয়োগ করেছিল, তার অর্ধেকেরও বেশি সামুদ্রিক ঝড়, জাহাজডুবি, জলদস্যুদের আক্রমণ ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন৷

আবার যারা লন্ডনে প্রধান কার্যালয়ে কাজ করতেন, তারাও যে খুব বেশি সন্তুষ্ট ছিলেন তেমন নয়। উচ্চপদে যারা কাজ করতেন তারা নিজেদের চাকরি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু যারা কেরানি পদে চাকরি করতেন, তাদের জন্য সবচেয়ে বিরক্তিকর সময় পার করতে হয়েছে।

মূলত কেরানিদের কাজ ছিল বিভিন্ন বিষয় হাতে লেখা। কিন্তু তাদের এক লেখাই বারবার লিখতে হতো, কখনো কখনো এক লেখাই ৭-৮ বার। এমনকি এক মিনিটের কোনো বক্তৃতাও তাদের পাঁচবার করে লিখতে হতো। ফলে অনেকেই বিরক্তিকর এই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মী সন্তুষ্টি ছিল মিশ্র৷ কেউ কেউ কাজ ও সুযোগ সুবিধা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু অনেকেই তা হতে পারেননি।

পরিশেষে পাঠকদের উদ্দেশে কিছু কথা, এই আর্টিকেল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরার কোনো প্রয়াস নিয়ে লেখা হয়নি। নিঃসন্দেহে তারা আমাদের শোষণ করেছে, আমাদের সম্পদ লুট করেছে। কিন্তু তারা কীভাবে দীর্ঘদিন এই সুবিশাল কোম্পানি পরিচালনা করেছেন, কর্মক্ষেত্র হিসেবে সেটি কেমন ছিল- সেটি তুলে ধরাই লেখাটির মূল উদ্দেশ্য। 

কোম্পানি পরিচালনা করার ক্ষেত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার কর্মীদের যেসব সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছেন, অনেকাংশেই তা প্রশংসার দাবিদার। কর্মীরা যে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাণ, তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে আরো একবার প্রমাণিত। আমরা বিশ্বাস করি, বিশ্বের সকল কর্মী তার প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান পাওয়া উচিত। কিন্তু কখনোই উচ্চ বেতনের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের অসৎ উদ্দেশ্য ও সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম হয়- এমন নীতি বাস্তবায়নে সহায়তা করা উচিত নয়, যেটি করেছিল ইস্ট কোম্পানির কর্মীরা।

ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ

১) ইস্ট ইন্ডিয়া আমলে ঢাকা
২) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস

This article is in Bangla language. It is about 'Modern features of East India Company as like Facebook, Google.'

Necessary references have been hyperlinked inside the article.

Featured Image Source: Julia Catt Photography/Alamy  

Related Articles

Exit mobile version