কালিনিনগ্রাদ কেন রাশিয়ার অধীনে?

ইউরোপের মানচিত্রের দিকে তাকালে বাল্টিক সাগরলাগোয়া এক ভূখণ্ডের দিকে চোখে পড়বে। কালিনিনগ্রাদ নামের এই অংশ ১৯৯১ সাল থেকে রাশিয়ান ফেডারেশনের অংশ, যদিও এর সাথে রাশিয়ার সরাসরি সংযোগ নেই। কীভাবে এই অংশ রাশিয়ার অধীনে চলে গেল? পার্শ্ববর্তী দেশগুলো কেন একে দখল করেনি?

কালিনিনগ্রাদের অবস্থান; Image Source: Euronews

ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়। টিউটনিক অর্ডারের অধীনে থাকা এই ভূখণ্ডের তৎকালীন নাম ছিল কোনিগসবার্গ। ষোড়শ শতাব্দীতে কোনিগসবার্গ প্রাশিয়া ডাচির অধীনে চলে যায়, তখন প্রাশিয়া ছিল পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথের অধীনে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই প্রাশিয়া শক্তিমত্তা অর্জন করে স্বাধীন হয়, এবং নিজেদের প্রথম রাজার অভিষেক এই কোনিগসবার্গ থেকেই দেয়।

প্রাশিয়ার প্রথম রাজা প্রথম ফ্রেডেরিকের অভিষেক হয়েছিল কালিনিনগ্রাদেই; Image Source: Wikimedia Commons

উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে নব্যগঠিত জার্মান সাম্রাজ্যতে অন্তর্ভুক্ত হয় প্রাশিয়া। মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে হওয়ার কারণে রাজধানী না হওয়া সত্ত্বেও এর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এবং জার্মান রাজাদের জন্মভূমি হওয়ায় এর গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট।

জার্মান সাম্রাজ্যের মানচিত্র (১৯১৪); Image Source: NZHistory

কোনিগসবার্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মূলত জার্মানরাই, সাথে পোল্যান্ড আর লিথুয়ানিয়ার সাথে সীমান্ত অঞ্চলে অল্প কিছু পোলিশ আর লিথুয়ানিয়ানদেরও চোখে পড়বে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা হেরে যাওয়ার পর জার্মান সাম্রাজ্য অনেক অঞ্চল পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর অধীনে চলে গেলেও কোনিগসবার্গের বেশ কিছু অংশ তখনও জার্মানির অধীনে ছিল, এই ‘ছিটমহল’ (মূল ভূখণ্ডের সাথে সরাসরি সংযুক্ত নয় এমন অঞ্চল) তখন পরিচিতি পায় পূর্ব প্রাশিয়া হিসেবে।

ভার্সাইয়ের চুক্তির পর জার্মান মানচিত্র এবং কোনিগসবার্গ (পূর্ব প্রাশিয়া); Image Source: Historica

এদিকে জার্মানিতে হিটলারের উত্থানের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জার্মান নাৎসি বাহিনী কোনিগসবার্গের বাকি অংশও দখল করে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে আগাতে থাকে। এদিকে ১৯৪৫-এ জার্মানির দিকে আগাতে থাকা রুশ বাহিনী কোনিগসবার্গ অবরোধ করে ফেলে, সেখানকার জার্মানরা পরাজয় বুঝতে পেরে দলে দলে জার্মানিতে পাড়ি জমায়।

বিশ্বযুদ্ধে দ্বিতীয়বার হারার পর জার্মানি পুনরায় কাঁটাছেড়ার সম্মুখীন হয়। কোনিগসবার্গের দক্ষিণ অংশ চলে যায় পোল্যান্ডের দখলে, উত্তরের খানিকটা লিথুয়ানিয়ান এসএসআর-এর কাছে। বাকি থাকে মাঝখানের সামান্য অংশ, যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ কোনিগসবার্গ শহর। এটি চলে যায় সোভিয়েতদের পেটে, রুশ বিপ্লবী নেতা মিখাইল কালিনিনের নামানুসারে নাম বদলে রাখা হয় কালিনিনগ্রাদ।

কালিনিনগ্রাদ প্রদেশ এবং কালিনিনগ্রাদের শহরের অবস্থান; Image Source: The Conversation

তাহলে কেন এই অংশ লিথুয়ানিয়ার অধীনে রাখা হয়নি? প্রথমত, এই শহরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব, বাল্টিক সাগরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর এই নগরীতে, ফলে কোনো ফেডারেশনের অধীনে না রেখে ৬৫০ কিলোমিটার দূরের এই ভূখণ্ড সরাসরি নিজেদের দখলে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। দ্বিতীয়ত, বিশ্বযুদ্ধের সময় এই অঞ্চল ব্যাপক ‘এথনিক ক্লিনজিং’-এর শিকার হয়েছিল। পালিয়ে যাওয়ার পর বাকি থাকা জার্মানদেরকেও পূর্ব জার্মানিতে পাঠিয়ে দেয় সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ, তার বিপরীতে সেখানে রুশভাষীদের নিয়ে আসা হয়।

স্তালিনের মৃত্যুর পর কালিনিনগ্রাদকে লিথুয়ানিয়ার অধীনে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করা হলেও ক্রুশ্চেভ একে সরাসরি ‘না’ বলে দেন, কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ রুশ জনগোষ্ঠীর এই অঞ্চল লিথুয়ানিয়ানদের সাথে একত্রিত হলে সংঘাতের সম্ভাবনা প্রবল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলেও একই কারণে সদ্য-স্বাধীন লিথুয়ানিয়াও এই অঞ্চলকে নিজেদের ভেতরে ঢোকাতে চায়নি, পোল্যান্ডের যুক্তিও তাই। এদিকে জার্মানির সাথে কালিনিনগ্রাদের ঐতিহাসিক যোগসূত্র থাকলেও, জার্মানির একত্রীকরণ অন্যান্য দেশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল। তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কোলও আন্তর্জাতিক চাপের ভয়ে কালিনিনগ্রাদকে পুনরায় জার্মানির অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করতে সাহস করেনি। তাছাড়া, সেখানকার স্থানীয় রুশরাও নিজেদেরকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে মনে করে, রাশিয়াও একে নিজেদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে প্রস্তুত রেখেছে, যে কারণে কালিনিনগ্রাদ এখনো রাশিয়ার অংশ।

Feature Image: ForumIAS Blog

This article is in Bengali language. It is about Kaliningrad, the Russian enclave surrounded by Poland and Lithuania.

References:
1. History Matters - Why does Russia own Kaliningrad/Konigsberg?

Related Articles

Exit mobile version