প্রাচীন মিসর। খ্রিস্টের জন্মের ১৩৯৩ বছর আগের কথা।
পুরো মিসরে যত ইসরায়েলি ছিল, তারা তখন ফারাওয়ের দাস। ইসরায়েলিদের প্রতি ফারাওয়ের নিষ্ঠুরতা ছিল চরম পর্যায়ে, এক বছর অন্তর অন্তর সকল নবজাতক হিব্রু পুত্রশিশুকে হত্যা করার আদেশ ছিল। আসলে, প্রতি বছরই মেরে ফেলবার নির্দেশ ছিল, কিন্তু এতে দাসের সংখ্যা বেশিমাত্রায় কমে যেতে পারে ভেবে সভাসদদের পরামর্শে সেটি এক বছর বাদে বাদে করা হয়।
এরকম সময়ে ইসরায়েলের ১২ গোত্রের মাঝে লেবিয় গোত্রের ইমরানের পরিবারে জন্ম নেন মুসা (আঃ)। তার মায়ের নাম ইবনে কাসিরের আল বিদায়া গ্রন্থ অনুযায়ী ‘আয়ারেখা‘, কিংবা ইউকাবাদ (يوكابد); তবে তাওরাতের হিব্রুতে তার নাম ইয়োহেভেদ (יוֹכֶבֶד)। আর বাবা ইমরানের (عِـمْـرَان) নাম হিব্রুতে আমরাম (עַמְרָם)।
মুসা (আঃ) এর জন্ম হয় যে বছর, সে বছর পুত্রহত্যার আদেশ ছিল। তার তিন বছরের বড় ভাই হারুন (هارون, হিব্রু আরৌন אַהֲרֹן) জন্মগ্রহণ করেন; সে বছর পুত্রহত্যার আদেশ ছিল না। আর তাছাড়া সাত বছরের বড় বোন মরিয়ম বা মিরিয়াম (מִרְיָם) ছিলেন।
এর আগ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ জেনে নিতে পড়ে ফেলুন, ইহুদী জাতির ইতিহাসের ষষ্ঠ পর্ব: দাসবন্দী বনী ইসরাইল এবং হযরত মুসা (আ:) এর জন্ম
মুসা (আঃ) এর জন্ম হয়েছিল হিব্রু পঞ্জিকার দ্বাদশ মাস আদার এর ৭ তারিখ। তার বাবা ইমরানকে ইহুদীদের পবিত্র গ্রন্থ তালমুদে বলা হয়েছে, সেই প্রজন্মের সেরা মানুষ।
জন্মের পর তিন মাস পর্যন্ত তার মা মুসা (আঃ)-কে লুকিয়ে রাখতেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে আর লুকোতে না পেরে একটি ঝুড়িতে করে তাকে ভাসিয়ে দেন নীলনদে। আর সে ঝুড়ি ভাসতে ভাসতে হাজির হলো ফারাও এর ঘাটে। ওদিকে মায়ের আদেশে মরিয়ম দেখছিলেন ঝুড়ির চূড়ান্ত গন্তব্য কী দাঁড়ায়।
ফারাও এর স্ত্রী আসিয়া (যিনি সম্ভবত পূর্ববর্তী কোনো ফারাও এর কন্যা) তখন আবিষ্কার করলেন সেই ঝুড়িটি। বাইবেল মতে, আবিষ্কার করেন ফারাওকন্যা বিথিয়া।
আসিয়াই ফারাওকে বুঝিয়ে রাজি করান শিশুটিকে পালন করার ব্যাপারে। মরিয়ম তখন হাজির হয়ে বললেন, তিনি তাকে দুধ পান করাবার জন্য কাউকে খুঁজে এনে দিতে পারবেন। একজন হিব্রুকন্যা আরেকজন হিব্রু নারীকে এনেছে দুধ পান করাতে, এতে ফারাও পরিবার অবাক হয়নি, কিন্তু তারা জানত না, এই নারীই আসলে শিশুটির আসল মা। জ্যোতিষীরা জানালো, ফারাওয়ের হুমকি স্বরূপ যে শিশুর জন্ম হবার কথা ছিল, তার মৃত্যু হয়েছে পানিতে ডুবে। ফারাও শিশুটিকে রাখতে রাজি হলেন। যার কাছে পরাভূত হবে ফারাও, তারই আবাস হলো ফারাওয়ের রাজপ্রাসাদে, বড় হতে লাগলো রাজপুত্র হিসেবে।
একবার ফারাওয়ের কোলে খেলছিলেন শিশু মুসা (আঃ)। ফারাওয়ের জ্বলজ্বলে মুকুট দেখে শিশুসুলভভাবেই হাত বাড়িয়ে দিলেন মুসা (আঃ) এবং খুলে ফেললেন। ফারাও এতে ভয় পেয়ে গেলেন, রেগেও গেলেন। জ্যোতিষীদের ডেকে এনে জিজ্ঞেস করলেন এর মানে কী। বেশিরভাগই জানালো, এই শিশুই তাকে পরাভূত করবে। কিন্তু একজন সভাসদ ফারাওকে জানালেন, ব্যাপারটা পরীক্ষা করা হোক, আসলেই শিশুটি জ্ঞান থেকে এ কাজ করেছে, নাকি শিশুসুলভ উজ্জ্বল বস্তুর আকর্ষণ থেকে করেছে। সেই সভাসদের নাম ইহুদী বর্ণনা অনুযায়ী জেথ্রো (ইসলামে জেথ্রোর নাম শুয়াইব (আঃ))।
ফারাও রাজি হলেন। মুসা (আঃ) এর সামনে দুটো পাত্র রাখা হলো। একটাতে সোনা-জহরত। আর অন্যটাতে কয়লার আগুন। মুসা (আঃ) সোনার দিকেই এগোলেন প্রথমে, কিন্তু জিব্রাইল (আঃ) তাকে ঘুরিয়ে দিলেন কয়লার দিকে। একটি কয়লা মুখে পুড়ে ফেললেন মুসা (আঃ)। তার হাত আর জিহ্বা পুড়ে গেল। তাই তিনি তোতলা হয়ে যান পরে। কিন্তু এটা প্রমাণ হলো, অন্যান্য শিশুর মতোই তিনি কেবল উজ্জ্বল জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। ফারাও তাকে প্রাণে বাঁচতে দিলেন।
বড় হতে হতে মুসা (আঃ) বুঝতে পারলেন, তিনি আসলে মিসরীয় নন, হিব্রু। যুবরাজ হলেও তার নিজের দাসজাতির করুণ দশায় কষ্ট পেতেন খুব। মিসরের যে এলাকায় হিব্রুরা থাকত তার নাম গোশেন। প্রায়ই গোশেনে গিয়ে বুড়ো হিব্রু দাসদের কাজে হাত লাগাতেন তিনি। ফারাওয়ের ওপর প্রভাব থাকার কারণে বিভিন্ন উপায়ে তিনি চেষ্টা করতেন তাদের কষ্ট কমাবার। মুসা (আঃ) এর চিন্তাধারা আর সিদ্ধান্তকে সম্মান করতেন ফারাও। মুসা (আঃ) যে কাজগুলো করেছিলেন তার মাঝে একটি ছিল, সপ্তাহে একটি দিন অন্তত তাদের পূর্ণ বিশ্রাম দেয়া। আর মুসা (আঃ) এর কারণে সেই দিনটি শনিবার দিনে রাখা সম্ভব হয়, ফলে হিব্রুদের পবিত্র সাব্বাথ (שַׁבָּת) দিবস তারা পালন করতে পারে। তাওরাত অনুযায়ী সৃষ্টির সপ্তম দিবসকে সাব্বাথ বা বিশ্রাম দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
একদিন মুসা (আঃ) গোশেনে গেলেন। সেখানে তিনি বেশ জনপ্রিয়। সেদিন দুপুর বা সন্ধ্যার দিকে তিনি দেখলেন, ফারাওয়ের এক মিসরীয় অফিসার (তত্ত্বাবধায়ক) তার অধীনের এক হিব্রুকে মারলো। উল্লেখ্য, প্রত্যেক তত্ত্বাবধায়কের অধীনে দশটি করে হিব্রু দাসের দল থাকত, আর প্রতি দলের একজন করে হিব্রু নেতা।
মুসা (আঃ) যখন দেখলেন হিব্রু লোকটিকে মিসরীয় অফিসার অন্যায়ভাবে মেরেছে এবং অত্যাচারিত হিব্রুটি তার সাহায্য চাইছে, তখন তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে মুসা (আঃ) ঘুষি মারলেন। কিন্তু মারটা এমন জোরেই হয়ে গিয়েছিল যে, লোকটি মারাই গেল। কিন্তু প্রাণে মারবার কোনো পরিকল্পনাই তার ছিল না। ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি তিনি লাশ বালুতে দাফন করে ফেললেন, এবং ফিরে আসলেন প্রাসাদে। তার আশা, কেউ দেখেনি তিনি যে একটা খুন করে ফেলেছেন।
পরে শীঘ্রই তিনি আবার গোশেন এলাকায় গেলেন। এবার দেখলেন, দুজন হিব্রু একে অন্যের সাথে ঝগড়া করছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে একজনকে (ঘটনাক্রমে আগের দিনের একই ব্যক্তি সে, এবারও সে সাহায্য চাইল) বললেন স্বজাতির সাথে মারামারি না করতে। তখন লোকটি বলল, “আমাদের ওপর প্রভাব খাটাতে কে বলেছে আপনাকে? আমাদেরও খুন করতে চান, যেভাবে ঐ মিসরীয় লোকটিকে করেছিলেন?” [পবিত্র কুরআনে সুরা কাসাসে ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়]
মুসা (আঃ) কষ্ট পেলেন, যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর। কিন্তু তার ভয়টা আরো বেড়ে গেল। এর মানে, তিনি যে খুন করেছেন সেটা মানুষ দেখেছে, ফারাও এর কানে পৌঁছাতে আর কত দেরি।
সত্যি সত্যি, ফারাও জেনে গেলেন। ফারাও তখন মুসা (আঃ) এর মৃত্যুদণ্ড দিলেন। এক লোক শহর থেকে দৌড়ে এসে জানালো, তার মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়েছে। ইসলামী বর্ণনাতে, মুসা (আঃ) তখন পালিয়ে যান।
কিন্তু, ইহুদী বর্ণনায়, মুসা (আঃ)-কে গ্রেফতার করা হয়, এবং যখন জল্লাদের অস্ত্র মুসা (আঃ) ঘাড়ে নেমে আসলো, তখন এক অলৌকিক ব্যাপার ঘটল। একদম পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল তার ঘাড়, ফিরে গেল জল্লাদের অস্ত্র। সবাই অবাক হয়ে গেল, এবং রীতিমত একটি গণ্ডগোল বেধে গেল। সে গণ্ডগোলের মাঝে মুসা (আঃ) পালিয়ে কুশ (כּוּשׁ) নামের এলাকায় চলে গেলেন। কুশ এলাকা (আফ্রিকার প্রাচীন আবিসিনিয়া বা ইথিওপিয়া) আসলে নুহ (আঃ) এর পুত্র কুশের নামে। উল্লেখ্য, কুশের পুত্র ছিল নমরুদ।
ইহুদীদের মিদ্রাশ (Yalkut Shimoni, 1:168) বিস্তারিতভাবে আমাদের জানায়, মুসা (আঃ) এর বয়স তখন ১৮ বছর ছিল। সেখানে গিয়ে তিনি দেখা পান ফারাওয়ের প্রাক্তন এক সভাসদের, নাম তার বিলাম। বিলাম কুশ এলাকার রাজা কোকিনাসকে সরিয়ে অন্যায়ভাবে রাজা হয়ে যায়। প্রায় নয় বছর ধরে মুসা (আঃ) কোকিনাসকে সহায়তা করেন হারানো রাজ্য ফিরে পেতে। মুসা (আঃ) এর অসাধারণ কিছু বুদ্ধিতে শেষপর্যন্ত রাজ্য পুনরুদ্ধার হয় বটে, কিন্তু ততদিনে কোকিনাস মারা গেছেন। কিন্তু জনগণ মুসা (আঃ)-কে তার যোগ্য পুরস্কার আর কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে। তারা তাকে রাজা বানিয়ে দেয়, আর রাজার বিধবা স্ত্রী রানী আদোনিয়াকে তার স্ত্রী হিসেবে। কিন্তু মুসা (আঃ) আদোনিয়াকে গ্রহণ করেননি, কারণ তিনি পৌত্তলিক ছিলেন।
মুসা (আঃ) রাজত্ব করতে লাগলেন বটে, কিন্তু রানী আদোনিয়ার মনে তখন ক্রোধের আগুন। তিনি নিজের ছেলে মুঞ্চানকে রাজা করবার জন্য জনগণকে উত্তেজিত করতে লাগলেন। কিন্তু জনগণ রাজি হয়নি। কিন্তু মুসা (আঃ) বুঝলেন, আসলে তার রাজা হওয়া এখানে ঠিক হচ্ছে না। তিনি সসম্মানে রাজত্ব ত্যাগ করলেন। প্রজারা তাকে বিদায় জানালো খুবই সম্মানের সাথে। (অন্য এক বর্ণনায় দেখা যায়, কোকিনাসের এক কন্যা মুসা (আঃ)-কে ভালবাসতেন, কিন্তু একই কারণে মুসা (আঃ) গ্রহণ করেননি। এমনকি এক উপকথায় পাওয়া যায় মুসা (আঃ) এক অলৌকিক আংটি পরিয়ে দেন সেই রাজকন্যাকে, যেন তিনি মুসা (আঃ) এর প্রতি ভালবাসা হারিয়ে ফেলেন।)
কুশ রাজ্য ত্যাগ করে মুসা (আঃ) এসে পৌঁছালেন মাদায়েন ভূমিতে। দীর্ঘ পথ তিনি শাক-লতা-পাতা ছাড়া কিছু খেতে পাননি, তার জুতোও ছিড়ে যাওয়াতে বা না থাকাতে পায়ে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল বলে বর্ণনা আছে।
সেখানে এক গাছের ছায়ায় তিনি বসলেন। কাছেই একটি কুয়া থেকে পানি তোলা হতো। কিন্তু ভারি পাথর না সরিয়ে সে কুয়ার মুখ খোলা যেত না। অন্যান্যরা পানি নেয়ার পর তলানির কিছু পানি গবাদি পশুকে খাওয়াবার জন্য দুটো মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু সেদিন তাদেরকে দেখে মুসা (আঃ) নিজেই এগিয়ে গিয়ে পাথর সরিয়ে দেন, আর মেয়ে দুটো উপর থেকেই পানি নিতে পারল। এতে তারা দুজন মুগ্ধ হয়ে গেল।
তাদের মাঝে একজন এসে বলল, আমাদের বাবা আপনাকে এই সাহায্যের পারিশ্রমিক দিতে চান, তাই ডাকছেন। মুসা (আঃ) তাদের সাথে গেলেন। তখন তার সাথে দেখা হলো তাদের পিতা শোয়াইব (আঃ) এর সাথে। শোয়াইব (شُـعَـيْـب) ছিলেন মাদায়েনের নবী, এবং একজন আরব। কথিত আছে, তার উম্মত তার কথা না শোনায় ধ্বংস হয়ে যায়। বাইবেলে তিনি জেথ্রো (হিব্রু יִתְרוֹ ইয়াসরু) নামে পরিচিত। তিনি সেই ব্যক্তি যিনি কিনা আগে কিছুদিন ফারাওয়ের দরবারে কাজ করেছিলেন, এবং তিনিই শিশু মুসা (আঃ)-কে বাঁচাতে জ্ঞান পরীক্ষার জন্য কয়লা-আগুন পরীক্ষা ব্যবস্থা করেছিলেন বলে ইহুদী বর্ণনায় আছে। পরে ফারাওয়ের বিশ্বাসের সাথে মিল না পড়ায় তিনি চলে আসেন কিংবা বহিষ্কৃত হন, এ কাহিনীগুলো বিস্তারিত জানা যায় না। সাহাবী ইবনে আব্বাস (রা) এ মতে সায় দিয়েছেন। কিন্তু এই বড় অবস্থায় মুসা (আঃ)-কে দেখে অবশ্য ইয়াসরু কিংবা শোয়াইব (আঃ) চিনতে পারেননি। তার আরেক নাম ছিল রাওয়েল।
একজন কন্যার পরামর্শে, তিনি তাকে তার অধীনে কাজ করবার প্রস্তাব দিলেন। সাথে এটাও বললেন, আট-দশ বছর কাজ করলে তার একজন কন্যার সাথে তিনি বিয়ে দেবেন মুসা (আঃ) এর।
হিব্রু বাইবেলে শোয়াইব (আঃ) এর সাত কন্যার কথা পাওয়া যায়, কিন্তু মুসা (আঃ) ১০ বছর কাজ করবার পর যার সাথে বিয়ে হয়েছিল তার নাম ছিল সাফুরা (হিব্রুতে সিফোরাহ צִפוֹרָה)। তাওরাত মতে, উপস্থিত কন্যাদের মাঝে বড় কন্যার সাথেই বিয়ে হয়েছিল মুসা (আঃ) এর। কিন্তু ইবনে কাসিরের মতে, বিয়েটা হয়েছিল ছোট কন্যার সাথে।
এত কাল ধরে মিসরে তার স্বজনদের সাথে তার কোনোই যোগাযোগ নেই। মুসা (আঃ) এর খুব ইচ্ছে হলো গোপনে মিসরে গিয়ে দেখা করে আসতে। তার স্ত্রী আর ছোট সন্তানদের সাথে নিয়ে তিনি রওনা হলেন। সাথে ছাগলের পাল ছিল। দিকবিদিকশুন্য মরুর রাস্তায় একটি ছাগল ছুটে গিয়ে হারিয়ে যায় বলে ইহুদী সূত্রে পাওয়া যায়। তখন সেটি খুঁজতে বের হন মুসা (আঃ)। হোরেব তথা সিনাই পর্বতের কাছে গিয়ে তিনি ছাগলটিকে খুঁজে পেলেন। তখনই এক অদ্ভুত দৃশ্য তার চোখে পড়ল। দূরে আগুন চোখে পড়ল।
ইবনে কাসির অনুযায়ী, সেই রাতটি ছিল বেশ ঠাণ্ডা। মরুভূমির মাঝে দিয়ে চলতে গিয়ে তারা বারবার পথ হারিয়ে ফেলছিলেন। চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করছিলেন ঠাণ্ডা তাড়াতে। কিন্তু কাজে লাগছিল না কিছুই। তখন চোখে পড়ল দূরে সিনাই পাহাড়ের কাছে আগুন জ্বলছে। তিনি স্ত্রী সন্তানদের বললেন, “তোমরা এখানে অপেক্ষা কর, আমি আগুন দেখতে পাচ্ছি। সম্ভবত আমি কয়লা আনতে পারব কিংবা পথের সন্ধান পাবো।” (কুরআন সুরা ত্বোয়াহা: ৯-১০)
তিনি পাহাড়ের সে আগুনের উৎসের দিকে গিয়ে দেখলেন একটি ঝোপে আগুন জ্বলছে। কিন্তু সেটি পুড়ে যাচ্ছে না!
তিনি আরেকটু এগোলেন। তখন সেই অগ্নিময় ঝোপ থেকে আওয়াজ আসলো বজ্রকণ্ঠে, “মুসা, মুসা!” (তাওরাত, হিজরত, ৩:৪)
মুসা বললেন, “এই তো আমি। উপস্থিত।”
আওয়াজ এলো, “মুসা! আমিই তোমার প্রভু, তোমার প্রতিপালক।” (কুরআন ২০: ৯-১০ এবং তাওরাত, হিজরত, ৩)
বিরান মরুভূমির মাঝে অচেনা এক পাহাড়ের ওপর একাকী দাঁড়িয়ে এক সময়ের যুবরাজ আর এখন মেষপালক মুসা (আঃ) অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন, বিশ্বজগতের স্রষ্টা তার সাথে কথা বলছেন!
চলবে পরের পর্বে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
১) মাদায়েন কোথায়?
হিব্রুতে এ জায়গাকে ডাকা হতো মিদিয়ান (מִדְיָן)। আরব উপদ্বীপের উত্তর-পশ্চিম কোণে, লোহিত সাগরের আকাবা উপসাগরের পূর্বদিকে এর অবস্থান। এ এলাকায় যারা বসবাস করত তারা ইব্রাহিম (আঃ) তৃতীয় স্ত্রী কেতুরার (קְטוּרָה) পুত্র মিদিয়ানের বংশধর বলে ইহুদীদের তাওরাতে বর্ণনা করা আছে। জেথ্রো বা শোয়াইব (আঃ) এ এলাকায় বসবাস করতেন। বর্তমানে আরবিভাষী ‘দ্রুজ’/Druze (درزي/דרוזי) ধর্মের অনুসারীরা তাকে তাদের প্রধান নবী বলে থাকে।
২) সিনাই পর্বতের কথা দেখা যাচ্ছে। তাহলে তুর পর্বত কোথায়?
মিসরে সিনাই উপদ্বীপ বলে একটি জায়গা আছে, আফ্রিকান দেশ মিসরের কেবল সে জায়গাটাই পড়েছে এশিয়াতে। লোহিত সাগর আর ভূমধ্যসাগরের মাঝে এর অবস্থান। হিব্রুতে সিনাই (סִינַי) বললেও, ইংরেজিতে সাইনাই (Sinai) ডাকা হয়, আরবিতে সিনা (سِينَاء)। ষাট হাজার বর্গ কিলোমিটারের এ বিশাল মরু এলাকায় রয়েছে অনেক পাহাড়। এর মাঝে একটির নাম সিনাই পর্বত। একে হোরেব পর্বতও ডাকা হয়, আবার আরবিতে জাবালে মুসা (جَبَل مُوسَىٰ) বলা হয়, অর্থাৎ মুসার পাহাড়। সিনাই পর্বতকে হিব্রুতে একে হার সিনাই (הַר סִינַי) ডাকা হয়, হার (הַר) শব্দের অর্থ পর্বত। ঠিক একইভাবে আরবিতে একে ডাকা হয় তুর সিনা (طُور سِينَاء), ‘তুর’ বলতে বোঝায় ‘পর্বত/পাহাড়’। অর্থাৎ তুর পাহাড় কথাটা ভুল, কারণ তুর মানেই পাহাড়। ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলিম তিন ধর্মাবলম্বীদের কাছেই খুব পবিত্র এ জায়গা। কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ তুর বা পাহাড়টি পবিত্র তুয়া উপত্যকায়।
অষ্টম পর্ব: সিনাই পর্বত থেকে ফারাওয়ের রাজদরবার
এ সিরিজের পর্বগুলো হলো:
প্রথম পর্ব: ইহুদী জাতির ইতিহাস: সূচনা পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব: মিশরে যাবার আগে কেমন ছিল বনি ইসরাইল?
তৃতীয় পর্ব: হযরত ইউসুফ (আ): দাসবালক থেকে মিসরের উজির- ইহুদী জাতির ইতিহাস
চতুর্থ পর্ব: ইউসুফ-জুলেখার কাহিনীর জানা অজানা অধ্যায়
পঞ্চম পর্ব: মসজিদুল আকসা আর বাইতুল মুকাদ্দাসের ইতিবৃত্ত
ষষ্ঠ পর্ব: দাসবন্দী বনী ইসরাইল এবং হযরত মুসা (আ:) এর জন্ম
সপ্তম পর্ব: মিসরের রাজপ্রাসাদ থেকে সিনাই পর্বত
অষ্টম পর্ব: সিনাই পর্বত থেকে ফারাওয়ের রাজদরবার
নবম পর্ব: মিসরের অভিশাপ
দশম পর্ব: দ্বিখণ্ডিত লোহিত সাগর, এক্সোডাসের সূচনা
একাদশ পর্ব: মরিস বুকাইলি আর ফিরাউনের সেই মমি
দ্বাদশ পর্ব: তূর পর্বতে ঐশ্বরিক সঙ্গ এবং তাওরাত লাভ
ত্রয়োদশ পর্ব: ইসরাইলের বাছুর পূজা এবং একজন সামেরির ইতিবৃত্ত
চতুর্দশ পর্ব: জীবন সায়াহ্নে দুই নবী
পঞ্চদশ পর্ব: রাহাব ও দুই গুপ্তচরের কাহিনী
ষোড়শ পর্ব: জেরিকোর পতন এবং স্যামসনের অলৌকিকতা
সপ্তদশ পর্ব: এক নতুন যুগের সূচনা
বোনাস প্রাসঙ্গিক আর্টিকেল:
দ্য ফার্স্ট মুসলিম: একজন ইহুদীর চোখে মহানুভব হযরত মুহাম্মাদ (সা)