সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্য ভাঙা: যেভাবে এক মিথের জন্ম দিয়েছে মার্কিন সেনাবাহিনী (১ম পর্ব)

১.

২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের যে দৃশ্য আপামর জনতার মনে চির অক্ষয় হয়ে রয়েছে, সেটি হলো দেশটির স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্য পতন। এই দৃশ্য বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয় আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বাহিনীর জয় এবং ইরাকি জনগণের মুক্তির স্মারক চিহ্ন হিসেবে।

কিন্তু, আসলেই কি তা সত্যি ছিল?

প্রায় সময়ই ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয় ইতিহাস রচনার অংশ হিসেবে। তবে আমেরিকান বাহিনীর ইরাক আক্রমণের সময়ে, সাদ্দামের ওই ভাস্কর্যের উৎখাতও হয়ে ওঠে ইতিহাস নতুন-করে-রচনা প্রচেষ্টার গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র।

তাই সাদ্দামের ওই ভাস্কর্যের কাহিনী থেকে আমরা একইসাথে দেখতে পাই একটি মিথ সৃষ্টির নানা সম্ভাবনা এবং সীমাবদ্ধতা।

ফিরদোস স্কয়ারে অবস্থিত সাদ্দামের ভাস্কর্য (ভাঙার আগমুহূর্তে); Image Source: Alexandra Boulat / VII

২.

‘অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম’-এর সূচনা ঘটে ২০০৩ সালের ২০ মার্চ। যেমনটি আগেই বলেছি, এই জোটের নেতৃত্বে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, এবং তাদের সঙ্গে ছিল অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের সৈন্যদল। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের দাবি অনুযায়ী, এই অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল একদম পরিষ্কার:

“ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুদ ধ্বংস করা, এবং জঙ্গীবাদের প্রতি সাদ্দাম হোসেনের সমর্থনকে শেষ করে দিয়ে, ইরাকি জনগণকে মুক্ত করা।”

তিনি আরো বলেন,

“যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ও আমাদের বন্ধু-সুহৃদরা কোনোভাবেই বেঁচে থাকবে না সেই দস্যুদের দয়া-দাক্ষিণ্যে, যারা গণহত্যার অস্ত্র হাতে নিয়ে জনসাধারণের শান্তি বিনষ্ট করছে। এটি হলো আমাদের নিজেদের জাতির নিরাপত্তা, এবং বিশ্ব শান্তি রক্ষার লড়াই। বিজয় ব্যতীত আর কোনো ফলাফলই আমরা মেনে নেব না।”

একটি আসন্ন যুদ্ধকে বুশ যেসব কারণ দর্শিয়ে ন্যায্যতা প্রদানের চেষ্টা করেন, তা নিয়ে তখনই উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়, এবং সেগুলো অব্যাহত রয়েছে আজও।

আক্রমণকারী দলগুলো খুব দ্রুতই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তারা বাগদাদে এসে পৌছায় ৭ এপ্রিল, যুদ্ধ শুরুর আড়াই সপ্তাহ পর। ওই বাগদাদেরই ফিরদোস স্কয়ারে, অর্থাৎ শহরের একদম প্রাণকেন্দ্রে, অবস্থিত ছিল সাদ্দামের ভাস্কর্যটি। দুদিন পরেই সেটি ভূপাতিত হয়।

৩.

২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে এক অভূতপূর্ব আইকনোক্লাজমের (মূর্তি ও ভাস্কর্যের বিরোধিতা) জোয়ার ওঠে। আইকনোক্লাজমের নানা জোয়ার অবশ্য আগেও দেখা গেছে – ইংরেজ সংস্কার আন্দোলন, ফরাসি বিপ্লব কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময়ে – কিন্তু ২০২০ সালের আইকনোক্লাজমটি ছিল বৈশ্বিক। প্রাচীন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং তাদের সাবেক উপনিবেশগুলোতে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে শুরু করে কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ, ভারত, বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ডে, ভাস্কর্যের উপর হামলা চালানো হতে থাকে। এমনকি ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকারীরাও তাদের আন্দোলনের স্বার্থে আক্রমণ করে অসংখ্য ভাস্কর্যে। এসব ভাস্কর্য ছিল কনফেডারেট (দাসপ্রথা সমর্থনকারী), দাস ব্যবসায়ী ও সাম্রাজ্যবাদীদের।

এডওয়ার্ড কলস্টনের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয় ব্রিস্টল, ইংল্যান্ডে। রিচমন্ড, ভার্জিনিয়ায় রবার্ট ই লি-র ভাস্কর্য ঢেকে ফেলা হয় গ্রাফিতি দিয়ে। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের একাধিক ভাস্কর্য আক্রান্ত হয় – মিনেসোটায় তাকে উপড়ে ফেলা হয়, গলা কাটা হয় ম্যাসাচুসেটসে, এবং ভার্জিনিয়ায় হ্রদের জলে ছুড়ে মারা হয়। বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের ভাস্কর্যে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এন্টওয়ার্পে, এবং লাল রঙে ভিজিয়ে দেয়া হয় ঘেঁন্টে। লন্ডনে উইনস্টন চার্চিলকে দেয়া হয় ‘বর্ণবাদী’ খেতাব।

‘বর্ণবাদী’ আখ্যা দেয়া হয় চার্চিলকে; Image Source: David Cliff/Nurphoto via Getty Images

অনেকেই ভয় পেতে শুরু বিষয়টি বুঝি পাগলামির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অনেকদিন ধরেই কনফেডারেটদের ভাস্কর্য ব্যবহৃত হতো গণবিক্ষোভের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে। কিন্তু অচিরেই জাতীয় আইকন এবং প্রগতিশীলদের ভাস্কর্যের উপরও আক্রমণ শানানো হয়। যেমন- ম্যাডিসন, উইসকনসিনের বিক্ষোভকারীরা নারী অধিকার আন্দোলনের স্মারক ‘ফরওয়ার্ড’ ভাস্কর্যটি এবং আরেকজন দাসপ্রথা বিলোপ আন্দোলনকারীর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে। রোচেস্টার, নিউ ইয়র্কে আরেক দাসপ্রথা বিলোপ আন্দোলনকারী ফ্রেডরিক ডগলাসের ভাস্কর্য সেটির বেদী থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। তাই অনেকের মনেই প্রশ্ন উদয় হয়: বিক্ষোভকারীরা কি ফ্যাসিবাদী ও ফ্যাসিবাদবিরোধীদের মধ্যে গুলিয়ে ফেলছে? নাকি কনফেডারেট ও দাস ব্যবসায়ীদের ভাস্কর্য ভাঙার বদলা হিসেবে এ কাজ করছে তাদের বিরোধী পক্ষ?

এই আগুনে নতুন করে ঘি ঢালেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন যেখানে বলা হয়, “অনেক বিক্ষোভকারী, নাশকতাকারী, এবং উদ্রবাদী বামপন্থীরা তাদের কাজের মাধ্যমে সরাসরি পরিচয় দিয়েছে তাদের সমর্থিত আদর্শবাদের – যেমন মার্কসবাদ – যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থাকে ধ্বংসের মদদ দেয়া হয়।” এই আদেশে বলা হয় যে ফেডারেল সম্পদ বিনষ্টকারীদের ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

এদিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বোরিস জনসন টুইটারে বলেন, “ওইসব ভাস্কর্য আমাদেরকে শিক্ষা দেয় আমাদের অতীতের ব্যাপারে, এবং সেই অতীতের ভুলগুলোর ব্যাপারেও। ওগুলোকে ভেঙে ফেললে আমাদের ইতিহাসের ব্যাপারে মিথ্যা বলা হবে, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে।” এরপর দেশটির কনজারভেটিভ সরকার ঘোষণা দেয় যে তারা ‘ক্রিমিনাল ড্যামেজ অ্যাক্ট’-এ পরিবর্তন আনবে, যার ফলে ব্রিটেনে যুদ্ধের কোনো স্মৃতিচিহ্নে আঘাত করা হলেও দোষী ব্যক্তির দশ বছরের জেল হবে।

জাদুঘর ও নগর কর্তৃপক্ষও দ্রুতই প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে। তবে, বেশিরভাগ সময়ই, তাদের প্রতিক্রিয়ার ধরন ছিল অন্যরকম। যেমন- দাসপ্রভু কলস্টনের ভাস্কর্য যেদিন ভেঙে ফেলা হয়, তার পরের দিন মিউজিয়াম অভ লন্ডন ডকল্যান্ডস তাদের নিজেদের একটি ভাস্কর্যও সরিয়ে ফেলে, যেটি ছিল আরেক দাস ব্যবসায়ী রবার্ট মিলিগানের।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ডানপন্থী রিপাবলিকান ও কনজার্ভেটিভ প্রশাসন দ্রুতই সুযোগ লুফে নেয় নিজেদেরকে আমেরিকান ও ব্রিটিশ সভ্যতার রক্ষাকর্তা প্রমাণের জন্য। কেননা এই সভ্যতা-প্রীতিই ছিল বর্বরতা ও ‘পলিটিক্যাল কারেক্টনেস’-এর বিরুদ্ধে তাদের শেষ ঢাল। তাই ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ সংস্কৃতি সচিব অলিভার ডাউডেন জাদুঘরগুলোর উদ্দেশ্যে চিঠি লেখেন, তাদেরকে হুমকি দেন যে ‘আন্দোলন বা রাজনীতি’ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা যদি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে তাদের অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়া হবে।

এসব ডামাডোলের ফাঁকে ২০২০ সালের ভাস্কর্য-আক্রমণের একটি প্যাটার্ন দাঁড়িয়ে যায়: যারা ভাস্কর্যে আক্রমণকারীদেরকে উৎসাহ দিচ্ছিল, তাদের অধিকাংশই ছিল বয়সে তরুণ, এবং সামাজিকভাবে উদারনৈতিক; অন্যদিকে যারা এই ধ্বংসযজ্ঞের বিরোধিতা করছিল, তারা বেশিরভাগই ছিল বয়োজ্যেষ্ঠ, এবং তুলনামূলকভাবে বেশি রক্ষণশীল।

তবে আপনি যদি আরেকটু তলিয়ে ভাবেন, তাহলে দেখবেন ভাস্কর্যকেন্দ্রিক এই ইস্যু আরো অনেক বেশি জটিল। ২০১৪ সালে যখন ইউক্রেনে লেনিনের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হচ্ছিল, কিংবা ২০০৩ সালে যখন ফিরদোস স্কয়ারে সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্য নামিয়ে ফেলা হলো, তখন কিন্তু পশ্চিমা বয়োজ্যেষ্ঠ রক্ষণশীলরা ঠিকই উৎফুল্ল হয়েছিল; অন্যদিকে তরুণ ও প্রগতিশীল প্রজন্ম অনিশ্চিত ছিল যে তাদের এই ভাস্কর্য-ভাঙা উদযাপন করা উচিত হবে কিনা। আবার ২০১৫ সালে যখন পালমিরায় প্রাচীন ভাস্কর্য ভাঙতে থাকে ইসলামিক স্টেট, তখন সকল রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষই সমস্বরে নিন্দাজ্ঞাপন করতে থাকে। অথচ পরবর্তীতে কনফেডারেট ও দাস ব্যবসায়ীদের ভাস্কর্য ভাঙার প্রশ্নেই ওই মানুষগুলো দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ল।

এর মূল কারণ এই যে, ভাস্কর্য নিরপেক্ষ নয়, এবং তারা কোনো শূন্যস্থানেও বাস করে না। তাদের ব্যাপারে আমাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, তা নির্ভর করে তারা কাদেরকে স্মরণ করছে, কারা তাদেরকে স্থাপন করছে, কিংবা কারা তাদের বিরোধিতা করছে, কারা তাদেরকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, এবং কেন, তার উপর।

সাদ্দাম হোসেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৭৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত; Image Source:  CCTV America

৪.

২০ বছর বয়সে সাদ্দাম হোসেন বাথ পার্টিতে যোগ দেন, এবং পরেই দুই দশকে, পার্টিতে তার ক্রমশ পদোন্নতি ঘটতে থাকে। ১৯৭৯ সালে তিনি ক্ষমতার শীর্ষাসনে বসেন। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড উচ্চাকাঙ্ক্ষী; চাইতেন আরব বিশ্বের নেতৃত্ব এবং পারস্য উপসাগরের দখল লাভ করতে। ১৯৮০ সালে তিনি ইরানের তেলক্ষেত্রগুলোতে আক্রমণ করেন, যার ফলে এক দীর্ঘ, খরুচে ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের শুরু হয়। ১৯৯০ সালে তিনি কুয়েত দখল করেন, যার ফলে জাতিসংঘ কর্তৃক তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে সাদ্দামের বিরুদ্ধে এক সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে, যেখানে আরো ছিল মিশর, ফ্রান্স, সৌদি আরব ও যুক্তরাজ্য। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত সেই লড়াইয়ের ফলস্বরূপ কুয়েত থেকে পিছু হটতে বাধ্য হন সাদ্দাম। বৈশ্বিক পরিসরে অপমানিত হয় ইরাক। দেশটির উত্তর ও দক্ষিণের অঞ্চলগুলোকে ‘নো-ফ্লাই জোন’ ঘোষণা করা হয়, যেখানকার এয়ার ট্রাফিকের উপর নজরদারি করতে থাকে আমেরিকান, ব্রিটিশ ও ফরাসি বাহিনী। দেশটির উপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, এবং পারমাণবিক, রাসায়নিক বা জৈবিক অস্ত্র নির্মাণও বাধাপ্রাপ্ত হয়। এদিকে অভ্যন্তরীণভাবে দেশটিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বিভিন্ন বিদ্রোহী দল, বিশেষত শিয়া ও কুর্দি গোষ্ঠীরা। তবে সাদ্দাম তাদেরকে নির্মমভাবে প্রতিহত করেন।

একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে, সাদ্দাম নিজেকে গড়ে তোলেন অনেকটা জোসেফ স্ট্যালিনের ধাঁচে। তারা দুজনেই ছিলেন বহিরাগত, যারা তাদের অনন্য নিষ্ঠুরতাকে পুঁজি করে, ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেন। এমনকি সাদ্দাম অনুকরণ করেন স্ট্যালিনের প্রচারণার ধরনও: নিজেকে তিনি উপস্থাপন করেন সদা-হাস্যোজ্জ্বল এক নেতা হিসেবে, যিনি সর্বদা কাজ করে চলেছেন ইরাকি জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে। তিনি প্রায় একই ধরনের মোচও রাখেন, এবং স্ট্যালিনেরই মতো, নিজের অসংখ্য ভাস্কর্য গড়ে তোলেন।

ইসলামি প্রথানুযায়ী মানব ব্যক্তিত্বদের, বিশেষত ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের, উপস্থাপন নিষিদ্ধ। তবে ইরাকি ইতিহাসে, ইসলাম তো তুলনামূলক সাম্প্রতিক একটি বিষয়। একদা মেসোপটেমিয়া নামে পরিচিত এই অঞ্চলের রয়েছে শিল্প-সংস্কৃতির (ভাস্কর্য নির্মাণেরও) প্রাচীন ও গৌরবময় ঐতিহ্য, হাজার বছরের ইতিহাস। ফলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের চিত্রায়ণ মেসোপটেমীয় সংস্কৃতির অনেক গভীরে প্রোথিত; এর উপর কোনো নিষেধাজ্ঞা চলে না। তাই তো সাদ্দামের শাসনামলে, তার চিত্রায়ণ শুধু সম্ভবই ছিল না, একইসাথে জরুরিও ছিল। সকল স্কুল, পাবলিক বিল্ডিং ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই তার ছবি বা এ-জাতীয় কিছুর উপস্থিতি ছিল বাধ্যতামূলক।

সাদ্দামের চিত্রায়ণ ও ভাস্কর্য নির্মাণে সামরিক বড়াইয়ের সঙ্গে নানা ঐতিহাসিক রেফারেন্সের এক স্বকীয় সংমিশ্রণ দেখা যায়। কিছু ভাস্কর্যে তাকে একজন অশ্বারোহী হিসেবে দেখানো হয়, যেখানে তার হাতে রয়েছে খোলা তরবারি, তাক করা জেরুজালেমের দিকে। উদ্যত ঘোড়াদের পাশেই আবার রয়েছে রকেট। এদিকে কখনো কখনো তার মাথায় পরা থাকে কুব্বাত আস সাখরা (ডোম অফ দ্য রক), যা অনেকটা হাল আমলের হেলমেটের রূপ ধারণ করে। তার বিভিন্ন ছবিতে এমন সব পোশাক-পরিচ্ছদ ও খুঁটিনাটি ব্যবহার করা হয়, যার মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা যায় হাম্মুরাবি (ব্যাবিলনের শাসক), নেবুচাদনেজার (ইহুদিদের বন্দিকারী), সালাদিন (খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের পরাজিতকারী, যার জন্মও হয়েছিল সাদ্দামের মতো তিকরিতে), এমনকি স্বয়ং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সঙ্গেও! এভাবেই গুরুত্বপূর্ণ সব ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের নির্যাস সাদ্দামের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে চেষ্টা করা হয় ইরাকের মানুষকে মেসোপটেমীয় ইতিহাসের সঙ্গে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে, এবং ইতিহাসের সেই নবরূপকে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে দিতে।

১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইরাকের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ করে দেয়, কেবল মানবিক প্রয়োজন ছাড়া। ফলে ইরাকের তৎকালীন চিত্রকর ও ভাস্করদের জন্য তাদের শিল্পকর্মের জন্য আবশ্যক কাঁচামালের নাগাল পাওয়া দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। রঙ-তুলি, ক্যানভাস, ব্রোঞ্জ ও পাথর পাওয়ার জন্য তাদের নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করতে হয়, যার মধ্যে একটি হলো সাদ্দামের চিত্রাঙ্কন ও ভাস্কর্য নির্মাণ। বিষয়টি অনেকটা এমন ছিল যে, সরকার যদি কোনো শিল্পের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, তাহলে শিল্পীকে সেই শিল্প নির্মাণের কাঁচামাল সরবরাহ করবে। তাছাড়া সেটি ছিল এমন এক সময়, যখন ইরাকের সাধারণ মানুষ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হলেও, সাদ্দাম বিশাল বিশাল সব প্রাসাদ নির্মাণ করতে থাকেন, এবং সেগুলো ভরিয়ে তোলেন নিজের স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে। নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব যে ওই সময়ে সাদ্দাম নিজের ঠিক কতগুলো ভাস্কর্য গড়িয়েছিলেন। তবে এ কথা সত্যি যে শুধু বাগদাদেই ছিল তেমন শখানেক ভাস্কর্য।

২০০২ সালের এপ্রিলে সাদ্দামের ৬৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে যে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয় ফিরদোস স্কয়ারে, সেটির আহামরি কোনো বিশেষত্ব ছিল না। ফিরদোস স্কয়ারকে বাগদাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান বলা যায় না। তাছাড়া ভাস্কর্যটিও অনন্য সাধারণ কিছু নয়: একটি দণ্ডায়মান ব্রোঞ্জের মূর্তি, ১২ মিটার উঁচু, ওজন এক টনের মতো। এটি যে খুব বিশেষ কিছু নয়, তার আরো একটি নজির এই যে, ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলার পর সেটির প্রকৃত নির্মাতা কে, তা নিয়েও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।

ভাস্কর্যটির নির্মাণকারী হিসেবে সম্ভাব্য অন্তত দুজন ভাস্করের নাম শোনা যায়, এবং সেই দুই নামের সঙ্গেই জড়িত রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কাহিনী। ফিরদোস স্কয়ারে সাদ্দামের সেই ভাস্কর্য নিয়ে কাহিনীর বৈশিষ্ট্য এমনই। কোনটি যে সত্যি আর কোনটি যে মিথ্যে, তাদের মধ্যকার দেয়াল খুব শীঘ্রই উধাও হয়ে যাবে।

বাগদাদে সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্য (২০০৫ সালে তোলা); Image Source: David Furst/AFP/Getty Images

৫.

ফরাসি দার্শনিক জঁ বদ্রিলার্দ হাইপাররিয়ালিটিকে (অতিবাস্তবতা) সংজ্ঞায়িত করেছেন এমন এক অবস্থা হিসেবে, যেখানে আপনি প্রকৃত বাস্তবতা এবং বাস্তবতার ভানের (সিমুলেশন) মধ্যে তফাৎ করতে পারবেন না। ১৯৯১ সালে, প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ে, তিনি এই থিম স্পর্শ করে তিনটি প্রবন্ধ রচনা করেন, যেগুলোকে পরবর্তীতে একত্র করে প্রকাশ করা হয় ‘দ্য গালফ ওয়ার ডিড নট টেক প্লেস’ বইটি। বদ্রিলার্দের যুক্তি হলো, ১৯৯১ সালের প্রথম কয়েক মাস যেসব প্রাসঙ্গিক ঘটনা ঘটেছিল, সেগুলো আসলে যুদ্ধ ছিল না, যে অর্থে আমরা যুদ্ধকে সাধারণত বুঝে থাকি। সেগুলো ছিল নিছকই যুদ্ধের ভান।

এর পেছনে দুটি কারণ ছিল।

প্রথমত, ঘটনাক্রমকে গণমাধ্যমের সাহায্যে খুব সাবধানে সাজানো হচ্ছিল: কোন কোন ছবি সংবাদে দেখানো যাবে তার নিয়ন্ত্রণ ছিল সম্মিলিত সেনাবাহিনীর হাতে, এবং তারাই ঠিক করে দিচ্ছিল কোন সাংবাদিকদের নিউজ কাভারের অনুমতি দেয়া হবে। টিভির সামনে বুঁদ হয়ে থাকা পশ্চিমের সাধারণ দর্শকদের সামনে হাজির হচ্ছিল অনবরত বোমাবাজি ও মিসাইল তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে ছুটে যাওয়ার ‘পয়েন্ট-অভ-ভিউ’ শটের ভিডিও। এর ইফেক্ট ছিল অনেকটা কম্পিউটারে ভিডিও গেম খেলার মতো: পরিষ্কার, নির্ভুল ও পরিণামহীন।

দ্বিতীয়ত, বদ্রিলার্দের মতে, যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে কখনোই কোনো সংশয় ছিল না। এটি ছিল একটি ‘ইতোমধ্যেই জিতে যাওয়া’ যুদ্ধ। সম্মিলিত বাহিনী অবশ্যই যুদ্ধে জয়লাভ করতে যাচ্ছিল, এবং সাদ্দাম মুখে যত হামবড়া ভাবই দেখাক না কেন, তার পক্ষে দীর্ঘস্থায়ী পাল্টা আঘাত হানা ছিল অসম্ভব। তাই এই যুদ্ধের ভান ছিল অনেকটাই অস্থিচর্মসার। সেখানে না ছিল কোনো উদ্বেগ, না কোনো সহিংসতা, না কোনো অনিশ্চয়তা। এ যেন যুদ্ধকে উলঙ্গ করে দিয়ে, তাকে কৃত্রিম কোনো কাপড়ে আচ্ছাদিত করা: দ্বিতীয় ত্বকের মতো।

বদ্রিলার্দ বর্ণিত উপসাগরীয় যুদ্ধের এই হাইপাররিয়ালিটি নাড়া দেয় লেখক, শিল্পী ও চলচ্চিত্র-নির্মাতাদেরও। তাছাড়া বিশ্ব তখন সবে ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে শুরু করেছে। ফলে সেই হাইপাররিয়ালিটি এক নতুন মাত্রা লাভ করে। বাস্তব অভিজ্ঞতা বনাম ভার্চুয়াল অভিজ্ঞতার যে উত্তেজনা ও উদ্বেগ, তা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ১৯৯৭ সালের একটি পলিটিক্যাল কমেডি ফিল্ম ‘ওয়াগ দ্য ডগ’-এ (১৯৯৩ সালের উপন্যাস হতে কিঞ্চিৎ অনুপ্রাণিত) একটি হাইপাররিয়াল যুদ্ধ দেখানো হয়। সেখানে দেখা যায়, একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট দেশে তার নামে প্রচারিত সেক্স স্ক্যান্ডালের হাত থেকে রক্ষা পেতে বিদেশে একটি কাল্পনিক যুদ্ধ সৃষ্টি করেন, যেন সাধারণ মানুষের নজর সেদিকে সরে যায়। এছাড়া হাইপাররিয়ালিটির উপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয় ১৯৯৯ সালের অ্যাকশন সায়েন্স-ফিকশন ব্লকবাস্টার, ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’। এমনকি সেখানকার চরিত্র মরফিয়াস বদ্রিলার্দের লেখা থেকে সরাসরি ধার করে বলে, “বাস্তবতার মরুভূমিতে স্বাগতম!”

২০০৩ সালের ২০ মার্চ শুরু হয় ‘অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম’; Image Source: Getty Images

 

কিন্তু ২০০৩ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী ‘অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম’ শুরু করল এবং ইরাক আক্রমণ করল, তখন পরিস্থিতি ছিল অনেকটাই ভিন্ন। এবারের যুদ্ধ শুধু ‘বাস্তবতার মরুভূমিতে’ লড়লেই চলছিল না, লড়তে হতো বাস্তব মরুভূমিতেও। এবং লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য ছিল ভূমি দখল। স্বভাবতই ইরাকি বাহিনীও প্রতিরোধ শুরু করে। কিছু অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় সম্মিলিত বাহিনী। তবে হ্যাঁ, এই যুদ্ধও, প্রকৃত প্রস্তাবে, ছিল ‘ইতোমধ্যেই জিতে যাওয়া’।

ইরাকি মুখপাত্র মোহাম্মদ সাঈদ আল-সাহাফ প্রেস ব্রিফিংয়ে এসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলতে থাকেন, সাদ্দাম নাকি যুদ্ধে জয়লাভ করতে চলেছেন। অবশ্য এ কথা খুব সহজেই অনুমেয় ছিল যে তিনি আসন্ন বিজয়ের যে ভান তৈরি করতে চাইছিলেন, তা বাস্তবতা ছিল না।

“বাগদাদ নিরাপদ আছে। লড়াই এখনো পুরোদমে চলছে। ওই কাফেররা শয়ে শয়ে আত্মহত্যা করছে বাগদাদের প্রবেশদ্বারে। ওই মিথ্যাবাদীদের কথা বিশ্বাস করবেন না,” এ কথাগুলোই তিনি বলেন প্যালেস্টাইন হোটেলের ছাদে দাঁড়িয়ে, আন্তর্জাতিক ক্যামেরা ক্রুকে।

অথচ ঠিক তার পেছনেই দর্শকরা দেখতে পায়, কীভাবে নদীর ওপাশে আমেরিকান ট্যাংকের আক্রমণ থেকে বাঁচতে পালাচ্ছে ইরাকি সৈন্যরা। এই দৃশ্যের সুবাদে আল-সাহাফ রাতারাতি তারকা বনে যান। তার নাম হয় ‘কমিকাল আলি’ (কেমিক্যাল আলি থেকে অনুপ্রাণিত; সাদ্দামের গোয়েন্দা প্রধান আলি হাসান আল-মাজিদ ১৯৮০-র দশকে কুর্দিদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে এ নাম পেয়েছিলেন)।

সাদ্দামের ভাস্কর্য মাটিতে নামিয়ে আনা ছিল ওই হাইপাররিয়ালিটির আরো বড় অর্জন। কেননা ওই ভাস্কর্য ভাঙাকেই বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করা হয় যুদ্ধের ক্লাইম্যাক্স হিসেবে, যেখানে সফলতা অর্জন করেছে ‘অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম’। সম্মিলিত বাহিনীদের আখ্যা দেয়া হয় মুক্তিদাতা হিসেবে, যারা ইরাকি জনগণকে সাহায্য করেছে অবশেষে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে, এবং তাদেরকে শোষণকারী স্বৈরশাসকের সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে।

কিন্তু বাস্তবতা এতটা সহজ, সাদাসিধা ছিল না।

কেন বলছি এ কথা? জানতে হলে আপনাকে পড়তে হবে দ্বিতীয় পর্ব! 

(মূল রচয়িতা : অ্যালেক্স ফন টুনজেলম্যান। তিনি একজন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ, চিত্রনাট্যকার ও লেখক। এই লেখাটি তার ২০২১ সালের ৮ জুলাই প্রকাশিত “Fallen Idols: Twelve Statues That Made History” বইয়ের অংশবিশেষ, যা দ্য গার্ডিয়ানে সম্পাদিত রূপে প্রকাশিত হয়েছে।) 

This article is in Bengali language. It is a translation of the article titled "The toppling of Saddam’s statue: how the US military made a myth" by Alex von Tunzelmann, originally published on The Guardian. Necessary references have been hyperlinked inside. 

Featured Image © Jerome Delay/AP

 
 

Related Articles

Exit mobile version