১
মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের তাড়া খেয়ে পালিয়ে ১৫৩৫ সালের শেষের দিকে গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ দিউতে অবস্থান করছিলেন। মুঘলদের তাড়া খেয়ে কিছুটা হতাশ হয়ে সুলতান অনেকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও পর্তুগীজদের সাথে সহযোগীতামূলক একটি চুক্তি করে ফেললেন।
বাহাদুর শাহ এবং পর্তুগীজ গভর্নর নূনো দে কুনহার মধ্যে সাক্ষরিত এ চুক্তির মূল শর্ত ছিলো, জল কিংবা স্থল, যেকোনো স্থানেই উভয়পক্ষ একে অপরের স্বার্থে লড়াই করবে।
বাহাদুর শাহ এই চুক্তিটি মূলত করেছিলেন মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গুজরাট পুনরুদ্ধার করার স্বার্থে। তিনি জানতেন, তার একার পক্ষে গুজরাট থেকে মুঘলদের পরাজিত করে বিতাড়িত করা সম্ভব না। তাই তিনি তার পাশে পর্তুগীজদের চাইছিলেন।
কিন্তু সুলতান বাহাদুর শাহকে এই চুক্তিটির জন্য অনেক বেশিই মূল্য দিয়ে দিতে হয়েছিলো। তিনি এই ঘৃণ্য পর্তুগীজদের দিউতে একটি দুর্গ তৈরির অনুমতি দিয়ে দেন, যা পরবর্তীতে শুধু গুজরাট না, গোটা হিন্দুস্তানের জন্যই গলার কাঁটা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলো। বাহাদুর শাহের এই অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে পর্তুগীজ জলদস্যুরা এই প্রথমবারের মতো হিন্দুস্তানের মাটিতে ঘাটি গেঁড়ে বসতে সক্ষম হয়েছিলো।
যা-ই হোক, এই চুক্তিটির মাধ্যমে বাহাদুর শাহ পর্তুগীজদের প্রতি চরম উদারতা প্রদর্শন করে ফেলেছিলেন, আদৌ যার যোগ্য তারা ছিলো কি না সে ব্যাপারে যে কেউই সন্দেহ পোষণ করতে পারেন। কিন্তু এই চুক্তির ফলে মোটের উপর লাভ এই পর্তুগীজ জলদস্যুদেরই হয়েছিলো। তারা বিগত ২৫ বছর ধরে হিন্দুস্তানের মাটিতে নিজেদের জন্য একটি শক্ত ঘাটি তৈরি করতে চেষ্টা করে আসছিলো। কিন্তু নিজেদের স্বভাবসুলভ নিকৃষ্ট সাম্রাজ্যবাদী আচরণের জন্য হিন্দুস্তানের কোথাওই ঘাটি গাড়তে সক্ষম হয়নি।
কিন্তু সামান্য বিচক্ষণতার অভাবে শেষপর্যন্ত বাহাদুর শাহ একেবারে যেন তাদের হাতে তুলেই একটি ঘাটি উপহার দিয়ে দিলেন!
২
সুলতান বাহাদুর শাহ ভেবেছিলেন, মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাকে অবশ্যই পর্তুগীজদের সহায়তা নিতে হবে।
কিন্তু গুজরাট দখল করার পর মুঘল প্রশাসক থেকে শুরু করে জেনারেল পর্যন্ত সবাই সীমাহীন ভোগবিলাসে ব্যস্ত থাকে। একইসাথে বাড়তে থাকে নিজেদের মধ্যে অনৈক্য। মূলত মুঘলদের বিলাসিতা আর অনৈক্যের জন্যই গুজরাটের রাজনৈতিক পরিস্থিতি রাতারাতি পাল্টে যেতে থাকে। গুজরাটের সাধারণ জনগণ মুঘলদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন তৈরি করলে পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নেয়।
এদিকে বাহাদুর শাহ নিজের পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতি দেখে পর্তুগীজদের সাহায্য ছাড়াই গুজরাট পুনরুদ্ধার করে নিতে সক্ষম হন।
তবে গুজরাট পুনরুদ্ধার করার পর বাহাদুর শাহ তীব্র অনুশোচনায় ভুগছিলেন। তিনি যে পর্তুগিজদের ঘাটি করার অনুমতি দিয়ে খাল কেটে কুমির নিয়ে এসেছিলেন, তা বেশ ভালোই অনুধাবন করতে পারছিলেন। কিন্তু তখন আর কিছুই করার ছিলো না। চুক্তির প্রতি তাকে সম্মান দেখাতেই হবে।
এদিকে দিউতে দুর্গ নির্মাণ প্রসঙ্গে স্থানীয় জনগণের সাথে এই পর্তুগীজদের বিরোধ বেধে গেলো। স্থানীয় জনগণ কোনোমতেই এই জলদস্যুদের হিন্দুস্তানের মাটিতে ঘাঁটি গাড়তে দিতে রাজি ছিলো না। এ ইস্যুতে দুই পক্ষেই নিয়মিত ছোটখাট সংঘর্ষ চলতে লাগলো।
অবস্থা আরো খারাপের দিকে মোড় নিতে থাকায়, ১৫৩৬ সালের শেষের দিকে বাহাদুর শাহ চাম্পানীর থেকে দিউতে এলেন।
১৫৩৬ সালের ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যার পর তিনি দিউ দুর্গে প্রবেশ করলেন। কী মনে করে কে জানে, বাহাদুর শাহ এসময় তার সাথে কোনো নিরাপত্তারক্ষী নিলেন না।
দুর্গের ভেতরে ঠিক কী হয়েছিলো, তা স্পষ্ট জানা যায় না। তবে বাহাদুর শাহ ঐ রাতেই দুর্গ থেকে সুস্থ অবস্থাতেই ফিরে এলেন।
বাহাদুর শাহ দুর্গ থেকে জীবিত ফেরার পর দুর্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পর্তুগীজ গভর্নের নিকট থেকে ভৎসর্না শুনতে হয়েছিলো। কারণ, সুযোগ পেয়েও সে নিরস্ত্র বাহাদুর শাহকে হত্যা করেনি!
পর্তুগীজরা মিত্রদের প্রতি তাদের চুক্তির মূল্য এভাবেই দিতে চেয়েছিলো!
৩
পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে, বাহদুর শাহ পর্তুগীজ গভর্নর নূনো দে কুনহাকে একটি ভোজ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালেন। কিন্তু গভর্নর নূনোর কাছে তথ্য ছিলো বাহাদুর শাহ তাকে বন্দী করে উসমানী সালতানাতের (অটোমান সাম্রাজ্য) সুলতান সুলায়মান আল কানুনীর হাতে তুলে দিতে যাচ্ছেন। যদিও এই তথ্যের তেমন কোনো ভিত্তি ছিলো না, তারপরেও ভয়ে তিনি ভোজ অনুষ্ঠানে গেলেন না।
তিনি অসুস্থতার ভান করে দুর্গে রয়ে গেলেন। আর তার পরিবর্তে ম্যানুয়েল দ্য সাসাকে সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দিলেন নিজের অপারগতা প্রকাশ করে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য।
উদারমনা বাহাদুর শাহ নূনো দে কুনহাকে দেখতে দুর্গের ভেতরে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিলেন।
১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৫৩৭ সাল। সুলতান বাহাদুর শাহ নূনো দে কুনহাকে দেখতে দিউ দুর্গে প্রবেশ করলেন। তার সাথে সেই সময় নিরাপত্তা বলতে কিছুই ছিলো না। নিতান্তই সাদামাটাভাবে উল্লেখযোগ্য কোন অস্ত্র কিংবা দেহরক্ষী ছাড়াই তিনি দুর্গে প্রবেশ করলেন। অল্প কয়েকজন তার সাথে ছিলো, তবে তাদের ব্যক্তিগত অস্ত্র ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো অস্ত্র তাদের কাছে ছিলো না।
নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার মতো একটি গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নে কী ভেবে বাহাদুর শাহ এতটা উদাসীন ছিলেন কে জানে! তিনি কি এই সাম্রাজ্যবাদী পর্তুগীজ জলদস্যুদের তার মতোই মর্যাদাবান আর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ভেবেছিলেন? যদি ভেবে থাকেন, তাহলে তার সেই ভুলের খেসারত তাকে নিজের জীবন দিয়েই মিটিয়ে দিতে হয়েছিলো।
৪
নূনো যখন বাহাদুর শাহের দুর্গে প্রবেশের খবর জানলেন, তখন তিনি নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারলেন না। বিশেষত যখন শুনলেন যে, বাহাদুর শাহ কোনো ধরনের নিরাপত্তা ছাড়াই তার দুর্গে প্রবেশ করেছেন। ব্যাপারটি অনেকটা বাঘের গুহায় নিরীহ হরিণের প্রবেশের মতোই ছিলো।
তবে দ্রুতই বাহাদুর শাহকে জানানো হলো, নূনো তার সাথে দেখা করতে আসছেন। এদিকে দুর্গের অভ্যন্তরের পরিস্থিতি দেখে বাহাদুর শাহের মনে সন্দেহ হলো। তিনি হঠাতই বুঝে গেলেন তিনি আসলে মারাত্মক একটি ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন।
যে নৌকায় করে তিনি দুর্গে এসেছিলেন, সাথে থাকা অল্প কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে দ্রুত সেই নৌকায় চড়ে বসলেন। যে করেই হোক তাকে জীবন নিয়ে তার শিবিরে ফিরতে হবে।
তবে পর্তুগীজরা আর আগের মতো ভুল করলো না এবার।
খুব দ্রুতই কয়েকটি নৌকা বাহাদুর শাহ আর তার সঙ্গীদের ঘিরে ফেললো। বাহাদুর শাহ সাথে থাকা হালকা অস্ত্র নিয়েই তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। তবে এত অল্প লোকবল নিয়ে এই বিশ্বাসঘাতক জলদস্যুদের সাথে পেরে উঠবেন না বুঝতে পেরে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন তিনি। বাহাদুর শাহ হয়তো সাঁতরেই তীরে ফিরতে চেয়েছিলেন। তবে তার সেই চাওয়া আর পূর্ণ হয়নি।
এক সাধারণ পর্তুগীজ নাবিকরুপী জলদস্যুর বল্লমের আঘাতে সমুদ্রেই প্রাণ হারাতে হয় গুজরাটের স্বাধীন সুলতান বাহাদুর শাহকে। গুজরাটের জনগণের প্রাণপ্রিয় শাসক মারা গেলেন তাদের থেকে অনেক দূরে সমুদ্রের বুকে, সম্পূর্ণ একাকী।
হত্যার পর পর্তুগীজরা বাহাদুর শাহের মৃতদেহ সমুদ্রে ফেলে দিলো। তার মৃতদেহ আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি। গুজরাটের মহান শাসক বাহাদুর শাহ, যিনি ছিলেন বিস্তীর্ণ এক ভূখন্ডের শাসনকর্তা, মৃত্যুর পর নিজের কবরের জন্য সামান্য মাটিও জুটলো না তার কপালে।
পর্তুগীজদের মতো এমন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে যারা মিত্র হিসেবে বেছে নেয়, তাদের পরিণতি সম্ভবত এমনই হয়!
৫
দিউতে পর্তুগীজদের দুর্গ তৈরির অনুমতি দেয়ার পর বাহাদুর শাহ বুঝে গিয়েছিলেন, তিনি খাল কেটে কুমির নিয়ে এসেছেন। তাই তিনি চেষ্টা করছিলেন দিউ থেকে পর্তুগীজদের উচ্ছেদ করার। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু তিনি পর্তুগীজ গভর্নর নূনো দে কুনহাকে অটোমান সুলতান সুলায়মান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের হাতে তুলে দেবেন- এ তথ্যের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। তিনি যদি সত্যিই তাকে বন্দী করতে চাইতেন, তাহলে অসুস্থতার ভান করে থাকা নূনোকে দেখতে দুর্গে যেতেন না। তা-ও তাদের বিশ্বাস করে এভাবে নিরাপত্তাহীন অবস্থায় তো কখনোই না।
নিজের মৃত্যুর জন্য বাহাদুর শাহের বোকামীই মূলত দায়ী। একজন সুলতানের জন্য এভাবে কোনোরূপ নিরাপত্তা ছাড়াই কোথাও যাওয়া উচিত না। জায়গাটা মিত্রপক্ষের হলেও না। আর পর্তুগীজদের তো কোনোভাবেই হিন্দুস্তানীয় কোনো মুসলিম সুলতানের জন্য মিত্র বলা যায় না। সুতরাং, নিজের এই বিরাট ভুলটির জন্য সমুদ্রের মাঝেই প্রাণ দিতে হলো বাহাদুর শাহকে।
আর এই ঘটনা দ্বারা এটা বেশ স্পষ্টই বোঝা যায়, পর্তুগীজদের মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের মিত্রদের কতটা সম্মান করে!
৬
১৫২৬ সালে বাহাদুর শাহ যখন গুজরাটের মসনদে বসেছিলেন, তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ২০ বছর। ১৫৩৫ সালে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের কাছে পরাজয় স্বীকার করে গুজরাট ত্যাগ করতে হয় তাকে। ঠিক এক বছর পরে গুজরাট থেকে মুঘলদের হটিয়ে তিনি আবারও গুজরাটের মসনদে বসতে সক্ষম হন।
এই হিসাবে মাত্র ১০ বছর গুজরাট শাসন করেছিলেন তিনি। পর্তুগীজদের হাতে তিনি যখন মারা যান তখন তার বয়স মাত্র ৩১ বছর। ঠিক টগবগে তরুণ বলা না গেলেও শাসক হিসেবে নিঃসন্দেহে তরুণই ছিলেন তিনি।
এই অল্প বয়স আর মাত্র ১০ বছরের শাসনকালে অনেক কিছুই অর্জন করেছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন ভীষণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। অবশ্য শাসকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী না হলে ঠিক মানায় না। তবে তার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে জীবনের শেষদিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিলো। তার প্রতিপক্ষ বাছাই করা আসলে ঠিক ছিলো না।
মুঘলদের নির্বুদ্ধিতা আর সম্রাট হুমায়ুনের নিজেকে নিয়ে মেতে থাকা, যে কারণেই হোক না কেন, গুজরাট আবারও বাহাদুর শাহের হাতে ধরা দিয়েছিলো। মুঘলদের গুজরাট থেকে তাড়ানোর ঘটনাকে বাহাদুর শাহের জীবনের অন্যতম সাফল্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়াই যায়।
যে বাহাদুর শাহ একসময় মুঘলদের ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছিলেন, সেই বাহাদুর শাহই আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে মুঘলদের গুজরাট থেকে বিতাড়িত করেছেন, এমন বৈচিত্রময় চরিত্র ইতিহাসে খুব কমই পাওয়া যায়।
এমন বৈচিত্রময় একজন শাসক, যিনি তার প্রজাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন, তার ক্ষেত্রে পর্তুগীজদের মতো সাম্রাজ্যবাদী জলদস্যুদের হাতে প্রাণ হারানোর ঘটনা সত্যিই পরিতাপের বিষয়।
৭
বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর পর্তুগীজ গভর্নর নূনো দে কুনহা দ্রুতই সুলতানের মৃত্যুর সুযোগটি কাজে লাগালেন। তিনি দিউতে বাহাদুর শাহের রাজকোষ আর অস্ত্রাগার লুট করে নিলেন।
এদিকে বাহাদুর শাহের এই নির্মম মৃত্যুর ঘটনাকে কাজে লাগাতে ভুললেন না দিল্লির আশেপাশে ভবঘুরের ন্যায় ঘুরতে থাকা আরেকজন ব্যক্তি। এই ভবঘুরে লোকটিকে আমরা চিনি। তিনি মুঘল বিদ্রোহী জামান মির্জা। মুঘল পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক হচ্ছে, তিনি হলেন হুমায়ুনের সৎ বোন মাসুমা বেগমের স্বামী। অবশ্য তার শরীরে তৈমুরীয় রক্তও ছিলো। এই জামান মির্জা সম্রাট হুমায়ুনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। পরবর্তীতে পালিয়ে তিনি বাহাদুর শাহের দরবারে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বিভিন্ন কারণেই সম্রাট হুমায়ুনকে বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে গুজরাটে অভিযান চালাতে হয়েছিলো। মুঘল অভিযানের মুখে ১৫৩৫ সালের ২৫ মার্চ বাহাদুর শাহ মন্দসৌর থেকে পালিয়ে যান। মন্দসৌর পর্যন্ত জামান মির্জা বাহাদুর শাহের সাথেই ছিলেন।
বাহাদুর শাহ পালিয়ে গেলে জামান মির্জাও সিন্ধুর দিকে পালিয়ে যান। সিন্ধু থেকে তিনি যান লাহোরে। লাহোর সে সময় কামরান মির্জার অধীনে ছিলো। জামান মির্জা লাহোর অবরোধ করলেন। কিন্তু কামরানের বাঁধার মুখে তাকে লাহোর অবরোধ পরিত্যক্ত করতে হয়। ১৫৩৬ সালের শেষের দিকে তিনি দিল্লিতে ফিরে আসেন। তবে কোনো আশাই দেখতে না পেয়ে দিল্লির পথেঘাটে ভবঘুরের মতো ঘুরতে থাকেন।
বাহাদুর শাহ আবারও গুজরাট অধিকার করে নিয়েছেন, এই তথ্য জামান মির্জা শুনেছেন। তিনি আবারও বাহাদুর শাহের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করলেন।
১৫৩৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্তুগীজদের বিশ্বাসঘাতকতায় গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ মৃত্যুবরণ করলেন।
বাহাদুর শাহ মারা গেলেন, কিন্তু তার কোনো উত্তরসূরি রেখে যেতে পারলেন না। ফলে গুজরাটের মসনদ নিয়ে আবারও পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে শুরু করলো।
পরিস্থিতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলেন চতুর জামান মির্জা।
তিনি বাহাদুর শাহের হেরেমের মহিলাদের কাছে গেলেন। তাদের সামনে বাহাদুর শাহের মৃত্যুশোকে কেঁদে কেঁদে নিজের পরিধানের কাপড় ছিড়তে লাগলেন। বাহাদুর শাহের মাকে বললেন, বাহাদুর শাহ তাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো মনে করতো। তাই তিনিও যেন তাকে তার ছেলের মতোই মনে করেন।
হেরেমের মহিলারা কিন্তু ঠিকই বুঝলেন জামান মির্জার এসব কাজের উদ্দেশ্য কী! তারা জামান মির্জাকে জানিয়ে দিলেন, গুজরাটের হেরেমের মহিলারা রাজনীতিতে অংশ নেয় না। তিনি যেন বাহাদুর শাহের আমিরদের সাথে দেখা করেন।
তবে বাহাদুর শাহের হেরেমের মহিলারা জামান মির্জাকে একেবারেই খালি হাতে যে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তা না। হেরেমের মহিলারা চাঁদা তুলে তৎকালীন ২০ লাখ গুজরাটি মুদ্রা সংগ্রহ করে জামান মির্জার হাতে দিলেন।
জামান মির্জা এই অর্থ হাতে পেয়ে দ্রুতই একটি চলনসই সেনাবাহিনী দাঁড় করে ফেললেন।
এর কিছুদিন পরেই তিনি গুজরাটের মসনদে বসতে সক্ষম হলেন।
৮
মসনদে বসার সময় জামান মির্জা বাহাদুর শাহের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো তিনি পর্তুগীজদের সাথেই হাত মেলালেন। বাহাদুর শাহের মৃত্যুর মাত্র ১ মাসের মাঝেই তিনি পর্তুগীজদের বিপুল অর্থ সাহায্য তো দিলেনই, সেই সাথে ১৫৩৭ সালের ২৭ মার্চে সাক্ষরিত এক চুক্তি মোতাবেক মঙ্গলোর, দমন আর সমুদ্র তীরবর্তী বিপুল পরিমাণ ভূমি তাদের দান করে নিলেন।
সদ্য মৃত সুলতান বাহাদুর শাহের আমিররা এবার গেলেন ক্ষেপে।
একে তো তিনি ছিলেন মুঘল পরিবারভুক্ত একজন সদস্য। আর গুজরাটে তখন মুঘলদের ঘৃণার চোখেই দেখা হতো। তাছাড়া তার বিলাসিতা অনেক আগে থেকেই গুজরাটিরা ভালো চোখে দেখেনি। অতীতে নিজের কর্মকান্ডের জন্য তাকে বিশ্বাসও করা যাচ্ছিলো না। তাছাড়া তিনি যেভাবে অভিনয় করে হেরেমের সমর্থন আদায় করে গুজরাটের মসনদে বসে গিয়েছিলেন, তা-ও গুজরাটিদের চোখ এড়ায়নি। তবুও বাহাদুর শাহের আমিররা জামান মির্জাকে সহ্য করে গিয়েছিলো।
কিন্তু তিনি যখন বাহাদুর শাহের মৃত্যুর মাত্র ১ মাসের মাঝেই পর্তুগীজদের সাথে হাত মিলিয়ে ফেললেন, তখন তা সহ্যসীমার বাইরে চলে গেলো।
বাহাদুর শাহের আমিররা বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। দিউতে জামান মির্জা আর ইমাদ উল মুলকের মাঝে যুদ্ধ হলো। যুদ্ধে জামান মির্জা শোচনীয় পরাজয় স্বীকার করে আবারও সিন্ধুর দিকে পালিয়ে গেলেন।
এদিকে জামান মির্জার পতনের পর গুজরাটের আমিররা বাহাদুর শাহের বোনের পুত্র খানদেশের মীরান শাহকে গুজরাটের সুলতান নিয়োজিত করলো। কিন্তু যাত্রাপথেই মীরান শাহ মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। এর কিছুদিন পর তারা বাহাদুর শাহের ভাই লতিফ খানের পুত্র মাহমদু খানকে গুজরাটের মসনদের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করলো। বাহাদুর শাহের করুণ মৃত্যুর প্রায় ১ বছর ৩ মাস পর, ১৫৩৮ সালের ১০ মার্চ মাহমুদ খান ‘মাহমুদ শাহ’ উপাধি নিয়ে গুজরাটের মসনদে আরোহণ করলেন।
তথ্যসূত্র
১। মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০০৫
২। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ: মোগল পর্ব), এ কে এম শাহনাওয়াজ, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ৩য় সংস্করণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০২
৩। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়, সাহাদত হোসেন খান, আফসার ব্রাদার্স, ২য় মুদ্রণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৩
এই সিরিজের আগের পর্বসমূহ
১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা || ২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ || ৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল || ৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক || ৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল || ৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল || ৭। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন || ৮। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: লোদী সাম্রাজ্য || ৯। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস || ১০। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রশস্ত্র || ১১। জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবুর: ‘একজন’ বাঘের উত্থান || ১২। বাদশাহ বাবরের কাবুলের দিনগুলো || ১৩। বাদশাহ বাবর: হিন্দুস্তানের পথে || ১৪। বাদশাহ বাবরের হিন্দুস্তান অভিযান: চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি || ১৫। মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান: হিন্দুস্তানে বাবরের চূড়ান্ত লড়াই || ১৬। খানুয়ার যুদ্ধ: মুঘল বনাম রাজপুত সংঘাত || ১৭। ঘাঘরার যুদ্ধ: মুঘল বনাম আফগান লড়াই || ১৮। কেমন ছিল সম্রাট বাবরের হিন্দুস্তানের দিনগুলো? || ১৯। মুঘল সম্রাট বাবরের মৃত্যু: মুঘল সাম্রাজ্য এবং হিন্দুস্তানের উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের অকাল পতন || ২০। সিংহাসনের ষড়যন্ত্র পেরিয়ে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের অভিষেক || ২১। মুঘল সাম্রাজ্যের নতুন দিগন্ত: সম্রাট হুমায়ুনের ঘটনাবহুল শাসনামল || ২২। দিল্লি সালতানাত থেকে মুজাফফরি সালতানাত: প্রাক-মুঘল শাসনামলে গুজরাটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস || ২৩। মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযানের প্রেক্ষাপট || ২৪। সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযান: সুলতান বাহাদুর শাহের পলায়ন || ২৫। সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযান ও গুজরাটের পতন || ২৬। গুজরাট থেকে মুঘলদের পলায়ন: মুঘল সাম্রাজ্যের চরম লজ্জাজনক একটি পরিণতি || ২৭। শের খান: হিন্দুস্তানের এক নতুন বাঘের উত্থানের গল্প || ২৮। শের খানের বাংলা অভিযান
ফিচার ইমেজ: Wikimedia Commons